রহিমুদ্দির আক্ষেপ (ছোট গল্প)
© নূর মোহাম্মদ নূরু
শীতের সকাল, বেলা গড়িয়েছে অনেক খানি। হাড় কাপানো শীতে ভালো ঘুম হয়নি রহিমুদ্দির। হাপানীর টান ছাড়াও আজ কাশিটাও বেড়েছে অনেক। তাই বিছানায় গড়া গড়ি দিতেও ভালো লাগেনি তার। এত বেলা হলো খাবারে কোন যোগাড় নাই। নাতিটা মায়ের আঁচল ধরে খাওয়ার বায়না ধরে ধমক ছাড়া কিছু পায়নি এখনো। একমাত্র নাতি মতির বয়স মাত্র সাত বছর। সে কি বুঝবে মায়ের রাগ বা অভিমান! অন্য দিন হলে মোনেনা তার জন্য গুড় মুড়ি অথবা রুটি ভাজির ব্যবস্থা করে দিতো। মতি দাদার সাথে বসে একসাথে নাস্তা করতো। কিন্তু আজ সকালটা ভালো যাচ্ছেনা।
রহিমুদ্দিন শেখ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এককালের বনেদি গেরস্ত। জমি জমা, হালের বলদ বউ বাচ্চা নিয়ে ছিলো সুখের সংসার। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ তা শুধুই গল্প। বউ মারা গেছে তিন বছর আগে, করোনা মহামারী বাঁচতে দেয়নি তাকে। সপ্তাহ খানেক যমে মানুষের টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত যমেরই জয় হয়! তাতেও আক্ষেপ ছিলোনা রহিমুদ্দির। কিন্তু চার যুগের অধিক কাল সুখে দুঃখে একসাথে কাটিয়েও শেষ বারের মতো তার মুখটা দেখার সৌভাগ্য হলোনা তার। তার কবর কোথায় হয়েছে সে হদিসও জানেনা সে। হাসপাতাল কতৃপক্ষ কোথাও হয়তো দাফন করেছে। বউয়ের কবরের হদিস না জানার আক্ষেপ আমৃত্যু তাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। বউয়ের সাথে সাথে গেছে সংসারের সুখ শান্তি আর জমি জিরাত। বয়সের ভারে কাজকর্ম করার ক্ষমতা হারিয়েছে অনেকদিন হলো। দেহে নানান ব্যমো বাসা বেধেছে; আছে হাপানী ! সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে একে একে খোয়াতে হয়েছে জমি-জিরাত, হালের বলদ; সব। এক সময়ের বনেদি গেরস্ত সব হারিয়ে আজ নিঃস্ব। একমাত্র বসত বাড়িটা ছাড়া সব বিসর্জন দিতে হয়েছে জঠর জ্বালা নিবারণের জন্য।
রহিমুদ্দির একমাত্র পুত্র, তার স্ত্রী মোমেনা আর নাতি মতি শেখ। এই নিয়ে ছিলো তাদের সংসার। গফুর শেখ চাকূরী করতো ঢাকার এক বেসরকারী সওদাগরী অফিসে। মহামারী করোনায় সে অফিস বন্ধ হয়ে গেলে চাকুরী হারায় গফুর শেখ। একদিকে মায়ের মৃত্যু অপর দিকে বেকার হয়ে যাওয়াতে গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হয় গফুরকে। বৃদ্ধ বাবা, নাবালক সন্তান আর বউয়ের ভরণ পোষণের দায়িত্ব পড়ে গফুরের উপর। জমি জিরাত বিহীন গফুরকে সংসারে হাল ধরতে হয় পরের জমিতে কামলা দিয়ে। কামলা ছাড়াও যখন যে কাজ পায় তাই করে গফুর শেখ। যে বছর দেশে ফসল ভালো হয় সে বছর তারও বেশ ভালো ভাবেই দিন কাটে। ন্যয্য পাওনার চেয়েও অতিরিক্ত কিছু বখশিস পায়। মোমেনা খুবই লক্ষী মেয়ে। খুব হিসেব করে সংসার চালায়। সারাবছরের খাবারের ব্যবস্থা রেখেও কিছু সঞ্চয় থাকে তার। এছাড়া বাড়িতে নানা ধরনের শাক সবজি ও হাস মুরগী ও একটি ছাগল লালন পালন করে বাজারে ডিম, দুধ ও তরী তরকারী বিক্রি করেও কিছু বাড়তি রোজগার আছে তার। দুর্দিনে যা তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও শশুরের অষুধ পথ্য এবং চা নাস্তার যীগান দেয় সে। শশুরের সেবা যত্নে কখনই অবহেলা করেনা মোমেনা। নিজের বাবা নাই; তাই শশুরকে নিজের বাবা জ্ঞানে সেবা যত্ন করে। শশুরের খুব ন্যাওটা হয়েছে মতি। সারা দিন তার সাথেই কাটে তার অষ্ট প্রহর।
গত রাতে বাড়ি ফেরেনি গফুর শেখ। শশুরকে রাতের খাবার খাইয়ে মতিকে ঘুম পাড়িয়ে গফুরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে মোমেনা। অন্য দিন মতি দাদার কাছেই শোয়। আজ গফুর বাড়ি ফেরেনি বলে মায়ের সাথেই রয়ে যায় মতি। সন্ধ্যা গড়িয়ে মাঝ রাত পেড়িয়ে ফজরের আযানের সময় হয়ে যায় কিন্তু গফুরের ফিরবার নাম নাই। গফুরের চিন্তায় তার রাতের খাওয়াও হয়নি। এমনতো কোন দিন করে নাই মতির বাপ! নানান কুচিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কোন বিপদ আপদ হয়নিতো মানুষটার। তার কোন কোন কিছু হলে অকুল পাথারে ভাসতে হবে সবাইকে। সারারাত অনাহারে নির্ঘুম কাটে মোমেনার।
চারিদিকের মসজিদের মাইক থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় টোকা পড়ে ঘরের দরজায়। সকল দুঃশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বাড়ি ফিরে গফুর শেখ। দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় রহিমুদ্দি শেখের। একটা চাপা কান্নার আওয়াজ আসে গফুরের ঘর থেকে। মোমানা কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। মোমেনাতো সহজে কাঁদেনা! সে খুব শক্ত মেয়ে। সকল পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে বিচক্ষনতার সাথে! আজ কী এমন ঘটনা ঘটলো যে মোমেনা কাঁদছে?
চারিদিক ফর্সা করে পূব দিকে লাল সূর্য উদয় হয়। এসময় মুখ গোমরা করে ঘর থেকে বের হয়ে যায় গফুর শেখ। কালু মহাজনের উত্তরের ভিটি জমিতে আজ লাঙ্গল চালাতে হবে। দেরী করলে কথা শোনাবেন মহাজন। কিন্তু তার বুকের মাঝে যে লাঙ্গল চলছে তার হিসাব কেউ কী রাখে?
শীতের সকাল বলে রোদের তেজ নাই খুব একটা। তবুও একটা অসহ্য যন্ত্রণা তাকে চৈত্রের কাঠফাঁটা রোদের মতো পোড়াচ্ছে। রহিমুদ্দি কিনারা করতে পারছেনা কিসের আগুন তাকে পোড়াচ্ছে? তার মাথায় একটাই ভাবনা; কেন কাঁদছে মোমেনা! এত বছর এক সাথে থেকেও তিনি কারো কষ্টের কথা, ব্যথা বেদনার কথা জানতে পারলেন না; এই আক্ষেপ তার কোন দিনও যাবেনা!
প্রকাশকালঃ ২৯ আগস্ট ২০২২ ইং
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৩:৫৭