আমাদের মেসের সবার রুমগুলো একদম নোংরা হয়ে থাকে । ময়লা হওয়া শার্ট প্যান্ট, লুঙ্গি, বই খাতায় পুরো ফ্লোর ভর্তি, পা ফেলার জায়গা নেই । কিন্তু মেসের নামটা চমৎকার,- 'প্যারাডাইস পিস কর্নার !'
এই নামটা রেখেছিলেন মেসের সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য পূর্ণ দাদা । পূর্ণ দাদার পুরো নাম পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় । আমি যেদিন প্রথম উনার রুমে গিয়েছিলাম সেদিন অবাক না হয়ে পারিনি । উনার রুমটাকে উনি এত সুন্দর ছিমছাম করে সাজিয়ে রাখলেন, মনেই হবে না উনি আমাদের নোংরা এই মেসের বাসিন্দা । মেসের ভেতর উনার এই রুম যেন অন্য জগত ।
পূর্ণেন্দু দাদা একটা বেসরকারি কলেজের লেকচারার, কলেজটা নাকি দুএক বছরের মাঝে সরকারি হয়ে যাবে ।
দাদার ত্রিশ পার হয়েছে, কিন্তু এখনো বিয়ে করেননি ।
দাদার সাথে আমার বেশ মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল । দাদা কারো সাথে সহজে মিশতে চাইতেন না । কিন্তু আমার সাথে উনার ঘনিষ্ঠতা ছিল মেসের অন্যদের জন্য ঈর্ষণীয় ।
প্রথম দিন দাদার রুমে গিয়ে সুন্দর পরিবেশ দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম । যার রুচিবোধ এত উন্নত, তার সাথে তো আর হাসিঠাট্টা করা যায় না । আমি দাদার দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরটা দেখছিলাম । দাদা বললেন, “মেসে কি নতুন উঠেছেন ?”
আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, “জী, আপনি পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় ?”
-“হ্যাঁ । ভেতরে আসুন ।” আমি যাবো কি না ভাবছিলাম । আমি তো উনার ভিন্ন জাত, উনি যদি জাতপাতে বিশ্বাসী লোক হন তবে আমার উপস্থিতিতে নিশ্চয়ই বিরক্ত বোধ করবেন ।
আমি দ্বিধা নিয়ে ঢুকলাম । দাদা ইশারায় বসতে বললেন ।
আমি বললাম, “আপনার নাম শুনেই আপনার সাথে দেখা করতে মন চাইল । চট্টোপাধ্যায় নামটা আমি এতদিন শুধু বই পুস্তকে পড়েছি । বিলিভ ইট ওর নট, এই নামের কোন মানুষ জীবনে দেখলাম না, তাই আপনাকে দেখতে এলাম ।” এই একটা কথা দিয়েই আমি সেদিন দাদাকে পটিয়ে ফেলেছিলাম ।
দাদা মুচকি হেসে বললেন, “দারুণ একটা কথা বলেছেন । এদেশে চট্টোপাধ্যায় নামের মানুষরা বিরল প্রজাতির প্রাণী হয়ে গেছে । তো এখন চট্টোপাধ্যায়কে কেমন দেখলেন ?”
আমি বললাম, “চমৎকার ! আপনি এত পরিপাটি ! নাকি সব চট্টোপাধ্যায়রা এমন হয় ?”
দাদা হা হা করে হেসে উঠলেন । সেদিন থেকে আমি আর দাদা ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম ।
আমার একটা অভ্যাস হল পরিচিত লোকদের থেকে কৌশলে তাদের প্রেম কাহিনী শুনে নেয়া । অবশ্য লোকজনের পেট থেকে তাদের প্রেমের ঘটনা বের করতে এত কৌশল খাটাতে হয় না । প্রত্যেকটা মানুষই তার প্রেমের ব্যপার স্যাপার অন্যের কাছে বলতে বেশ আগ্রহী থাকে । সাধারণত বেশিরভাগ প্রেমের ঘটনা প্রায় একইরকম হয় । কিন্তু পূর্ণেন্দু দাদার প্রেমের গল্পটা ছিল সম্পুর্ন ভিন্ন ধাঁচের । আমার আজকের এই গল্প দাদার সেই কাহিনী নিয়ে ।
গল্পটা এতটাই ভিন্ন, এটাকে ঠিক প্রেমের গল্প বলা যায় না । যাহোক, গল্পটা প্রেম না অন্য কিছুর গল্প তা পাঠকরা বিবেচনা করে নেবেন ।
কথা উঠেছিল বিয়ে নিয়ে । একদিন দাদা আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি কবে বিয়ে করব । প্রসঙ্গক্রমে আমিও দাদার কাছে অনুরূপ বিষয় জানতে চাইলাম ।
দাদা বললেন তার বিয়ের জন্য পাত্রির খোঁজ চলছে । কিন্তু সমস্যা হল পাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না । দাদা ব্রাহ্মণের ছেলে, দাদাকে তার জাত মিলিয়ে ব্রাহ্মণী বিয়ে করতে হবে । ঝামেলার ব্যপার হল দাদার পিতা নাকি এমন পাত্রী খুঁজছেন যে শুধু জাতে ব্রাহ্মণী হলে চলবে না, পাত্রীর পরিবারকে দাদাদের মত 'চট্টোপাধ্যায়' হতে হবে ! কি আশ্চর্য, এই যুগেও মানুষ এত রক্ষণশীল হয় ?
দাদাকে বললাম, দাদা আপনার কি মনে হয় আপনি শেষ পর্যন্ত চট্টোপাধ্যায় খুঁজে পাবেন ?
দাদা জবাব দিলেন- মোটেই না, শেষ পর্যন্ত আমার বাবাকে চট্টোপাধ্যায়ের আশা ছাড়তেই হবে ।
আমি আবার বললাম, কি আশ্চর্য ! চট্টোপাধ্যায় কি এতই কম ?
-আসলে চট্টোপাধ্যায় না থাকার ব্যপারটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয় । তোমাকে এটা আরেকদিন বলব । আজ একটা চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ের কথা শুনো ।
-বলেন ।
- আমার বয়স যখন আট বছর তখন বাবা খুলনা বি এল কলেজে শিক্ষকতা করতেন । আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে আরেক ভদ্রলোকের সাথে আমার বাবার বন্ধুত্ব ছিল । সেই ভদ্রলোকও ছিলেন চট্টোপাধ্যায় । বাবার সাথে ভদ্রলোকের যেমন বন্ধুত্ব ছিল তেমনি উনার স্ত্রীর সাথে আমার মায়ের খাতির ছিল । সেই চট্টোপাধ্যায় বাবুর একটা বাচ্চা মেয়ে ছিল । তার নাম ছিল মালতী চট্টোপাধ্যায়, সবাই ডাকতো হেভেন । হেভেন নামটা কেমন যেন একটু বিচিত্র প্রকৃতির, তাই না ?
-না দাদা, আমার কাছে বিচিত্র লাগছে না । জান্নাতুল ফেরদৌস তো মেয়েদের একটা কমন নাম, ওই জান্নাত আর হেভেন তো একই জিনিস ।
-হ্যাঁ, তাই তো । তো আসল কথা শুনো, হেভেন মেয়েটা আমার চেয়ে চার পাঁচ বছরের ছোট ছিল । আমি তাকে কোলে নিয়ে ঘুরতাম, খেলতাম । একদিন আমার মায়ের কাছে আবদার ধরে বসলাম, মা আমি হেভেনকে বিয়ে করব । মা হাসতে হাসতে কথাটা গিয়ে বললেন হেভেনের মাকে । উনিও যেন কথা শুনে সেরাম মজা পেলেন । ওই দুজন মহিলার হাসি তামাশা দেখে আমি ভয় পেলাম, কোন ভুল করলাম না তো ! হেভেনের মা বলল, এখনো তো নিজের হাতে শুচু করতেও শেখনি, এখনি বিয়ে করে ফেলবে ? আগে বড় হয়ে নিন বাবু ।
দাদার মুখে এই মজার কথা শুনে আমি হাসলাম । তবে দাদা গম্ভির রইলেন, তাই হাসি থামিয়ে জানতে চাইলাম- তারপর ?
-তারপর বলার মত কিছুই হয়নি । সময়ের সাথে সাথে আমরা দূরে চলে গেলাম । উনারা সপরিবারে ইতালি চলে গিয়েছিলেন । বাবার সাথে হেভেনের বাবার চিঠি চলত । বাবা একদিন জানালেন হেভেন নাকি আঠারো বছর বয়স হবার আগেই একটা বখে যাওয়া মেয়ে হয়ে গেছে । আমি ভেবে অবাক হতাম, ছেলেরা বখে যায় শুনেছিলাম । কিন্তু মেয়েরাও বখে যায় ? সে বখে গিয়ে কি করল তা জানার ইচ্ছে ছিল । অনেকদিন পর জানতে পারলাম হেভেন নাকি একটা পর্ন ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত হয়েছে । আমি নেট থেকে খুঁজে হেভেনের পর্ন ভিডিও বের করলাম ।
-এখনো কি উনি এসবের সাথে যুক্ত ?
-হুম, এখনো । এসব করে সে অল্প বয়সেই কোটি টাকা কামিয়ে ফেলেছে । ওর ফ্যান অসংখ্য । তুমি শুনলে আমাকে খারাপ মনে করবে, আমিও কিন্তু হেভেনের পর্ন ভিডিওর ভক্ত । আমি টাকা খরচ করে ওর ওয়েবসাইট সাবস্ক্রাইব করেছি । ওর আপলোড করা যে কোন ভিডিও আমি প্রথম দিনই ডাউনলোড করে নিই ।
-দাদা, আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ।
-অবিশ্বাসের কি আছে ? আমার ল্যাপটপে তার পঞ্চাশ জিবি ভিডিও আছে । তুমি দেখবে ?
-আরে না না । মানে ব্যপারটাকে রূপকথার মত মনে হচ্ছে ।
-ও । রূপকথাই তো, এ যুগের রূপকথা এরকম হয় । আমি একটা ডিসিশান নিয়েছি । হেভেনকে আমি মনে করিয়ে দেব আমি পূর্ণ, যে তার জীবনের প্রথম বেলার সাথী ছিলাম । আমি তাকে বলব এখনো সে আমার কাছে সেই ছোট্ট শিশুর মত নিষ্পাপ আছে । সে যদি পর্ন ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে রাজি হয় তবে আমি তাকে বিয়ে করব ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৮ সকাল ১১:২৩