খুব ছোট বয়সে আমাকে গল্প বলার ছলে মা ঘটনাটা বলেছিলেন । ঘটনাটা আমার মায়ের মা অর্থাৎ আমার নানুর জীবনে ঘটে যাওয়া ব্যাখ্যাতীত একটি ঘটনা ।
আমার নানুর প্রথম দুই সন্তান জন্মের পরপরই মারা গিয়েছিল । স্বাভাবিকভাবেই তাঁর তৃতীয় সন্তানের জন্ম হবার সময় তিনি অনেক শঙ্কিত ছিলেন । নানু ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ কবজে খুব বিশ্বাস করতেন । তিনি পরিচিত একজন হুজুরের কাছে সন্তানের মঙ্গল কামনা করে অনেক আমল ও তাবিজ গ্রহন করেন ।
নানুর সুস্থ সুন্দর একটি ছেলে সন্তান এলো । সবাই তো আনন্দিত, কিন্তু সন্তানের জীবন নিয়ে নানু তখনো শঙ্কিত । নানুর পরিচিত সেই হুজুর এসে সন্তানের জন্য দোয়া করে গেলেন । হুজুর বলেছিলেন, যদি প্রথম সপ্তাহ ভালোয় ভালোয় কেটে যায় তাহলে নবজাতকের জীবনের আর কোন ভয় নেই । হুজুর পরামর্শ দিয়েছিলেন যদি নানু রাতে ভয় পান তাহলে খারাপ কিছু ঘটতে পারে । যাই ঘটুক, নানু যেন সাহস রাখে । হুজুর আরো বললেন ঘুমানোর সময় সংকোচ লাগলে নানু যেন মাথার কাছে আলো জ্বালিয়ে রাখেন ।
হুজুরের পরামর্শ মতই নানু হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়তেন । দুদিন কোন ঝামেলা ছাড়া কেটে যায় ।
তৃতীয় দিন রাতে নানু যথারীতি ঘুমাচ্ছিলেন । গভীর রাতে ঘুমের মাঝে নানু একটা জোরালো আওয়াজ শুনতে পান । পুরনো বিল্ডিং ভাঙ্গার সময় দেয়ালে বড় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে যেভাবে শব্দ হয়, ঠিক সেভাবেই ঘরের ছাদে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে । সেই আঘাতে একটানা ‘ধুম, ধুম’ করে শব্দ হচ্ছে । নানুর ঘুম ভেঙ্গে যায় । তার তন্দ্রা পুরোপুরি কেটে যাবার পর সেই আওয়াজটা বন্ধ হয়ে যায় । নানু ভাবলেন এই আওয়াজটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন ছিল । নয়ত ঘুম ভাংতেই আওয়াজ কেন বন্ধ হবে ? যাহোক, ঘুম ভাঙ্গার পর নানু দেখলেন হ্যারিকেনের আলো নিভু নিভু করছে । হ্যারিকেনে তেল ফুরিয়ে গেলে হ্যারিকেন যেভাবে নিভে যায় অনেকটা সেভাবেই হ্যারিকেনের আলোটা নিভে যাচ্ছে । নানু বেশ অবাক হন । কারণ তিনি ঘুমানোর আগেই হ্যারিকেনে তেল ভরে রেখেছেন । এতো তাড়াতাড়ি তেল শেষ হয়ে যাবার কথা নয় । নানু হ্যারিকেন চেক করে দেখলেন তেল ঠিকই আছে, কিন্তু হ্যারিকেনের সলতেটা জ্বলে ক্ষয় হয়ে গেছে । পুরনো সলতে বদলে নতুন সলতে দেবার কথা আগের দিন মনে এলেও সলতে বদলাতে নানু ভুলে গেছেন । নানু সলতে বদলানোর জন্য হ্যারিকেন নিভিয়ে দিলেন । ঘর অন্ধকার হয়ে গেল , ঠিক তখনি নানু শুনতে পেলেন ঘরের ছাদে যেন অনেক মানুষ ধুপধাপ করে পা ফেলে সশব্দে হাঁটছে । নানু প্রথমে ভাবলেন এটা তাঁর মনের ভুল । কিন্তু ধুপধাপ করে মানুষের হাঁটাহাঁটির সেই আওয়াজটা বন্ধ না হয়ে ক্রমে বেড়েই চলছিল । নানু তাড়াতাড়ি নতুন সলতে লাগিয়ে আলো জ্বালালেন । আলো জ্বালানোর পর সব শব্দ থেমে যায় । তারপর হ্যারিকেনের আলোয় নানু দেখতে পেলেন তাঁর রুমের দরজায় একজন বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে । বৃদ্ধার গায়ে সাদা কাপড়, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে সাদা কাপড় যেমন তামাটে হয়ে যায়, বৃদ্ধার গায়ে তেমন একটি পুরনো সাদা শাড়ি জড়িয়ে আছে । বৃদ্ধাটি একদৃষ্টে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা নানুর নবজাতক সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছে ।
নানু প্রচণ্ড ভয় পেলেন, তিনি দৌড়ে গিয়ে তাঁর সন্তানকে বুকে নিয়ে খাটের এক কোণায় বসে দোয়া কলমা পড়তে শুরু করেন । কয়েক মুহুর্ত পর নানু দেখেন সেই বৃদ্ধাটি খাটের অপর পাশে একটা শিশুকে কোলে নিয়ে নানুর মত বসে আছে । ধীরে ধীরে বৃদ্ধাটি তার কোলের শিশুর চেহারা দেখালো । স্মল পক্স বা গুটি বসন্ত হলে মানুষের গায়ে যেমন অসংখ্য ছোট ছোট গুটি দাগ দেখা যায়, সেই শিশুর মুখে তেমন গুটির কালো দাগ পড়ে আছে । শিশুটির চোখ খোলা, চোখ দুটোতে কোন মনি নেই, সেই চোখগুলো সাদা ধবধবে । বোঝা যাচ্ছে বৃদ্ধার কোলের শিশুটি মৃত । বৃদ্ধা তার কোলের শিশুকে আমার নানুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন । নানু বুঝতে পারলেন সেই বৃদ্ধা তার কোলের মৃত শিশুটি নানুকে দিয়ে নানুর কাছ থেকে জীবিত শিশুটি নিতে চাইছে । নানু চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠেন । তাঁর চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে আসে । তবে কেউ এসে পৌঁছানোর আগেই সেই বৃদ্ধাটি হাওয়ায় মিলে যায় ।
সেদিনের পর নানু এবং তাঁর সন্তানের আর কোন সমস্যা হয়নি । আমার নানু বারো বছর আগে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন । আর নানুর সেই সন্তান, আমার মামা, এখনো বেঁচে আছেন ।
নানু সারাজীবন বিশ্বাস করতেন এমন ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে, নানুর মত আমার মা বিশ্বাস করতেন । এমনকি, মজার ব্যপার হল আমার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে এমন অনেক শিক্ষিত লোকও আছেন যারা এই ঘটনাটাকে ধ্রুব সত্য মনে করেন ।
আমি মনে করি না নানু মিথ্যা বলেছিলেন । তবে আমি ঘটনাটাকে যেভাবে শুনেছি ঠিক সেরকম ভয়ংকর মনে করি না । আমার নানু এই অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা কেন প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার একটি স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি দিতে পারি । আমি নিশ্চিত আমার ব্যাখ্যা শুনে সবাই সন্তুষ্ট হবেন ।
যাহোক, সেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি এখানে দিতে চাচ্ছি না । আমার উদ্দেশ্য ছিল গল্পের আকারে নানুর ঘটনা বর্ণনা করা । এই ঘটনার পেছনের কার্যকারণটা পাঠকরাই বের করে নিন ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৮ রাত ১০:২৫