somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্নলোকের প্রথম প্রহর

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি যখন জানতে চাইলাম রেড ওয়াইন কেন ফ্রিজে রাখা হয়না, শুধু হোয়াইট ওয়াইন কেন রাখা হয়। দুটোই তো ওয়াইন, তবে কেন এই তারতম্য! রেস্টুরেন্টের গামনার তখন বললো, রেড ওয়াইন রুমের তাপমাত্রায় রাখতে হয়। ঠান্ডা রেড ওয়াইন গলা দিয়ে নামে না। তাছাড়া, রেড ওয়াইন কিছুটা উষ্ম না হলে এর বিশেষ ফ্লেভারটাও উবে যায়। সাহেবরা, ঠান্ডা রেড ওয়াইন খায় না।

আমি মনোযোগ দিয়ে বারী আঙ্কেলের কথা শুনছিলাম। পাশেই, রেস্টুরেন্টের পুরোনো ওয়েটার মিলন দাঁড়িয়ে হাসছিলো। মিলন আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, কিন্তু দক্ষ ওয়েটার। এই রেস্টুরেন্টে ও দু’বছর ধরে কাজ করছে। বারী আংকেল এই রেস্টুরেন্টের মালিক। ব্রিটেনে রেস্টুরেন্টের মালিকদেরকে গামনার বলে ডাকা হয়। হোটেলের সাহেব কাস্টমাররা অবশ্য বারী আংকেলকে মিস্টার মিয়া বলেই সম্মোধন করে। বারী মিয়া থেকে মিস্টার মিয়া। জুম্মার নামাজে যাওয়ার আগে, বারী আংকেল আমাকে সাদা এবং লাল মদ পরিবেশনের আদ্যোপান্ত শিখিয়ে তড়িঘড়ি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, সন্ধ্যায় এসে আমাকে তিনি শিখাবেন কিভাবে বিয়ার এবং সাম্বুকা পরিবেশন করতে হয়।

'মিলন মিয়া.....', পান চিবুতে চিবুতে বারী আংকেল বললো, 'ওরে টেবিল সাজানোটা শিখায় দিও। আর শোনো, ছয় ব্যারেল বিয়ার আসবে, গুইনা রাইখো। পেমেন্ট সব করাই আছে। আমি যাই।'

'জি কাকা, আমি আছি। কোনো চিন্তা কইরেন না।' কিচেন থেকে হাত মুছতে মুছতে মিলন বেড়িয়ে এলো। এখনো সে হাসছে। কেন হাসছে বুঝতে পারলাম না।

মিলন আমাকে একের পর এক শেখালো কিভাবে টেবিলক্লথ বিছাতে হয়, কিভাবে টেবিলে স্টার্টারের প্লেট রেখে তার পাশে কাটা চামচ, গোল চামচ এবং ছুড়ি সাজাতে হয়। কিভাবে ন্যাপকিন ভাঁজ করতে হয়। আমি মনোযোগ দিয়ে শিখছিলাম। কিন্তু ন্যাপকিনটা সঠিক মতো ভাঁজ করতে পারছিলাম না। ন্যাপকিন ভাঁজ করে ফুলের মতো বানিয়ে তাকে গ্লাসের ভেতরে সাজিয়ে রাখার কৌশলটা ঠিক ধরতে পারছিলামনা। মিলন দাঁত বের করে হাসছিলো। একটু পরে কিচেন থেকে আবুল ভাই বের হয়ে আসলো। সেও কেন জানি হাসছিলো। আবুল ভাই রেস্টুরেন্টের তান্দুরি শেফ। ওনার হাত লাল হয়ে ছিল তান্দুরীর মসল্লায়। ওনার চোখ দুটোও কেমন লাল হয়ে ছিল। আবুল ভাই লোক ভালো। উনি আমাকে শেখালেন কিভাবে ন্যাপকিন ভাঁজ করতে হয়। আমি ন্যাপকিন ভাঁজ করা শিখে ফেললাম। হাসপাতালে ইন্টার্নির সময় জীবনে প্রথম যেদিন অপারেশনের রুগী ড্র্যাপিং করা শিখেছিলাম সেদিন যেমন ভালো লেগেছিলো, আজ ন্যাপকিন ভাঁজ করতে শিখেও তেমন ভালো লাগলো।

মিলন তখনও হাসছিলো। আমি বিরক্ত হয়ে মিলনের থেকে মুখ ফিরিয়ে আবুল ভাইয়ের লাল চোখ দুটোর দিকে তাকালাম। হাসিমুখের চেয়ে ওই লাল চোখ দুটোকেই তখন আমার অনেক সহানুভূতিশীল এবং সহায়ক মনে হলো।

'আয়ো, ভেতরে আয়ো।' বলেই আবুল ভাই কিচেনের ভেতরে চলে গেলো। আমিও তার পিছু নিলাম। মাঝারি ধরণের কিচেন। ঢুকতেই হাতের ডান পাশে আট বার্নারের দুটো চুলা এবং তারপরেই বসানো হয়েছে তান্দুরি ক্লে-ওভেন। চুলাগুলোর উল্টো দিকে লম্বা একটা স্টিলের টেবিল, আর তার সাথেই লাগানো বড় একটা সিংক। টেবিলে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে পেঁয়াজ কুচি করছে। ছেলেটা বেশ লম্বা এবং স্বাস্থবান। আমার দিকে একবার তাকালো, দাঁত বের করে হাসলো, তারপর আবার খচ খচ করে পেঁয়াজ কেটে চললো। বয়স্ক মতো একটা লোক সিঙ্কে এক গাদা প্লেট, গ্লাস ধুচ্ছে। সবাই আমার কাছে ওই ক্লে-ওভেনটির মতোই অপরিচিত। কিচেনে এখন কোনো রান্না হচ্ছে না। সব চুলাই বন্ধ। তারপরও রুমটা কেমন ভ্যাপস্যা গরম হয়ে আছে। হঠাৎ পেয়াঁজ কাটুনে ছেলেটার পায়ের দিকে চোখ পড়লো। ছেলেটা লুঙ্গির সাথে এডিডাসের একজোড়া সাদা কেডস পরে আছে।

কিচেনের শেষ প্রান্তে একটা চাপা দরজা। ওই দরজা দিয়ে আমি আর আবুল ভাই ঢুকলাম স্টোর রুমে। আবুল ভাই আমাকে সব দেখাচ্ছিল, কোথায় কেচাপ, কোথায় মিন্ট সস ইত্যাদি। স্টোর রুমের পশ্চিম দিকের দেয়াল জুড়ে রয়েছে বড় একটা দুই পাল্লার দরজা। দরোজার উপরে সবুজ বাতির এক্সিট সাইন লাগানো। দরজা খুলে আমরা দুজন বাইরে বের হয়ে এলাম।

পড়ন্ত হেমন্তে সুন্দর রৌদ উঠেছিল সেদিন।

'স্মোক করো নি?'
'হুম। করি।'
'ধরাও একটা।' - বলেই আবুল ভাই সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে ধরলো।
'এই দেশে গোল্ডলিফ কোথায় পাইলেন?' আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম। 'এখানে কোনো দোকানে আমিতো এখনো গোল্ডলিফ সিগারেট দেখিনি। ট্রিপল ফাইভও দেখিনি। তবে বেনসন দেখেছি।'

'এই দ্যাশে সবই পাওয়া যায়।' আবুল ভাই আমার দিকে হাসি মুখে তাকালো। ওনার হাসিটা নিখাঁদ, কোনো রহস্য নেই।
'আপনি ধড়াবেন না?'
'না।'
'ফ্রাইডেতে কাম শুরু করতে কইসে কে তোমারে?'
'কেন? ফ্রাইডেতে কি প্রব্লেম?' আমি অতি উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলাম।
'আইজ মরছো তুমি!' আবুল ভাই হাসছে আর বলছে, 'ফ্রাইডে আর স্যাটারডে হইলো গিয়া কিয়ামত!'

আমি তখনও বুঝতে পারছিলামনা, ঘটনাটা কি!

হঠাৎ কোথা থেকে ঠান্ডা এক ঝটকা বাতাস এসে লাগলো গায়ে। হেমন্তের কোমল স্নিগ্ধতা বিদীর্ণ করে রুক্ষ শীত আগমনের মহড়া শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে! আমার ভালোই লাগছিলো, তবে আবুল ভাই কাঁপছিল ঠান্ডায়। সে গোল্ডলিফের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধারালো। ধরিয়েই লম্বা একটা টান। সিগারেটে কেমন চটচট করে শব্দ হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো সিগারেটের তামাকে কিছু একটা ফুটছে। ধোয়ার গন্ধ থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, একই প্যাকেট থেকে বের করলেও আমার সিগারেট আর আবুল ভাইয়ের সিগারেট এক সিগারেট নয়। আবুল ভাইয়ের সিগারেট স্পেশাল সিগারেট। তার চোখ লাল হওয়ার কারণ তখন আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

'হুনো মিয়া, কই। রেস্টুরেন্টের ব্যবসাই হইলো গিয়া সপ্তাহে দুই দিন। ফ্রাইডে আর স্যাটারডে। সানডেতেও কিছুটা বিজি হয়। তবে আসল ব্যবসা ওই দুদিনই। মাসের এই আট দিনে যে ব্যবসা হয় তা গোটা মাসের বেচা বিক্রির চেয়েও অনেক বেশি। সবে আইছো তো, সবই দেখবা।'
'আগে কোনআনে কাজ করছো নি?'
'না। এখানেই ফার্স্ট।'
'বালা।'- বলেই সে হো হো করে হেসে উঠলো।
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, কেন!

'কোনানে থাকবা? রেস্টুরেন্টের উপরে, নাকি অন্যখানে?'
আমি বললাম, 'বাসায় থাকবো।'

'চলো, ভিত্রে যাই। লাঞ্চ খাই। ল্যাম্ব কারি রানছি।'

আবুল ভাই সিলেটি আর শুদ্ধ বাংলার এক বিশেষ মিশ্র ভাষায় কথা বলে। শুধু সে না, রেস্টুরেন্টের সবাই; গামনার থেকে শুরু করে ওয়েটার, বাবুর্চি সবাই একই ভাষায় কথা বলে। এখানে কাজ করতে হলে, আমাকেও এই ভাষাটা আয়ত্ত করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। আমি মনোযোগ দিয়ে সবার কথা বলার ধরণ লক্ষ্য করছিলাম।

স্টোর রুমের বিশাল দু’-পাল্লার দরজা বন্ধ করে আমরা সোজা চলে এলাম কিচেনে। এডিডাস ছেলেটি তখনও পেঁয়াজ কেঁটে চলছে। বুড়ো চাচা ততক্ষনে থালা বাসন ধোয়া শেষ করে প্লেটে ভাত নিয়ে টেবিলের উপরে আসন পেতে খেতে বসেছে। কিচেনে অথবা স্টোর রুমে কোথাও একটা চেয়ারও দেখতে পেলাম না। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ অবাক লেগেছিলো।

'এ মিলনন্যা........ কি রান্ধ?' আবুল ভাই চেঁচালো।
'এইতো মামা, স্পেশাল কারি বানাই। ল্যাম্ব কারির সাথে স্পিনিচ মিশায়া শাক-গোস্ত বানাই।'

'দেহা যায় বড় শেফ হয়ে গেছো যে! বেশী বাইড়ো না বুঝলা মিয়া!' আবুল ভাই চুলার কাছে যেয়ে দেখলো মিলন কি রাঁধে। 'এহঃ মাইরালাইসো মিয়া! এইডা মুহে দেয়া যাবে? করসো কি!' বলতে বলতেই চামচ দিয়ে কিছুটা শাক-গোস্ত তুলে নিলো সে তার ভাত ভর্তি প্লেটে।

'তুমিও খায়া নাও।' আবুল ভায়ের দৃষ্টি এবার আমার দিকে।
আমি বললাম, 'জ্বি।'

আমি হাতে একটা প্লেট নিয়ে খুব সংকোচে ভাত আর ল্যাম্ব কারি নিয়ে খেতে শুরু করলাম। আমি, আবুল ভাই, মিলন সবাই হাতে প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে লাগলাম। এডিডাস তখনও এক মনে পেঁয়াজ কেঁটে যাচ্ছিলো।

হঠাৎ ধড়াস করে দরজা খুলে কিচেনে ঢুকলো শ্যামলা মতো মাঝ বয়সী একটা ছেলে। চুল খাড়া খাড়া। পরনে কালো টি-শার্ট আর খাকি ব্যাগি প্যান্ট।

'কিরে এই তোর সকাল হইলো?' মুখে ভাত নিয়ে আবুল ভাই জিগ্যেস করলো।

মিলন দাঁত বের করে আবুল ভাইকে বললো,'মামা, জিগ্যেস করেন কালকে কয় টাকা হারছে?'
'হ, কও চেনি, কালকে কয় টাকা খোয়াছো?', আবুল ভাই জানতে চাইলো। 'তোরে না কইছি, রুলে ঘূর্ণি বন্ধ কর।'

'মামা, মিলনরে বিশ্বাস কইরেননা; আমি রুলে খেলিনা। বাদ দিছি।' জাফর ভাই ঢুলুঢুলু চোখে জবাব দিলো।

জাফর ভাই এসেছে রাজশাহী থেকে। সবার মতো সেও ছাত্র হিসেবে এসেছে। ভর্তি হয়েছে লন্ডনের একটা ভিসা কলেজে। মিলন যে কলেজে পড়ে, জাফরও সেই একই কলেজে। মিলন অবশ্য রংপুরের ছেলে। এডিডাস এসেছে সিলেটের প্রতন্ত গ্রাম থেকে। সেও ছাত্র হিসেবে এসেছে। আজ থেকে ষোলো বছর আগে আবুল ভাইও এসেছিলো ছাত্র হিসেবে। এই রেস্টুরেন্টের সবাই ছাত্র হিসেবে লন্ডনে এসেছে। আমিও ছাত্র হিসেবে এসেছি গত বছর। মাস্টার্স শেষ করেছি মাত্র। রেজাল্টের অপেক্ষায় বসে আছি। এই রেস্টুরেন্টে শুধুমাত্র ওই বুড়ো চাচা মিয়া ছাত্র হিসেবে আসেনি। সে এসেছিল ভিজিট ভিসায়। আর ফিরে যায়নি দেশে। এখন ইলিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে রয়ে গেছে ইংল্যান্ডে। এগারো বছর যাবৎ সে লন্ডনে পড়ে আছে, এই রেস্টুরেন্টেই। তার গোটা পরিবার বাংলাদেশে। এগারো বছর সে তার পরিবারের কাওকে দেখেনা। শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠায় দেশে। আর মাত্র তিন বছর। তিন বছর পরেই সে বৈধ ভাবে বসবাস করার অনুমতি পাবে ব্রিটেনে। এই তিন বছরের অপেক্ষায় সে দিন গুনছে। তিন বছর পর তার সুদিন আসবে। সে তার পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। পরিবারকে সে লন্ডনে নিয়ে আসবে। চোদ্দ বছর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সে তার স্বপ্নের জীবন শুরু করবে তার এই চির স্বপ্নের ব্রিটেনে।

স্বপ্নের ব্রিটেনে সবাই আসে স্বপ্নের জীবন গড়তে। কেও সেই স্বপ্নের জীবনের ধরা পায় নিমিষেই; কাওকে বা অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। কারও স্বপ্ন আবার ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় নেশার তামাকে, কারও বা স্বপ্ন চাপা পরে যায় ল্যাডব্রোকের রুলে বোর্ডের তলায়। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে।

আমি কি স্বপ্ন নিয়ে লন্ডনে এসেছিলাম তা মনে করার চেষ্টা করছি আর খাচ্ছি। কোন ফাঁকে যে সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে খেয়াল নেই। সবাই সিংকে হাত ধুচ্ছে। আমিও ধুলাম। সবার মতো আমিও আমার প্লেটটা ধুয়ে জায়গা মতো রেখে সবাইকে অনুসরণ করে রেস্টুরেন্টের উপরতলায় চলে এলাম। উপরতলায় রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা।

রুমে ঢুকেই দেখি এডিডাস তার মুখে ক্রিম ঘসছে। ক্রিম ঘষে ঘষে মুখ তেলতেলে করে ফেলেছে। আমাদের ঢুকতে দেখেই সে হড়হড় করে নিচে নেমে গেলো। কেও ওর দিকে তাকালো না। আমি শুধু তাকালাম। ছেলেটা এখনো এডিডাসের ওই সাদা কেডস জোড়া পড়ে আছে!

বেশ বড়সড় একটা রুম। রুমটির তিন দেয়াল ঘেঁষেই বিছানা পাতা। এক পাশে একটা দ্বিতল বাঙ্কবেড, আর ওপর দুই পাশে দু’টি সিঙ্গেল বেড। মোট চারজনের থাকার ব্যবস্থা। আপাতত রুমটিতে থাকে মিলন, এডিডাস আর বুড়ো মিয়া। আবুল ভাই থাকে তার নিজের বাসায়। আমি আগেই সিন্ধান্ত নিয়েছে আমি এখানে থাকবো না। আমি থাকবো বাসায়। অবশ্য রেস্টুরেন্টে থাকা খাওয়া ফ্রি। তারপরও, এই ফ্রি আয়োজনের কোনো অস্তিত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আমার স্বপ্নের জীবনে নেই।

'এই হুনো, তুমি থাকবা এই বেডে।' আবুল ভাই বললো।
আমি বললাম, 'না, আমি বাসায় থাকবো। এখানে থাকবো না।'
সে বললো, 'ওকে, নো প্রব্লেম।'

পুরোটা দুপুর জুড়ে অনেক কথা হলো। অনেক হাসি ঠাট্টা হলো। অনেক কিছু জানা হলো। কানেকানে জাফর ভাই আমাকে বললো যে সে আমাকে রুলে খেলতে নিয়ে যাবে। দু' দোকান পরেই রুলের ঘর। গত সপ্তাহে সে পাঁচশো পঞ্চাশ পাউন্ড জিতেছে। মিলন আমাকে বললো থার্টিফার্স্ট নাইটের প্ল্যান। সে বয়সে আমাদের চেয়ে সবচেয়ে ছোট। তাই ওর প্ল্যানও পাগলামোতে ভরা।

আড্ডায় আড্ডয় ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা। রেস্টুরেন্ট খোলার সময় হয়ে গেছে। ছয়টা থেকে কাস্টমার আসা শুরু করবে। আজ আমার চাকরির প্রথম দিন। আমাকে ওয়েটারের ড্রেস দেয়া হলো। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো ওয়েস্টকোট, কালো নেকটাই আর সাথে কালো জুতা। মিলন আমাকে নেকটাই বাঁধা শিখিয়ে দিলো। ওয়েটারের ড্রেস পড়ে খুব অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা, যেদিন সাদা এপ্রোন পড়ে মেডিকেল কলেজে প্রথম ক্লাস করতে গিয়েছিলাম। সেদিন কোনো অপ্রস্তু লাগেনি। সেদিন বরং গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল। মনে পড়ে, সেদিন সারাদিন এপ্রোন পড়ে ছিলাম। আর আজ, ওয়েটারের ড্রেস পড়ে কোথায় নিজেকে লুকোনো যায় সেই পথ খুচ্ছি! কিন্ত, কোনো এক অদ্ভুত দেয়ালে লুকোনোর সবগুলো পথই যেন রুদ্ধ হয়ে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো, কোনো এক মারাত্মক অপরাধে আমাকে কনডেম সেলে পুড়ে রাখা হয়েছে। লোহার শেকল আর ডান্ডা বেড়ির ভারে আমি নড়তে পারছিলাম না। পাথরের মতো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু ভাবছিলাম, কি আমার অপরাধ! কেন আমাকে এভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। রেস্টুরেন্টের আঁধো আলো আঁধো অন্ধকারে আমি দেখছিলাম আমার চারপাশে মানুষগুলো সব এদিক-ওদিক হাঁটা-হাঁটি করছে। কারা হাঁটছে, কেন হাঁটছে বুঝতে পারছিলামনা। হঠাৎ, কে একজন এসে আমার হাতে কতগুলো গরম প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বললো, যাও, ওই টেবিলে প্লেট গুলো দিয়ে আস। আমার হুঁশ ফিরে এলো।

আমি প্লেটগুলো নিয়ে মিলনের কাছে গেলাম। মিলন রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে বড় টেবিলে বারো-চোদ্দ জন কাস্টমারকে খাবার পরিবেশন করছে। রেস্টুরেন্টের কোনো টেবিলই খালি নেই। ইংলিশ সাহেবেরা খাচ্ছে। উচ্চ শব্দে হো হো করে হাসছে। আবার খাচ্ছে। বিয়ার পান করছে। মদ পান করছে। কেও খাচ্ছে ঝালফ্রেজি। কেও খাচ্ছে সাসলিক। আমি এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখছিলাম। সাহেবেরা খাচ্ছে, হাসছে; আর ওয়েস্টকোট নেকটাই পড়ে সাহেব সেঁজে আমরা ওদের খাওয়াচ্ছি। কেউবা আবার বিয়ারের গ্লাস উল্টে ফেলে টেবিলক্লথ ভিজিয়ে ফেলছে; আর আমরা ক্লান্তিহীন ভাবে নতুন ক্লথ পেতে দিচ্ছি টেবিলে। নতুন কাস্টমার আসছে এক এক করে; আর আমরা ড্রাফট বিয়ার, লাগার বিয়ার গ্লাস উপচে ভর্তি করে দিচ্ছি ওদের একের পর এক। ওনিয়ন ভাজি, পাপাডাম, ভিন্ডালু, ফ্লোটা কফি, পাইন্যাপল ডিলাইট- হাজার রকমের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। আজ আমার প্রথম দিন, তাই আমি শুধু দেখছিলাম আর শিখছিলাম কিভাবে ওগুলো পরিবেশন করা হয়। শিখছিলাম কোন খাবারের কি নাম। কোন গ্লাসে কোন মদ পরিবেশন করা হয়। প্রথম দিনই আমি শিখে ফেললাম, কিভাবে বিয়ার আর লেমোনেড মিশিয়ে স্যান্ডি বানানো হয়। কিভাবে কফির সাথে বেইলি মিশিয়ে ফ্লোটা কফি বানাতে হয়। সবকিছুই যেন আমার কাছে থোরিকাম ন্যাজাল স্পেকুলাম দিয়ে নাসারন্ধ পর্যবেক্ষণের মতোই জটিল মনে হচ্চিলো!

কিভাবে যে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে, খেয়ালই করিনি। রেস্টুরেন্ট একেবারে খালি হয়ে গেছে। কোনার এক লম্বা টেবিলে ছয়জন কাস্টমার তাদের শেষ পানটুকু করে নিচ্ছে। রেস্টুরেন্টের বারে দাঁড়িয়ে বারী আংকেল এতক্ষন সবকিছু তদারকী করছিলো। আমার চোখে চোখ পরতেই বলে উঠলো, 'ভাতিজা, এইখানে আস, তোমারে সাম্বুকা বানানো শিখাই।' বলেই, সে ট্রের উপরে ছয়টা ছোট শট গ্লাস রাখলো। তারপর, বোতল থেকে রংহীন সাম্বুকা ঢাললো গ্লাসগুলোতে। পকেট থেকে লাইটার বের করে প্রতিটি গ্লাসের মুখে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। ছয়টি গ্লাস মৃদু আলোর অপূর্ব রঙে জ্বলতে লাগলো। বারী আঙ্কেলের কপালে পরিশ্রমের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকলেও, সাম্বুকার প্রজ্জলিত রঙিন আলোতে তার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠা পরিতৃপ্তির হাসি আমার চোখ এড়াতে পারলো না। সে নিজ হাতে সাম্বুকা নিয়ে পরিবেশন করলো তার শেষ ছয় কাস্টমারকে। সে জানে ফ্রি সাম্বুকায় কত বরকত।

রাত সাড়ে এগারোটা থেকে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করা শুরু হয়ে গেলো। আজ আমার প্রথম দিন, তাই আমাকে একটু আগেই ছেড়ে দেয়া হলো। আমাকে এগারোটা চল্লিশের বাস ধরতে হবে। আমি তাড়াহুড়ো করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাস স্টপে ছাব্বিশ নাম্বার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া বইছিলো। হঠাৎ পিঠের দিকে বরফের মতো ঠান্ডা অনুভব করলাম। বুঝতে পারলাম, ঘামে শার্ট ভিজে আছে। বাস এসে থামতেই অটোমেটিক দরজা খুলে গেলো। আমি ডাবলডেকার বাসের উপর তলায় উঠে গেলাম। বাস চলতে লাগলো দুলে দুলে। সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা- এই বারো ঘন্টা কি করেছি মনে করার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম মনটা বেশ ভারী হয়ে আছে। ছাব্বিশ নাম্বার বাসে কোথায় যাচ্ছি সেই গন্তব্য আমার জানা। কিন্তু আমার ভাগ্যের গন্তব্য কি আমি জানি? ওই এডিডাস ছেলেটি কি জানে? অথবা জাফর ভাই? আবুল ভাই কি তার কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছুতে পেরেছে? আমি অনুভব করলাম আমার মনটা আসলেই বেশ ভারী হয়ে পড়েছে। আমি বাসের জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকালাম। আকাশের দিকে তাকালাম। অসম্ভব সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছিল সেদিন।

খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭,
স্যার আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং বিল্ডিং,
ইম্পেরিয়াল কলেজ,
লন্ডন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫০
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×