somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছায়ার সঙ্গে ফেরা

১২ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অনেকদিন পর এলাম! সবকিছুই কেমন যেনো বদলে গেছে। বাস থেকে নামলেই চায়ের দোকানটা পড়তো। সেখানে এখন বড় মুদি দোকান। কিন্তু "ফজলু টি স্টল" লেখা সাইনবোর্ডটা এখনো রয়ে গেছে। সবকিছু বদলে গেলেও পথগুলোর গতিপথ বদলায়নি। আমি জানি, কোন পথ ধরে গেলে
আসিফদের বাড়ি পৌঁছে যাবো। বাজার থেকে মাইলখানেক পথ হেঁটে গেলেই আসিফদের বাড়ি। এতক্ষণ বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকার কারনে ঘুমের একটা ভাব এসে গেছে। এক কাপ চা খাবার ইচ্ছেটা এখন প্রয়োজনে রূপ নিলো। একটা চায়ের দোকানে ঢুকে পড়লাম। বেঞ্চিতে বসতেই দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিটা টের পেলাম। শরীর বিশ্রামের জন্য মুখিয়ে আছে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো, কেন এলাম! এতদিন পর! বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার কারনে? নাকি অবচেতন মন আবার নাফিসাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে। নাফিসা! একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটা দিলাম। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটার ওজন বেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। দুইপাশে ধানের জমি। মাঝখানে পায়ে হাঁটা পথ। আর কিছুদূর গেলেই একটা বাঁশের সাঁকো পড়বে। কিছুই ভুলিনি! সব মনে আছে। নাফিসাকেও। একদিন হঠাৎ কি যেন হয়ে গেলো! নাফিসাকে চুমু খেয়ে ফেলেছিলাম! নাফিসা সেদিন আর সামনে আসেনি।

আসিফদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে লাগলাম। কাকে ডাকবো? মৃত বন্ধুর নাম ধরে ডাকবো? কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এক বৃদ্ধ এসে উদ্ধার করলেন, সঙ্কট থেকে।

-কারে বিচরাও বাজান!
-আমি আসিফের বন্ধু। ওর মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছি।
-আসো, ভিতরে আসো।

বৃদ্ধকে অনুসরণ করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করি। বাড়ির ভেতরের আবহাওয়াটা অনেক বদলে গেছে। বাড়িটা মরে গেছে মনে হচ্ছে। বাড়িও কি মানুষের মতো করে মরে যায়? আসিফের মৃত্যুর পর ওর শোকে হয়তো বাড়িটাও মরতে বসেছে। বাইরের ঘরে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ ভেতরে খবর দিতে গেলেন। ঘরটাতে চোখ বোলালাম। এই ঘরে অনেকগুলো দিন কেটেছে আমার। এটা আসিফের ঘর। সরকার বদলের পর সেবার যখন আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিলো প্রতিপক্ষের ভয়ে, সেবার কিছুদিন আমি এই ঘরে থেকেছি। আবার আসিফ মারা যাবার পরেও এসেছি।
আসিফের মা এসে দাঁড়ালেন, রুমে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম।
তিনি সালামের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কেমন আছো, বাবা?
- ভাল, খালাম্মা। আপনারা কেমন আছেন? আপনাদের দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো, তাই চলে এলাম।
-আমাদের আর থাকা। আসিফ মারা যাওয়ার পর আর ভালো থাকা হয়নি।

আসিফের মা কেঁদে উঠলেন, সশব্দে। দরজার আড়াল থেকে একটা কণ্ঠ চাপা গলায় বলে উঠলো,
-মা, তোমাকে কাঁদতে মানা করেছিলাম। তোমার শরীর ভালোনা।
নাফিসা! আমি উৎসুক হয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলাম। কেউ এলোনা। খালাম্মা কিছুক্ষণ কেঁদে আমাকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন।

বালিশে হেলান দিয়ে তন্দ্রামত এলো। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টের পাইনি। ঘুম ভাঙ্গার পর, তাকিয়ে দেখি নাফিসা রুমে দাঁড়িয়ে আছে। নাফিসার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো!
-মা আপনাকে গোসল করে নিতে বলছেন। কিছু লাগবে? গামছা আছে?
-আছে। কেমন আছো, তুমি?
জবাব না দিয়ে চলে গেলো, নাফিসা। তীব্র অপমানবোধ আমার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। ইচ্ছে করলো, নাফিসাকে শক্ত করে ধরে বলি, আসিফের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী নই। আমি সেখানে গিয়েছিলাম আসিফের ইচ্ছায়। আসিফ আমার ইচ্ছায় যায়নি।

আসিফ আমার ইউনিভার্সিটির সবচাইতে কাছের বন্ধু ছিলো। আমরা হলে একই রুমে থাকতাম। একই দলের রাজনীতি করতাম। সেদিন আমাদের একটা মিছিল ছিলো। মারামারি হবার কোন কথা ছিলোনা। ক্ষমতাসীন দলের অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল। আমি আর আসিফ মিছিলের সামনেই ছিলাম। হঠাৎ প্রতিপক্ষের ছেলেরা মিছিলে হামলে পড়ে। দুই পক্ষে মাত্র কয়েক রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়েছিলো। সেই কয়েক রাউন্ড গুলির একটি আসিফের মাথায় আঘাত হানে। আসিফ মরে যায়। আসিফের লাশ তাদের বাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনার দায়িত্বটা আমিই নিয়েছিলাম। আসিফের লাশ দাফন হবার পরেরদিন চলে যাবার আগে নাফিসা এসেছিলো, কিছুক্ষণের জন্য। আসিফের কথা বলতে গিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠেছিলো। আমি তার চোখের জল মুছে দেই। চোখের জল মুছে দিতে গিয়ে আমি নাফিসার বারবার কেঁপে উঠা ঠোঁটে ঠোঁট বসাই। নাফিসা চমকে উঠে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। "আপনি ভাইয়াকে মরতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আপনি কেনো বেঁচে এলেন?"
কথাগুলো বলে নাফিসা ছিটকে বের হয়ে যায় রুম থেকে। পরে আর নাফিসা আমার সামনে আসেনি। নাফিসাকে আমি ভালোবেসেছি।
দুপুরের খাবার টেবিলেই আমি জানিয়ে দিলাম, বিকেলে ফিরে যাবার কথা। কেউ থাকতে বললোনা। একবারো। আমি অবাক হলাম না, আমি অপাক্তেয়। নাফিসার কাছে অপাক্তেয়।

বিকেলর রোদ মরে এসেছে। আমি হাঁটছি বাস স্ট্যান্ডের দিকে। আমার হাতে একটা চিরকুট। বিদায় নিয়ে বের হবার আগে নাফিসা আমাকে এই চিরকূটটা দিয়েছে, আজ। সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে আবার পড়লাম লেখাগুলো, "আমি আপনাকে ঘৃণা করি। আপনি আর কোনদিন আসবেন না, আমাদের বাড়ীতে। আমাদের খবর নিতে আসার দরকার নেই।"

দ্রুত বাসস্ট্যান্ডের দিকে বাড়ালাম। বাস মিস হয়ে গেলে, আজ রাতে আবার থেকে যেতে হবে। আমি আর কোনদিন থাকতে চাইনা। আর কোনদিন আসবোনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:৫১
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×