ঐ আগস্ট মাসেরই কথা।
একটা জন্মদিনের প্রোগ্রাম শেষ করে ফেরার সময় হুট করে মেয়েটা বলে বসলো, তোর কাজ না থাকলে চল্ একটু ঘুরে আসি।
কাজ ছিল কিনা মনে নাই, তবে আমি গেলাম ওর সাথে। ভার্সিটিতে ভর্তির পর তখনও ডিওএইচএস এলাকায় সেভাবে যাওয়া-আসা শুরু হয় নি। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। আমরা রিকশায় উঠলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ঐদিনও বৃষ্টি ছিল। টিপটিপ-আদুরে ধরণের বৃষ্টি।
ইসিবি চত্তর পর্যন্ত গেলাম। সত্যি বলতে গেলে, ঐদিনই ভালোমত জায়গাটা ঘুরে দেখলাম প্রথমবার।
রাস্তায় বেশি লোকজন ছিলনা।
“এখানে বসা নিষেধ” সাইনবোর্ডের সামনে বসে ছিলাম আমরা দুইজন। ওর কালো ড্রেসটা স্পষ্ট মনে আছে আমার, আর আমার কালো পাঞ্জাবী। ওর ক্যামেরায় আমাদের অনেক সুন্দর একটা ছবি আছে ঐদিনের। রিকশাওয়ালা মামাকে দিয়ে তোলানো। দাঁত বের করা আমরা দুইজন। অজানা কারণে আমাদের 'ফটোগ্রাফার'ও কেন যেন ছবি তোলার সময় দাঁত বের করে হাসছিল।
সত্যি বলতে কি, নিজেকে ব্যাবিলনের রাজা মনে হচ্ছিল। আর পিছনে ইসিবি চত্বরের ভাস্কর্যটাকে মনে হচ্ছিল ব্যাবিলনের সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত বাগান।
আমি বলতে পারবো না কখনও ঐ মুহূর্তগুলো কেমন ছিল। শুধু বলতে পারবো, মিনিটে আমার হার্ট ছিয়াত্তরের চেয়ে অন্তত দশবার বেশি কাঁপছিল। তবুও বাচ্চাদের মত অর্থহীন একটা আনন্দ হয় তখন, কেমন একটা নেশার মতন।
মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে দশটা অতিরিক্ত হার্টবিটের কারণ খুঁজতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। কিন্তু কি লাভ? আমার হার্ট আর ব্রেইন কেমন অদ্ভুত রকমের একটা পরকীয়ায় একজন আরেকজনের সাথে যুক্ত। এখানে যেন আমার ইচ্ছার কোনও দাম নেই।
ডিওএইচএসে রাস্তার দুইপাশে খালি জায়গাগুলোতে আমার অনেক সুন্দর কিছু দুপুর কাটে। নিচু দেয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে আমি আর ও এলোমেলো সব প্ল্যান করতাম; অর্থহীন, অ-জ্ঞানগর্ভ সব আলোচনা করতাম। যদিও ঐসব প্ল্যানের স্থায়িত্ব বড়জোর দশ মিনিট।
তবে এরই মধ্যে আমাদের ঐক্যজোটে বিরোধী দল আক্রমণ করতো যথারীতি। আমাদের দুইজনের পশ্চাদ্দেশে পিষ্ট দেয়ালের বক্ষ-বিদীর্ণ করে এদিক-সেদিক থেকে যোগ দিত পিঁপড়া। কিন্তু এখানেও বিপত্তি, পিঁপড়া মারতে গেলেও মহারাণী চোখ গরম করে তাকাবেন।
- খামাখা মারলি কেন এটা, বল্ কেন মারলি?
সাঙ্গু নদীর শান্ত পানিতে ক্ষণিকের জন্য রোদের শাসনের রূপ দেখলে বুঝতেন, মাঝে মাঝে অকারণে কেন আমি দুয়েকটা পিঁপড়া মেরে ফেলতাম। পিঁপড়া সমাজ এতকিছু জানলে এই পাপের জন্য নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দিত আমাকে।
ফাঁকা প্লটগুলোতে পুকুরের মতন ছিল তখন কয়েক জায়গায়। ওগুলোই ছিল আমাদের ভরদুপুরের লাবণী-পয়েন্ট, আর বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা থাকলে তা-ই হয়ে যেত মাধবকুণ্ড।
ছোট্ট একটা পাথরের উপর বসে আমরা একদিন ঠাণ্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। গল্পের মত টলটলে পানি ছিল না। বরং কাদা তো ছিলই, এমনকি কেঁচো-জোঁকেরও ভয় ছিল। কিন্তু আমাকে ঘেঁষে যতটুকু সময় ছিল ও, এগুলো মাথায় আসে নি একবারো।
জীবন একটা ‘লুপ’ হলে ঐ অংশটাই অসংখ্যবার রিপিট করাতাম আমি হয়তো।
সেদিন ওদিকটায় গেলাম অনেকদিন পর। জ্বলন্ত সিগারেটের ছাই ছড়িয়ে দিয়ে আসলাম এবার। আমার এবং আমার খুব প্রিয় একজনের মিশে যাওয়া পায়ের ছাপ আর পিষে যাওয়া পরাবাস্তবতার ওপর আমার পুড়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসগুলো রেখে এলাম।
কারণ এখনও আমার কাছে ইসিবি ক্যান্টিনের মানে খুব সুন্দর ঐ মেয়েটা, খুব সহজেই যার চোখে আলো-আঁধারি খেলা করতো। এখনও করে নিশ্চয়ই। আমার ইচ্ছা করতো, খুব কাছ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবো। নিঃশ্বাস ফেলা দূরত্ব না হোক, অন্তত ওর মন খারাপের সময় কয়েক সেকেন্ড মাথায় হাত দিতে পারার মত দূরত্ব হলেই চলতো আমার।
(চলবে)