[ যারা আমার লেখার মূল বিষয়বস্তু না পড়ে আজেবাজে মন্তব্য করে, হাসিমস্করা করে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, দয়াকরে আমার দু:খবেদনা নিয়ে মজা করবেন না।পড়া না পড়া আপনাদের স্বাধীনতা, কিন্তু আজেবাজে মন্তব্য করে কাউকে আঘাত দেওয়া সভ্যতা-ভব্যতার মধ্যে পড়ে না। ]
আমার আজকের লেখাটা গত ১ অক্টোবর ২০১০ তারিখে প্রকাশিত পোস্টিং-এর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ লেখাটা আমার দাদু ও তার লাগানো গাছগুলো নিয়ে। আমার দাদুরা ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্তু হয়েছিল রাঙামাটি জেলার বন্দুকভাঙা নামক এলাকা থেকে। গ্রাম, ঘরবাড়ী, জায়গা-জমি সব পানিতে ডুবে গেলে দাদুরা প্রথমে মারিশ্যাতে যায়। সেখানে জঙ্গল কেটে জুমচাষ করে বছর দু’য়েক কাটায়। জুমের সাথে কিছু ধানি জমিও তারা প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু বাঁধের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি করে দেওয়ায় সেসব ধানি জমিও ডুবে যায়। অবশেষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দাদুরা খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে চলে আসে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর আগে বর্তমান গ্রামে এসে বসতিস্থাপন করেছিল (গ্রামের নাম উহ্য রাখলাম নিরাপত্তার কারণে ।কেননা, সেনাগোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এসব লেখা পড়ে আমার জীবন তক্তা বানিয়ে দিতে পারে)।পানছড়িতে জঙ্গল সাফ করে কোনমতে কিছু ধানি জমি উদ্ধার করতে পেরেছিল।কিন্তু যে পরিমাণ জমি পেয়েছিল সে পরিমাণ জমিতে চাষ করে দাদুর জীবন অর্থাৎ আমাদের পরিবার ঠিকমত চলতে পারতো না।দু:খে ক্ষোভে দাদু অনেক গল্প বলতো তার সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রামের কথা, জমির উর্বরতার কথা।পুরনো জায়গায় জীবন অনেক সুখের ছিল। বলতো তাদের গ্রামের ফিত্তিতে (কর্ণফুলী নদীর পাড়ে একটা খাল) এক খেপ জাল মারলে একবেলা মাছ অনায়াসে পাওয়া যেতো। কিন্তু নতুন জায়গায় এসে সেসব সুখস্বাচ্ছন্দ্য আরে নেই। সেসব আজ স্বপ্ন।
গত লেখায় বলেছিলাম, আমাদের পুরনো বাড়ীর জায়গাতে আর্মি ক্যাম্প (বর্তমানে বিডিআর ক্যাম্প) বানানো হয়েছিল। অর্থাৎ দাদুরা (তারা তিন ভাই ছিল) পানছড়ি উপজেলাতে এসে প্রথম যেখানে ঘর বানিয়েছিল সেখানে আর্মিরা ১৯৮৩ সালের দিকে ক্যাম্প তৈরী করেছিল। ক্যাম্প হওয়ার কারণে দাদুদের অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়। কিন্তু ক্যাম্পের জায়গায় দাদুর অনেক স্মৃতি আছে।দাদুর লাগানো অনেক আমগাছ, কাঁঠালগাছ, জাম্বুরা গাছ ও বটগাছ আছে। বর্তমানে বিডিআরের জোয়ানরা সেসব গাছ থেকে আম কাঁঠাল ও জাম্বুরা খায়। বটগাছের নীচে বসে গল্প করে। সেন্ট্রি (পাহারা) দেয়।
কিন্তু দু:খের বিষয় হলো, আর্মিরা যখন ক্যাম্প তৈরী করছিল তখন তারা গ্রামবাসীদের জোর করে বিনা পয়সার ক্যাম্পে কাজ (যেটাকে জবরদস্তিমূলক শ্রম বলে) করিয়েছিল।ক্যাম্পের চারদিকের জঙ্গল কয়েক মাস পর পর সাফ দিতে হতো। চারপাশে ধারালো বাঁশে টুকরা দিয়ে ঘেরা দিয়ে দিতে হতো। সেসব গাছবাঁশ গ্রামবাসীদের জঙ্গল থেকে এনে দিতে হতো এবং অবশ্যই বিনাপয়সায়। দাদুকেও বেশ অনেকবার ক্যাম্পে কাজ করে দিতে হয়েছিল। কাজ করে দেওয়ার পাশাপাশি অনেক গালি-গঞ্জনাও খেতে হয়েছিল। সেসব কথা আমাদের বলতো। দু:খ করে বলতো, “বাড়ীর জমিও নিয়ে গেল, আবার অপমান, লাঞ্জনা দিচ্ছে এ শুয়োরগুলো (আর্মিরা)”। এখন ভাবি, দাদুর গালি-গঞ্জনা খেতে পাওয়ার হয়ত অন্যতম একটা কারণ ছিল, দাদু বাংলা বলতে পারে না।লেখাপড়া জানে না। আর্মিরা যা করতে বলে হয়ত ঠিক সেভাবে তাদের তালিম অনুসরণ করতে পারেনি।হয়ত আর্মিরা ঝারি মারতো। আর্মিরা তো সেময় আহত বাঘের চেয়েও ভয়ংকর ছিল।
ঘরে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় খাবারের পর অবসর সময়ে দাদু আমাদের সেসব গল্প বলতো। বলতো, “নাতিরা, তোমরা পড়ালেখা করো।এ বাঙালদের সাথে মাথা দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। তাদের ভাষা শিখতে হবে। তারা যে ভাষায় গালি দেয়, সে ভাষায় তোমাদেরও গালি দিতে হবে”।
আজ ব্লগে যখন লেখা দিই এবং বাজে মন্তব্য দেখি, তখন দাদুর সেই কথাগুলো খুব মনে পড়ে, কানে বাজে।
দাদু নেই। এক দশক আগে ইহলোক ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে তাকে ভারতের শরণার্থী শিবিরে শরণার্থী হিসেবে দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হয়েছিল দীর্ঘ এক যুগ। ৮৬-৮৭ সাল। তখন ছিল এক বিভীষিকাময় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। আর্মি ও সেটেলারদের অত্যাচারে আমাদের জীবন বাঁচার তাগিদে গ্রামছাড়তে হয়েছিল।মনে পড়ে কীভাবে আমাদের গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। মনে পড়ে রাতের অন্ধকারে আমাদের গ্রামে আগুন লাগানো হয়েছিল। কানে বাজে বোমার শব্দ, গোলাগুলির শব্দ।কানে বাজে মানুষের আর্তচিৎকার।
শান্তিচুক্তির পর আমরা দেশে ফিরলাম। ফেরার দু’বছর পর দাদু ইহলোক ছেড়ে চলে গেলো।
দাদু নেই, কিন্তু তার লাগানো আম-কাঁঠাল-জাম্বুরা ও বটগাছগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। উদারভাবে এখনও বিডিআর জোয়ানদের ফল দেয়, ছায়া দেয়। বিডিআর জোয়ানরা হয়তো জানেনা, কে এই গাছগুলো লাগিয়েছিল।
আমি যখন ক্যাম্পের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, আমার মন কেঁদে উঠে।তারচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে, হেঁটে যাওয়ার পথে যখন কোন বিডিআরের জোয়ান জিজ্ঞেস করে, “তোমার বাড়ী কই”? যেই লোক আমার বাড়ীর জমি দখল করে, সেই কিনা জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ী কোথায়! এরচেয়ে দু:খ আর কী হতে পারে! প্রশ্নটা অন্যভাবেও হতে পারে। “তোমার বাড়ী কই” এ প্রশ্ন অনেক আঘাত দেয়। এ নিয়ে দু’একবার বচসাও হয়েছিল বিডিআর জোয়ানদের সাথে।
শান্তিচুক্তির পর জায়গা জমি ফেরত পাওয়ার কথা।সেই জমি ফেরত পাইনি। পাবো এমন সম্ভাবনাও দেখি না। কেননা, জমিটা দাবী করলে সরকার এখন মালিকানার দলিলপত্র দাবী করে।দাদুর তো কোন দলিলপত্র নেই, তখন দলিল করারও প্রয়োজন হয়নি।কিন্তু সেই বটগাছ, সেই আম-কাঁঠাল ও জাম্বুরার গাছগুলো এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। জানিনা, গাছগুলো কেমন আছে মূল মালিককে ছাড়া? পার্বত্য ভূমিকমিশন কী দাদুর লাগানো গাছগুলোকে সাক্ষী হিসেবে মানবে?
কিন্তু আদালত বসে শহরে।গাছগুলোকে কী আদালতে হাজির করাতে পারবো? ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান খাদেমুল সাহেব কী আমাদের গাছগুলোকে সাক্ষী হিসেবে মানবেন?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ২:১৩