somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দাদুর লাগানো গাছগুলো কী ভালো আছে? পার্বত্য ভূমি কমিশন তাদের সাক্ষী মানবেন কী?

০৩ রা অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[ যারা আমার লেখার মূল বিষয়বস্তু না পড়ে আজেবাজে মন্তব্য করে, হাসিমস্করা করে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, দয়াকরে আমার দু:খবেদনা নিয়ে মজা করবেন না।পড়া না পড়া আপনাদের স্বাধীনতা, কিন্তু আজেবাজে মন্তব্য করে কাউকে আঘাত দেওয়া সভ্যতা-ভব্যতার মধ্যে পড়ে না। ]

আমার আজকের লেখাটা গত ১ অক্টোবর ২০১০ তারিখে প্রকাশিত পোস্টিং-এর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ লেখাটা আমার দাদু ও তার লাগানো গাছগুলো নিয়ে। আমার দাদুরা ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্তু হয়েছিল রাঙামাটি জেলার বন্দুকভাঙা নামক এলাকা থেকে। গ্রাম, ঘরবাড়ী, জায়গা-জমি সব পানিতে ডুবে গেলে দাদুরা প্রথমে মারিশ্যাতে যায়। সেখানে জঙ্গল কেটে জুমচাষ করে বছর দু’য়েক কাটায়। জুমের সাথে কিছু ধানি জমিও তারা প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু বাঁধের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি করে দেওয়ায় সেসব ধানি জমিও ডুবে যায়। অবশেষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দাদুরা খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে চলে আসে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর আগে বর্তমান গ্রামে এসে বসতিস্থাপন করেছিল (গ্রামের নাম উহ্য রাখলাম নিরাপত্তার কারণে ।কেননা, সেনাগোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এসব লেখা পড়ে আমার জীবন তক্তা বানিয়ে দিতে পারে)।পানছড়িতে জঙ্গল সাফ করে কোনমতে কিছু ধানি জমি উদ্ধার করতে পেরেছিল।কিন্তু যে পরিমাণ জমি পেয়েছিল সে পরিমাণ জমিতে চাষ করে দাদুর জীবন অর্থাৎ আমাদের পরিবার ঠিকমত চলতে পারতো না।দু:খে ক্ষোভে দাদু অনেক গল্প বলতো তার সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রামের কথা, জমির উর্বরতার কথা।পুরনো জায়গায় জীবন অনেক সুখের ছিল। বলতো তাদের গ্রামের ফিত্তিতে (কর্ণফুলী নদীর পাড়ে একটা খাল) এক খেপ জাল মারলে একবেলা মাছ অনায়াসে পাওয়া যেতো। কিন্তু নতুন জায়গায় এসে সেসব সুখস্বাচ্ছন্দ্য আরে নেই। সেসব আজ স্বপ্ন।

গত লেখায় বলেছিলাম, আমাদের পুরনো বাড়ীর জায়গাতে আর্মি ক্যাম্প (বর্তমানে বিডিআর ক্যাম্প) বানানো হয়েছিল। অর্থাৎ দাদুরা (তারা তিন ভাই ছিল) পানছড়ি উপজেলাতে এসে প্রথম যেখানে ঘর বানিয়েছিল সেখানে আর্মিরা ১৯৮৩ সালের দিকে ক্যাম্প তৈরী করেছিল। ক্যাম্প হওয়ার কারণে দাদুদের অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়। কিন্তু ক্যাম্পের জায়গায় দাদুর অনেক স্মৃতি আছে।দাদুর লাগানো অনেক আমগাছ, কাঁঠালগাছ, জাম্বুরা গাছ ও বটগাছ আছে। বর্তমানে বিডিআরের জোয়ানরা সেসব গাছ থেকে আম কাঁঠাল ও জাম্বুরা খায়। বটগাছের নীচে বসে গল্প করে। সেন্ট্রি (পাহারা) দেয়।

কিন্তু দু:খের বিষয় হলো, আর্মিরা যখন ক্যাম্প তৈরী করছিল তখন তারা গ্রামবাসীদের জোর করে বিনা পয়সার ক্যাম্পে কাজ (যেটাকে জবরদস্তিমূলক শ্রম বলে) করিয়েছিল।ক্যাম্পের চারদিকের জঙ্গল কয়েক মাস পর পর সাফ দিতে হতো। চারপাশে ধারালো বাঁশে টুকরা দিয়ে ঘেরা দিয়ে দিতে হতো। সেসব গাছবাঁশ গ্রামবাসীদের জঙ্গল থেকে এনে দিতে হতো এবং অবশ্যই বিনাপয়সায়। দাদুকেও বেশ অনেকবার ক্যাম্পে কাজ করে দিতে হয়েছিল। কাজ করে দেওয়ার পাশাপাশি অনেক গালি-গঞ্জনাও খেতে হয়েছিল। সেসব কথা আমাদের বলতো। দু:খ করে বলতো, “বাড়ীর জমিও নিয়ে গেল, আবার অপমান, লাঞ্জনা দিচ্ছে এ শুয়োরগুলো (আর্মিরা)”। এখন ভাবি, দাদুর গালি-গঞ্জনা খেতে পাওয়ার হয়ত অন্যতম একটা কারণ ছিল, দাদু বাংলা বলতে পারে না।লেখাপড়া জানে না। আর্মিরা যা করতে বলে হয়ত ঠিক সেভাবে তাদের তালিম অনুসরণ করতে পারেনি।হয়ত আর্মিরা ঝারি মারতো। আর্মিরা তো সেময় আহত বাঘের চেয়েও ভয়ংকর ছিল।

ঘরে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় খাবারের পর অবসর সময়ে দাদু আমাদের সেসব গল্প বলতো। বলতো, “নাতিরা, তোমরা পড়ালেখা করো।এ বাঙালদের সাথে মাথা দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। তাদের ভাষা শিখতে হবে। তারা যে ভাষায় গালি দেয়, সে ভাষায় তোমাদেরও গালি দিতে হবে”।

আজ ব্লগে যখন লেখা দিই এবং বাজে মন্তব্য দেখি, তখন দাদুর সেই কথাগুলো খুব মনে পড়ে, কানে বাজে।

দাদু নেই। এক দশক আগে ইহলোক ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে তাকে ভারতের শরণার্থী শিবিরে শরণার্থী হিসেবে দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হয়েছিল দীর্ঘ এক যুগ। ৮৬-৮৭ সাল। তখন ছিল এক বিভীষিকাময় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। আর্মি ও সেটেলারদের অত্যাচারে আমাদের জীবন বাঁচার তাগিদে গ্রামছাড়তে হয়েছিল।মনে পড়ে কীভাবে আমাদের গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। মনে পড়ে রাতের অন্ধকারে আমাদের গ্রামে আগুন লাগানো হয়েছিল। কানে বাজে বোমার শব্দ, গোলাগুলির শব্দ।কানে বাজে মানুষের আর্তচিৎকার।

শান্তিচুক্তির পর আমরা দেশে ফিরলাম। ফেরার দু’বছর পর দাদু ইহলোক ছেড়ে চলে গেলো।

দাদু নেই, কিন্তু তার লাগানো আম-কাঁঠাল-জাম্বুরা ও বটগাছগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। উদারভাবে এখনও বিডিআর জোয়ানদের ফল দেয়, ছায়া দেয়। বিডিআর জোয়ানরা হয়তো জানেনা, কে এই গাছগুলো লাগিয়েছিল।

আমি যখন ক্যাম্পের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, আমার মন কেঁদে উঠে।তারচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে, হেঁটে যাওয়ার পথে যখন কোন বিডিআরের জোয়ান জিজ্ঞেস করে, “তোমার বাড়ী কই”? যেই লোক আমার বাড়ীর জমি দখল করে, সেই কিনা জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ী কোথায়! এরচেয়ে দু:খ আর কী হতে পারে! প্রশ্নটা অন্যভাবেও হতে পারে। “তোমার বাড়ী কই” এ প্রশ্ন অনেক আঘাত দেয়। এ নিয়ে দু’একবার বচসাও হয়েছিল বিডিআর জোয়ানদের সাথে।

শান্তিচুক্তির পর জায়গা জমি ফেরত পাওয়ার কথা।সেই জমি ফেরত পাইনি। পাবো এমন সম্ভাবনাও দেখি না। কেননা, জমিটা দাবী করলে সরকার এখন মালিকানার দলিলপত্র দাবী করে।দাদুর তো কোন দলিলপত্র নেই, তখন দলিল করারও প্রয়োজন হয়নি।কিন্তু সেই বটগাছ, সেই আম-কাঁঠাল ও জাম্বুরার গাছগুলো এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। জানিনা, গাছগুলো কেমন আছে মূল মালিককে ছাড়া? পার্বত্য ভূমিকমিশন কী দাদুর লাগানো গাছগুলোকে সাক্ষী হিসেবে মানবে?

কিন্তু আদালত বসে শহরে।গাছগুলোকে কী আদালতে হাজির করাতে পারবো? ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান খাদেমুল সাহেব কী আমাদের গাছগুলোকে সাক্ষী হিসেবে মানবেন?

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ২:১৩
১৭টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×