[আদিবাসী বিতর্ক নিয়ে Kungo Thang আমাকে একটা নোটে ট্যাগ করেছেন। তার নোটটা ছিলোঃ “পৃথিবীকে একটাই দেশ আছে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসক জাতি নিজেদেরকে আদিবাসী এবং বাকীদের বহিরাগত বলে দাবী করে— দেশটির নাম বাংলাদেশ। বিপন্ন নিপীড়িত শোষিত বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসী বাঙালি জাতিসত্তার জয় হোক... আমিন!”! এই নোটের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন জনে মন্তব্য দিয়েছেন। আমিও দিয়েছিলাম।আমার ফেসবুকের সেই নোটটা পরিমার্জন করে এই ব্লগে ছাপালাম।]
******************************************
বাঙালিদের (দুঃখিত সবার কথা বলছি না, তবে অধিকাংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) আদিবাসী নিয়ে বিতর্কে মশগুল হতে দেখে একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো। এই কৌতুকটা অনেক আগে কোন এক পত্রিকায় পড়েছিলাম। একদিন পড়া আদায় করতে না পারার জন্যে শাস্তি হিসেবে শিক্ষক ছেলেকে আটকিয়ে রেখেছিলেন।ফলে ছেলের বাড়ী ফিরতে দেরী হলো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবা ছেলের দেরী হওয়ার কারণ জানতে চাইলো।
বাবাঃ আজকে স্কুল থেকে ফিরতে দেরী হলো কেন?
ছেলেঃ বাবা স্যারে জিজ্ঞেস করেছে গাইবান্ধা কোথায়? বলতে পারিনি বলে স্যার আমাকে আটকে রেখেছে।
বাবাঃ আরে বোকা তুই বলতে পারলি না, গাইটা খড়ের গাদার কাছে বান্ধা আছে।
শিক্ষকের ‘গাইবান্ধা’ আর ছেলের বাবার ‘গাইবান্ধা’ কি এক? আদিবাসী প্রশ্নেও এই কৌতুকের তাৎপর্য আছে। আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ আর বাঙালিদের ‘আদিবাসী’ এক নয়। অর্থ ভিন্ন ভিন্ন।রাষ্ট্রের শোষণ-নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে প্রান্তিক হতে হতে ‘আদিবাসী’ পরিচিতিটা আদিবাসীদের কাছে ‘আত্মপরিচয়ের’ এবং ন্যূনতম মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার প্রশ্ন।অন্যদিকে, বাঙালিদের কাছে ‘আদিবাসী’ বললে তাদের মানসপটে ভেসে উঠে কে আগে এসেছে আর কে পরে এসে সেই বিতর্ক। এই বিতর্কের কী শেষ আছে? যেমনটা বাবা-ছেলের কৌতুকের উদাহরণ।ছেলের কাছে ‘গাইবান্ধা’ মানে হলো বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলা, আর বাবার কাছে হলো খড়ের গাদার কাছে বেঁধে রাখা ‘গাই’।বাবা-ছেলে তাদের বোঝার মধ্যে কী কখনো এক হতে পারবে?
আহা! হাজার বছরের বাঙালি জাতি!কীভাবে বোঝাই হাজার বছরের বাঙালি জাতিকে! দার্শনিকরা দুনিয়াদারির সমস্যা বুঝার জন্যে কী কী তত্ত নিয়ে এসেছেন। তারা দুনিয়াকে বুঝার জন্যে একটা ধারনা এনেছেন – দুনিয়াকে চোখে যেভাবে দেখেছি সেভাবে বিচার করা যার ইংরেজী প্রত্যয় Positivist approach. এই approach-এ বাঙালিরা বলে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডায় আর আমেরিকায় সাদা চামড়ারা যেভাবে কালো চামড়াদের অত্যাচার করেছে, আমরা তো সেভাবে কিছুই করিনি। সাদা চামড়াদের মত কারোর জায়গায় গিয়ে বসতি করিনি। সাদা চামড়াদের সাথে আমাদের মিল হবে কীভাবে? তাই তো বাঙালিরা বলে এখানে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডায় আর আমেরিকার মত অবস্থা নেই, তাই আদিবাসীও নেই। অর্থাৎ বাঙালি জাতি সাদা চামড়ার লোকদের চেয়েও ভালো জাতি! আহা! বলিহারি!
কিন্তু দার্শনিকরা আরো একটা তত্ত দিয়েছেন। সেটা হলো, ‘কেবল দুনিয়াকে চোখে যেভাবে দেখেছি সেভাবে বিচার করি’ –এভাবে দুনিয়াদারির সমস্যা দেখার চেষ্টা করা হলে সেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হবে না, পুরো সত্য জানা হবে না । পুরো সত্য জ্ঞান জানতে হলে ‘সাদা চোখে দেখার সীমার’ বাইরে যেতে হবে। বিষয় বা সমস্যার গভীরে গিয়ে কীভাবে হলো, কেন হলো ইত্যাদি ভেঙেচুরে বিশ্লেষণ করতে হবে যেটাকে নাম দেওয়া হয়েছে constructivist approach ।এই constructivist approach দিয়ে বাঙালিরা আদিবাসী ইস্যুকে দেখে না। কিন্তু সাদা চামড়াওয়ালাদের চেয়ে বেশি ভাল সাজার চেষ্টা করলে কী হবে!তারা কী কখনো চিন্তা করে দেখেছে, তারা সাদা চামড়াদের চেয়ে কোন অংশে কম? তারা কী কখনো ভেবে দেখেছে, আদিবাসীদের (তাদের ভাষায় ‘উপজাতি বা সংখ্যালঘু জাতি, এখন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’) উপর তারা কী করেছে আর করে যাচ্ছে? তারা কী কখনো আত্মজিজ্ঞাসা করেছে, বাংলাদেশের সংবিধান বানানোর সময় বাঙালি বাদে আর কোন জাতিকে কেন চোখে দেখতে পায়নি। বাংলা ভাষা বাদে আর অন্য কোন জাতির ভাষা চোখে কেন পড়েনি? কেন মনে পড়েনি উর্দুর বিপরীতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা কী কী করেছিলো? তাদের মুখে কেন শুধু বাঙালি জিন্দাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ জিন্দাবাদ? বাঙালি জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে তুলতে কী তারা ভুলে গেছে অস্ট্রেলিয়া আর কানাডা তাদের কৃতকর্মের জন্যে আদিবাসীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছে।
বাঙালির বাঙালি জাতীয়তাবাদের জিন্দাবাদের তোড়ে আমরা আদিবাসীরা যখন ভেসে যাচ্ছি, নিজেদের জায়গা থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য হচ্ছি, রাষ্ট্রের উদাসীনতায় আমাদের জীবন জীবিকা হারাচ্ছি, তখন আমরা চিৎকার করে দাবী জানাচ্ছি, “ওহে বাঙালি ভাইসব, আমাদের বাঁচতে দিন। আমরাও এদেশের মানুষ। আমরাও আদি থেকে এখাসে বসবাস করে আসছি।” কিন্ত বাঙালি জাতি শোনে না। বাঙালির অত্যাচার চালতে থাকে। তাই তো পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ‘জুম্ম জাতি’ নাম ধারন করে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, সারা বাংলাদেশে আরো অনেক জাতি আছে। সবাই মিলে আমরা আদিবাসী। সবাই মিলে আমরা আদিবাসীরা যখন বাঙালি জাতির কাছে দাবী জানাচ্ছি, “হে বাঙালি জাতি, তোমরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তোমাদের ক্ষমতা অনেক। ক্ষমতার জোরে আমাদের ঠেলে দিও না। তোমাদের সাথে আমাদেরকেও নিয়ে নাও। সংবিধানে আমাদের নামও আদিবাসী হিসেবে লিখে দাও”, তখন ক্ষমতাধর বাঙালিরা কী বলে! আমরা আদিবাসীরা যেই ‘আদিবাসী’ শব্দ উচ্চারণ করি, তখন বাঙালিরা জিজ্ঞেস করে উঠে, “ওহে উপজাতি, বাংলায় আগমন তোমাদের কবে রে?”
তাজ্জব বনে যাই। কে আগে এসেছে, আর কে পরে এসেছে সেই অর্থে তো আদিবাসীরা ‘আদিবাসী’ শব্দটা চিন্তা করেনি। বাঙালিরা ‘আদিবাসী’ শব্দ উচ্চারণ করার সাথে সাথে বুঝে থাকেন, আদি+বাসী=আদিবাসী বা আদি অধিবাসী। আদিবাসীরা অবাক বিস্ময়ে তাকাই –আদিবাসীদের দাবী ঠেকানোর জন্যে যুক্তি খাঁড়া করতে বাঙালিরা তখন হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস খুঁজতে থাকে।
আরে বাবা! আদিবাসী নিয়ে এত প্যাঁচাল কেন? বাঙালিরা যদি “আদি+বাসী” অর্থে “আদিবাসী” বুঝে থাকে তাহলেও এতে আদিবাসীদের কোন কোন সমস্যা নেই। আমরা আদিবাসীরা যে যে অঞ্চলে বসবাস করে আসছি সেসব অঞ্চলে আদিবাসীদের আগে কোন বাঙালি কখনো বসতিস্থাপন করেনি।সেজন্যে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় তো বলে থাকেন, “আমরা আদিতেও আদিবাসী।কেননা, আমরা কোন বাঙালিকে উচ্ছেদ করে বর্তমান জায়গাগুলোতে বসতিস্থাপন করিনি”। অর্থাৎ আমরা সেটেলার নই, আমরা আদি থেকেই আমাদের জায়গায় বসবাস করে আসছি।
তারপরও বাঙালিরা আদিবাসীর সংজ্ঞা খুঁজতে খাকবে? তাহলে তো আমাদেরও বাঙালির সংজ্ঞা খুঁজতে হবে।কারা বাঙালি? বাংলা বললেই কী বাঙালি?
আসলে কোন জাতির সংজ্ঞা দেওয়া যথাযথ নয়। এখানে বুদ্ধি বা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নেই। বরং সংজ্ঞা দিতে গেলে সেই সংজ্ঞায় সেই জাতিসত্তার অখন্ডতা ধারন করা সম্ভব নাও হতে পারে।সেজন্যে জাতিসংঘের একটি স্টাডিতে বলা হয়েছে, আদিবাসীর সংজ্ঞা খুঁজা অবান্তর।বরং সেখানে অন্যতম একটি মানদন্ড ঠিক করা হয়েছে, ‘আত্মপরিচিতি’ (self-identification) । অর্থাৎ যারা আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে চায় সেটা সম্মান জানাতে হবে। আর যারা আদিবাসী হতে চায় না, তাদেরকে আদিবাসী বানানো কারোর অধিকার নেই। এখন সব বাঙালি যদি তাদের বাঙালি পরিচিতি ভুলে গিয়ে ‘আদিবাসী’ হতে চায় তাহলে আদিবাসীদের স্বাগত জানানো উচিত। সবার নাম বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে লেখা হোক।
Kungo Thang তার একটা মন্তব্যে আদিবাসী কারা সে সম্পর্কে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইনের উদাহরণ টেনে এনেছেন। সর্বশেষ আইএলওর চুক্তি ১৬৯ নং আইনে উল্লেখিত সংজ্ঞাও এনেছেন। সেটা হলোঃ
“People in independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonization or establishment of present state boundaries and who irrespective of their legal status, retain some or all of their social, economic, cultural and political institutions.”
বোকাদের জন্যেও এটার বাংলা অনুবাদের প্রয়োজন নেই। আসলে এটা আদিবাসীর সংজ্ঞা নয়, কাজ করতে গেলে চলনসই একটা সংজ্ঞা (working definition) লাগে। সেজন্যে আইএলও আদিবাসী কারা হতে পারে সেটার একটা সংজ্ঞা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে মাত্র। সোজা কথায়, কোন জাতিকে সংজ্ঞায়িত করে পরিচিতি নির্ধারণ করে দেওয়া বা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়।আমাদের উপর অন্যায়ভাবে পরিচিতি চাপিয়ে বাংলাদেশ সরকার, অন্যভাবে বললে বাঙালিরা এই অন্যায় করতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার অযথা প্যাঁচাল বাড়াতে চাচ্ছে। আদিবাসী শব্দটা তো বাংলাদেশে নতুন নয়।। বাংলাদেশে প্রচলিত অনেক আইনে আদিবাসী (indigenous/aboriginals) আছে।যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৯০০ সালের শাসনবিধিতে আদিবাসী পাহাড়ী (indigenous hillmen) লেখা আছে। সেজন্যে তো পাহাড়ের লোকজন এখনো ‘পাহাড়ী’ বলে পরিচয় দেয়। অন্যদিকে ১৯৫০ সালের বঙ্গীয় প্রজাসত্ত্ব আইনে গারো, সাঁওতাল ইত্যাদি আদিবাসীতের বুঝাতে aboriginals [অনুচ্ছেদ ৯৭ (১)] লেখা আছে। আরো অনেক উদাহরণ আছে। এসব আইনে indigenous/aboriginals শব্দগুলো দিয়ে কিন্তু বাঙালিদের বোঝানো হয়নি। তারপরেও সরকার বা বাঙালিরা কী ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়ে প্যাঁচাল পাড়তে থাকবে?
লেখা শেষ করার আগে বাব-ছেলের গাইবান্ধা কৌতুকটা আরো একবার স্মরণ করি। গাইবান্ধা কোথায় প্রশ্নের মত বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রশ্ন হতে পারেঃ আদিবাসী কারা? আর বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিও ছেলের বাবার “খড়ের গাদার কাছে গাই বান্ধা আছে” – এরকম শেখানো বুলি মুখস্থ করে বিশ্ব সভায় গিয়ে উগরে দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। যারা আছে তারা সংখ্যালঘু উপজাতি”। আরে বোকা! বাবার শেখানো বুলি বললেই কী মাস্টার নম্বর দেবেন? বিশ্ব সভায় যারা উপস্থিত থাকে তাদের সবাইকে কী বাংলাদেশ সরকার বোকা মনে করে?
আরে বাঙালি জাতি! আরে বাঙালির সরকার! আমার নাম নিয়েও একটা কৌতুক বলি। আমার নাম অডঙ। এর মানে হলো ডানপিটে। ছোটবেলায় ডানপিটে ছিলাম, মারপিট করতাম। তাই আমার নাম হয়েছিলো অডঙ। এখন বড় হয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতটাই হয়েছি। নীরব, চুপচাপ। কম্পিউটার পেলে ভাত-পানি ভুলে কী বোর্ড চাপতে পারি। এখন আমার নামে শুনে কী আমার সেই ছোটবেলার ডানপিটে স্বভাবটা আপনাদের চোখে ভেসে উঠবে? ভয়ে কেউ কী আমার নামের অক্ষরগুলো ওলটপালট করে ‘ডঙঅ’ করে দিতে চায়? তখন কী আমি মানবো? ‘ডঙঅ’ বললে কেউ চিনবে আমাকে?
ঠিক আমার নামের অর্থের উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই, যেই পরিচিতি যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠেছে, কেউ অস্বীকার করলেই কী সেই পরিচিতি মুছে যাবে? অবশ্যই না। আমরা আদিবাসী, আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছি। এই পরিচিতি আমাদের সত্তার মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। কাজেই সরকার উপজাতি বলুক, আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীই বলুক, বা যে নামেই ডাকুক, আমাদের পরিচিতি আমাদের মধ্যে থাকবে - আমরা আদিবাসী।
************
অডঙ চাকমা, ৩ জুন ২০১১
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১১ বিকাল ৪:৩০