হাসপাতাল জায়গাটাই আমার অপছন্দ। সেখানে এমন ভাগ্য আমার, পেশার দিক থেকে আমি ডাক্তার। সরকারি হাসপাতালে কাজ করি, প্রাইভেট প্র্যাকটিসও আছে। কাজেই দিনের বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে কাটে আমার।
সদ্য বদলী হয়েছি আমি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। এখনও জয়েন করিনি অবশ্য। তবে, তার আগেই আসতে হলো হাসপাতালে। আসলে কিছুই হয়নি আমার। তাও বুকে ব্যাথার মিথ্যা অভিনয় করে এখানে আসা। ইমার্জেন্সিতে ডিউটি-রত ডাঃ শহীদের সাথে আমার দেখা হওয়াটা আসলে ভীষণ জরুরী।
আশেপাশে হাজার হাজার রোগী। সরকারী হাসপাতালগুলোতে এমনই ভিড় থাকে। মাথা নষ্ট করার মতন। কাশির শব্দ, বমির শব্দ, চিৎকার, কাতরানো, কান্নাকাটি, আহাজারি - এসবই ভেসে আসছে কানে। সাধারণ জ্বর, কাশি, সর্দি, হাঁচি এসব বাদেও, কারেন্টের শক খাওয়া, আগুনে পুড়ে যাওয়া, হাতে ব্লেডের পোঁচ লাগা রুগী - কোন রকমের রোগীরই অভাব নেই এখানে। এমনকি এক ছুরিকাহত লোককে নিয়ে দুইজন পুলিশ কনস্টেবল এসেছে। তাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে একচোট হেসে নিলাম আমি। আমার আসল পরিচয় জানলে ঐ লোককে ছেঁড়ে আমাকে ধরতেই ব্যস্ত হয়ে পড়তো ঠোলা দুটো।
একজন নার্স এসে আমাকে রুমে ঢুকতে বলল। রুমে ঢুকে দেখি ডাক্তার বাইরে গিয়েছেন একটু। রুমের মধ্যে একটা বিছানায় কিশোর বয়সী একটা ছেলেকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। গতরাতে হাত কেটে আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল ছেলেটা। মাত্রই ট্রিটমেন্ট শেষ হয়েছে, হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। এখনও চেতনা নাশকের কারণে ব্যথাটা ঠিকমত টের পাচ্ছে না মনে হয়। বিড়বিড় করে আপনমনে কি যেন বলছে ছেলেটা। নার্স এসে আমার ব্লাড-প্রেশার মেপে নিলো। এরমধ্যেই ডাক্তার ভেতরে ঢুকলেন।
আমার সামনের চেয়ারে এসে বসলেন ডাঃ শহীদ। নার্সকে বললেন, "শেফালি, তুমি একটু বাইরে যাও। আমি দেখছি।"
নার্স বাইরে যাওয়ার পর, আমার দিকে ফিরে পরিচিত একটা হাসি ছুঁড়ে দিলেন তিনি। হ্যান্ডশেকের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে দুয়েকবার নাড়লাম আমি। "আপনিই তাহলে ডাঃ সুব্রত, আপনার কথা আগে অনেক শুনেছি আমি। আপনি এখানে ট্রান্সফার হওয়ার খবর গতকাল শৈল্পিক-থেকে আমাকে মেসেজ দিয়ে জানানো হয়েছে।"
"হ্যাঁ। আসলে খুব হঠাৎ করে হয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা। ঠেকাতে চেষ্টা কম করিনি, কিন্তু পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে এক হাসপাতালে তাই এবারের ট্রান্সফারটা একরকম নিশ্চিতই ছিল।"
"হুম। কিন্তু সেটাই তো সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। একসাথে এক হাসপাতালে দুইজন শিল্পী কাজ করলে সমস্যা। তার উপর শৈল্পিকের নিয়মেও নিষেধ করা আছে এই বিষয়ে।"
"সেটা নিয়ে কথা বলতেই আমার এখানে আসা। আপনারও তো এই হাসপাতালে তিন বছর হতে চলল। আমার মনে হয় আপনি এখন অনুরোধ করলে আপনাকে অন্যত্র ট্রান্সফার করে দেয়া হতে পারে। সেটাই মনে হয় আমাদের দুজনের জন্য বেস্ট অপশন হবে।"
ডাঃ শহীদ মৃদু হাসলেন, "দেখুন, তাতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু, সদ্যই বিয়ে করলাম। মেয়েও এই সিলেটের। সুবিদ বাজার বাসা। সেখানেই এখন থাকছি আমি। এই অবস্থায় ট্রান্সফার হলে সমস্যা হয়ে যাবে আমার। অন্যদিকে নিয়মের ব্যাপারে আমারও জানা আছে। কাজেই, কি যে করা যায় তাই ভাবছিলাম গতকাল থেকে।"
সহজ হবে না ব্যাপারটা, বুঝতে পারলাম আমি। বিছানায় শুইয়ে রাখা ছেলেটা এবার বেশ জোড়েই বলে উঠলো, "না না না। আর বাঁচতে চাই না আমি। আর বাঁচতে চাই না।" সেদিকে ফিরে তাকালাম আমি। ডাঃ শহীদও তাকালেন। "একটু দাঁড়ান। বেচারাকে আরেকটু পেইন-কিলার দিয়ে আসি," বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
বিছানার কাছের টেবিলে সিরিঞ্জ আর পেইন-কিলারের বোতলটা রাখা ছিল। ইনজেকশনে ভরে ছেলেটার হাতে পুশ করে দিলেন তিনি। হেঁটে ফিরে আসলেন আবার চেয়ারে। "তা, আপনার মতে অন্য কোন উপায় থাকলে সেটা কি বলুন, শুনি।"
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, "দেখুন, আমার পরিবার এখানে আসায় ভীষণ খুশীই হয়েছে। ময়মনসিংহের তুলনায়, সিলেট বিশাল বিভাগীয় শহর। ছেলের লেখাপড়া, বাজার করা, ভালো বাসা-পরিবেশ। সব মিলিয়ে আমিও সমস্যায় পরে গেছি। তা না হলে কোন উপজেলায় চলে যেতাম আমি অনুরোধ করে। আমার কাছেও মেসেজ এসেছে শৈল্পিকের এবং সেখানে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমাদের মধ্যে একজনকে এই শহর ছেঁড়ে চলে যেতে হবে। আপনার সাথে দেখা করে একটা মিউচুয়াল সিদ্ধান্তে আসতে বলা হয়েছে সেখানে।"
বিছানায় থাকা ছেলেটা হঠাৎ হাত-পা ছুঁড়ে এক মুহূর্তে কেমন নেতিয়ে পড়লো। ডাঃ শহীদ হাতঘড়ির দিকে তাকালেন এক মিনিট। "দুপুর ১২টা বেজে ৩৪ মিনিট। ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময় কাজে লাগবে। কি বলেন?" আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকালেন তিনি। "দেখুন সবাই জানে আপনি একজন দারুণ শিল্পী। অনেক সুনাম আপনার আমাদের সার্কেলে। কিন্তু, একসাথে আমাদের পক্ষে একই হাসপাতালে থাকা সম্ভব না। তার ফলে রোগীদের মৃত্যুর সংখ্যাটা হঠাৎই বেড়ে যাবে। এমনও হতে পারে কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে পড়ে গেল ব্যাপারটা। ঐ সাংঘাতিকগুলোর কথা ভুললেও চলবে না। দুজনই তখন ফেঁসে যাবো। শৈল্পিকের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে। এক কাজ করুন, আপনি বরং এ চাকরিটা ছেঁড়ে দিয়ে কোন প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি খুঁজে নিন। আমার বেশ কিছু পরিচিত লোক আছে এখানে, আপনি বললে..."
"অসম্ভব," বলে উঠলাম আমি। "এটা কি বলছেন আপনি? সেরকম হলে আপনিও তো চাকরি ছাড়তে পারেন। তাই না?"
ডাঃ শহীদ উঠে দাঁড়ালেন, "সেক্ষেত্রে আমি আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারছি না। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। শৈল্পিকের সাথে কথা বলবো আমি। আপনিও বলুন। দেখুন ওরা কি সমাধান দেয়। তাই মেনে নিতে হবে আমাদের।" হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। হ্যান্ডশেক করতে ধরলাম আমি। মনে হল একটা পিপড়া কামড় দিয়েছে আমাকে। ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে নিলাম। ডাঃ শহীদ আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, "আমার নামটা হয়তো আগে শুনেন নি আপনি। তবে আমিও একজন সুদক্ষ শিল্পী। চিন্তার কিছু নেই। খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পরবেন আপনি। বুকে ব্যথা নিয়ে এসেছেন যখন, হার্ট এটাক বলেই চালিয়ে দেয়া যাবে। ওপারে যাত্রা শুভ হোক সেই কামনা রইলো।"
ঢলে পড়তে পড়তে বুঝলাম ডাঃ শহীদ নার্সকে ডাকাডাকি শুরু করেছেন। জিহ্বা জড়িয়ে আসছে আমার। কিছু বলতে পারবো না, বুঝাতেও পারবো না কিছু। ছেলেটাকে আসলে কিছুই দেয়া হয় নি। পুরো ব্যাপারটাই আমাকে ধোঁকা দেয়ার জন্য করা হয়েছে। ইনজেকশন না। আসল জিনিস ছিল ডাঃ শহীদের হাতে। ওর হাতে পড়ে থাকা সোনালী আংটিটাতেই যত কেরামতি। আংটির ডগা থেকে আসা বিষটা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আমার শরীরে। শৈল্পিক-এ ডাঃ শহীদকে দেয়া ছদ্মনামের কথা মাথায় আসলো আমার - 'বিষধর।’ নাহ, লোকটা আমার চাইতে দক্ষ শিল্পী। মানতেই হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:০৭