শনিবার সকাল থেকে বাংলাদেশের
সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্রেকিং নিউজ-
উত্তেজনা-হুলস্থুল। যা চলছে এই রাত অবধি।
খবর আকারে বলা হচ্ছে, মানবতাবিরোধী
অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং দণ্ড
কার্যকরের শেষ ধাপে থাকা জামায়াতে
ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল আলী
আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং বিএনপির
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের
চৌধুরী ‘রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা’
চেয়েছেন।
এ নিয়ে দেশের মানুষদের মধ্য দুই ধরনের
প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। প্রথম পক্ষ -- সাধারণ
মানুষ এবং বিএনপি জামায়াতের
নেতাকর্মীরা -- বিভ্রান্তি এবং সন্দেহের
মধ্যে আছেন। বিভিন্ন কারণে তাদের কাছে
প্রাণভিক্ষা চাওয়া বিষয়টি ‘যৌক্তিক’ মনে
হচ্ছে না। এর সাথে যোগ হয়েছে
ক্ষমতাসীনদের হয়ে এদেশের মিডিয়ার
পক্ষপাতের বিষয়টি।
কিন্তু যে হারে সারাদিন ধরে টিভি এবং
অনলাইন সংবাদমাধ্যমে নির্ধিদ্বায় এই ‘তথ্য’
প্রচার হচ্ছে তাতে অনেকে অবিশ্বাস
করতেও ভয় পাচ্ছেন! এত প্রচারণা কি মিথ্যা
হতে পারে?!
আর দ্বিতীয় পক্ষ ক্ষমতাসীন দল এবং দলের
প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি ও মিডিয়া। এই
পক্ষ সকাল থেকে এই খবরগুলো উৎসাহের
সাথে ফেসুবকে (বন্ধ!) শেয়ার করে দুই
অপরাধীর ‘স্বীকারোক্তি’র বয়ান প্রচার
করছিলেন!
দুপুরের পর থেকে মোটামুটি উল্লেখযোগ্য
অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোতে (জাতীয়
পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের
ওয়েবসাইটসহ) চোখ রাখছিলাম। সবাই
একটাই খবর দিচ্ছে, ‘প্রাণভিক্ষার আবেদন
করেছেন সাকা-মুজাহিদ'। এতগুলো টিভি-
পত্রিকা তো আর এক সাথে একটা ভুয়া খবর
দিতে পারে না। অবশ্যই এর ভিত্তি আছে।
এবং একই সাথে ফাঁকিও আছে!
‘ভিত্তি’টা কী? আর ‘ফাঁকি’টাই বা কী?
ভিত্তি হচ্ছে, মুজাহিদ এবং সালাউদ্দিন
কাদের- দুইজনের পরিবারই রাষ্ট্রপতির
কাছে একটি করে ‘আবেদন’ করেছেন।
মুজাহিদের আবেদনটির ব্যাপারে এনটিভি
অনলাইন জানাচ্ছে--
“একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড
হামলার মামলা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চান
জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান
মোহাম্মাদ মুজাহিদ। এ জন্য আইনি লড়াই
চালিয়ে যেতে চান তিনি। আজ শনিবার
দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট অডিটরিয়ামে
মুজাহিদের পরিবার আয়োজিত এক সংবাদ
সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়।
এ বিষেয়ে ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে
রাষ্ট্রপতির কাছে একটি আবেদন করা হবে
বলেও মুজাহিদের পরিবারের পক্ষ থেকে
জানানো হয়েছে। কারণ সংবিধানের ৪৯
অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একমাত্র রাষ্ট্রপতি
চাইলেই মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখতে পারেন।”
কেন আবেদনটি করা হবে সেটা বুঝতে একই
খবরের আরেকটি প্যারা তুলে দিচ্ছি--
“সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে
তামান্না-ই জাহান বলেন, বিশেষ
ট্রাইব্যুনালে মামলা চলমান থাকাবস্থায় যদি
অন্য কোনো মামলায় কারো দণ্ড কার্যকর
করা হলে সেটি হবে নাগরিকের অধিকার
লঙ্ঘন। যেহেতু আলী আহসান মোহাম্মাদ
মুজাহিদ রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সাংবিধানিক
অভিভাবক মনে করেন। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতি
নিজেই একজন আইনজীবী। তাই মুজাহিদের
আইন ও সংবিধানিক অধিকার পেতে তিনি
কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা প্রকাশ
করেছেন তিনি।”
অর্থাৎ, এটা পরিস্কার যে, মুজাহিদের
আবেদনটি প্রাণভিক্ষার নয়, বরং ২১
আগস্টের মামলার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত
দণ্ড স্থগিতের আবেদন।
'প্রাণভিক্ষা' চাওয়ার বিষয়টি মুজাহিদের
পরিবার এবং দল সরাসরি প্রত্যাখ্যান
করেছে। সংবাদমাধ্যমে এই খবরগুলো আছে।
---------------------------
এবার দেখা যাক সালাউদ্দিন কাদেরের
‘আবেদন’টি কেমন?
মিডিয়া জানাচ্ছে, সালাউদ্দিনও
প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। কিন্তু তার
পরিবার- মানে স্ত্রী এবং ছেলে এটা
অস্বীকার করেছেন (দলও অস্বীকার
করেছে)।
বিবিসি বাংলা থেকে--
“সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত
কাদের চৌধুরীও এ খবরটিকে অবিশ্বাস্য
বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তারা
আইনজীবীর মাধ্যমে দুদিন ধরে মি. চৌধুরীর
সাথে দেখা করতে চেষ্টা করছেন কিন্তু
ব্যর্থ হচ্ছেন। মি. চৌধুরীর সাথে দেখা করা
গেলে এ বিষয়ক বিভ্রান্তি দূর হতো বলে
তিনি উল্লেখ করেন।”
প্রথম আলো থেকে ছেলের বক্তব্য--
“সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বড় ছেলে
ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেছেন, ‘হুম্মাম
কাদের চৌধুরী (সাকার আরেক ছেলে) আজ
শনিবার রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে একটি
আবেদন নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু
রাষ্ট্রপতির কার্যালয় সেটি গ্রহণ করেনি।
আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি
আমার বাবা মার্সি পিটিশন করেছেন। কিন্তু
আমরা এ বিষয়ে অবগত নই। আমাদের এটি
বিশ্বাস হয় না। আমরা যখন দুদিন আগে তাঁর
সঙ্গে দেখা করেছিলাম তখন তিনি আমাদের
জানিয়েছিলেন আইনজীবীদের সঙ্গে কথা
বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু
আইনজীবীদের তাঁর সঙ্গে দেখা করতে
দেওয়া হয়নি।”
লক্ষণীয়, আইনজীবীর সাথে দেখা করতে
দেয়া হয়নি, পরিবারের কেউ ‘মার্সি
পিটিশন’ নিয়ে কিছু জানেন না। কিন্তু তারা
একটি 'আবেদন'-এর কথা বলছেন।
তাহলে আবেদনটি কেমন?
সালাউদ্দিনের দল বিএনপি জানাচ্ছে--
(প্রথম আলোর খবর থেকে)
“বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর
চন্দ্র রায় বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। তাঁর পরিবারের
পক্ষ থেকেও প্রাণভিক্ষা চাওয়া হবে না।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ইচ্ছানুযায়ী, এ
বিচার নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের
পর্যবেক্ষণ রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর পরিবার
তুলে ধরবেন। এ ব্যাপারে আজ বিকেলেই
রাষ্ট্রপতির কাছে একটি আবেদন (পিটিশন)
দেওয়া হবে।” (শিরোনাম- সাকা চৌধুরীর
প্রাণভিক্ষা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য'।
মানবজমিন জানাচ্ছে--
“আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার
প্রক্রিয়ার ত্রুটি বিচ্যুতি তুলে ধরে ন্যায়
বিচার চেয়ে প্রেডিডেন্ট আব্দুল হামিদের
কাছে চিঠি দেবেন সালাউদ্দিন কাদের
চৌধুরীর পরিবার। শনিবার রাজধানীর
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা
জিয়ার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে
একথা জানান সালাউদ্দিন কাদেরের স্ত্রী
ফরহাৎ কাদের চৌধুরী। সংবাদ সম্মেলনে
বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং দলের
ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানও ছিলেন।”
অর্থাৎ, এটিও 'প্রাণভিক্ষার আবেদন' বা
'মার্সি পিটিশন' নয়।
দুইটি আবেদনের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়
লক্ষ্যণীয় যে, কোনোটিই ট্রাইবুন্যালের
বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।
মুজাহিদের আবেদনটির ভিত্তি তৈরি হয়েছে
অন্য একটি বিচারাধীন মামলাকে কেন্দ্র
করে উদ্ভুত একটি পরিস্থিতি থেকে। হয়তো
বা তার পরিবার এ থেকে একটি সুযোগ
নিতে আবেদনটি করেছিলেন।
আর সালাউদ্দিনেরটি 'ক্রুটিপূর্ণ বিচারের'
মাধ্যমে পরিবারের একজন সদস্যকে হারাতে
বসা প্রিয়জনদের মনের স্বান্তনামূলক একটি
চিঠি মাত্র। তারা এটা ভালভাবেই বুঝার
কথা যে, সালাউদ্দিন বিচারের ত্রুটি ধরিয়ে
দিয়ে যতই চিঠি দেন বা আবেদন করুন না
কেন, রাষ্ট্রপতির তাতে কান দিয়ে কিছু
করার নেই। তবু, বিক্ষুব্ধ মনের স্বান্তনা
আরকি।
কিন্তু সরকার এবং সরকারকে অনুসরণ করে
সংবাদমাধ্যমগুলো এই দুটি আবেদন/চিঠিকে
'প্রাণভিক্ষার আবেদন' বলে প্রচার করছে।
সরকারের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটনী
জেনারেলের বক্তব্য থেকেও বুঝা যায় যে,
ওই দুটি চিঠি/আবেদনকেই উনারা
''প্রাণভিক্ষার আবেদন' হিসেবে গণ্য
করছেন।
বিডিনিউজে অ্যাটর্নি জেনারল মাহবুবে
আলমের বক্তব্য এসেছে। “‘মার্সি পিটিশন’
ছাড়া আর কিছুর সুযোগ নেই: অ্যাটর্নি
জেনারেল” শিরোনামের খবরটি থেকে
উদ্ধৃতি দিচ্ছি--
“যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর
পরিবার বলেছে, তারা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বিচারে
মৃত্যুদণ্ডের অভিযোগ জানিয়ে রাষ্ট্রপতির
কাছে চিঠি দেবেন।
২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার
নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আরেক
যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মো. মুজাহিদের
প্রাণদণ্ড কার্যকর স্থগিত রাখতে
রাষ্ট্রপতিকে আহ্বান জানিয়েছে তার
পরিবার।
শনিবার দুপুরে যুদ্ধাপরাধী সাবেক দুটি
মন্ত্রীর পরিবারের সংবাদ সম্মেলনের পর
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে
আলম বলেছেন, আইনি সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত
নিষ্পত্তির পর এখন আসামিদের কাছে
রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন
ছাড়া অন্য কোনো আবেদনের সুযোগ নেই।”
এই খবরটিতে মাহবুবে আলমের নিচের দুটি
বক্তব্য লক্ষ্যণীয়--
“মাহবুবে আলম বলেন, “রাষ্ট্রপতি পদ এমন না
যে, আসামি তার কাছে চিঠিপত্র লেনদেন
করবে। উনি উনার নিকটাত্মীয়দের কাছে
চিঠিপত্র লেনদেন করতে পারেন।”
“এই পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির কাছে কেবল
মার্সি পিটিশন করতে পারেন। সংবিধানে
যে সুবিধা দেওয়া আছে, সেইটুকু তিনি করতে
পারবেন। সংবিধান অনুসারে তিনি কেবল
মার্সি পিটিশনই করতে পারেন।”
আগেই বলেছি, মুজাহিদ এবং সালাউদ্দিনের
পরিবার যে আবেদনগুলো করেছে সেটা
আইনি কোনো প্রক্রিয়ার অংশ নয়। এটা
তারা এর বাইরে থেকে করছেন। কিন্তু
যেহেতু এই পর্যায়ে ‘মার্সি পিটিশনের’
বাইরে অন্য কিছু আইনি প্রক্রিয়ায়
গ্রহণযোগ্য হবে না, ফলে প্রক্রিয়ার বাইরে
গিয়ে করা আবেদনগুলোকে অ্যাটনী
জেনারেল উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘প্রক্রিয়ার
ভেতরে ধরে গণ্য করছেন’! তিনি স্পষ্টই
বলছেন, ‘এই পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির কাছে
কেবল মার্সি পিটিশন করতে পারেন’। এর
অর্থ- মার্সি পিটিশনের বাইরে কিছু করতে
পারেন না। আর করলে সেটাই মার্সি পিটিশন
হিসেবে গণ্য হবে!
যেহেতু ‘মার্সি পিটিশন' করেছেন- এটার
প্রচারণা রাজনৈতিকভাবে বিএনপি-
জামায়াতের জন্য ক্ষতিকর এবং সরকারের
জন্য খুবই উপকারী- তাই সরকারের চরম অনুগত
কর্মকর্তা হিসেবে মাহবুবে আলমের জন্য
সেই এঙ্গেল থেকে আবেদনগুলোকে দেখে
সেটা প্রচার করা একটা 'নৈতিক' দায়িত্ব
অবশ্যই! তিনি সেটা করেছেন। একই দায়িত্ব
পালন করেছে এবং করে চলেছে অনুগত
সংবাদমাধ্যমও। এই দায়িত্বটি পালনে অন্য
সরকারি ব্যক্তিত্বরাও পিছিয়ে নেই।
আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রসচিবসহ আরো অনেকে
সেই কাজই করছেন।
এই প্রাণ ভিক্ষা নাটকের সবচেয়ে মজাদার
পর্ব ছিল শেষে । রাত আটটার দিকে সাকা ও
মুজাহিদ পরিবার বলেছেন, তাদেরকে জেল
কর্তা ফোন করে দেখা করতে যেতে
বলেছেন। ধারনা করা হচ্ছে এটাই জীবনের
শেষ দেখা । ঐদিকে রাত পৌনে দশটায়
মিডিয়া গুলো ব্রেকিং দিচ্ছে, প্রেসিডেন্ট
প্রানভিক্ষার আবেদন নাকচ করেছেন। কথা
হচ্ছে, আবেদন নাকচ করার আগেই কারা
কতৃপক্ষ "শেষ দেখার" কথা জানালেন
কেমনে? তাহলে পুরোটাই কি সাজানো?
অনেকেই এ প্রশ্ন করেছেন সোশাল মিডিয়ায়!