somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি অত্যন্ত সাধারণ ও বোকা মানুষের ভালোবাসাহীন জীবনের গল্প

০৮ ই আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৪:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আম্মা আজকাল ঠিকমত হাটতে পারেননা।হাঁটার সময় কেমন যেন একটা জড়তা কাজ করে।নিজের হাতে ঘরদোর পরিষ্কার করতে ভালোবাসতেন।এখন আর সেটাও করেন না।চুপ করে নিজ ঘরে বসে কলকাতার সুনীল বাবু,সমরেশ এদের গল্প উপন্যাস পড়েন আর মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন ভাবেন।বাবা দেশের বাহিরে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত,মাঝে মাঝে দেশে আসেন।আর আমি এই-সেই চাকরী বাকরী, সদ্য বিয়ের পর গড়ে ওঠা সংসার এসব নিয়েই খানিকটা ব্যস্ত।টঙ্গী কলেজ গেটে অবস্থিত আমার ছোট্ট ভাড়া বাড়ির মাঝে আমাদের ছোট্ট একচিলতে অনুভূতিহীন নিথর পরিবার।তাতে কি যেন থেকেও নেই!

তিন মাস আগে আমার স্ত্রী পরিচয় পাওয়া তিথী নামের অতি সাধাসিধে মেয়েটি আমার মায়ের থেকে বোধহয় একটু দূরে দূরেই থাকেন, আর আমার থেকে অনেক অনেক দূরে।বিয়ের আগে তার সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয়, সেদিন এত শান্ত কোমল মেয়েটিকে কি করে যেন নিজের কাছের বলেই মনে হয়েছিলো।পরবর্তী দেখা বিয়ের পর যখন আমি বাসর ঘরে যাই।তখন তার প্রথম কথা ছিলো, “আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি”।

ব্যস এভাবেই শুরু হলো আমাদের সুখের সংসার।গত তিন মাসে কোনদিন একবারের জন্যও এমন হয়নি যখন আমি তার পাশে যেয়ে একটু আকাশ পাতালের কল্পকথা গাইতে পারি।তিথী আমাকে দেখলে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে, তখন মনে হয় আমি যেন অনেক দূরের কেউ।তাই আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত বোধ করি এবং যতটা সম্ভব নিজেও ওর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।

মা জানেন সব কিছু, কিন্তু কখনো কিছু বলেন না।মা মনে মনে তিথীকে বেশ ভালোবাসেন আমি টের পাই।তিথীকেও দেখি মায়ের পাশে বসে মাঝেসাঝে কি নিয়ে যেন কাঁদে। আর আমি আমাদের নীরস সংসারে না পারি কাঁদতে, না পারি হাসতে।কিন্তু বিশ্বাস করুন এতে আমার মনে কোন দুঃখ নেই।আমি এভাবে বাঁচতেই শিখে গেছি সেই ছোট্টকাল হতে।বাবাকে জীবনে পেয়েছি খুব অল্প সময়ের জন্য, মা একটা বয়সের পর আমাকে আমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন।স্কুল কলেজের হাতেগোণা কিছু বন্ধুবান্ধব রয়েছে বৈকি যারা এখন বেশিরভাগ ইউএসএ, কানাডা অথবা যুক্তরাজ্যে পি.এইচ.ডি করছে বা করা শেষ হয়েছে।সবাই তারা ভালো আছে, অনেক ভালো।আমি শুধু রয়ে গেছি জরাজীর্ণ আবার একই সাথে অতি ব্যস্ত নগরী ঢাকার ছোট্ট এক কোণায় ভালোবাসাহীন জীবনে।মাঝে মাঝে নিজেকে শুধু প্রশ্ন করেছি, আমার জীবনে ভালোবাসারা কোথায়?মনে হয় আমাদের সবারই মনের কোণায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই উঁকি দিয়ে যায়, তাই না?

শুক্রবার দিন ভোরবেলা অফিসে আসলাম অত্যন্ত বিরক্ত চিত্তে।মরার চাকরীতে উইকেন্ড পাওয়ার সুযোগ মাঝে মাঝে জোটেনা।একারণে প্রায়ই মনে হয় ভেগে যাই বনে বাদাড়ে এইসব ফালতু চাকরী বাকরী ছেড়ে।টারজানের মত গাছে গাছে বানর হয়ে ঝুলবো আর ফলমূলের জুস খাবো।তারপর যখন আবার পরিবারের কথা মনে হয় তখন শুধুই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর ভাবি কবে একটু শান্তি পাবো।আজকে সকালে অফিসে এসেই শুনি আমার চাইনীজ বস আমাকে খুঁজছে।আমি হন্তদন্ত হয়ে বসের রুমে ঢোকার সাথে সাথে সে আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে বললো, “মাই ডিয়ার, তোমার চাকরী আর নেই।যাও রাস্তা মাপো”।

আমি সুন্দর হাসি দিয়ে বললাম, “ভাগতে পারলে ভালোই হতো স্যামি, কিন্তু তুমি তো আমাকে ছাড়বেনা। কি দরকারে খুঁজছিলে সেটা এখন বলো।”

স্যামি আমার দিকে আরো ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বললো, “ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখ তোমার কানাডায় ফ্লাইট।ছয় মাস থাকতে হবে আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং স্টেশনে।যদি না যেতে চাও তাহলে আমার টেবিলের ওপরে আরেকটা লেটার আছে, তোমার টারমিনেশন।ওইটা নিয়ে ভাগো”।

আমি একটুখানি অবাক হলাম, কিন্তু তা ঘটনার আকস্মিকতায়।তবুও স্বাভাবিক ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে বললাম, “পাসপোর্ট করা হয়নি, পরে জমা দেবো।”এটা বলে যখন চলে যাচ্ছিলাম তখন স্যামি আবার ডাকলো, "অর্ক তুমি একবারও আমাকে থ্যাঙ্কস জানালেনা।তুমি একটু অদ্ভুত, বেশি বেশি অদ্ভুত।”

আমি জানিনা আমাকে কেন সে অদ্ভুত বললো, আমার কাছে একবারও ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগেনি।অদ্ভুত লাগা শুরু হলো যখন ম্যানিটোবার উইনিপেগ শহরে যা পৃথিবীর শীতলতম শহর বলে পরিচিত সেখানে পৌছালাম।গ্লোবালাইজেশন কি সেটা কেউ বুঝতে হলে অবশ্যই তাকে এই সিটিতে আসতে হবে।চমৎকার সাজানো গোছানো শহরে সুন্দর কিছু পার্ক এবং অত্যাধুনিক মিউজিয়াম অবস্থিত যা ঘুরে ঘুরে দেখবো বলে আগেই প্ল্যান করে রেখেছি।

আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো উইনিপেগ রেইলওয়ে মিউজিয়াম থেকে ২ কি.মি. দূরবর্তী একটি ছোট্ট বাঙ্গালী এপার্টম্যান্টে।আমার পাশের এপার্টমেন্টে থাকে একটি বাঙ্গালী পরিবার যাদের আতিথেয়তায় আমি নিঃসন্দেহে বিমুগ্ধ।আমি প্রথম যেদিন আমার ফ্লাট 5Aতে থাকার জন্য উঠলাম, সেদিনই আমার সাথে একটু মোটাসোটা করে মধ্যবয়স্ক রিয়া আন্টি দেখা করতে এলেন একটা বিশাল কোম্বল আর দুইটিন বিস্কুট নিয়ে।আমার দিকে বেশ আপন আপন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললেন, “বাবা তুমি চাইলে এই কম্বলটা ব্যবহার করতে পারো।আর কিছু কুকিজ আছে।যদি রাতে ক্ষুধা লাগে খেয়ে নিতে পারো”।

আমি এবং আমার ক্ষুধার্ত পেট অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে তাকে ধন্যবাদ জানালো।একটু পরে তার দুই মেয়ে এসে আমাকে চিড়িয়াখানার বাসিন্দা হিসেবে কেমন যেন একটা উইর্ড লুক দিলো যাতে আমি বেশ মনঃকষ্টের শিকার হলাম।মেয়েগুলার নাম খুবই সুন্দর- ত্রপী আর ত্রিপি।একজন ডাক্তারী পড়ছে, আরেকজন কেবল এ লেভেল শেষ করেছে।সেদিন রিয়া আন্টি আর ত্রপি-ত্রিপীর সাথে আর বেশি কথা হলোনা।

পরবর্তী এক সপ্তাহ খুব ব্যস্ত ছিলাম কাজে অকাজে।দুদিন ছুটি পেয়ে রিয়া আন্টির বাসায় গেলাম সামান্য কিছু গিফট নিয়ে।আন্টি তখন পিঠা বানাচ্ছে এবং তার দুই মেয়ে বসে বসে একটি এনিমেশন মুভি দেখছে।আমিও মুভি দেখতে বসে পড়লাম এবং কিছুক্ষণ পর আন্টির হাতে বানানো চমৎকার কিছু কুলি পিঠা ভক্ষণ করে মনের আনন্দে তেলতেলে হাসি দিয়ে বললাম “ধন্যবাদ”।"

এরপর কথা বলতে বলতে জানলাম, এই পরিবারটি কানাডা এসেছে ১৬ বছর আগে।আসার কিছুদিন পর আঙ্কেল হার্টের সমস্যায় পড়েন এবং দুইমেয়ে এবং তাদের মাকে একা রেখে চলে যান।আমি জানিনা কি সেই মানসিক শক্তি যার জন্য রিয়া আন্টি তার মেয়েদেরকে নিয়ে এই অপরিচিত শহরে বাস করার সাহস পেয়েছিলেন।দেশীয় সংস্কৃতি আর আচার ব্যবহার তার মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দিতেও উনি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি।আমি সত্যিই ভাগ্যবান এই দূরদেশে এসে এমন চমৎকার একটি পরিবারের সান্নিধ্য পেয়েছি বলে।

সমস্যা হলো যখন আমি আরো ঘনিষ্ঠ হলাম এই পরিবারটির সাথে।জানতে পারলাম ত্রপী ডাক্তারীতে ভর্তি হওয়ার পর একটি ছেলের প্রেমে পড়ে তার জীবনের সব হারিয়ে এসেছে।অত্যন্ত লজ্জার সাথে জানাচ্ছি ছেলেটি বাংলাদেশী ছিলো।ত্রপী কি করে সেই কষ্ট আর যন্ত্রণা ভুলে জীবন চালিয়ে নিচ্ছে আমি জানিনা, অবশ্য জানার আগ্রহ আমার মধ্যে বেশ কম।এই ছোট্ট পরিবারটি নিদারুণ টানাটানির মধ্যে বেশ হাসিখুশি বলেই জানতাম।কিন্তু সত্যি বললে কি তারা আসলে ভালো নেই আমি এটা বেশ বুঝতে পারি।

ত্রিপী খুব চঞ্ছল একটি মেয়ে এবং প্রায়ই আমাকে বলে “তুমি বিয়ে না করলে তোমার সাথে বেশ প্রেম করা যেত, তাই না অর্ক”"।আমি বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।

এভাবে করে একমাস চলে গেলো।কোন এক ছুটির দিনে আমি আমার এপার্টমেন্টের ছোট্ট জানালা দিয়ে তুষারপাত দেখছিলাম, ঠিক তখন ত্রিপি এসে দরজায় নক করলো।তার চোখ দেখলাম কাঁদতে কাঁদতে ফুলে আছে।সে ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কি একটু বাসায় আসবে?আপু না আবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে”"।

আমি সাথে সাথে দৌড়িয়ে ওদের বাসায় গেলাম।দেখলাম আন্টি মেডিকেল সাপোর্টের জন্য ফোনে কথা বলছে।ত্রিপি বড় বড় অসহায় চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপুর কিছু হলে আমি মরে যাব”।
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “একটু ব্রেভ হও, বি পেশেন্ট।কিছু হবেনা”।

আমার ধারণা মিথ্যা ছিলো যা এর পাঁচ ঘন্টা পরে জানা গেলো।আমি এরপর কি হয়েছে তা পাঠককে জানাতে চাইনা।আমার জীবনের অন্যতম খারাপ সময় আমি তখন কাটিয়েছি।আমি ত্রপীর আত্নার জন্য প্রার্থনা করি যেন যেই কষ্ট বুকে নিয়ে মেয়েটি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো আল্লাহ যেন তা মুছে দিয়ে মেয়েটিকে জান্নাতে থাকার সুযোগ করে দেন।রিয়া আন্টি আর ত্রিপির দিকে আমি ভয়ে তাকাতাম না।যে ভয়ংকর শূন্যতা তাদের নয়নে আশ্রয় নিয়েছিলো তার গভীরতা আমার মত অনুভূতিহীন মানুষ কোনদিন খুজে পাবেনা।নিঃসঙ্গ ত্রিপীকে আমি বেশ সময় দিতাম তখন।আমি ভয় পেতাম যদি সেও তার বোনের মত কিছু করে বসে।
হঠাৎ করে একদিন ত্রিপী আমাকে বললো, “অর্ক আমি আপুর মত বোকা না।আমি জানি আমার কি করা উচিত আর কি উচিত না।Don’t Worry; ok?”

আমি তার দিকে আশ্বস্ত হাসি দিয়ে বললাম “ধন্যবাদ”।

হঠাৎ করে ওর সোনালী রঙ করা চুলের ফাঁকে মায়াময় মুখটি দেখে মনে হলো, কোথায় যেন আমি ওকে দেখেছি।উত্তর পেলাম তিন মুহূর্ত পর।ওর সাথে তিথীর মুখমন্ডলে কোথায় যেন একটু মিল আছে, সামান্য হলেও আছে।

“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন, আমার প্রেমে পড়েছো”?

ত্রিপীর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আমি কিছুটা নয়, বেশ খানিকটাই অপ্রস্তুত হলাম এবং বললাম, “আমি ভালোবাসতে জানিনা”।

ত্রিপীর তার মুখ থেকে চুল সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমিও জানিনা।কিন্তু তোমাকে কেমন যেন লাগে”।

আমি ওর সামনে থেকে উঠে চলে এলাম।নিজেকে বড় ক্লান্ত নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিলো।আমার অপু নামের সেই ছেলেটার কথা বার বার কেন যেন মনে পড়ছে।তিথী কি অপুর দিকে ওভাবেই তাকাতো আজকে যেভাবে ত্রিপী আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।বিয়ের রাতে যখন তিথী আমায় বলে অপুর কথা তখন আমি একটুও কষ্ট পাইনি।আমার আসলে জানতে ইচ্ছা করছিলো বারবার, সে কোন ভালোবাসার বুননে তিথী অপুকে বেধেছিলো যা ছিঁড়ে ফেলে ছেলেটি মহাকালে পাড়ি জমিয়েছে।তিথীকে বলতে ইচ্ছা করছে, প্রিয় তিথী অপুকে দেয়া তোমার ভালোবাসা সবটাই তোমার কাছে পবিত্র আত্নার দাবী হয়েই থাকুক।আমি তাতে কখনো জায়গা চাইনি, চাবোওনা।তুমি তোমার হারানো স্বপ্নগুলো নিয়ে সুখে থাকো, অনেক অনেক সুখে।

ত্রিপীর কথা ভাবছি,এই প্রথম কোন মেয়ে আমাকে বললো তার আমাকে খানিকটা হলেও ভালো লাগে।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার ডিপার্টমেন্টের বরুণা নামের একটি মেয়েকেও আমার বেশ ভালো লেগেছিলো।কি অদ্ভুত ব্যাপার, কোন একদিন আমার ক্লাসেরই আরেকটি ছেলের সাথে তার ফাটাফাটি প্রেম শুরু হয়ে যায়।ওই বয়সে সেটা হয়তো বড়সড় আঘাত ছিলো যে জন্য আমি প্রায় বছরখানেক সুস্থ ছিলাম না।বরুণাকে কেন ভালোবেসেছিলাম তাও নাহয় বলেই ফেলি।ওর নয়নজোড়া আর তার মাঝে লুকিয়ে থাকা প্রগাঢ়তা আমাকে খানিকটা ভালো লাগা দিয়েছিলো, কিন্তু ভালোবেসেছিলাম ওর কাউকে পাত্তা না দেয়ার মানসিকতাকে অথবা ওর নারী হওয়ার অহংবোধকে।

সেই বরুণা,সেই ভালোলাগার মেয়েটি আমাদের ফেয়ারওয়েলের দিন আমার কাছে এসে বললো, “অর্ক তুমি এখনোও আমার দিকে কিভাবে যেন তাকাও।মজার কথা বলি, আমার তোমাকে কিন্তু কখনো খারাপ লাগেনি।এখন যে শুভ্রর সাথে আছি, তবুও তোমাকে খারাপ লাগেনা।কারণ তোমার তাকানোর মাঝে কিছু একটা আছে।এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকলে মেয়েদের কিন্তু ঘৃণা, বিরক্তি এমন কিছু হয়না।কিন্তু ভয় হয়, প্রবল ভালোবাসার ভয়। আমার কথা বুঝেছো?”

আমি মাথা নেড়ে অনুভূতিহীন দৃষ্টি দিয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকলাম।ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমি জানতাম তুমি বুঝবেনা।কিন্তু একটা কথা বলে যাই, কখনো কাউকে ভালো লাগলে তাকে বলে ফেলতে শেখো।ঠিক আছে?”

আমি কিছু না বলে মাটির দিকে চেয়ে ছিলাম।কি যে মনে হচ্ছিলো নিজেও জানিনা।

ত্রিপির সাথে আমি সেদিনের পর অনেকদিন কথা বলিনি।ঠিক দেশে ফিরে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে রিয়া আন্টি আর ওর সাথে দেখা করতে গেলাম ওদের ফ্লাটে।চলে যাওয়ার সময় ত্রিপি অনেকক্ষণ আমার সাথে এপার্টম্যান্টের পাশে লনে গিয়ে হাঁটলো।আমি বুঝতে পারছিলাম না ওকে কি বলবো।ওই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “চলে যাচ্ছো ৫ তারিখ?”
আমি হাসিমুখে তাকিয়ে বললাম, “হ্যা”।

এবার ও আমার হাত ধরে বললো, “তোমাকে সেদিন মিথ্যা বলেছিলাম।আমার তোমাকে আসলে ওভাবে ঠিক ভালো লাগেনা।মনে হয় শুধু একটু উইর্ড টাইপ।বুঝেছো না?”

আমি আবার হাসিমুখে বললাম “হ্যা”।

“কিন্তু আমার অনেক একা একা লাগে জানো?যখন মনে হয় তুমি চলে যাবে, আমি তোমাকে আর দেখবোনা, তোমার এই ঝকঝকে নীল জিন্সের জ্যাকেট আর চোখের সামনে আসবেনা তখন অনেক কষ্ট হয় জানো”।এটুকু বলে ত্রিপি আমার দিকে আবার কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকলো।আমি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলাম।

আগস্টের ৫ তারিখ আমি সেইন্ট এন্ড্রিউস এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।রিয়া আন্টি আমাকে বিদায় দিতে আসতে পারেননি।কিন্তু ত্রিপি ঠিকই এসেছিলো বেশ হাসিমুখে।আমার জন্য কিছু চকোলেট আর একটা সুন্দর উলের মাফলার নিয়ে যা রিয়া আন্টি বানিয়ে দিয়েছিলো।ও যতই হাসিমুখে থাকুক, আমি ওর চোখের কোণায় হীরকজলের ঝিকিমিকি দেখতে ভুল করিনি একটুও।ওর ভালো লাগার কথা জানার পর থেকে আমি যে অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হয়েছি সেটা কি কেউ জানে?মনে হয় না।
আমি যাওয়ার আগে ত্রিপির মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলো, "ভালো থেকো মেয়ে"।
ও আমার বুড়ো আঙ্গুল ছুয়ে বলেছিলো, তুমিও যাকে ভালবাসো তাকে নিয়ে অনেক ভালো থেকো।

এটুকু বলে একবারও সে আমার দিকে তাকালোনা।পিছনে ঘুরে দ্রুত পায়ে চলে গেলো, রেখে গেলো একটুকরো হতাশা।আমি সমস্ত আকাশ পথে কিছু মুখে দিতে পারিনি।আমাকে কি কেউ কখনো ভালবেসেছে?মনে হয় না।যখন কেউ এভাবে ভালবাসলো তখন আমার সামনে তিথীর শান্ত স্নিগ্ধ মুখটা বারবার ভেসে ওঠে।আমি তখন আর কিছুই ভাবতে পারিনা।আফসোস!যে তিথী আমার কাবিন করা বউ,তার হৃদয়ে আমাকে খানিকটাও আশ্রয় দেয়নি।

বাংলাদেশ পৌছালাম গভীর রাতে।মা আমাকে নিতে এসেছে।আমি বুঝিনা এত গভীর রাতে মা কেন কষ্ট করে নিতে আসলো।আমাকে দেখে মায়ের অনেকদিনের জমাট বাঁধা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।গাড়িতে উঠে দেখি তিথি বসে আছে।আমি বসলাম মাঝে আর দুই পাশে তিথি ও মা।মা তিথিকে বার বার বলছে, “আমার ছেলে আমার বুকে ফিরে আসছে”"।

আমি তিথির পাশে যতক্ষণ বসে ছিলাম ততক্ষণ অস্বস্তি বোধ করছিলাম।মনে হচ্ছিলো ও সামাজিকতার খাতিরে বাধ্য হয়ে এসেছে।আমার এটা ভালো লাগেনা।

বাসায় গিয়ে দেখি এলাহী রান্নাবান্না।আমার নীরস ছোট্ট বাসা আর তার মাঝে বাস করা লিলিপুট পরিবারে কেমন যেন জীবনের আলো ঝিকমিক করছে।রাতে খেয়েদেয়ে যখন ঘুমুতে গেলাম, তখন তিথি আমার পাশে এই প্রথমবারের মত বসে প্রশ্ন করলো, কেমন আছি।আমি মাথা নেড়ে বোঝাতে চাইলাম খারাপ না।ও আমাকে অবাক করে দিয়ে এরপর প্রশ্ন করলো, “আপনি আমার সাথে একদিনো কথা বলেননি এই ছয় মাসে।কেন”?

আমি আমতা আমতা করে জবাব দিলাম, “তোমার হয়তো ভালো লাগতোনা”।

ও একটু চুপ থেকে হাতে কাচের চুড়িগুলো ধরে ঘুরোতে ঘুরোতে বললো, “আমার অনেক কষ্ট হয়েছে।আর এমন করবেন না”।

আমি কিছু না বলে চুপ করে বসে আছি।ও এবার আমার একদম কাছে এসে বসে বললো, “প্রমিজ করুন আর আমাকে ছেড়ে যাবেন না”।
আমি অনেক অভিমান নিয়ে বললাম “পারবো না”"।

সেদিন রাতে তিথি যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন আমি ভাবছিলাম ত্রিপি এখন কি করছে?আমার থেকে বছর আটেক ছোট্ট একটি মেয়ের ভালোবাসায় কতটা গভীরতা ছিলো সেটা আমি জানিনা।তার কালোর মাঝে হালকা সোনালী চুলের মাঝে দিয়ে দেখতে পাওয়া সেই মায়াভরা চোখজোড়া এখন কি লোনাজলে সিক্ত হয়ে আছে?আমি মনে মনে বলি, ত্রিপি তুমি অনেক ভালো থেকো।ধরিত্রীর সকল শোভিত পুষ্প তোমাকে তাদের সুবাসে আলিঙ্গন করে থাক।

********************************************************************
বোধহয় বছর দেড়েক আগে একটি মেয়েকে(কানাডায় বসবাসকারী) কথা দিয়েছিলাম তার মত কাউকে নিয়ে একটি লেখা লিখবো।এতদিন পরে আজ সকালবেলা মাথায় ধপ করে গল্পটি এসে পড়লো।আমার সব লেখার মত এটিতেও ভালোবাসার সূক্ষ অনুভূতিগুলো প্রাধান্য পেয়েছে বলে বোধ করি যা কিছুটা একঘেয়ে বলে মনে হয়।যারা কষ্ট করে আমার লেখা পড়লেন এবং লেখা পড়ে বিরক্তানুভূতিতে আক্রান্ত হলেন তাদের কাছে সত্যি ক্ষমাপ্রার্থী।তবে বিশ্বাস করুন, এই লেখার প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি ভালোবাসা বেশ যত্নের সাথে নিজে অনুভব করে লিখেছি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ৭:৩৭
৪০টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×