somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিভাজন

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“তোমার তো আমার সাথে এমনটা করার কথা ছিলোনা তাই না? এমন করতে পারলা?”
আমি মিতির দিকে তাকিয়ে থাকি। মিতিকে আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিনা। মিতি আমার দিকে তাকাচ্ছেনা একবারও।তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। যেই কয়বার ভুল করে তাকিয়েছে আমি প্রকান্ড একটা ঘৃণা দেখেছি। ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মত ঘৃণা, একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে এমন ঘৃণা করতে পারে জানা ছিলোনা। আমি বিড়বিড় করছিলাম। বলার আসলে কোন ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না। আমার সাথে নবনীর কথা হয় ফেসবুকে বেশ কয়েকদিন হলো। কেন যেন এই ব্যাপারটা আমি মিতিকে বলিনি। আচ্ছা আমার মাঝে কি নবনীকে নিয়ে সত্যি সত্যি কোন ফ্যান্টাসী ছিলো? তার সাথে আমি কি কোন সম্পর্ক...

নাহ! কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছেনা। মিতি আমার পাশ থেকে উঠে গেলো। রাত্রি ৯টা ৩১ বাজে। আমি দশটার মধ্যে সাধারণত ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু আজকে হয়তো সারারাত ঘুম আর আসবেনা। খেয়াল করলাম আমি লজ্জা পাচ্ছি, নিজের প্রতি বিরক্ত হচ্ছি। কি করতে কি হয়ে গেলো। নবনী নামে মেয়েটার সাথে আমার তো দরকার ছিলোনা এতো কথা বলার। মিতি কান্না থামিয়ে খুব তাড়াহুড়া করে একটা ছোট্ট ব্যাগ গুছানো শুরু করলো। আমি একটু সাহস করে ওকে বললাম, “ভুল হয়ে গেছে। তেমন কিচ্ছু না। আমি ওকে ঠিকমত চিনিই না। দেখাও হয়নি সেভাবে। আমি তোমার সাথে কোন দুই নম্বরী করিনি। বিশ্বাস করো”।
মিতি আমার সামনে দাড়িয়ে সেই ভয়ংকর ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। তারপর কাপাকাপা গলায় বললো, “-আচ্ছা নবনী সেদিন যখন হঠাৎ করে তোমার হাতে হাতটা লেগে গেলো তখন কেমন যেন লেগেছিলো- এই কথাটা তুমি ওই মাগীকে বলছো না? বলো, বলছো না? আমার হাত তো এখন ধরতেই চাওনা। শেষ কবে তুমি আমার হাত ধরে একটা ভালো কথা বলছিলা? ওই মেয়ের সাথে একটা টাচ হলো, এতে কেমন কেমন লাগা শুরু হয়ে গেলো। তোমাদের জাতটাই খারাপ। তোমার বাপ ছিলো একটা চরিত্রহীন, তুমি তো তারই ছেলে, তাই না! এই কাজই তো করবা”।
আমি আমতা আমতা করে বলি, “তোমার পায়ে ধরি। একটু শান্ত হও। বিশ্বাস করো, আমার সাথে ওর কিচ্ছু হয় নাই”।
মিতি আমার গলা চেপে ধরে বলে, “তুই একটা কুত্তা। তুই কুত্তা, শূয়োর। তুই মানুষ না। নিজেকে যেয়ে আয়নায় দেখো। দেখো একবার চেহারাটা। ছি! আমার বমি আসতেছে। তোর মত জানোয়ারকে আমি ঘৃণাও করবোনা কখনো। তুই এটারও যোগ্য না”।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার জগতটা দুলছিলো। কেন এমন হলো। এমনটা তো হওয়ার কথা না। চার বছর ধরে সংসার করছি। আমার তো মিতির সাথে এমন করা ঠিক হয়নাই। আমি আসলেই খারাপ মানুষ। অনেক অনেক খারাপ। খুব অনুশোচনা হচ্ছে। একবার মনে হলো ও বাসা থেকে চলে যাওয়ার আগে ওর পায়ে ধরি। দু একবার স্ত্রীর পায়ে ধরলে পুরুষ মানুষের কোন অপমান হয়না। তারপর অদ্ভূতভাবে খেয়াল করলাম আমার ওই ইচ্ছাটা মরে গেছে। এর আগেও আমাদের ঝগড়া হয়েছে। ও চলে যেতে চেয়েছে বাসা থেকে। আমি ওকে অনেক কিছু করে মানিয়েছি, বুঝিয়েছি, শান্ত করেছি। কিন্তু আজকে কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে। আমি সেই টানটা বোধ করছিনা। আমার মনে হচ্ছে ও চলে গেলেই হয়তো ভালো হয়। এটাই হওয়া উচিত।
মিতি আমার কাছে এসে আবার বলে, “তুমি আমার সাথে এইরকম করলা কিভাবে বলো তো?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, “মিতি আমার ভালোবাসার দরকার ছিলো। তুমি আমাকে ভালোবাসোনা এটা আমি যেমন জানি তুমিও তেমন জানো। আমি রাস্তায় রাস্তায় যেয়ে ছ্যাচড়ামি করে বেড়ায়নি, ওই সাহসটাও আমার নাই। যার মেসেজ দেখছো, ও খুব ভালো মেয়ে। আমার সাথে পরিচয়ের পর থেকে খুব ভালোবাসার কথা বলতো। আমার ভালোবাসার কথা শুনতে ভালো লাগতো। তুমি সবসময় তোমার রাগ, তোমার অধিকার, তোমার চাহিদা নিয়ে ব্যস্ত ছিলা। আমাকে বোঝোওনাই কখনো, ভালোও বাসো নাই। আমিও মানুষ, হয়তো খুব নিম্ন প্রকৃতির।কিন্তু আমারও কারো সাথে দুই একটা কথা বলার দরকার আছে, নিজের কথা। তোমার সাথে...”
মিতি আমার কথা শেষ করতে দিলোনা। ও আমাকে থাপ্পড় দিয়ে বললো, “এইজন্য ফস্টিনস্টি করে বেড়াবা।কোথাকার কোন মাগীর সাথে হাত লাগালাগির...তুমি একটা অমানুষ। এইরকম একটা মানুষ যার মধ্যে এই বোধশক্তিটাও নাই যে সে অপরাধ করছে”।
আমি শান্ত কন্ঠে বললাম, “মিতি তুমি চলে যাও। আমি খুব খারাপ মানুষ। তোমার কথাই ঠিক। আমার মত মানুষকে তোমার ছেড়ে চলে যাওয়াই উচিত। আমার সাথে থাকলে না তুমি, না আমি সুখী থাকবো। তোমার আমার মধ্যে হচ্ছেনা!”
মিতি সোফায় বসে পড়লো। আমাদের কেনা নতুন নীল রঙের সোফাটা। ড্রইং রুমে জায়গা হচ্ছেনা তাই বেডরুমে নিয়ে এসেছি। আমি মাঝে মাঝে এটাতে বসে জানালার বাহিরে তাকিয়ে থাকি। আমার বাসা থেকে একটা বিল্ডিং পড়েই নবনীরা থাকে। মাঝে মাঝে ওকে জানালা দিয়ে দেখতাম। ভালো লাগতো। মনে হতো আবার বয়সটা ১৮-১৯ হয়ে গেছে। সেই রকম একটা ভয় ভয় অনুভূতি, কেমন যেন ঘোর লাগা, কিছুই ভালো না লাগা।
মিতি কাঁদছে। আমার খারাপ লাগছে। বেশি খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে একটু পর মিতি বুঝতে পারবে ওর আসলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ওর মা ওর ভাইয়ের বাসায় থাকে। ওর ভাবী ওকে দুই চোখে দেখতে পারেনা। বাবা মারা গেছে তো অনেক বছর হয়েছে। আমি ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে চিন্তা করি। আমি খুব অসহায় বোধ করতাম। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলি, “মিতি একটা কাজ করি। আমি চলে যাচ্ছি বাসা থেকে। আমি ভুল করছি, আমার এখানে থাকার তো কোন আর প্রয়োজন নাই”।
মিতির কান্না থেমেছে। মাটির দিকে তাকিয়ে ও খুব জোরে জোরে পা ঘষছে। আমার মনে হলো ওর আচরণ ধীরে ধীরে খুব অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। গরগর করে বললো, “তোমার কেনা ফ্ল্যাট, তুমি থাকবা। আমাকে করুণা করবানা অন্তু।আমি দরকার হলে শরীর বেঁচে খাবো, তারপরও তোমার মত শূয়োরের করুণা আমার লাগবেনা”।
আমি ওকে কিছু বলার ভাষা আর খুজে পাচ্ছিনা। মিতি যেতে পারছেনা। আমি চাচ্ছিনা এই রাতে এমন ভাবে ও চলে যাক। ইশ! কি খুশি ছিলাম যখন ওর সাথে বিয়ে হলো। ও খুশি ছিলো কি? ছিলো হয়তো। বিয়ের পর তিনদিন লজ্জায় আমরা ঠিকমত কথাই বলতে পারিনাই। এরেঞ্জ ম্যারিজ ছিলো। যদিও কিছুটা পূর্বপরিচিত। খুব বেশি না সেটা। হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেলো। ঠিকমত জানা শোনা কিছুই হলোনা। এখন মনে হয় এমনটা ঠিক হয়নাই। বিয়ের কিছু দিন পর থেকে আমার মনে হলো, আসলে আমরা কাজটা ঠিক করিনি। ও অন্যরকম, আমার সাথে ওর হয়না। আমার বেশিরভাগ কাজ, কথাবার্তাই ওর বিরক্ত লাগে। আমার কিছুই ওর ভালো লাগেনা। প্রথম প্রথম চেষ্টা করেছি একটা ভালো বোঝাপড়ার, তারপর একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছি। কি দরকার! আমি নাহয় আমার মত থাকি, ও ওর মত থাকুক। আমাদের একসাথে থাকাটাই একটা অর্থহীন বোঝার মত হয়ে গিয়েছিলো।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে দরজায় কে যেন কলিংবেল বাজালো। দরজা খুলে দেখার মত শক্তি বা মানসিকতা কোনটাই আমার ছিলোনা। এক মিনিট নীরবতার পর আবার কলিংবেল বাজলো। মিতি তখনও ঝিম মেরে বসে আছে। আমি উপায় না দেখে ধীরে ধীরে দরজার কাছে যাই। জিজ্ঞাসা করি, “কে?”
একটা ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠ থেকে উত্তর আসলো, “আপনার একটা পার্সেল ছিলো স্যার”।
খুব অদ্ভূত লাগলো। এতো রাতে কেউ পার্সেল দিতে আসে। আমার বেশি কিছু চিন্তা করার মানসিকতা ছিলোনা।আস্তে করে দরজা খুলি। সিড়ির লাইট বন্ধ ছিলো। তাই কাউকে দেখলাম না। সাড়া না পেয়ে দরজার বাহিরে মাথা বের করে উঁকি দিলাম। ঠিক তখন মনে হলো চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। তারপর একটা প্রলয়ংকারী ঝড় কোথা থেকে কিভাবে আসলো বুঝলাম না। কি প্রচন্ড যন্ত্রণা। আমি কি মরে যাচ্ছি? মনে হয়। ঝপ করে পড়ে গেলাম। এরপর সব অন্ধকার। আর কিছু মনে পড়ছিলোনা।কিচ্ছু না।

জ্ঞান ফিরে আসার পর চারদিক কেমন শো শো আওয়াজ শুনছিলাম। কে যেন খুব কাছ থেকে চিৎকার করছে । পাশ থেকে একজন যেন বললো, “স্যার আপনার চশমাটা খুব সুন্দর। ব্র্যান্ডের মনে হয় তাই না?”
আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না। ব্যথায় কুকড়ে যাচ্ছিলাম বারবার, আমার চোখ মনে হচ্ছে যন্ত্রণায় ফেটে যাবে। আমি গো গো করছিলাম। অপরিচিত কন্ঠ আবার বলে উঠলো, “আপনার ফ্রিজে ঠান্ডা পানি পেলাম না। মনটা খুব খারাপ হয়েছিলো। আপনার স্ত্রীকে দুইটা চড় দিছি এজন্য। কিছু মনে নিয়েন না”।
আমি অনেক কষ্টে একটা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আশেপাশে শুধু অন্ধকার। বেদম জোরে কেউ একজন মনে হয় আমার পেটে একটা লাঠি দিলো। ভক করে বমি করে দিলাম। আমার খুব ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে লোকটা আমাকে মেরে ফেলবে। আচ্ছা মিতিকে কি মেরে ফেলেছে? ওর কোন শব্দ পাচ্ছিনা। আমি কাশতে কাশতে বললাম, “আপনি কে?”
কেউ একজন আমার পাশে বসলো। আমার কাধে হাত দিয়ে বললো, “স্যার লাথিটা একটু জোরে মেরে দিছি। আপনি বেহুশ হয়ে পড়ে ছিলেন। একটু বাড়ি দিলে জ্ঞান আসবে ঠিকমত তাই একটু মজাক করলাম। আসেন আমারে ধরেন, আপনারে বসাই সোফায়। সোফাটা আমার ভালো লাগছে। কালার উপর সোনালী ব্লক। সোফায় আকাম করে মজা পাইছি। আসেন আমাকে ধরেন, বসেন সোফায়”।
আমি ভয় পাচ্ছিলাম, খুব ভয়। বাম চোখটা কোনরকমে খুলে সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখলাম। লোকটার চোখ ভয়ানক লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে একটা পশু। শিকার করার আগে পশু যেমন করে শিকারের দিকে তাকিয়ে থাকে ঠিক তেমন করে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি তার হাত ধরে বললাম, “ভাই আমার কাছে কি চান? এভাবে আমাকে মাইরেন না। আলমারীতে অনেক টাকা আছে। আমার বউয়ের বেশ অনেকগুলো গহনা আছে। ওগুলো নিয়ে যান। আর কিছু লাগলে বলেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো। আমার স্ত্রী কোথায়? আমাদের ছেড়ে দেন”।

লোকটা ঘরের চারপাশে হাটলো। বিছানার উপর উঠে জানালার পর্দাটা ভালোভাবে টেনে আমার কাছে এসে গালে সজোরে একটা চড় মেরে বললো, “চুপ কর শূয়োরের বাচ্চা। তোর মত পয়সাওয়ালার মুখে আমি মুইত্যা দেই। টাকার গরম দেখাস শূয়োরের বাচ্চা। টাকার জন্য আসছি তোর কাছে??”
আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে থাকি। চোখ খুললেই মানুষের মত কথা বলা ভয়ংকর পশুটাকে দেখবো। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মুখ ঢেকে বললাম, “আপনি কি চান বলেন? আমি আপনার সাথে কি করছি, মারছেন কেন?”
লোকটা ড্রইং রুমের দিকে চলে গেলো। ওর পায়ের আওয়াজ শুনছিলাম খুব মনোযোগ দিয়ে। যেই মনে হলো ও আর রুমে নেই আমি আঙ্গুল একটু ফাক করে চারদিকে দেখার চেষ্টা করছিলাম। নাহ আসলেও চলে গেছে। আমি মিতিকে খুজতে লাগলাম। ও কোথায়? ওকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো।আমার একটা পা মনে হয় ভেঙ্গে দিয়েছে। আমি কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে এসে মিতিকে খুজতে থাকলাম। লোকটা পাশের রুমে সিগারেট খাচ্ছে। লোকটাকে সাহস করে ডাক দিলাম, “ভাই আমার বউ কই? আমি একটু ওর সাথে কথা বলি?”
লোকটা পাশে এসে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বললো, “স্যার আমার নাম রইস। বাবায় পুরা নাম দিছিলো, রইছ শেখ। বাবার নাম মালেক শেখ। আপনার আর আপনার পরিবারের সাথে একটু মিসটেক করছি। কিছু মনে নিয়েন না। মাঝে মাঝে মাথা আউলায় যায়। কি করতে যে কি করি। আপনার পা বাইড়ায় ভাঙ্গি দিছি। শুধু ডান পা। মানুষ মারার আগে তার সাথে একটু দুষ্টুমি করি। এইটা কোন পাপ না। জগত আপনার মত টাকা পয়সাওয়ালা লোকগুলা নষ্ট করতেছে। তাদেরকে একটু টিট ফর ট্যাট দেই। এইটায় মাইন্ড খাওয়ার কিচ্ছু নাই”।
আমি উঠে বসলাম। তার সামনে হাত জোড় করে বললাম, “ভাই আমি অত ধনী কেউ না। একটা মোটামুটি চাকরী করি। ব্যাঙ্কে খুব একটা টাকা পয়সাও নেই জমানো। আমি আপনার সাথে কি কোন অপরাধ করছি? আমাকে মেরে ফেলেন চাইলে। কিন্তু আমার স্ত্রীর সাথে একটু কথা বলতে দেন।প্লীজ?”
রইস হেসে বলে, “বউ দেইখে কি করবেন। চেহারা বিগড়ায় দিছি। এখন আর ভালো লাগবেনা। পাও একটু কেটে গেছে। আপনার মত ডান পা। গোড়ালির কাছে কেটে দিছি। আর হাটতে পারবোনা এই জীবনে। আবার একটু কইর‍্যা খাইয়াও দিছি।হেহেহে...ল্যাংড়া খোড়া বেইজ্জত বউ লইয়া কি করবেন? একটু পর আপনারেও কুটকুট কইরা মাইর‍্যা ফেলবো”।
প্রচন্ড বমি আসলো। মনে হচ্ছে লোকটা মিথ্যা কথা বলছেনা। আমি বমি করছি, চিৎকার করছি। পাশে রইস দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। সে আমার মুখে আবার লাথি মেরে বলে, “ও স্যার বড়লোকের বউয়ের কাম সাইর‍্যা দিছি। এখন বাচ্চা অইবো, আমার মত চেহারা। হেহেহে...”
আমি দাড়ানোর চেষ্টা করি। মিতির কাছে যাওয়া দরকার। আল্লাহ তুমি মেয়েটাকে বাচায় রাখো। আমার কোন দোয়া কালাম এখন মনে পড়ছেনা। আমি রইসকে পাশ কাটায় আল্লাহ আল্লাহ বলতে বলতে আমাদের ছোট্ট বেডরুমে গেলাম। এটা আমাদের কোন সন্তান হলে তার জন্য বরাদ্দ ছিলো। যদিও অর্থহীন ছিলো ব্যাপারটা। আমার বাচ্চা কাচ্চার ব্যাপারে কোন আগ্রহ ছিলোনা। আমার আর মিতির কোন বাচ্চা হোক আমি চাচ্ছিলাম না। একটা বাজে সময়ে আরেকটা নতুন জীবন আমন্ত্রণ জানানোটা একেবারেই অর্থহীন। রইস আমাকে ওর কাধে ভর দিয়ে নিয়ে গেলো। ও খিলখিল করে হাসছে। রুমে ঢুকে দেখলাম মিতির শরীরটা পড়ে আছে মাটিতে। ওর মুখ দিয়ে একটা জান্তব গোঙ্গানীর শব্দ আসছে। আমি রইসের দিকে তাকিয়ে তীব্র আক্রোশ অথচ অন্তিম করুণা নিয়ে বলি, “কেন?”
রইস হাসে। আমাকে বলে, “আরে স্যার কিছুই তো করিনাই তেমন। সপ্তাহ খানেক আগে উত্তরায় এক বেটিরে আট টুকরা করছি। গলা ফালায় দেয়ার আগ পর্যন্ত জীবিত ছিলো। বিশ্বাস করেন। আমারে বেটি কয় ওরে মাফ কইর‍্যা দিতে। আরে শালার আমি গেছি নিজেরে একবুক শান্তি দিতে। আমার কাছে মাগী মাফ চায়। বাইঞ্চোত,বাইঞ্চোত খাস বাইঞ্চোত সব।স্যার একটু টয়লেটটা ব্যবহার করে আসি। অনেকক্ষণ হলো বেগ সামলায় রাখছি। মুখটাও কুলি করবো। অনেক বেশি গালাগালি করছি একদিনে। আমি এমনিতে শিক্ষিত স্যার। ইন্টার পাশ করছি।বিষয় ছিলো বিজ্ঞান। রসায়ন খুব ভালো লাগতো। আরো পড়ার ইচ্ছা ছিলো। পারিনাই। পয়সা ছিলোনা”।
আমি রইসের কথা শুনছিলাম না। শুধু মিতির হাত ধরে ওকে ডাকছিলাম। মিতির গোঙ্গানীর আওয়াজটা বেড়েই যাচ্ছিলো। আমি ওর পাশে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম। হাত ধরে বললাম, “আমি খুব স্যরি। বিশ্বাস করো আমি খুব স্যরি। আমার কারো সাথে কোন সম্পর্ক ছিলোনা। যেই মেয়েটার মেসেজ দেখছো ওর সাথে আমার জীবনে একবারই দেখা হয়েছে। কিচ্ছু ছিলোনা। আমি আসলে ভালোবাসা খুজতাম খুব। তুমি আমাকে পছন্দ করতানা। সত্যি জানো, আমাকে কেউ পছন্দ করতোনা কখনো আম্মু ছাড়া। তোমার সাথে বিয়ের পর ভাবলাম কেউ একজন আমাকে খুব ভালোবাসবে। কিন্তু তোমার আমাকে ভালো লাগতোনা। আমি কিন্তু জানি তোমার একটা এফেয়ার ছিলো আমার সাথে বিয়ের আগে। তোমার চাচাতো ভাই হাসিবের সাথে। আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে তুমি বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করলা। হাসিব মাঝে মাঝে বাসায় আসতো। একদিন আমি দেখে ফেললাম ও তোমার হাত ধরে টানাটানি করছে। আমি জানি তুমি বিয়ের পর সব ভুলে যেতে চেয়েছো। কিন্তু আমি খুব বুঝতাম তুমি ওকে এখনও ভালোবাসো। ও তোমাকে ভালোবাসতোনা, নাহলে আমার সাথে বিয়ে হতে দিতোনা। আমি এই কথাটা অনেকবার তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি। সাহস হয়নাই। আমি জানি তুমি ওর থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু আসলেও কি পারতে? এভাবে দিনের পর দিন আমি ওর প্রতি তোমার দুর্বলতাটা অনুভব করতাম। একটা সময় মনে হলো, আমিও এমন করবো। তুমি অন্য কাউকে চাইলে আমি কেন পারবোনা। আমি কিন্তু আসলে পারিনি। নবনী নামের মেয়েটা আমাকে সত্যি ভালোবাসে অনেক। আমি ওর মুখে যতবার আমার জন্য ভালোবাসার কথা শুনেছি ততবার মনে হয়েছে তুমি যদি বলতা এই কথাগুলা তাহলে কেমন হতো। আমার ভালো লাগতো ওর কথাগুলো শুনতে। খুব। মিতি আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করো”।
মিতির গোঙ্গানী একটু কমে গেলো। ও ওর দুর্বল হাত দিয়ে আমাকে ধরলো। আমি ওর হাত ধরে চিৎকার করে কাদছিলাম। ও কি যেন বলতে চাচ্ছিলো। কিছু একটা যা আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর মুখের কাছে কান নিয়ে আসি। ও ফিসফিস করে শুধু একটা কথাই বললো, “স্যরি...”
তারপর সব শুনশান। মিতি সেই মুহুর্ত থেকে শুধুই একজন মৃত। আর আমি জীবিত থেকেও মৃত। এই ঘরের একমাত্র জীবিত প্রাণী তখন রইস। সে আমার তোয়ালেটা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো, “স্যার মাঝে মাঝে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়।অশ্লীল কাজ করে ফেলি। করতে চাইনা এমন না। কিন্তু বুঝি করা ঠিক না। আমি আপনাদের ফ্ল্যাটের নিচ তলায় এক স্যারের কাছে মাঝে মাঝে আসতাম। সে আমারে চাকরী দিবে বলছিলো। দিলো না। হাতে পায়ে ধরছি দিলোই না। তারপর একদিন দেখি আপনে এই ম্যাডামের সাথে হাসিমুখে গল্প করতে করতে নিচে যাচ্ছেন। কি সুন্দর একটা ছাই রঙের নতুন গাড়িতে উঠতেছেন। বউটাও মাশাল্লাহ কি সুন্দর। ভাল লাগেনাই। খালি মনে হতো, মাইরা ফেলাই। এগুলা সব আবর্জনা, সমাজের আবর্জনা। পৃথিবী কি হাসিমুখ কইর‍্যা গাড়িতে চইড়া মাল খাওনওয়ালাগো জায়গা। দুনিয়া তাদের জায়গা যারা আমার মত জুতার তলা খোয়ায় চাকরী খুজে। সারাদিন না খাইয়া রাতের বেলা বিড়ি খাওয়ার টাকা দিয়ে দুই টাকার বন কিন্যা পেট পুরা খায়। তারপর রাত্রে স্বপ্ন দেখে। মধুর মধুর সব স্বপ্ন। স্যার আপনি সিগারেট খান? এক পিস ধার দিবেন। আপনারে জবাই দেওয়ার আগে একটা ভালো বিড়ি খায়া মরতে চাই”।
আমি রইসকে ডাকি। কাছে এলে বলি, “আমার বেডরুমে নিয়ে চলো। ওখানে আছে। বন্ধু ফ্রান্স থেকে সোনালী রঙের প্যাকেটে লা এন ভিয়েরে নামের একটা চুরুট নিয়ে এসেছিলো। চলো আমি একটা খাই। তুমিও খাও”।
রইস আমার কাছে এসে মুখের উপর ভক করে থুতু ফেললো। চিৎকার করে বললো, “কুত্তার বাচ্চা, আমার সাথে ভাব মারাস। চুরুট চিনাস। আমার দেখ। চোখ খুইলা দেখ। আমার নাম রইস শেখ। আমি তোর খোদা। তোর একমাত্র খোদা। তুই এমনে কুইজ্যা হয়ে বসে থাকবি, কুত্তার মত। কুত্তা মাইর খায়া যেমনে গোঙ্গায় তেমন কইর‍্যা গোঙ্গাবি। আরেকটা কথা বলবিনা। আমারে চুরুট শিখায়, শাউয়ার পোলা”।
আমি রইসের দিকে হাত বাড়িয়ে দেই। রইসকে বলি, “স্যার চলেন ওই রুমে যাই। আপনাকে একটা ভালো সিগারেট খাওয়াই। চলেন”।
রইস আমার দিকে পশুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে কৌতুহল। প্রবল কৌতুহল। সে কি ভাবছে আমি জানিনা। কিন্তু তার চোখ ভরা অনেক গল্প। কি অদ্ভূত, আমার খুব তার গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে। রইস একটা সময় আমার হাত ধরে। টেনে নিয়ে যায় পাশের রুমে। আমার ভেতরে একটা কেমন নির্লিপ্ততা চলে এসেছে। এমনটা হয় যখন একজন বুঝতে পারে তার ভেতরের মানুষটা আর বেঁচে নেই। আমি রইসকে একটা চুরুট দিয়ে বলি, “রইস ভাই ভালো আছেন?”
রইস চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমি তাকে বলি, “একটা কথা রাখবেন ভাই। একটু নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছা করছে। বারান্দায় যেতে চাই। আজকে ভরা পূর্ণিমা। চাঁদ দেখবো। পাঁচ মিনিট জাস্ট। কথা দিচ্ছি কোন আওয়াজ করবোনা। আমার গলায় ওই শক্তিও নাই। যেতে দিবেন ভাই?”
রইস আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বললো, “স্যার কবিতা লেখেন নাকি? আমিও আগে লিখতাম”।
আমি ওর সাথে হাসলাম। আমার ডান চোখের উপরে ফেটে গিয়েছে। সেটা টের পেলাম এতক্ষণ পর। এজন্যই চোখ খুলতে পারছিলাম না। রইসকে আহত চোখটা দেখায় বললাম, “আমার চোখে প্রায় অন্ধকার দেখছি। ভালোমত দেখলে আমার বউ যাকে ওই ঘরে রেখে আসলেন তাকে নিয়ে জীবনের শেষ কবিতাটা লিখতাম। দুই চোখ খুলে চাঁদ দেখতে দেখতে কবিতা লিখতাম”।
অধরে আজ শশী জেগেছে
ক্ষুধাহীন মানুষটা কথা রেখেছে
তোমাকে না চেয়েও ভালোবেসেছে

আমি রইসের সাথে বারান্দায় বসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছি। সারা শরীরের এমন কোন জায়গা নেই আমার ব্যথা হচ্ছেনা। কি ঘৃণা নিয়ে রইস আমাকে এমন অর্ধমৃত হাল করেছে তা না দেখলে কেউ হয়তো বিশ্বাস করবেনা। বারান্দাটা, তাকে জোৎস্ন্যা রাতে ঘিরে থাকা চাঁদ মিতির ভালো লাগে তাই একটা রোলিং চেয়ার কিনেছিলাম। ওটাতে এখন রইস চুরুট টানতে টানতে দোল খাচ্ছে। মিতি আমার উপর মেজাজ খারাপ হলে মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে থাকতো। আমাদের সংসারটা খুব অগোছালো ছিলো। মিতি হয়তো ঠিকই বলেছিলো। আমাদের বিয়েটা শুধুই একটা ভুল। আমি দেরীতে বুঝেছি, মিতি অনেক আগেই বুঝেছে কিন্তু বেরোতে পারেনি।
রইস নীরবতা ভেঙ্গে আমাকে বললো, “এর আগে স্যার ১৬টা খুন করেছি। সবাই খুব ভয় পাচ্ছিলো গলা ফালায় দেয়ার আগে। আপনি এমন নির্ভয়ে আছেন কেন? ভাব চুদাইতাছেন?”
আমি রইসকে বলি, “আমার নিজেকে আপনার মত লাগছে এখন। একদম আপনার মত। আমরা সবাই আসলে আপনার মত। ভেতরে একটা জন্তু বাস করে, আহত জন্তু। কেউ কেউ সাহসী হয়ে সেই জন্তুটা বের করে আনে, কেউ পারেনা। তারা ভীতু। এই জগতটা ভীতুদের জন্য না। আপনি ঠিক বলেছেন, আমরা হলাম সমাজের আবর্জনা”।
রইস খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো, “স্যার কথা আমি ঠিকই বলি। আমি খুন করি কেন জানেন? আমার কিন্তু বাবা মা ভালো ছিলো। ভালো ভালো বিদ্যা দিছে। আরবী পড়াইছে। ইংরেজী পড়াইছে। বাপে একদম পাক্কা সৎ লোক ছিলো। কিন্তু সব শেষ হইয়া গেলো একদিন। আপনার মত কিছু সুখী মানুষ একদিন আমার সব শেষ কইর‍্যা দিলো। আপনার মত লোকগুলা আমারে দিয়া ভিক্ষা করাইলো, আমার মায়েরে বেশ্যা বানাইলো। আমি হইছিলাম খাইনকার পোলা। উঠতে বসে গাইল খাইতাম। একদিন আপনারা আমার গায়ে পিশাপ কইরা বললেন, আমার কোন ইজ্জত নাই। আমি মানুষ না। বেশ্যার পোলার ইজ্জত থাকেনা। আমারে দিয়া বাথরুমের গু পরিষ্কার করাইলো। আমি কোন নেশা ভাম করতাম না। তারা আমারে হিরোঞ্চি বানাইলো, শরীরের মধ্যে হাওয়া ঢুকায় দিলো।মাইনষের কাছে ভিক্ষা করছি, হিরোইনের টাকার জন্য বন্ধুরে পিটায় মারছি।আপনাদের দেখলে আমার লোভ হয় আবার ঘেন্নাও হয়। যখন ঘেন্না উঠে তখন একটা একটা কইরা সাফ করি। স্যার আমার ভাষা কি খুব অভদ্র শুনাইতাছে?”
আমি মাথা নাড়ি। রইস আবার বলে, “স্য্যার খুব চেষ্টা করি আপনাদের ভাষায় শুদ্ধ ভাবে কথা বলতে। কিন্ত মাঝে মাঝে এমন রাগ হয় যখন...”
রইস আমার দিকে তাকায় থাকে। আমি জানি ও এখন আমাকে আবার আঘাত করবে। কিন্তু কেন যেন থেমে গেলো। রাগে গরগর করতে করতে বললো, “ইচ্ছা লয় শালা তোদের মত টুথপেস্ট দিয়া দাত সাদা করা সব বেজন্মাগুলারে মাইরা গাইড়া ফেলি। জীবন কি আমারে দেইখা শেখ...সব মান্দার পোলা তোরা। হাসোস, গাড়িতে চড়োস। আমি তোদের মত মানুষ ছিলাম না? আমারে দিয়া কি না করাইছোস!”
রইস থামে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। আমার দিকে শান্ত চোখে তাকায় বলে, “স্যার নিঃশ্বাসের টান লাগে মাঝে মাঝে। আপনার বউ কিন্তু মাল ভালো ছিলো। অনেক রিকুয়েস্ট করছিলাম একটা চুমা দিতে। দেয়নাই। জিহবা টাইন্যা অর্ধেক ফাইড়া দিছি। আমারে চুমাইতে ঘিন্না লাগে? ফক্কিনী মাগী। গায়ের রঙ একটু ধলা বইলা মাগীর খুব তেশ বাড়ছিলো”।
আমি রইসের কাছে আগায় যাই। ওকে বলি, “রইস ভাই আমার বউয়ের নাম মিতি ছিলো। তার সাথে আমি ছোট খাটো একটা প্রতারণা করেছিলাম। আমি সেইজন্য বেশ লজ্জিত। সে অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলো। আমাকে সে পছন্দ করতোনা সেটা আমার সমস্যা, তার না। যেহেতু সে মারা গিয়েছে, আমরা তার প্রসঙ্গটা বাদ দেই”।
রইস খিলখিল করে হাসে। আমার পেটে লাঠি দিয়া বলে, “খানকির পোলা তুই আমারে ভালো ভাষা শিখাস। তোর মায়েরে লইয়া আমি ব্যবসা করমু, তখন বুঝবি ভালো কথা কারে কয়। মায়েরে জিগাবি কাস্টোমার কি কয়া গাইল দিছে আকামের সময়। হেহেহেহে...”
আমি রইসের দিকে তাকাই থাকি। কোন যন্ত্রণা হচ্ছেনা। মাথায় হঠাৎ চিন্তা আসলো, আমি কি মরে গেছি? তারপর হাসি এলো। হাসি থামিয়ে রইসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। ওর চেহারাটা আমার মনে রাখা দরকার। খুব দরকার।
রইস আমাকে ধমক দিয়ে বলে, “কিরে রাগ উঠতেছে খুব। আমারে নোংরা লাগতেছে। তোর রেজার দিয়ে আজকে যাওয়ার আগে দাড়ি কাইটা যামু। একদম ফকফকা হয়া বাইর হমু। টাকা রাখছোস কই যেন? আমার টাকা লাগবো কিছু। মাইয়া খাইছি, মাল খামুনা এইটাতো হয়না। বহুত আলাপ হইছে। এইবার তোর গলা ছিলমু। ভাব নিসনা খবরদার। ভয় পা আমারে। ভয় পাওয়া বেজন্মা দেখলে ভাল লাগে। তোরে মাইর‍্যা মজা পামু। গা ভরা গোশত।ফ্রাই কইরা খাওন যাইবো। আমি অবশ্য তোর মত কুত্তার মাংশ খাইনা”।
রইস আমার কাছে আগায় আসে। আমার ভয় লাগেনা। ওকে শান্তভাবে বলি, “রইস তোমাকে তুমি করে বললাম কিছু মনে কইরোনা। তুমি একজন বেশ্যার ছেলে, তোমাকে আপনি বলতে ইচ্ছা করছেনা।তোমার একটা ভুল হয়েছে, জানো?”।
রইস থমকে দাঁড়ায় যায়। আমার ঠোট রইসের মারে ফুলে গিয়েছিলো। কথা বের হতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। সেই ছেড়া ঠোট নিয়ে মৃদু হেসে বললাম, “আজকে তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছিলে। সেটায় সেন্ট পারসেন্ট সফল। এখন নিজেকে কেন যেন তোমার মতই একজন মনে হচ্ছে, একদম খাটি পিশাচ। তুমি হলে আমার আয়না। আমি এখন আমাকে তোমার মাঝে খুব পরিষ্কার দেখছি। সবার আয়না ভালো লাগেনা। আমারও লাগেনা। তোমারও একটা দুর্বলতা আছে। সেটা যেদিন জানবো, তোমাকে আমি ভেঙ্গে ফেলবো”।
রইস আমার গলা টিপে ধরে ফেলে বলে, “ওই সিনেমার ডায়ালগ মারাবিনা। তুই হলি কুত্তা, ফকফকা সাদা কুত্তা। আমি তোর খোদা”।
আমি রইসকে ভালোভাবে খেয়াল করি। বয়স পয়ত্রিশের আশেপাশে হবে। ওর মুখ দিয়ে হিস হিস শব্দ বের হচ্ছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি শরীরে যা শক্তি বেঁচে ছিলো তা দিয়ে কোনরকমে ওকে এক ঝটকা দিয়ে সরিয়ে ফেলি। বারান্দায় রেলিং লাগানো হয়নি। নতুন ফ্ল্যাট। দোতলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে লাফ দিলে মরে যাবার কথা না হয়তো। অবশ্য মৃত্যুকে ভয়ও লাগছেনা। আমি লাফ দিলাম।ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটলো যে রইস শুধু তার হাতে আমার শার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে হয়তো হতভম্ব হয়ে ছিলো, ভাবতে পারেনি এই আহত অবস্থায় আমি সাহস করে এমন কিছু করতে পারি। কিন্তু আমার তখন আরেকটু বেঁচে থাকার ইচ্ছা ছিলো। রইসকে সামনে বসিয়ে গল্প করার ইচ্ছা ছিলো।

নিচে পড়ার পর আমি কোন আওয়াজ পাচ্ছিলাম না। শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছিলো কি? তাও বুঝতে পারছিলাম না। বাবা মারা যাওয়ার আগে বলেছিলো, তার নাকি খুব উষ্ণতা বোধ হচ্ছে। আমার এমনটাই লাগছিলো। কি অদ্ভূত, চারদিকে কত আলো। হঠাৎ করে সব আলো নিভে গেলো। আমি মানুষের চিৎকার শুনতে পেলাম, একটা কুকুর প্রাণপনে ঘেউ ঘেউ করছে। আমি চোখ না মেলেও আশেপাশে সব যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। রইসের চেহারাটা হঠাৎ গুটিকয়েক মানুষের ভীড়ে দেখতে পাই। সে হাসিমুখে বলছে, “নিজেকে দেখতে পাচ্ছো?”

দু বছর পরে কোন এক সকাল বেলার কথা। আমি এবং আমার প্রায় খোড়া পা হেটে হেটে কিছু আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে নীচে গেলাম। এই সময় আফজাল স্টোরে এতো ভীড় থাকার কথা না। এক কাস্টমার অকথ্য ভাষায় আফজাল স্টোরের এক কর্মচারীকে মা বাপ তুলে গালি দিচ্ছে। আমি এগিয়ে যেয়ে নিজেই এক ডজন ডিম বেছে বেছে নেই। টাকাটা দেয়া লাগবে, কিন্তু কর্মচারী সবাই ঝগড়া করতে ব্যস্ত। উপায় না দেখে ১০০ টাকার ১টা নোট দোকানের ভিতর ছুড়ে মারি। একটা সিগারেটের প্যাকেট কেনা দরকার ছিলো। সম্ভব হচ্ছেনা। সকাল বেলা দুইটা না টানলে ভালো লাগেনা। হেটে হেটে তেজকুনিপাড়ার ২ নং গলির ১০/এ বাসার সিড়ি ধরে আস্তে আস্তে এগোতে থাকি। এটা আমার চাচার বাসা। হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পর গত দেড় বছর ধরে এ বাসাতেই থাকি। বাসাটা আমার বাবার পরিবারের। দোতলা বাসার নিচ তলা ভাড়া। দ্বিতীয় তালায় চাচা থাকেন। বিশাল বাড়ি। চারটা বেড রুম। গেস্ট রুমে আমাকে বেশ আরামের সাথে বসবাস করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। দাদী এখনো বেঁচে আছেন। বয়স প্রায় ৯০। তার প্রধাণ কাজ চাচীর বাপ মা তুলে গালি দেয়া। চাচী শুনে কিছু মনে করেন না। উনার মাথায় কিছুটা সমস্যা আছে। এটা নিয়ে অবশ্য কারো কোন মাথা ব্যথা নেই।
আমি ডিম চাচীর হাতে দিয়ে বলি, “আজকে দুপুরে খাবোনা। একটু বাইরে বের হবো। আপনারা খেয়ে নিয়েন”।
চাচী ভাজি রান্না করতে করতে বলে, “অন্তু মাত্র পা ঠিক হইছে। এখনই দৌড়াইতে শুরু করবা?”
আমি কিছু না বলে ডাইনিং টেবিলে যেয়ে বসি। চাচা ড্রইং রুমে পেপার পড়ছিলেন। আমাকে একটু আস্তে আস্তে ডাক দিয়ে বললেন, “একটু এদিকে আসো তো বাবা। তোমার সাথে দুইটা বাতচিত আছে”।
আমি চাচার পাশের সোফায় বসি। চাচা আমার দিকে তাকায় বলে, “তুমি অনেক শুকায় যাচ্ছো দিনদিন। আজকাল নাকি খুব ধূমপান করতেছো”।
আমি হেসে বলি, “চাচা কোন সমস্যা নাই। আপনার শরীর কেমন এখন?”
চাচা পেপারটা ভাজ করে আমার দিকে না তাকিয়ে বলেন, “আমার বন্ধু এখন ডি আই জি, ঢাকা নর্থ জোনের। কালকে আমার সাথে কথা হয়েছিলো। তুমি যদি চাও তার সাথে কথা বলতে পারো”।
আমি নীরবে বসে থাকি। বুঝতে পারছিনা কি বলার আছে তাকে। চাচা নিজেই আবার বলেন, “তোমার কি আসলেও কিচ্ছু মনে নাই? লোকটা দেখতে কেমন ছিলো?”
আমি মাথা নাড়ি। বলি, “আমার কিছু মনে নাই চাচা”।
চাচা ঘাড় সোজা করে বসেন। এরপর উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলেন, “তুমি এখন হালকা হাটতে পারছো তো মনে হয় তাই না?”
আমিও উঠে দাড়াই। হাসিমুখে বলি, “সব ঠিক আছে চাচা। আপনারা অনুমতি দিলে আমি আমার ফ্ল্যাটে শিফট হয়ে যেতে চাচ্ছিলাম”।
চাচা আমার হাত ধরে ডাইনিংরুমে যেয়ে বসেন। চাচী দুটো খালি প্লেট আমাদের সামনে রেখে বলেন, “ডিম ভেজে দিবো নাকি অমলেট খাবে?”
চাচা মুখ বেজার করে বলেন, “ওকে না চাইলেও একটা ডিম দেবে। ছেলেটা শুকায় যাচ্ছে”।
চাচী ডিম এনে দিলে চাচা চাচীকে বলেন, “পরের মাসে আমরা অন্তুর মালিবাগের বাসায় উঠবো। ওর এখানে ভালো লাগছেনা। তোমার কোন আপত্তি আছে?”
চাচী আমাদের সাথে টেবিলে বসে বলেন, “নাহ কেন আপত্তি করবো? নতুন বাসায় থাকতে তো ভালোই লাগবে। তোমার অফিস যেতে একটু কষ্ট হবে হয়তো”।
আমি হতবাক হয়ে চাচার দিকে তাকায় থাকি। চাচা মুখে রুটি দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, “কয় তারিখ যেতে চাচ্ছো? বাসার নিচে গ্যারেজ আছে নাকি গাড়িটা অন্য গ্যারেজে ভাড়া নিয়ে রাখতে হবে?”


অনেকদিন পর আবীরদের বাসায় গেলাম। ওদের বাসাটা ফার্মগেটের মোড় থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। আবীর আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। সে কিছুদিন আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। প্রথম বউ তার অফিসের এক কলিগের সাথে ভেগে যাওয়ার পর সে খুব মন খারাপ করে বলেছিলো, শালার জীবনে আর বিয়েই করবোনা।বাজে পাড়ায় যাবো শখ উঠলে, কিন্তু এই বিয়া শাদীতে নাই।কেউ কথা রাখেনি, বন্ধুও কথা রাখেনি। দ্বিতীয় বিয়ের পর আমার সাথে দেখা হয়েছিলো। হাসপাতালে আমাকে দেখে সে কিছুক্ষণ চোখের জল ফেলে বললো, “তোর যে অবস্থা। বিয়ের ব্যাপারে তাই আর কিছু বললাম না। দ্বিতীয় বউটাও দোস্ত ভালো না। ভেগে যেতে পারে। সেদিন নিচতলার মেসের মোবাশ্বের নামে এক ছেলের সাথে দেখলাম দরজার বাহিরে দাঁড়ায় বেশ হাসি তামাশা করতেছে। বিয়ে সকল ধ্বংশের মূল, আমি নিঃস্ব হয়ে গেলামরে দোস্ত। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠ। তোকে নিয়ে বান্দরবন যাবো। আত্নার উপর অনেক চাপ পড়েছে। হালকা করা দরকার”।

আবীরের বাসায় যেয়ে দেখি আবীর মুখ বেজার করে বসে আছে। আমি হাসিমুখে বললাম, “কেমন আছিস? বউ ভেগে গেছে?”
ভাবী পাশের রুম থেকে হাসতে হাসতে এসে বলে, “অন্তু ভাই আমার ভাগা লাগবেনা। আপনার ভাইয়ের যে অবস্থা সেই তো মনে হচ্ছে ভেগে যাবে”।
আমি তাকিয়ে থাকি। বন্ধু মন খারাপ করে বললো, “দোস্ত সকালে বাজারে গেছিলাম। ভুলে মোবাইল রেখে গেছিলাম ঘরে। সেই সময় রুনা ফোন করছিলো। বেটি আর কাম পায়নাই। ৭ বছর পর একদম সঠিক সময়ে ফোন দিছে। আমার বউরে সে আহলাদ কইর‍্যা আমার সাথে তার গোপন প্রেম কাহিনী ফাস কইর‍্যা দিছে। সকাল থেকে খুব মানসিক নির্যাতনের উপর আছি দোস্ত। চল বান্দরবান যাই।আর ভাল লাগতেছেনা”।
ভাবী চা নিয়ে এসে বললো, “ভাইয়া কেমন আছেন এখন? শরীর ভালো। আপনাকে হাটতে দেখে খুব ভালো লাগছে”।
ভাবীকে চা হাতে নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, “সব ঠিক আছে। বাচ্চা কেমন আছে?”
বন্ধু ভাবির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো, “দোস্ত বাচ্চা মাশাল্লাহ বাপ ডাকা শিখে গেছে। সমস্যা হইলো সে এখন সবাইরেই বাবা ডাকে।আমি খুব পেরেশানীতে আছি।তোকেও ডাকবে। দাড়া দেখাই”।
ছোট্ট শিখামণি আমাকে বাবা ডাকেনি।কিন্তু কোলে প্রস্রাব করে দিয়েছিলো। আবীর এতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। আমাকে বারবার গর্ব করে বলে, “দেখছোস কি দুষ্টু হয়ে গেছে। একেবারে বেত্তমিজ হইতেছে একটা”।
আমি আবীরের মমতা ভরা চোখের দিকে তাকাই। তারা মেয়েটা আমার কোলে প্রস্রাব করেছে, এতেও তার আনন্দে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছে। আমার আর মিতির যদি একটা মেয়ে থাকতো তাহলে আমারও কি এমন বোকা বোকা অনুভূতি হতো?

আবীরকে ভাবী চলে যাওয়ার পর বললাম, “আবীর একটা কাজে আসছিলাম। তুই কি এখনো পত্রিকায় কাজ করিস?”
আবীর মাথা নেড়ে বলে, “আমি এখন কালের কন্ঠতে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছি। কি লাগবে বল?”
আমি হেসে বলি, “কিছু লাগবেনা দোস্ত। আমি একজন লোককে খুজছি। তার ব্যাপারে আমি তেমন কিছু জানিনা।শুধু একটা তথ্য জানি। তুই কি একটু কষ্ট করে, দুই বছর আগে ১০ই মে থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত উত্তরায় ঘটা একটা নারী খুনের তথ্য দিতে পারবি?মহিলাকে খুব বাজে ভাবে হত্যা করা হয়েছিলো”।
আবীর চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “কেন খুজছিস বল তো? রইসের সাথে ওই নারী হত্যার কোন সম্পর্ক আছে?”
আমি হাত নেড়ে বলি, “হয়তো নাই। অথবা হয়তো ওইরাতে ও আমাকে সত্যি কথা বলেছিলো। আমার সাথে দুর্ঘটনা হয় জুন মাসের ১ তারিখ। ও বলছিলো সপ্তাহ খানেক আগে ও উত্তরাতে এক মহিলাকে আট টুকরা করছিলো। আমি সেই সংবাদটা পড়তে চাচ্ছি। সম্ভব?”
আবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সম্ভব। আমার আসলে মনে আছে এমন একটা ঘটনা হয়েছিলো উত্তরায় ৮ নম্বর সেক্টরে। মহিলার চোখ গালিয়ে দেয়া ছবি দেখে আমি বমি করে দিয়েছিলাম। তোকে সব তথ্য দিতে পারবো। কিন্তু একটা অনুরোধ করি। তুই একটু নিরাপদে চলাফেরা কর। যে এইসব কাজ করছে, সে মানুষ না দোস্ত। না না, I meant literally he is not a human being. তুই এই ব্যাপারে আর নিজে নিজে আগাস না”।
আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। যতবার ওই রাতের কথা চিন্তা করি মিতির গোঙ্গানীর আওয়াজ কানে আসে। আমি আবীরকে বিড়বিড় করে বলি, “মিতির লাশটা কি তোরা আসলেও পাসনি?”
আবীর অনেকক্ষণ নীরব থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, “দেখ অনেকদিন হয়ে গেছে। তোর এই সব থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত”।
আমি আবার বললাম, “পেয়েছিলি?”
আবীর কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে অসহায় দৃষ্টিতে। আমি অপেক্ষা করি ওর জবাবের। ও মিনমিন করছিলো। আমি কাছে যেয়ে বসি। ও আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বলে, “লাশটা পাওয়া গেছিলো।খুব বাজে অবস্থায় মাথা ছাড়া পাইছিলাম।আমার বন্ধু তখন পুলিশের বড় পোস্টে, কেসটা ওর হাতে ছিলো। ওকে আমি অনুরোধ করছিলাম যেন কোথাও লাশের ব্যাপারে কিছু না বলে। ভাবীর পরিবার খুব অনুরোধ করছিলো যেন এই ব্যাপারে কোথাও কোন খবর না যায়। দোস্ত আমি নিজে জানাজায় ছিলাম।তুই আর এইসব নিয়ে কোন কথা বাড়াইস না। মনে কর, একটা দুর্ঘটনা হইছে”।
আমি উঠে দাড়াই। আবীরকে বলি, “তোর জন্য একটা গিফট আনছিলাম। শুভ জন্মদিন দোস্ত। আমি পরের সপ্তাহে এসে তোর কাছ থেকে উত্তরায় হত্যাকান্ডের পুরো ব্যাপারটা জানতে আসবো। যদি পারিস, মহিলার কোন আত্নীয়ের ঠিকানা জেনে রাখিস”।
বন্ধুর হাতে ঘড়ি পড়িয়ে দিয়ে আমি রাস্তায় বের হয়ে পড়ি। আজকে খুব রোদ উঠেছে। এমন এক রোদ্দুরমাখা দিনে আমি নবনীর সাথে দেখা করেছিলাম। নবনীর হাতে একটা গোলাপী রঙের ঘড়ি ছিলো। সেদিন খুব ইতস্তত বোধ করছিলাম। শখের বশে লেখালিখি করি। সে কিভাবে কিভাবে যেন আমার সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করে ফেলে। তারপর কুটকুট করে কথা বলতেই থাকে। প্রথম দিকে কিছু বলতাম না। কিন্তু একটা সময় লোভ জাগলো।সত্যি ভালোবাসার, উন্মত্ত ভালোবাসার লোভ। আমি একটু একটু সাহস করে কথা বলতাম। একদিন ফোনে কথা হলো। আমাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতো, “আপনার কি আমাকে ভালো লাগে? আমি ভয়ে ভয়ে বলতাম, না ওইরকম না। তবে ভালো লাগে। তুমি যে বাচ্চাদের মত করো ওটা ভালো লাগে”।
নবনীর সাথে আমার আর দেখা হয়নি। একদিন কথা হয়েছিলো। ও আমার পুরানো ফোন নম্বরটা ঠিক হওয়ার পর ফোন দিয়েছিলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন আছেন?এখন কি সুস্থ?”
আমি হেসে বললাম, “অনেকদিন পর। হাটতে পারিনা এখনো ঠিকমত। তুমি ভালো আছো?”
ও চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। তারপর বললো, “আমার গত মে মাসে বিয়ে হয়ে গেছে। আব্বু আম্মু এতো জোর করছিলো, পারলাম না। এখন নাখালপাড়া থাকি।আপনি আমাকে এসে নিয়ে যাবেন?”
আমি মন খুলে হাসলাম। ওকে বললাম, “নিয়ে কোথায় যাবো? গল্প শোনাতে হবে? আমি এখন আর গল্পটল্প লিখিনা পিচ্চি। যাই হোক তোমাকে শুভকামনা।খুব ভালো লাগলো তোমার বিয়ের কথা শুনে”।
নবনীর গরম নিঃশ্বাসের শব্দে খাপাছাড়া ফোন কেটে দেয়ার আওয়াজটা খুব বিচ্ছিরি লেগেছিলো। এই বিচ্ছিরি ভাবটা জীবনের সুর কেটে যাওয়ার। আমি আসলেও মরে গিয়েছিলাম। ওয়াসফির হাসিফ অন্তু মারা গিয়েছিলো। সে আর জীবিত হবেনা।

আবীরকে নিয়ে মুগদাপাড়ার একটা আধাপাকা তিনতলা বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছি। উত্তরায় খুন হওয়া মহিলার স্বামী এই বাড়িতে থাকেন। মহিলার নাম ছিলো শিরিন। স্বামীর নাম ছিলো শরীফ মাসুম। শরীফ মাসুম একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। খুব ছোট্ট চাকরী, কিন্তু তাতে একা মানুষের চলতে সমস্যা হয়না। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর অনেকদিন অসুস্থ ছিলেন। পত্রিকার লেখা অনুযায়ী সেই কালো রাতে তিনি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন জমিজমার কাজে। তার পাঁচ বছরের একটা ছেলে আছে। ছেলেকে নিয়ে তিনি কোনরকমে দিন পার করেন। আমি আবীরকে জিজ্ঞাসা করি, “ভদ্রলোকের সাথে তোর কথা হয়েছে তো ফোনে? জানিয়েছিস যে আমরা আসবো?”
আবীর মাথা নেড়ে বললো, “খুবই অমায়িক ব্যক্তি। স্ত্রীর কথা বলার পর খুব আফসোস করলো। বললো দুই বছর কেটে গেছে কিন্তু এখনো সে খুব শকের মধ্যে থাকে। চল উপরে উঠি। দোতলায় বাসা”।
আমি হাতের সিগারেটটা ফেলে উপরে উঠলাম। বাসায় কলিংবেল টিপলে ভদ্রলোক নিজেই দরজা খুলে দিলো। মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া খুব সাধারণ দেখতে একজন লোক। গালে খোচাখোচা দাড়ি, দেখেই মনে হয় খুব বিধ্বস্ত। আমাকে দেখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন, আমিও তাকিয়ে থাকলাম। উনিই প্রথম বললেন, “বসুন।কাজের ছেলেটা এখনও আসেনি। ঘরে চা নেই। ও আসলে ওকে দিয়ে চা আনাবো। চিনি দেয়া টোস্ট বিস্কুট আছে। খাবেন?”
আবীর জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বললো, “আরেহ না না। কিচ্ছু লাগবেনা। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য খুব দুঃখিত মাসুম ভাই। আমার বন্ধু আপনার সাথে একটু কথা বলবে”।
আমি মাসুম সাহেবকে মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। তাকে বললাম, “আপনার স্ত্রীর নাম শিরিন ছিলো তাই না?”
মাসুম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “জ্বী। খুব ভালো মেয়ে ছিলো। একই গ্রামে ছিলাম আমরা। মা একদিন গ্রামে গেলে প্রায় জোর করে বিয়ে করিয়ে দিলো। আমার কোন অভিযোগ ছিলোনা। ওর সাথে প্রায় চার বছর সংসার করলাম। উত্তরায় ছাদের উপর একরুমের একটা বাসায় ছোট্ট সংসার সাজালাম। সব শেষ হয়ে গেলো”।
আমি চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলাম, “যে মানুষটা ওকে খুন করলো কেন খুন করলো বলতে পারেন?”
মাসুম সাহেব আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, “আপনার স্ত্রীকে কেন হত্যা করেছিলো?”
আমি হাসলাম। আবীরকে বললাম, “চল যাই”।
আবীর অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আর কিছু জিজ্ঞেস করবিনা?”
আমি বললাম, “নাহ! যা জানার দরকার জেনে গেছি”।
এরপর মাসুম সাহেবকে বললাম, “আপনার ছেলে কোথায়?”
সে মাথা নেড়ে বললো, “ও গ্রামে আছে, ঘুরতে পাঠিয়েছি”।

আবীরকে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। তারপর ওকে বিদায় দিয়ে মাসুম সাহেবের বাসায় আসলাম আবার। দরজা খোলাই ছিলো। আমাকে দেখে মাসুম সাহেব বললেন, “আসুন ভেতরে।ভালো আছেন স্যার?আপনার সাথে দেখা হবে জানতাম”
আমি হাত বাড়িয়ে দেই। হাসিমুখে বলি, “রইস তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?”
রইস দরজা আটকে বললো, “ব্রাক্ষণবাড়িয়ার একটা ছোট্ট গ্রামে, নাম বললে তো চিনবেন না। আপনার সাথে আবার দেখা হয়ে সত্যি খুব ভালো লাগছে স্যার। সকালে এক প্যাকেট জ্যুস কিনেছিলাম। আপনাকে এক গ্লাস দেবো?”
আমি মাথা নেড়ে বলি, “অরেঞ্জ হলে দাও। তবে আগে বসো। তোমাকে এভাবে কাকতালীয় ভাবে পেয়ে যাবো তা আশা করিনি একেবারেই। তোমার বউ দেখতে খুব সুন্দরী ছিলো। এত সুন্দর মেয়ে মেরে ফেললা?”
রইস জুসের গ্লাস হাতে দিয়ে বললো, “স্যার জুসটা আঙ্গুরের। খুব ভালো জিনিস। ভালো না লাগলে আমার মুখে বমি করে দিয়েন”।
আমি জুসের কাপে চুমুক দিলাম। বাহিরে একটা এম্বুলেন্সের তীব্র আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। রইস খুব ঘামছে। সে খুব উত্তেজিত আমি বুঝতে পারছি। তাকে নিজ থেকেই বললাম, “ কেউ কিছু জানেনা। তুমি নিশ্চিন্তে আমার সাথে কথা বলতে পারো”।
রইস হেসে বললো, “আমি আসলে বুঝতেছিনা স্যার আপনি কি চাচ্ছেন। একটু কনফিউশানে পড়ে গেছি। বাদ দেন। আমার বউ কিন্তু স্যার খুব খারাপ মাগী ছিলো। বাচ্চাটা আমার না। আমি ওরে প্রেম করে বিয়ে করে নিয়ে আসছিলাম। সোনা দানা বহুত দিছি। মাগী একদিন খাইলো ধরা। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের এক রাতে বাসায় এসে দেখি নিচতলার মেসের এক ছেলে ড্রইংরুমে বসে আছে। ছেলে আমারে দেখে কেমন জানি আকুপাকু করে। আমি আপনার ভাবীরে কিছু বলিনাই। এরপর একদিন খাইলো রাম ধরা। আমি অফিস যাওয়ার কথা বইলা বাড়ির পাশের গলিতে লুকায় ছিলাম। একটু পর দেখি মাগীর ঘরে ওই বেজন্মাটা ঢুকছে। বুঝেনই তো কি করে। আপনাগো মতই বেজন্মা একটা। মনে এতো ব্যাথা পাইছিলাম স্যার”।
আমি জুসের খালি গ্লাসটা টেবিলে রেখে রইসের দিকে তাকিয়ে চুকচুক করলাম। ওকে বললাম, “তোমার ছেলের নাম কি রাখছো রইস?”
রইসের চোখে মুখে আমি পিতৃত্বের মায়াস্পর্শ দেখলাম। সে বললো, “ওর দাদার নামে রাখছি।ইব্রাহীম শেখ। নামের মধ্যে একটা জমিদারী গন্ধ আছেনা স্যার? আমাদের এক নবীজিও ছিলেন এই নামে?”
আমি হাসি। রইসকে বলি, “আমি আজকে উঠি।কাল পরশু একবার আসবো। দেখা করে যাবো। তোমার সাথে হয়তো একদিন একটা খুন করতেও যাবো। আজকাল রক্ত নিয়ে খেলতে খুব ইচ্ছা করে। রক্তের গন্ধ খুব মিষ্টি তাই না?”
রইস এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমাকে বলে, “তোরে তো আমি যাইতে দিবোনা। ভাব চুদাইতে আসছোস। চুপ কইর‍্যা বইসা থাক”।
আমি হেসে বলি, “আমার তোমার গল্পগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগে। আমি নিয়মিত এসে তোমার গল্প শুনবো। কোন ঝামেলা করবোনা। হয়তো একটা বন্ধুত্ব হয়ে যাবে। কি বলো?”
রইস ভাবছে। ও এখন একটা ধাধার মধ্যে পড়ে গেছে। সে ভাবছে কি করবে। কিছু বলছেনা। আমি ওর কাধে হাত দিয়ে বলি, “তুমি ভান করো তুমি অনেক সাহসী। ব্যাপারটা কিন্তু এমন না। তুমি অনেক ভীতু। তুমি একজন ব্যর্থ মানুষ। তোমাদের মত মানুষরা সবাইকে ব্যর্থ দেখতে চায়। কাউকে সুখী দেখলে, সফল দেখলে তারা উন্মাদ হয়ে পড়ে। আমি কিন্তু সুখী ছিলাম না। ব্যর্থ ছিলাম। আমি তোমার মতই একজন ছিলাম। বুঝতে পেরেছো?”
রইসের মুখ খুব ঘেমে গেছে। সে আসলেও ভয় পেয়েছে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঠিক আমি না, আমার মাঝের পশুটা।ও জানে এই পশুটা ওকে আক্রমণ করবে। কিন্তু ঠিক কখন সেটা ওর জানা নেই। আমার ওকে নিয়ে এই খেলাটা খেলতে ভালো লাগছে।

বুধবার রাতে রাস্তা এতো ফাকা থাকবে আমার জানা ছিলোনা। এভাবে মাঝে মাঝেই রাস্তায় হাটতে বের হই। সারা রাত ঘুরে ফিরে খুব সকালে ফিরে আসি। ভালো লাগে। আজকে আমার সঙ্গী রইস। ওর সাথে প্রায় এক সপ্তাহ পর দেখা। ও আমাকে একটা পতিতালয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে ওর পছন্দের একটা মেয়ে থাকে। প্রায় রাতে যেয়ে সে তার সাথে দেখা করে। কিন্তু কোন ছোয়াছোয়ি খেলা হয়না। সে শুধুই গল্প করে। মেয়েটার নাম আমিনা। এটা অবশ্য সঠিক নাম না। কিছু কাস্টমার পুত পবিত্র নাম পছন্দ করে তাই তাকে এই নাম দেয়া হয়েছে। আমিনাকে দেখে আমি খানিকটা চমকে গেলাম। আমার ধারণা ছিলো পতিতালয়ের মেয়েরা খুব একটা সুশ্রী হয়না। আমার ধারণা সঠিক না। রইস আমাকে আমিনার সাথে দেখা করিয়ে বলে, “স্যারের সাথে আগে তো মনে হয় তোমার দেখা হয়নাই বেগম। সে একজন অতি শিক্ষিত ভদ্র সুশীল ব্যক্তি। তুমি চাইলে আমি তার সাথে তোমাকে রাত কাটানোর অনুমতি দিতে পারি”।
আমিনা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায় থাকে। তারপর নির্লিপ্ত ভাবে বলে, “আপনার পায়ে কি হইছে। ঠিকমত হাটতে পারেন না ক্যান?”
আমি হেসে রইসের দিকে তাকায় বলি, “কুত্তা কামড় দিয়েছিলো তাই না রইস?”
রইস হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলে, “স্যার আমার মতই রহস্যময় মানুষ।তাকে বুঝতে পারতেছিনা। তাই পাশে নিয়া ঘুরতেছি। তুমি উনাকে পায়ে ধরে সালাম দেও”।
আমিনা আমাকে সালাম দিলো না। অন্যদিকে তাকায় বললো, “আজকে কি আপনে আসবেন ভেতরে না আপনার স্যাররে তুষ্ট করতে হইবো?”
আমি রইসকে ইশারায় ভেতরে যেতে বলে পাশের একটা নোংরা দোকানে বসে সস্তামানের সিগারেট ধরাই। দোকানের ভেতরে একটা ১৩ বছরের ছেলে রুপা গেঞ্জী গায়ে দিয়ে বসে আছে। একটু পরপর সে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করলো, “চা খাবেন?”
আমি মাথা নাড়লে সে একটু কাছে বসে বললো, “ভালো কিছু নতুন মাইয়া আসছে। আমি দেখায় দিলে কিছু বখশিস দিয়েন”।
আমি ওর হাতে ৫০ টাকার একটা নতুন কচকচে নোট দিয়ে বললাম,”আজকে শরীরটা ভালো না। অন্য আরেকদিন আসবো। তখন দেখায় দিও”।
ছেলেটা চলে গেলো। একটু পর আবার এসে বললো, “কিছু ভালো হিজড়া আছে। ডাইক্যা দিমু?”
আমি হাসি। এই হাসির অর্থ হ্যা অথবা না যেকোন একটা হতে পারে। ছেলেটা বুঝতে পারছেনা কি করবে। সে আবার তার চা বানানোর কাজে মন দিলো।

রইস দুই ঘন্টা পরে আমার কাছে আসলো। এসে বললো, “স্যার একটা কথা জিজ্ঞাসা করি”।
আমি বলি, “করো”।
রইস হাটে। আমিও রাস্তা ধরে হাটছি। সে ইতস্তত বোধ করছে কোন কারণে। আমাকে হাত মুচড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি আমার কাছে কি চাইতেছেন?”
আমি রইসের কাধে হাত দিয়ে বলি, “কিছু না। ভয় পাওয়ার কিছু নাই তোমার। আমি ল্যাংড়া মানুষ, অনেক কষ্টে হাটতে হয়। চোখ একটা প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে। নিজে তোমার কিছু করতে পারবোনা, অন্য কাউকেও কিছু করতে দিবোনা।আমার থেকে তোমার কি বিপদ হবে বলো?”
রইস একটা সস্তা সিগারেট ধরায়। এটার গন্ধ আমার সহ্য হয়না। আমি ভদ্রতা করে তাকে কিছু বলিনা। সে বাতাসে ধোয়া ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে বলে, “ছোটকালে বাপ মা বলতো খারাপ সংগে না যাইতে। বলতো আমি খারাপ হইয়া যাবো। আমি বাবা মার কথা শুনছি, মান্য করছি। কিন্তু আজকে আমি কিন্তু অনেক খারাপ মানুষ তাই না?”
আমি রাস্তার পাশের আইলে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আকাশটা একদম কালো হয়ে আছে। আমার কালো আকাশ ভালো লাগেনা। রইসের দিকে তাকিয়ে বলি, “খারাপ ভালো আপেক্ষিক ব্যাপার। কারো চোখে তুমি খারাপ হইতেই পারো, কারো চোখে অনেক ভালো মানুষ”।
রইস খেক খেক করে হাসে এবং কাশে। তার চোখে আলো ঝিলমিল করছে। আমাকে বলে, “ভালো বলছেন অন্তু সাহেব। আপনারা জ্ঞানী গুণী মানুষ, আপনারা সবসময়েই ভালো কথা বলেন।তবে আমি কিন্তু জানি আপনে কেন আমারে পুলিশে ধরায় দেন নাই। আপনে আমার কাছে জানতে চান কিছু তাই না?”
আমি মাথা নাড়ি। তাকে বলি, “জগত সংসার ভালো লাগেনা। সব ছন্নছাড়া লাগে। আমার ভেতরে একটা জন্তু বাস করে এখন বুঝলা। ঘুমায় ছিলো। তুমি জাগিয়ে দিয়েছো। তোমাকে ধন্যবাদ”।
রইস আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমাকে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর বলে, “আমার ছেলেটা কই? খানকির পোলা আমার ছেলেরে গ্রাম থিকা কিডন্যাপ করছোস?”
আমি হাসি। তাকে বলি, “ রইস একটা ব্যাপার খেয়াল করোনি হয়তো। আমি কিন্তু মোটামুটি বেশ ধনী মানুষ। তোমার সব খোজ নিতে আমার খুব একটা তাই কষ্ট হয়নি। আমার মালিবাগের ফ্ল্যাটে চলো। তোমার ছেলে সেখান যত্নে আছে। রাত বেশি হয় নাই। দেখো একটা সিএনজি ভাড়া করতে পারো কিনা”।
রইসকে নিয়ে আমি যখন আমার ফ্ল্যাটে পৌছালাম তখন রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। রইস রাগে হিসহিস করছে। সে আমার রক্ত চায়। আর আমি তাকে নিয়ে খেলতে চাই। তাকে বাসায় এনে ড্রইংরুমে চেয়ার টেনে বসতে দেই। বলি, “ক্ষুধা লাগছে তাই না? কিছু খাবে?”
রইস শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে বলে, “ছেলেটারে দিয়া দেন। নিয়া যাই। এরপর আমি আপনারে চিনিনা, আপনেও আমারে চিনেন না”।
আমি ফ্রিজ থেকে তরকারী বের করে ওর সামনে রেখে বললাম, “গোশত আছে ভালো। কালকে রাতেই রান্না করছি। সাথে গরম ভাত। সালাদ কেটে দিচ্ছি। বুঝলা প্রায় দুই বছর ফ্ল্যাটে আসিনাই। কালকে এসে দেখি দারোয়ান তার পরিবার নিয়ে আমার এখানে বাস করা শুরু করছে। আমি পাছায় লাথি দিয়েছি দারোয়ানের। ওর বউ খুবই শরমিন্দা হয়ে আমাকে বলে, ফ্ল্যাটটা তারা ছেড়ে দিচ্ছিলো, গরম পানির নাকি সমস্যা”।
রইস হঠাৎ করে সামনে এসে আমার গলা টিপে বলে, “ওই ল্যাংড়ার পুত আমার পোলারে আন, তোর গরম পানি পিছে দিয়া ভরমু”।
আমি ওর হাতটা সরাই। ওকে শান্ত হতে বলি। আমার খুব হাসি পাচ্ছে। রইসের যন্ত্রণা দেখতে ভালো লাগছে। ওকে বলি, “রইস ভাত খাও। তোমার ছেলেকে আমার দরকার নাই ভাই। আমি ওকে দিয়ে দিবো। ও আমার কাছেই আছে। ভাত খেয়ে ছেলেকে নিয়ে চলে যাও। রাগ করলে বা আমাকে মেরে ফেললে ছেলেকে আর পাবেনা। সেটা কি আর ঠিক হবে?”
রইস চিৎকার করে ওর ছেলেকে ডাকে, এই ঘর ওই ঘর দৌড়িয়ে বেড়ায়। আমি ওভেনে ভাত তরকারী গরম করি। রইস ঘর্মাক্ত শরীরে আমার সামনে এসে বলে, “ভাত দে। ভাত খামু”।
আমি ওকে হাতে ধরে আবার চেয়ারে বসিয়ে নিজেই ভাত বেড়ে খেতে দেই। রইস সালাদ চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।গোশতের তরকারী তার পছন্দ হয়নাই। আমি ওকে তবুও চার পিস গোশত দিয়ে বললাম, “রইস তরকারীটা ভারত থেকে আনা মশলা দিয়ে রান্না করেছি। আহমেদাবাদের বিরিয়ানীর মশলার গন্ধ পাবে। পেট ভরে খাও”।
রইস চুপ করে খেয়ে এসে আমার পাশে বসে বললো, “কই?”
আমি ওর পাশের চেয়ারে বসে বলি, “ছেলের পেটের মাংশ কিছু তো তুমি খেয়ে ফেলছো। আমি কিছু খেয়েছি আগেই। পুরা ছেলে দিতে পারবোনা। চলবে?”
রইস তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। আমিও তাকিয়ে থাকি। ও খেয়াল করার আগেই আমি ওর মাথায় প্রচন্ড জোরে সামনে থাকা কাচের জগটা দিয়ে বাড়ি মারি। কিছু বুঝে উঠার আগেই কাটা গাছের মত সে ঝপ করে পড়ে গেলো। রইস কি জানে আজকে ওর সাথে আমার শেষ খেলা?
রইসকে খুব তাড়াতাড়ি আমি একটা চেয়ারের সাথে বেধে ফেলি। ওর কপাল চুইয়ে এখনো রক্ত পড়ছে। আমার বেডরুমে ব্যান্ডেজ আছে। লাগাতে ইচ্ছা করছেনা। কি দরকার।
ওর জ্ঞান ফিরলো পাক্কা একঘন্টা পর। আমার দিকে সে তাকাতে পারছেনা। আমি ওর পাশে বসে চুরুট টানছি। ও ইশারা দেয় ওকে একটা চুরুট দেয়ার জন্য। আমি কিছুক্ষণ ভেবে ওর ঠোটে একটা চুরুট গুজে দেই। ওর হাত বাধা। এতে মনে হয় ওর কোন যায় আসেনা। একটু পর ওকে বলি, “মাথাটা ভার লাগছে রইস?”
ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখে কোন অনুভূতি নাই। মিনমিন করে শুধু বললো, “রান্নাটা ভালো হয়নাই অন্তু সাহেব”।
আমি ওর কথায় সায় দেই। ওকে বলি, “রইস ছেলেটা তো তোমার না। ওর প্রতি তোমার মত জানোয়ারের এত মায়া কেন? তোমার এই দুর্বলতা বুঝতে আমার বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে। যাকে মায়া করো তাকে নিয়ে কষ্ট দিলে খুব খারাপ লাগে তাই না?”
রইস নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি আবার হেসে বললাম, “আমি কিন্তু ঘটনা জানি। ছেলেটা তোমার সাথে যেই মহিলার বিয়ে হয়েছিলো তার আগের ঘরের। তুমি নিজে নপুংশক। ছেলেটার যৌনাংগ তুমি কেটে দিয়েছিলে যেন ও বড় হয়ে ঠিক তোমার মত একজন হতে পারে, তাই না? ঠিক তোমার মত বৃহন্নলা!”
রইস আমার মুখে থুতু দেয়।আমাকে চিৎকার করে বলে, “তুই একটা শূয়োরের বাচ্চা। তুই একটা জারজ”।
আমি বেসিন থেকে মুখ ধুয়ে এসে আবার ওর পাশে বসে বলি, “থুতু মেরোনা রইস। আমি এরপর এমন করলে তোমার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো। আজকে তোমার আর আমার অনেক গল্প হবে। বেশ না?”
রইস চোখ নামিয়ে রাখে। আমাকে বলে, “আমি এইসব ডরাই না। আমি তোর মত সাদা কুত্তার বাচ্চা না। আমার কোন ভয় নাই”।
আমি রইসের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হাসলাম। ওকে বললাম, “রইস আমি তোমার গ্রাম আলোকদীতে গিয়েছিলাম। তোমার সাথে সেদিন দেখা হওয়ার দুদিন পরেই গিয়েছিলাম। তোমার মা খুব ভালো মানুষ। আমাকে বেশ খাতির যত্ন করেছে। আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে সব জানি। খুব ছোটকালে তোমার চাচা তোমার জিনিস কেটে দিয়েছিলো,তাই না?তারপর তোমার বাপকেও ইটের ভাটায় তোমার সামনে পুড়িয়ে মেরেছিলো। কেমন লেগেছিলো তোমার?”
রইস এখন শান্ত হয়ে বসে আছে। কিন্তু ওর ভেতরটা অনেক ছটফট করছ। আমি ওকে আবার বলি, “তোমাকে যদি এখন আশুলিয়ায় নিয়ে একটা জ্বলন্ত ভাটার মাঝে রেখে আসি কেমন হবে? মনে আছে তোমার বাবার পোড়া মাংশের গন্ধটা কেমন ছিলো?মনে নাই?”
রইসের মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। আমাকে গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললো, “তোর বউরে কেন মারছি জানিস? তোর বউরে যে আমি আদর কইর‍্যা তিতির ডাকতাম জানোস?”
আমি আগ্রহ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর চুরুটটা অনেক আগে নিভে গেছে। আমি ওর পাশে বসে আবার চুরুটটা জ্বালিয়ে দেই। ওকে বলি, “আমি শুনছি। বলতে থাকো”।
রইস হিংস্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোর বউ আমার প্রেমিকা ছিলো বুঝছোস। একসাথে আমরা থিয়েটার করতাম। একদিন ওরে প্রস্তাব দিলাম। কবিতা শুনাইলাম। কার কবিতা জানোস? কুত্তার বাচ্চা! দুরান্তে দেইলি আলগিয়েরির নাম শুনছোস। তোদের মত অল্প জানা কুত্তারা ওরে ডাকে দান্তে। আমি দান্তের কবিতা ধার কইর‍্যা ওরে চিঠি লিখছি দুইরাত ভাইব্যা, মন উজাড় কইরা শুনাইছি। আমারে কইলো এফেয়ার আছে। স্যরি। গুষ্টি মারি আমি তোর স্যরির।সব বেশ্যা। ওর কোন চাচাতো ভাইয়ের সাথে এফেয়ার ছিলোনা? আর বিয়া করলো কারে? তোরে।ক্যান? পয়সা আছে তোর। ভালো চাকরী করোস। তোর বউ যে কত হারামী ছিলো, জানোস?আমি কতবার ওর নাভীতে হাত দিছি জানোস?”
আমি ড্রিল মেশিন দিয়ে ওর গালে একটা ছোট্ট ফুটো করি। মিতিকে নিয়ে এমন নোংরা কথা শুনে আমার রাগ হচ্ছিলো। তবে কাজটা করতে আমার কষ্ট হয়েছে। হাজার হোক, মানুষের চামড়া। মানুষের রক্ত। ও গোঙ্গাচ্ছে। এর মধ্যে ফজরের আযান দিয়ে দিয়েছে। তারপর ওর পাশে বসে অপেক্ষা করি। একটু পর বলি, “রইস তুমি ঢাকায় এসে অনেকগুলো থিয়েটারে কাজ করেছো আমি জানি। তোমার ব্যাপারে যতটুকু জেনেছি তুমি খুব ব্যর্থ থিয়েটারকর্মী ছিলে। খুব বেশিদিন কোথাও টিকতেনা। কিন্তু এটা তো তোমার শুধু শখ ছিলো। আমার ভুল না হলে তুমি রসায়নে একটা মাস্টার্স করেছিলে। বিষয় ছিলো ভৌত রসায়ন। তোমার একটা পেপার ছিলো প্রোটিন ড্রপলেট নিয়ে। বেসরকারী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছিলে। সব ছেড়ে পরে একটা স্কুলে চাকরী নিলে।কেন?”
রইস মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে লালার মত। শরীর থেকে রক্ত অনেকটা ঝড়ে গেছে। আমি ওর মুখে লাথি দিয়ে বললাম, “কথা বলো বাবু। কথা তোমাকে বলতেই হবে”।
রইস আমার দিকে ঘাড় বাকিয়ে তাকিয়ে বললো, “আমার নাম আনোয়ার পাশা। এইটা তো জানো তাই না?আমি তোমাদের মত ছিলাম, কিন্তু তোমাদের সমাজ আমাকে মেনে নেয়নাই। দুইটা বিয়ে করছিলাম। বিয়ের রাতে আমার সমস্যা জেনে দুইজনই পালায় গেলো। আমার সবসময় অন্য মানুষ হতে ইচ্ছা করতো।সাধারণ তোমাদের মত মানুষ। তোমাদের মত কাউকে ভালোবাসতে, হাত ধরে মনের কথা বলতে ইচ্ছা করতো। একসময় থিয়েটারের দিকে ঝুকলাম। তোমাদের মত সাধারণ মানুষের চরিত্রে মিশে যেতাম। নিজেকে তোমাদের মত স্বাভাবিক মানুষ বানায় অভিনয় করতে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু আমাকে থিয়েটারের লোকজন বলতো, হবেনা আমাকে দিয়ে। অভিনয় ভালো হয়না।ভুয়া কথা, বাজে কথা। আমারে কেউ চিনতেই পারলোনা। ঠিক করে বলো তো অন্তু মিয়া আমি কি ভালো অভিনয় করিনা? একদম চরিত্রের সাথে মিশে যাই না?তোমার বউরে আমি সত্যি খুব চাইতাম। আমাকে ও ধোকা দিলো। এতো ভালোবাসলাম, কিন্তু গোনায় ধরলোনা। মনটা খুব খারাপ লাগছিলো। তোমাদের দূর থেকে দেখতাম। ইচ্ছা করতো প্রতিদিন তোমার শরীরটা পিস পিস করে কাটি। তোমার বউরে মারার আগে ১৬টা খুন করছি। প্রথম খুন করছি আমার তৃতীয় বউকে। সে আমার সমস্যা জাইনাও অনেক দিন টিক্কা গেছিলো। মেয়ে ভালো ছিলো, কিন্তু একদিন দেখি ওর পুরান জামাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলতেছে। আমার প্রেম তার ভালো লাগেনা। শরীরের টান ধরছে। পুরান জামাইরে লাগবো। ধরে আট পিস করছি। কি শান্তি! আমার বেস্ট ওয়ার্ক। গর্ব করে বলার মত। তোমাকেও বলছিলাম, ভুলে হিন্ট দিয়া দিছি। ওখান থেকেই আমাকে খুজে পাইছো তাই না? একটু flaw হয়ে গেছে। আমি তো জানতাম না তুমি বারান্দা থেকে লাফ মারবা, আবার বাইচ্যাও যাবা। যাই হোক, কসম খোদার এর পরের বার আর এমন হবেনা”।
আমি আনোয়ার পাশার দিকে তাকিয়ে থাকি। লোকটা প্রচন্ড অসুস্থ। ওকে দেখলে কে বলবে এই সুস্থ সরল চেহারার লোকটা এমন একটা ভয়ংকর জানোয়ারকে ভিতরে নিয়ে আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে বললো “অন্তু আমি ভালো অভিনয় করি, ঠিক কি না? যখন যেমন ইচ্ছা তেমন মানুষ হয়ে যাইতে পারি। ঠিক করে বলো, তোমাকে প্রথমদিন যা যা বলছিলাম তুমি একদম বিশ্বাস করছিলা না? পারবা আমার মত নানান চরিত্র হইয়া ঘুরে বেড়াইতে? নিজেই নিজের আত্নার শান্তির ব্যবস্থা করতে?”
আমি ওর সামনে থেকে উঠে চলে যাই। আবীরকে ফোন দিয়ে পুলিশ নিয়ে আসতে বলি। আমার এখন ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে সময়টাও অনেক ক্লান্ত। লোকটা অর্ধমৃত হয়ে আছে। পুলিশ আসার আগে তার বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে চুক চুক করি। একটা শেষ কাজ বাকি আছে। রইস আমার দিকে তাকিয়ে হাপাচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে তার আরেকটু কাছে এগিয়ে যাই।
পরেরদিন অনেকগুলো নিউজপেপারে আনোয়ার পাশা ওরফে রইসকে নিয়ে খবর বের হলো। তাতে আকর্ষণীয় একটা অংশ পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে দেয়া হলোঃ

আনোয়ার পাশা তার প্রতিবেশীদের নিকট খুবই নির্ঝঞ্জাট মানুষ ছিলেন। তার বলা উদ্ধৃতি থেকে জানা গেছে, সে আজ পর্যন্ত ১৬টি খুন করেছে। সবাই নারী ছিলো, এবং সবগুলো খুনই অত্যন্ত বিভৎস ও অমানবিক। গোপন সূত্র থেকে খবর পেয়ে তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকেও গতকাল রাতে ফকিরাপুল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ছেলেটি মানসিক এবং দৈহিক বৈকল্যের শিকার। আনোয়ার পাশা কেন এভাবে একের পর এক খুন করেছে তা জানা যায়নি। ধারণা করা যায়, সে মানসিকভাবে সুস্থ ছিলোনা। তাকে গতকাল ভোর সাতটায় মালিবাগের এক ফ্ল্যাট থেকে অভিযান চালিয়ে আহত অবস্থায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তার ডান পা আঘাতপ্রাপ্ত ছিলো এবং মুখ থেকে জিহবা ছিড়ে ফেলা হয়েছিলো। ফ্ল্যাটের মালিক ওয়াসফির হাসিফ এসময় বাসার বাহিরে ছিলেন। ভোরবেলা চাচার বাসা থেকে ফেরার সময় ফ্ল্যাটের ভেতর চিৎকার শুনে উনি মালিবাগ থানায় ফোন করেন। পুলিশ আনোয়ার পাশাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সে পুলিশকে বলে, সে একজন মানবাধিকার কর্মী। মানব অধিকার সমুহত রাখাই তার জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।


আমি পেপারটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকি প্রিয় বারান্দায়। হঠাৎ করে একদিন আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো, হঠাৎ করে আমার এমন অদ্ভূত এক পশুর সাথে সাক্ষাত হয়েছিলো। আচ্ছা মানুষ ও পশুর মধ্যে আমরা যে দাগ কেটে পার্থক্য করি তা কতটা যৌক্তিক? আনোয়ার পাশা নানান চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে তুষ্ট রাখতো, বেঁচে থাকতে চাইতো। কিছু চরিত্রে সে পশুর মতই অমানবিক ছিলো। এতে তার কোন গ্লানি ছিলোনা, আত্নদহন ছিলোনা। সে সুখী ছিলো, সমাজের চোখেও অতিসজ্জন ব্যক্তি।এমন বহুরূপী কেউ যখন হঠাৎ করে আমার মত নয়টা পাচটা অফিস করা অসুখী মানুষের ভান ধরে বেঁচে থাকা কারো জীবনে দেখা দেয়, তখন সাধারণ মানুষটা কি আর সাধারণ থেকে যায়? আমি আনোয়ার পাশাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সে হয়তো আমার মত জীবন পেলে এমন পশু হয়ে যেতোনা। আর আমি তার মত কদর্য সময়ের স্পর্শ পেলে হয়তো, এমন একজনই হয়ে যেতাম। আমরা তাকে অসুস্থ মানসিক ভাবে পঙ্গু বলে মেনে নিয়েছি, অথচ এমনটাও কি হতে পারে সে আমাদের মতই শুধু সুখ খুজে বেড়াতো? আমাদের সুখের জায়গাটা তার থেকে ভিন্ন ছিলো, সমাজ ব্যবস্থায় স্বীকৃত ছিলো। তাই দিনের শেষে আমরা সুস্থ সাধারণ, আর সে শুধুই একজন পশু।তাই না?

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:১২
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬

গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×