মীনা খালা ও তার হাউজ অব ইন্সপিরেশন –
টুংটাং রিকশার বেল বাজানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে ।শব্দটা বাড়ীর পূর্ব দিক থেকেই আসছে । পূর্ব দিকেই শহরের প্রধান সড়ক। আর এন রোড । যশোরের বিখ্যাত আর এন রোড । পূর্ব দিগন্ত হতে একটা আলো উজ্জল হয়ে ধীরে ধীরে রাস্তার পাশের দোতলা বাড়ীটিকে সকালের অপার্থিব সর্গীয় আলোয় ভরিয়ে তুললো । বাড়ীর দোতলার বারান্দায়,ছাদে নানা প্রজাতির টব eর ফুলগুলি যেন হেসে উঠলো । পাচিলের মধ্যে থাকা নারকেল গাছে বসে কয়েকটা কাক চিৎকারে সুপ্রভাত জানালো ।
সূর্য উঠার সাথে সাথে সারা রাতের ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলো বাড়ীটা।
তারপরে কলতলায় প্রানের স্পন্দন
রান্না ঘরে প্রানের স্পন্দন
ছেলেমেয়েদের ঘরে প্রানের স্পন্দন - -- - -- - --- - । পুরো মীনা হাউজে প্রানের স্পন্দন ।
সাধারনতঃ একটি মানুষের জীবনে অন্য কারো বা অন্য কিছুর প্রভাব থাকে । যেমন কারো চারিত্রিক প্রভাব অন্য মানুষকে পালটিয়ে দেয় । যেমন কোন প্রিয় শিক্ষক বা প্রিয় নেতার ছোয়ায় বা কোন তীর্থস্থান বা কোন জায়গার প্রভাবেও মানুষ আমুল পালটায় যায় । এ কথা বলার মানে হল এই যে আমার জীবনে ও এরকম একটি বাড়ী আমাদের সপ্ন দেখাতে সহায়তা করেছে। বাড়ীটার কোন নাম নেই। তাতে কি । নাম দেয়া যেতে পারে । ধরলাম বাড়ীটার নাম মীনা হাউজ় । আমার খালার নামে বাড়ীটার নাম দিলাম । মীনা হাউজে সব কিছু একটা নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে । ওই বাড়িটার ছেলেমেয়েগুলোও সেইরকম ডিসিপ্লিনড ! কি পড়াশুনা কি খাওয়া-দাওয়া-খেলাধুলা সবখানেই এক ধরনের সুশৃংখল ব্যবস্থাপনা ,কৃচ্ছতা ! কোন কিছুর কোন বাতুলতা নেই, কোন কিছুর অভাব যে আছে বাইরে থেকে তা বোঝার কোন উপায় নেই । সব ছকে বাধা । সকালে যার যার মত করে পড়ছে,উঠছে,খাচ্ছে ,স্কুল-কলেজে যাচ্ছে কোথাও কোন চিৎকার নেই,চেচামেচি নেই বা ছন্দপতন নেই। আসলে খালাই সব কিছু চালাচ্ছেন ।পুরো কন্ট্রোলারের ভুমিকায় রয়েছেন আমার মীনা খালা। খালা যে খুব বাজখাই টাইপ তাও না । নিরবে এক সম্মোহনী যাদুতে তিনি করিয়ে নিচ্ছেন সব ।
আমরা গ্রাম থেকে যখন ষান্মাসিক বা বাৎসরিক ভিত্তিতে যশোর শহরে বেড়াতে আসতাম তখন অন্য কোথাও না যেয়ে অবলীলায় নির্লজ্জের মত মীনাখালার স্কন্ধে চেপে বসতাম । আমাদের অন্য আত্মীয় থাকলেও আমরা মীনা খালাকে জালাতে সাচ্ছন্দ বোধ করতাম ।কারন তিনিই শুধু গ্রাম থেকে আসা এইসব শহুরে নিয়ম বিবর্জিত মানুষগুলোকে তার অসাধারন মমতায় আপন করে নিতেন । দারুন গল্প করতেও পারতেন । আর আমরাও মীনা হাউজে একধরনের সস্তি নিয়ে থাকতাম । সম্ভবতঃ আমার মা উনার কাছে ছেলেমেয়ে মানুষ করার দীক্ষা নিতে আসতেন । আমার মা, খুব করে ফলো করতেন খালাকে । মা তাই উদাহরন হিসাবে টেনে আনতেন খালার ছেলেমেয়েদের । ওরা কত ভাল, ওরা কত ভাল রেজাল্ট করছে। ওরা ক্যাডেট কলেজে পড়ছে আমাদের ও পড়তে হবে -- -- ---
খালার ছেলেমেয়েদের মত হওয়ার চাপ আমাদের মধ্যে ছিল । সেই চাপ নিয়ে গ্রাম-উপশহরে বড় হওয়া আমাদের ।
চাপের কারনে হোক আর যে কারনেই হোক আজ আমরা ক’ভাইবোন আল্লাহর ইচ্ছায় ভাল আছি। আর তাই মাঝে মাঝে মীনা খালা আর তার বাড়িটার কথা মনে পড়ে । খালার ছেলেমেয়েরা ও যার যার মত করে বড় হোয়েছেন,বিখ্যাত হয়েছেন ,ভাল আছেন ।মাঝে মধ্যে দেখা-যাতায়াত হয়। তারা হয়ত জানেন না যে তারা একসময় আমাদের আইডল ছিলেন । একসময় আমাদেরকে তাদের মত হওয়ার জন্য বলা হত ।
আজও মীনা খালা যশোরেই থাকেন সেই মীনা হাউজে। বাড়ীর গলিটা আগের মতই আছে ।ছোটবেলায় গলির মধ্যে একটা গন্ধ পেতাম যা আমি আজ ও পাই এই ৩২-৩৩ বছর পরেও ।