এক চিলতে রোদ বারান্দায় শুয়ে আছে । গাছের ছায়া নেচে নেচে ছবি আঁকছে সেখানে । কাক ডাকছে আশেপাশে কোথাও । ঝুন ঝুন করে রিক্সা যাচ্ছে ।চারিদিক কোলাহল । সবখানে জীবনের বড় বেশী উপস্থিতি
জানান দিচ্ছে ।শুধু ঘরটার মধ্যে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা আর বেদনার নানা চিত্র । দীর্ঘশ্বাসেরা সারা ঘরের মধ্যে আনাগোনা করছে
কেননা বিছানায় শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ ।
অথচ কিছুদিন আগেও তাকেও বৃদ্ধ বলা যেতনা । প্রৌঢ়ই মানানসই ছিল ।
মাত্র কয়েকদিন আগেও তিনি দেদারসে ঘুরে বেড়িয়েছেন ।
শহর, গ্রাম, ঢাকা - -সব খানেইতো একা একা বেড়িয়েছেন । পথে ঘাটে, জার্নিতে লোকজনের সাথে গল্প করেছেন । জমিয়ে খেলেছেন নাতি পুতিদের সাথে ।
অথচ ইদানিং তিনি অসুস্থ্য হয়ে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন ।তিন মাসেই শরীর আর শরীর নেই ,হাড্ডিসার ! একটা শীর্ন দেহ যা করুনা করে যেন প্রান বাঁচিয়ে রেখেছে ।
তার সৌম্য দর্শন চেহারাটা মাত্র ক’দিনেই আচেনা হয়ে গেছে । ক্রমশঃ বৃদ্ধতর হয়ে গেছেন তিনি ।
তিনি নিঃসাড় সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকেন । সারাদিন ।
উঠতে বসতে ভীষন কষ্ট হয় । একাও পারেন না ।
মাঝে মাঝে যন্ত্রনায় কুঁকড়ে গেলেও কাউকে কষ্টের কথা কিছু বলেন না পাছে তার জন্য অন্যরা কেউ কষ্ট পায়।
কষ্ট তিনি নিজের মধ্যেই চেপে রাখেন ।সারাজীবন যা তিনি করে এসেছেন ।
আবার দৃশ্যপট চেঞ্জ হয়ে যায় ।
আকাশটা অন্ধকার হয়ে আসে এবার । কোথা থেকে যেন রাশি রাশি মেঘ ভেসে আসছে ।
অযাচিত মেঘগুলো কাঁধে করে ভর সন্ধ্যা ডেকে এনেছে ।বাড়ির পাশের গাছ গুলোকে ধীরে ধীরে কালো ছায়ার মত লাগছে । পুকুরের জল স্থীর হয়ে আছে মাঝে মাঝে কিছু ঢেউ ছাড়া ।শিশুরাও যেনবা কোলাহল হটাৎ থামিয়ে দিয়েছে ।
মানুষটার দু নয়ন এবার সিলিং থেকে সরে এসে জানালার বাইরে স্থীর ।
কতই বা তার বয়স ।বাহাত্তর বা তিয়াত্তর ।
হাটাৎ নামা সন্ধ্যায় জানালার দিকে তাকিয়ে এবার তিনি মন খারাপ করেন শরীরের যন্ত্রনা আর আশংকায় ।
বড় যন্ত্রনা হল এই শুয়ে থাকা ।শুয়ে থেকে থেকে তার পিঠে তো ঘা হয়ে গেল ।তিনি ইদানিং পরনির্ভ্রর হয়ে পড়েছেন খুব । যা তিনি কোনকালেই ছিলেন না এতকাল সব কাজ একা করেই অভ্যস্ত তিনি ।
প্রয়োজনে অনেকদিন তিনি খুলনার বাসায় একা থেকেছেন, একা রান্না করেছেন ।
কোন সমস্যা হয়নি ।অথচ আজ তাকে সব কাজের জন্য সাহায্য নিতে হচ্ছে কারো । উঠতে , বসতে, খেতে -- সব কিছুতেই । এই পর মুখাপেক্ষীতা তার স্বভাব বিরুদ্ধ -
তার এই সত্তোরোর্ধ জীবনে তাকে আজ অসুখের কাছে আত্মসমর্পন করতে হচ্ছে । অথচ তার বড় ভাই কি চমৎকার গ্রামের বাড়িতে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন ।হিসাব মেলাতে কষ্ট হয় তার । সারাটি জীবন তিনি খুব ছঁকে ফেলে তিনি পার করছেন ।
চা না, সিগারেট না, পান তামাক কিছুনা
আড্ডা না , ইচ্ছৃংখলতা না , বেহিসাবী কিচ্ছু না উপরন্ত অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে পার করা তার জীবন ।
তারপরেও তার জীবনে কেন এই দুর্যোগ !
আল্লাহ কে তো নিয়মিতভাবে সেই ক্লাস সেভেন থেকেই নামাজের মাধ্যমে ডাকেন ।তার কাছে ফরিয়াদ করে আসছেন- আল্লাহ আমায় সুস্থ্য রেখো । সুস্থ্য রেখেই মৃত্যু দিও ।
জীবনে অবশ্য তার প্রাপ্তির অংশটা কম না । আলহামদুলিল্লাহ ।
সন্তানেরা তার মুখ উজ্জল করেছে ।নিজেও শুন্য থেকেই শহরে ঘরবাড়ি করেছেন , জমি করেছেন । সবখানেই প্রাপ্তির প্রশান্তি ।আর এর মধ্যে কিনা তার এই অসুস্থ্যতা ।
কি যে এক রোগ , একেবারে শেষ করে দিয়ে যাচ্ছে ! তিনি কি বাচঁবেন ? তার কি হয়েছে ? সে কথা সন্তানদের কাউকে জিজ্ঞাসা করতে মন চাইছে না ।উনার বিশ্বাস , যাই হোক তা সন্তানেরা ঠিকই চিকিৎসা করিয়ে ঠিক করে দেবে ।
তিনি বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে ভাবেন এসব কথা ।সবই তো ঠিক মতোই চলছিল । ঈদে পার্বনে ছেলেরা-বৌমারা আর তাদের ছেলেমেয়েরা বাড়ি আসছে ।তাদের বাড়ি ‘চাতক নীড়’ হাসি-খুশিতে- চিৎকারে গমগম করছে । পাড়া প্রতিবেশীরা বেশ সমীহ করছে আর কেমন একটা দৃষ্টি দিয়ে দেখছে -আহা ! কি সুখের সংসার ।
বলছে – আপনারা কত স্বআর্থক ।
বাচ্চারা দাদাভাই, নানাভাই করে বাড়িটাকে একটা উৎসবের মধ্যে ফেলে দেয় ।
ছেলেমেয়ে, বৌমা-জামাই ইত্যাদিদের সাথে একটা মধুর সম্পর্কের রেশ যখন সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে তখনই তার এই অসুস্থ্যতা । তার এই জটিল রোগের উত্থান মেনে নেয়া যায় ??
তার লিভারে সমস্যা কেন হবে ? কোনদিন জন্ডিজই হয়নি তার । তাহলে ?
তিনি কি আর সুস্থ্য হতে পারবেন না ???
জীবনে কি তিনি আর অপলক সকাল দেখতে পারবেন না ?
তিনি কি কোনদিন আর শিশিরে পা ভিঁজিয়ে হাঁটতে পারবেন না ?
তিনি কি নাতি-পুতিদের হাত ধরে গ্রামের পথে হাঁটতে পারবেন না ? তাদের কি গল্প শোনাতে পারবেন না ?
ছেলে-মেয়েদের বাড়ি আগমনে এক মিলিত খুশিতে আর কি মিলতে পারবেন না ?
মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে আর কি দেখা হবে না ? - - --
- - - - - -- --- - - - - - এমন হাজার প্রশ্ন খুঁজে ফেরেন তিনি - -- -- -- -,
এমন হাজার প্রশ্ন খুঁজে খুঁজে একদিন নিজেই হারিয়ে গেলেন আমার হাতের উপর দিয়েই ।
গত বছর এই রোজার মাসে আমার পিতা আমাদের ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছেন।
গত একটা বছর তাঁর জন্য এক ভয়াবহ শূন্যতা কুরে কুরে খেয়েছে আমাকে, আমাদের । প্রতিটা দিন ।
বাসায় প্রবেশ করে বা বাসায় ঘুরতে ফিরতে আহসান মঞ্জিলে দাঁড়িয়ে তাঁর তোলা ছবি দেখি আর বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে কান্নার ঝড়। এ ঘটনা প্রতিদিনের ।
আব্বার মৃত্যুটা সত্যি মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয়েছে , হচ্ছে ।
চিন্তাই করতে পারিনা তিনি নেই অথচ তাঁকে ছাড়াই আমাদের চলতে হচ্ছে, চালিয়ে নিতে হচ্ছে ।
কি রূঢ় বাস্তবতা , তাইনা ?
মৃত্যু মানে একজনের প্রস্থান । তাতে সবাই একটু থমকে দাঁড়িয়ে থেকে আবার ফিরে যায় জীবনের উৎসবে ।
এমনি করে -- একদিন আমরাও এভাবে -- -- -
( রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানিস ছাগিরা )