somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।। জলে জোৎস্নায় ।।

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের একটা জলাধার ছিল ।
ওটা ছিল আমাদের প্রানের জলাধার । জলাধারকে ঘিরে আমাদের বসতি গড়ে ওঠে আর জলাধারকে ঘিরে আমাদের জীবনের চাকা ঘুরত, আমাদের সবুজ স্বপ্নগুলো বাড়ন্ত অবয়ব পেত ।রাত্রির গভীরে ভীষন নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকত ঐ জলাধারে । একটা প্রানের প্রতিক হয়ে উঠেছিল ওটা ।

কত সুখ দুঃখের উপাখ্যান রচিত হয়েছে এই জলাধার কে ঘিরে ।

কেন, সেইযে তিতাস নামের আপুটা ঝাঁপ দিল সেই জলাধারে তা জানতে পারিনি । কি এমন দুঃখ পেয়েছিল সে যার জন্য তাকে এমন করে আত্মাহুতি দিতে হল । এখনও বুঝিনা কেন মানুষ এভাবে মরে যায় !

তিতাস তো সাঁতার ই জানতো না ।
তিতাসের মৃত্যু আমাদের কাঁদিয়েছিল ,সবাইকে কাঁদিয়েছিল ।পুরো জলাধারের সব বসতিদের কাঁদিয়েছিল । মানুষের কেন যে মরতে সাধ হয় তখনো বুঝিনি ।
এখনো বুঝিনা ।

আমি তিতাস আপুকে তিতাপু বলতাম । বড় বড় চোখ । হাসলে টোল পড়ত দু’ গালেই । আমার সাথে দেখা হলেই আমার মাথা এলোমেলো করে আমায় রাগাতো । আমি কি আর রাগতাম ! সুপ্ত শিহরণে তিতাপুর বড় চোখের মধ্যে হারিয়ে যেতাম । সেতো আর বুঝতে পারতো না ।বুঝতে না পারার এটাই মজা । আমি কি ভাবছি তা শুধুই আমি জানি ।

আমি জানতাম তিতাপুকে কয়েকজন পথে ঘাটে খুব জ্বালাতন করে । তারা বাড়ি পর্যন্ত এসে জ্বালায় ।বাড়ির পিছনে ওৎ পেতে থাকে ।
সারাক্ষন ওদের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে তিতাপু ।

বছর কয়েক আগেও তিতাপুকে কেউ লক্ষ্য করত না । যেদিন থেকে তিতাপু ওড়না পরে হাইস্কুলে যাওয়া শুরু করল সেদিন থেকেই তিতাপু ঐসব বখাটে ছেলেদের নজর কাড়ল । ওরাই এলাকায় মৎস্যন্যায় তৈরী করে রেখেছিল ।

ওরাই এলাকার মাস্তান !
সরকার দলীয় রাজনীতির ছায়াতলে থেকে এসব করে বেড়ায় । থানা পুলিশও ওদের বিরুদ্ধে কিছু করেনা । বরং ওদের অফিসে বসিয়ে চা খাওয়ায় । কারন ওদের নেতাদের মদদ পুষ্ট এইসব পুলিশ-মাস্তান সব । ক্ষমতা ওদের আজীবনের অধিকারের মত । সরকার বদল হলে ওদের চেহারা বদল হয় তখন অন্য আরেকদল এসে একই কাজ করতে থাকে । অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়না । আমরা শোষিত হব এটাই যেন নিয়তির বিধান । ওরা আমাদের সব নষ্ট করে । ওরা এ সমাজের কলুষিত মানুষ জেনেও কেউ ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেনা কেননা আমরা একতাবদ্ধ হতে পারিনা । আমরা একতাবদ্ধ না হতে পারার কারনে আজ বড় অসহায় !

এই তো কিছুদিন আগে পাড়ার এক চাচাকে বেদম মারল ওরা ।একজন বয়স্ক লোক। তাকে মারার কারন এই ছেলেরা রাস্তায় কোন মেয়ের ওড়না ধরে টান মেরেছে আর ঐ চাচা সেটা দেখে ফেলেছিল এবং গ্রাম্য শালিসে সেটা সে সবার সামনে বলেছিল ।এটাই ছিল তার অপরাধ । কিন্ত তার প্রতিবাদ সেদিন কেউ করিনি আমরা । সত্য কে না বলতে বলতে আমরাই মিথ্যার বেসাত নিয়ে স্বপ্ন দেখি । সেদিন কেউই বলিনি –তোমরা যা করছ এ অন্যায় !

সেদিন আমরা কিছুই বলিনি, কোন ক্রোধ তৈরী হয়নি আমাদের মধ্যে । নপুংশক দৃষ্টি ফেলে নিজের প্রানের মায়া করে যাই শুধু আর এই সুযোগে মাস্তান-সন্ত্রাসী তাদের সীমানা প্রাচীর পার হয়ে আমাদের সদর দরজায় হামলে পড়ে ।

যেমন পড়েছিল তিতাপুর সামনে ।

অথচ তিতাপু আমাদের মধ্যে কি একটা মায়া তৈরী করে রাখত সব সময় ।

কতদিন তিতাপুর সাথে আমি বা আমার মত কেউ কেউ একসাথে কাশফুল দেখতে নদীর পাড়ে গেছি । ধান ক্ষেতের আইল ধরে হেটে গেছি গহীন ফসলের সম্ভারে । কতদিন আকাশ ভেঙ্গে পড়া দিগন্তে যাব বলে পার হয়েছি লাঙ্গল চষা প্রান্তর । অনেকদিন সন্ধ্যায় জোনাকি ধরার জন্য আমরা বাগানে বাগানে ঘুরেছি ।

আমাদের এত প্রিয় সাহসী তিতাপুও ঐসব মাস্তানদের ভয় পেত খুউব ।

----- তিতাপু, ওদের এত ভয় পাও কেন ?

---- আমি যে এখন বড় হয়ে গেছি ।আমরা মেয়েরা হলাম হরিণের মত । নিজের শরীর নিজের কাছেই বড় শত্রু ।

এসব কথা আমি বুঝতাম না ।আর এসব বলে তিতাপু কেমন উদাস হয়ে যেত । সে উদাসীনতা আমার বুকের মধ্যে কষ্টের বিনুনী বুনত ।আমি ঘাড় সোজা করে তেজী ঘোড়ার মত বলতাম –
--- তিতাপু , দেখো বড় হয়ে ওদের আমি শাস্তি দেব ।

পরীর মত মেয়ে তিতাপুর চোখ সরোবরে জল উপচে পড়তে থাকে ,আমার মুখের দিকে কেমন স্বপ্ন ভরা চোখে তাকিয়েই থাকে যেন - ভাই আমার, তুই তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা।

এসব দেখে তখন আমার খুব কষ্ট হতে থাকে ।

তাই আমি বড় একজন মাস্তান হবার স্বপ্ন দেখতাম যাতে করে এইসব ছোটখাট মাস্তানদের মেরে এলাকা ছাড়া করতে পারি । তিতাপুকে যারা বিরক্ত করে যারা অপমান করে তাদের শাস্তি দেবার ইচ্ছা হত খুব । তিতাপুর এই অপমান ছোট্ট বুকে সইতে পারতাম না । বুকে বড় বিঁধত ।

আমার খুব মনে পড়ে । কোন একদিন আকাশে ছিল ভয়াবহ পূর্নিমা । আকাশ ভেঙ্গে জোৎস্নার বান ডেকেছে । চারিপাশ ভেসে যাচ্ছে রূপালী জোৎস্নায় । গাছের পাতায় জোৎস্নার ঝিলিক ।একবার তাকিয়ে থাকলে নেশা ধরে যায় ।তিতাপু এসে বলল-
----এই ,চলতো। জোৎস্নার গাঙ্গে গা ধুইয়ে আসি ।

আমাকে কে পায় ! অমন জোৎস্নায় পড়ায় কারো মন বসে ! দুজনে মিলে ছায়াময় ঝোপঝাড় পেরিয়ে খোলা মাঠে এসে দাড়ালাম । জোৎস্নার সাগর বলা যায় ।

তিতাপু বলল , চল বড় পুকুরটাতে নেমে পড়ি ।অর্থাৎ সেই জলাধারে ।

---সত্যি ,যাবে তুমি ?

----আরে চল ।দেখবি জলে জোৎস্নায় কি সুন্দর মাখামাখি ।

চুপি চুপি দুজন জলাধারের কাছে গিয়ে নির্বাক হয়ে যাই অনেকক্ষন । দুজন হা হয়ে গিলছি অপার বিশুদ্ধ জোৎস্নার রূপালী ধারা । জলে না নেমে বরং জোৎস্নায় স্নান সেরেছি দুজন ।তিতাপু তখনো কিশোরী । কারো নজর ওভাবে পড়েনি বলেই এই স্বাধীনতাটুকু সেদিন নিতে পেরেছিলাম । পরে অনেক জোৎস্না আর অনেক ইচ্ছা থাকলেও তিতাপু আর যায়নি । অথচ আমি কতদিন কত জোৎস্নায় তার পিছন ঘুর ঘুর করেছি ।যদি একবার যেতে বলে । না, আর যায়নি সে ।

ও হ্যাঁ , জোৎস্না দেখতে তারপর মাত্র একবারই গিয়েছিল সে । একাই গিয়েছিল নাকি কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তা বলা যায়না । কারন আইন এক কথা বলে আর সাক্ষ্য বলে অন্যকথা ।আর বিচারের রায় হয় অন্য আরেক রকমের ।

সেবার জোৎস্না রাতের সকালেই তিতাপুকে জলাধারের পানিতে উপুড় হয়ে ভাসতে দেখা যায় । তিতাপু জোৎস্না আর জলের সাথে মাখামাখি করতে পেরেছিল সত্য কিন্ত সে বড় প্রানহীন অবস্থায় ।
সেদিন তিতাপু প্রাকৃতিক ডাকে ঘরের বাইরে এলে একদল মানবরূপী পশু হিংস্রতা আর লোলুপতায় ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ে । তিতাপুকে ধরে নিয়ে সেই আকাশভাঙ্গা জোৎস্নায় তাকে জলাধারে ফেলে দেয় । আহা , বেচারী! জোৎস্না বড় ভালবাসত, জল বড় ভালবাসত ।আর সেখানেই তার স্থান হল ।

তিতাপু মরে গিয়ে আমায় মাস্তান হওয়া থেকে রক্ষা করলো কিন্ত ভিতু হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারল না । এখন গালের চোয়াল শক্ত আর পুরুষালী চেহারা নিয়েও আমি একেবারে সবার অধস্তনের মত হয়ে থাকি । সময় পেলে জলাধারটির পাশে বসি । ভাবি, কোথায় তিতাপুর প্রানহীন শরীরটা ভেসে ছিল । আমি আমার কান্না লুকিয়ে রাখি মেয়েলি স্বভাবের কারো মতন ।

তুমুল জোৎস্নায় বড় একা লাগে আমার । আমার ও খুব ইচ্ছা করে জলে জোৎস্নায় মিশে যেতে। তিতাপুর মত । জলাধারের পাশে বসে নপুংশকের মত এসব ক্লীব ভাবনা ভাবতে থাকি ।

জলে জোৎস্নায় /২১।০৯।১৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×