আমাদের একটা জলাধার ছিল ।
ওটা ছিল আমাদের প্রানের জলাধার । জলাধারকে ঘিরে আমাদের বসতি গড়ে ওঠে আর জলাধারকে ঘিরে আমাদের জীবনের চাকা ঘুরত, আমাদের সবুজ স্বপ্নগুলো বাড়ন্ত অবয়ব পেত ।রাত্রির গভীরে ভীষন নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকত ঐ জলাধারে । একটা প্রানের প্রতিক হয়ে উঠেছিল ওটা ।
কত সুখ দুঃখের উপাখ্যান রচিত হয়েছে এই জলাধার কে ঘিরে ।
কেন, সেইযে তিতাস নামের আপুটা ঝাঁপ দিল সেই জলাধারে তা জানতে পারিনি । কি এমন দুঃখ পেয়েছিল সে যার জন্য তাকে এমন করে আত্মাহুতি দিতে হল । এখনও বুঝিনা কেন মানুষ এভাবে মরে যায় !
তিতাস তো সাঁতার ই জানতো না ।
তিতাসের মৃত্যু আমাদের কাঁদিয়েছিল ,সবাইকে কাঁদিয়েছিল ।পুরো জলাধারের সব বসতিদের কাঁদিয়েছিল । মানুষের কেন যে মরতে সাধ হয় তখনো বুঝিনি ।
এখনো বুঝিনা ।
আমি তিতাস আপুকে তিতাপু বলতাম । বড় বড় চোখ । হাসলে টোল পড়ত দু’ গালেই । আমার সাথে দেখা হলেই আমার মাথা এলোমেলো করে আমায় রাগাতো । আমি কি আর রাগতাম ! সুপ্ত শিহরণে তিতাপুর বড় চোখের মধ্যে হারিয়ে যেতাম । সেতো আর বুঝতে পারতো না ।বুঝতে না পারার এটাই মজা । আমি কি ভাবছি তা শুধুই আমি জানি ।
আমি জানতাম তিতাপুকে কয়েকজন পথে ঘাটে খুব জ্বালাতন করে । তারা বাড়ি পর্যন্ত এসে জ্বালায় ।বাড়ির পিছনে ওৎ পেতে থাকে ।
সারাক্ষন ওদের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে তিতাপু ।
বছর কয়েক আগেও তিতাপুকে কেউ লক্ষ্য করত না । যেদিন থেকে তিতাপু ওড়না পরে হাইস্কুলে যাওয়া শুরু করল সেদিন থেকেই তিতাপু ঐসব বখাটে ছেলেদের নজর কাড়ল । ওরাই এলাকায় মৎস্যন্যায় তৈরী করে রেখেছিল ।
ওরাই এলাকার মাস্তান !
সরকার দলীয় রাজনীতির ছায়াতলে থেকে এসব করে বেড়ায় । থানা পুলিশও ওদের বিরুদ্ধে কিছু করেনা । বরং ওদের অফিসে বসিয়ে চা খাওয়ায় । কারন ওদের নেতাদের মদদ পুষ্ট এইসব পুলিশ-মাস্তান সব । ক্ষমতা ওদের আজীবনের অধিকারের মত । সরকার বদল হলে ওদের চেহারা বদল হয় তখন অন্য আরেকদল এসে একই কাজ করতে থাকে । অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়না । আমরা শোষিত হব এটাই যেন নিয়তির বিধান । ওরা আমাদের সব নষ্ট করে । ওরা এ সমাজের কলুষিত মানুষ জেনেও কেউ ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেনা কেননা আমরা একতাবদ্ধ হতে পারিনা । আমরা একতাবদ্ধ না হতে পারার কারনে আজ বড় অসহায় !
এই তো কিছুদিন আগে পাড়ার এক চাচাকে বেদম মারল ওরা ।একজন বয়স্ক লোক। তাকে মারার কারন এই ছেলেরা রাস্তায় কোন মেয়ের ওড়না ধরে টান মেরেছে আর ঐ চাচা সেটা দেখে ফেলেছিল এবং গ্রাম্য শালিসে সেটা সে সবার সামনে বলেছিল ।এটাই ছিল তার অপরাধ । কিন্ত তার প্রতিবাদ সেদিন কেউ করিনি আমরা । সত্য কে না বলতে বলতে আমরাই মিথ্যার বেসাত নিয়ে স্বপ্ন দেখি । সেদিন কেউই বলিনি –তোমরা যা করছ এ অন্যায় !
সেদিন আমরা কিছুই বলিনি, কোন ক্রোধ তৈরী হয়নি আমাদের মধ্যে । নপুংশক দৃষ্টি ফেলে নিজের প্রানের মায়া করে যাই শুধু আর এই সুযোগে মাস্তান-সন্ত্রাসী তাদের সীমানা প্রাচীর পার হয়ে আমাদের সদর দরজায় হামলে পড়ে ।
যেমন পড়েছিল তিতাপুর সামনে ।
অথচ তিতাপু আমাদের মধ্যে কি একটা মায়া তৈরী করে রাখত সব সময় ।
কতদিন তিতাপুর সাথে আমি বা আমার মত কেউ কেউ একসাথে কাশফুল দেখতে নদীর পাড়ে গেছি । ধান ক্ষেতের আইল ধরে হেটে গেছি গহীন ফসলের সম্ভারে । কতদিন আকাশ ভেঙ্গে পড়া দিগন্তে যাব বলে পার হয়েছি লাঙ্গল চষা প্রান্তর । অনেকদিন সন্ধ্যায় জোনাকি ধরার জন্য আমরা বাগানে বাগানে ঘুরেছি ।
আমাদের এত প্রিয় সাহসী তিতাপুও ঐসব মাস্তানদের ভয় পেত খুউব ।
----- তিতাপু, ওদের এত ভয় পাও কেন ?
---- আমি যে এখন বড় হয়ে গেছি ।আমরা মেয়েরা হলাম হরিণের মত । নিজের শরীর নিজের কাছেই বড় শত্রু ।
এসব কথা আমি বুঝতাম না ।আর এসব বলে তিতাপু কেমন উদাস হয়ে যেত । সে উদাসীনতা আমার বুকের মধ্যে কষ্টের বিনুনী বুনত ।আমি ঘাড় সোজা করে তেজী ঘোড়ার মত বলতাম –
--- তিতাপু , দেখো বড় হয়ে ওদের আমি শাস্তি দেব ।
পরীর মত মেয়ে তিতাপুর চোখ সরোবরে জল উপচে পড়তে থাকে ,আমার মুখের দিকে কেমন স্বপ্ন ভরা চোখে তাকিয়েই থাকে যেন - ভাই আমার, তুই তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা।
এসব দেখে তখন আমার খুব কষ্ট হতে থাকে ।
তাই আমি বড় একজন মাস্তান হবার স্বপ্ন দেখতাম যাতে করে এইসব ছোটখাট মাস্তানদের মেরে এলাকা ছাড়া করতে পারি । তিতাপুকে যারা বিরক্ত করে যারা অপমান করে তাদের শাস্তি দেবার ইচ্ছা হত খুব । তিতাপুর এই অপমান ছোট্ট বুকে সইতে পারতাম না । বুকে বড় বিঁধত ।
আমার খুব মনে পড়ে । কোন একদিন আকাশে ছিল ভয়াবহ পূর্নিমা । আকাশ ভেঙ্গে জোৎস্নার বান ডেকেছে । চারিপাশ ভেসে যাচ্ছে রূপালী জোৎস্নায় । গাছের পাতায় জোৎস্নার ঝিলিক ।একবার তাকিয়ে থাকলে নেশা ধরে যায় ।তিতাপু এসে বলল-
----এই ,চলতো। জোৎস্নার গাঙ্গে গা ধুইয়ে আসি ।
আমাকে কে পায় ! অমন জোৎস্নায় পড়ায় কারো মন বসে ! দুজনে মিলে ছায়াময় ঝোপঝাড় পেরিয়ে খোলা মাঠে এসে দাড়ালাম । জোৎস্নার সাগর বলা যায় ।
তিতাপু বলল , চল বড় পুকুরটাতে নেমে পড়ি ।অর্থাৎ সেই জলাধারে ।
---সত্যি ,যাবে তুমি ?
----আরে চল ।দেখবি জলে জোৎস্নায় কি সুন্দর মাখামাখি ।
চুপি চুপি দুজন জলাধারের কাছে গিয়ে নির্বাক হয়ে যাই অনেকক্ষন । দুজন হা হয়ে গিলছি অপার বিশুদ্ধ জোৎস্নার রূপালী ধারা । জলে না নেমে বরং জোৎস্নায় স্নান সেরেছি দুজন ।তিতাপু তখনো কিশোরী । কারো নজর ওভাবে পড়েনি বলেই এই স্বাধীনতাটুকু সেদিন নিতে পেরেছিলাম । পরে অনেক জোৎস্না আর অনেক ইচ্ছা থাকলেও তিতাপু আর যায়নি । অথচ আমি কতদিন কত জোৎস্নায় তার পিছন ঘুর ঘুর করেছি ।যদি একবার যেতে বলে । না, আর যায়নি সে ।
ও হ্যাঁ , জোৎস্না দেখতে তারপর মাত্র একবারই গিয়েছিল সে । একাই গিয়েছিল নাকি কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তা বলা যায়না । কারন আইন এক কথা বলে আর সাক্ষ্য বলে অন্যকথা ।আর বিচারের রায় হয় অন্য আরেক রকমের ।
সেবার জোৎস্না রাতের সকালেই তিতাপুকে জলাধারের পানিতে উপুড় হয়ে ভাসতে দেখা যায় । তিতাপু জোৎস্না আর জলের সাথে মাখামাখি করতে পেরেছিল সত্য কিন্ত সে বড় প্রানহীন অবস্থায় ।
সেদিন তিতাপু প্রাকৃতিক ডাকে ঘরের বাইরে এলে একদল মানবরূপী পশু হিংস্রতা আর লোলুপতায় ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ে । তিতাপুকে ধরে নিয়ে সেই আকাশভাঙ্গা জোৎস্নায় তাকে জলাধারে ফেলে দেয় । আহা , বেচারী! জোৎস্না বড় ভালবাসত, জল বড় ভালবাসত ।আর সেখানেই তার স্থান হল ।
তিতাপু মরে গিয়ে আমায় মাস্তান হওয়া থেকে রক্ষা করলো কিন্ত ভিতু হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারল না । এখন গালের চোয়াল শক্ত আর পুরুষালী চেহারা নিয়েও আমি একেবারে সবার অধস্তনের মত হয়ে থাকি । সময় পেলে জলাধারটির পাশে বসি । ভাবি, কোথায় তিতাপুর প্রানহীন শরীরটা ভেসে ছিল । আমি আমার কান্না লুকিয়ে রাখি মেয়েলি স্বভাবের কারো মতন ।
তুমুল জোৎস্নায় বড় একা লাগে আমার । আমার ও খুব ইচ্ছা করে জলে জোৎস্নায় মিশে যেতে। তিতাপুর মত । জলাধারের পাশে বসে নপুংশকের মত এসব ক্লীব ভাবনা ভাবতে থাকি ।
জলে জোৎস্নায় /২১।০৯।১৪