somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেসকোর্স, ৭ মার্চ ও একটি ইসলামী জলসার গল্প

২৬ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এডিট করার সময় এক রহস্যজনক কারণে পোস্টটি গায়েব হয়ে যাওয়ায় আরো তথ্যসংযুক্তিসহ আবারও পোস্টানো হলো

সাদামাটা খবরটা এরকম : ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে একটি বিশাল ইসলামী জলসার আয়োজন করা হয়। দেশে সামরিক শাসন বলবৎ থাকলেও ইসলামী জলসা মোটেও রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠান বলে বিবেচিত হয়নি। যদিও আয়োজকদের রাজনৈতিক পরিচিতি কয়েকবছর পর স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামাতে ইসলামীর সদস্য।

আগের বছর ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত দলটি নিষিদ্ধ ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে (ডিসেম্বর ১৯৭১) এক বিবৃতিতে মুসলিম লীগ, নেজাম ই ইসলামী ও জামাতে ইসলামীসহ সব ধরণের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয় যা সেদিন পর্যন্ত বলবত থাকে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা দখল করার পর এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। আর তার উত্তরসূরী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাদের অবাধ রাজনীতির সুযোগ দেন।


খবরের বিশেষ খবর : সীরাত মাহফিল নামের ওই ওয়াজ মাহফিলে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তৃতা করেছেন উপ-সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি (মোহাম্মদ গোলাম) তোয়াব। তার সংক্ষিপ্ত পরিচিত তুলে ধরা যাক। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে এখনও কিংবদন্তীর মর্যাদা পেয়ে থাকেন তিনি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরের মতো লড়েছেন, খেতাব পেয়েছেন। তার অনেক ছাত্র গুরুর মর্যাদা রেখেছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের আবেদন করা হলেও তোয়াব তা প্রত্যাখ্যান করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নিয়ে জার্মানি (তখনকার পশ্চিম জার্মানি) চলে যান তিনি, ইনস্ট্রাকটরের চাকুরি নেন ন্যাটোর এয়ারফোর্স স্কুলে। এর আগে অনেকগুলো কোর্সের সুবাদে এলাকাটা তার পরিচিত। বিয়ে করেন স্থানীয় মেয়ে হেনরিয়েটাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাকে দেশে উড়িয়ে আনা হয়। এ.কে খন্দকারকে সরিয়ে তাকে বিমান বাহিনী প্রধান করা হয় সরাসরি এয়ার ভাইস মার্শাল পদবী দিয়ে। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে তিনি উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন। উল্লেখ করা যেতে পারে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের সময় তোয়াব খালেদ মোশাররফের পক্ষে ছিলেন। তাকে ব্যাজ পড়িয়েছেন মেজর জেনারেলের যার ছবি পত্রিকায় এসেছে।



খবরের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খবর : যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর সভাপতিত্বে আয়োজিত এই জলসায় অতিথি হিসেবে ছিলেন পাকিস্তান ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতেরা। সভায় অভিযোগ করা হয় যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ইসলাম ও রসুল সম্পর্কে কোনো আলোচনা করা সম্ভবপর ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব ঘোষণা করেন যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘দায়িত্বভার’ আমাদের’। তার বক্তৃতার সময় শ্লোগান ওঠে- তোয়াব ভাই, তোয়াব ভাই, চাঁন-তারা পতাকা চাই। জলসার আয়োজকরা ৬ দফা দাবী পেশ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো দেশের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা, জাতীয় পতাকা পরিবর্তন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন, ইসলামী বিরোধী ও বেদাতি শহীদ মিনার ধ্বংস করা(ইত্তেফাক, ৮ মার্চ, ১৯৭৬)

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের পর রেডিওতে মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা দেন। খবরটি লুফে নেয় পাকিস্তান। আর জেদ্দায় আশ্রয় নেওয়া গোলাম আযম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে আবেদন জানায় ইসলামী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে। ১৬ আগস্ট সৌদি আরব সাবেক লেকচারার গোলামের অনুরোধ রাখে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, এই রেসকোর্সেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার মৃত্যুর পরের বছরই সেই একই দিনে ভয়ানক স্পর্ধায় লাখো রাজাকার-আলবদরের শো ডাউন ঘটায় জামাত। ১৯৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর যদিও স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে প্রথম সংবাদ সম্মেলনটি করে তারা। সেখানেও তারা দাবি তোলে একটি ইসলামী সংবিধান প্রণয়নের। এই কাজটা তারা আগেই করতে পারতো যদি তোয়াব তাদের আশাপূরণে সফল হতেন। কি সেই আশা? সে এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের গল্প।



খবরের ফলো-আপ : পরের মাসে অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ৩০ এপ্রিল বগুড়া সেনানিবাসে একটি অভ্যুত্থান ঘটে। ফার্স্ট বেঙ্গল ক্যাভালেরি ও ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারসের এই বিদ্রোহের নায়ক হয়ে আবির্ভূত হন কর্ণেল ফারুক রহমান! আগের বছর ৩ নভেম্বর জেল হত্যা ঘটিয়ে বিশেষ একটি বিমানে দেশ ছেড়েছিলেন ‘বিদ্রোহী ৬ মেজরের’ অন্যতম ফারুক (যদিও তার পদবী ছিলো কর্ণেল, কিন্তু মিডিয়ায় তিনি অবনমিত), চুক্তি হয়েছিলো তারা আর দেশে ফিরবেন না। অভিযোগ ওঠে তোয়াব গোপনে ফারুকসহ চারজনকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। আর তারাই নেতৃত্ব দেন এই সেনা বিদ্রোহের। বিদ্রোহীদের দাবী ছিলো বাংলাদেশকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা এবং ক্ষমতায় তাদেরও অন্তর্ভূক্তি।




সেনা প্রধান জিয়া কঠোরহাতেই এই বিদ্রোহ দমন করেন। যদিও ফারুককে মানাতে তার বাবা-মা ও বোন দেনদরবার করেন। তাদের মধ্যস্থতায় ঠিক হয় তার বিচার না করে তাকে দেশত্যাগ করতে দেওয়া হবে। যদিও পরে ফারুককে জিয়া কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়েছেন, এরশাদ দিয়েছেন ফ্রিডম পার্টির ব্যানারে রাজনীতি করার অধিকার। এই ঘটনায় তোয়াবের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ভেস্তে যায় একটি (জামাতে) ইসলামী বিপ্লবের ভয়াবহ নীলনকশা। ১৯৯৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মিউনিখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই নষ্ট বিপ্লবের জনক।

সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক ৮ মার্চ ১৯৭৬
বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলাদেশী, নির্বাচিত প্রবন্ধ (ডঃ আনিসুজ্জামান, পৃ. ১৪৯-১৫০)
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন
God willing: the politics of Islamism in Bangladesh ( By Ali Riaz)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:৩৯
৩৬টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভারত সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৫২



শেখ হাসিনা ভারতে বসে ষড়যন্ত্র-অপপ্রচার করছেন। ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশে একটি অশান্তি হোক। কারণ ভারত একটি মসনদ হারিয়েছে। সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে।

আওয়ামী লীগ প্রতিদিন একটি সোনার ডিম পেড়ে নরেন্দ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক রহমানের এখনই সময়।

লিখেছেন শাহিন-৯৯, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৮




দেশ এখন বেশ বহুমুখী চ্যালেন্জ মুখাবেলা করছে বিশেষ করে ভারতের মিডিয়াগুলোর সর্বদা মিথ্যচার বেশ অস্বস্থিকর অবস্থা তৈরি হচ্ছে।
বর্তমান সরকার অবশ্য বেশ শান্ত মেজাজে সব কিছু চমৎকারভাবে হ্যান্ডেল করছে তবুও জনপ্রতিনিধির... ...বাকিটুকু পড়ুন

পত্রিকায় শেখ মুজিবের শাসন-আমল ১৯৭২,১৯৭৪

লিখেছেন রাকু হাসান, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:০২



ইতিহাস বহমান নদীর মত। তাকে তার মত চলতে দেওয়াই শ্রেয়। সে নদীতে কেউ পূর্ণার্থে
স্নান কিংবা সে পানি পান করবে না ,সেটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার । যে বই,ইতিহাস উগ্রবাদ,জঙ্গিবাদ কিংবা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনধিকার চর্চা নয়, শান্তিরক্ষি ভারতে প্রয়োজন

লিখেছেন মোহাম্মদ সজল রহমান, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৫৫

বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় অভিযুক্ত এবং ইসকন সংগঠন থেকে বহিঃস্কৃত ধর্ম প্রচারক বিতর্কিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, তার মুক্তির জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের এক শ্রেণীর জনগণ যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে, তাতে মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমরা উকিলরা কেউ চিন্ময়ের পক্ষে দাঁড়াবো না , না এবং না

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২




সাবাস বাংলাদেশের উকিল । ...বাকিটুকু পড়ুন

×