গতকাল, ১৫/০৪/২০১৫, বুধবার দুপুর ২টায় (ফোনালাপে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ি) গাউছিয়া হক কমিটি কেন্দ্রিয় শাখার সাধারন সম্পাদক জনাব জামাল আহমেদ শিকদার ইন্তেকাল করেছেন।
ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন!
জামাল শিকদার, যাকে আমি অনেক ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি এবং যাকে "শিকদার নানা" বলে সম্বোধন করে আসছি, উনি মারা গেছেন। খবরটা হজম করতে আমার একটু সময় লেগেছে। জামাল শিকদারকে দেখলে আমার প্রায়ই বটবৃক্ষের কথা মনে হত। বটবৃক্ষের কখনো বয়স বাড়ে না। বটবৃক্ষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ছায়া হয়ে, আশ্রয় হয়ে, ঐতিহ্য হয়ে। বটবৃক্ষের অমোঘ অপরিবর্তনীয়তার মতই ধ্রুব ছিলেন জামাল শিকদার; অন্তত আমার কাছে। সাম্প্রতিক সময়ে শারীরিক অসামর্থ্যতার কারণে হয়ত তার অনুপস্হিতি নিত্যদিনকার প্রাত্যহিকতায় তেমন দৃষ্টিগোচর হবে না কিন্তু তাঁর শুন্যতা ঠিকই হাড়ে হাড়ে টের পাবেন বিজ্ঞ জনেরা।
অনেক ছোটবেলা থেকেই চেনা হলেও তাঁর সাথে আমার মিথষ্ক্রিয়া, যাকে বলে "ইন্টারেকশন", সেটা হয় অনেক পরে এসে। তখন আমি কলেজে পড়ি। একদিন হাফেজ আবুল কালাম মারফত খবর পেলাম আমাকে ডাকা হইছে একটা মিটিং-এ। একটা কম্পিউটার কম্পোজ করা চিঠি যাতে আমার নামটা হস্তাক্ষরে লেখা। জীবনে এর আগে এত সম্মান করে কেও মিটিং -এ ডাকে নাই। একটা ছেলেমানুষি গাম্ভীর্য নিয়ে যাই দেখা করতে। বলার অপেক্ষা রাখেনা মিটিংটা ডেকেছিলেন আর কেও না এই জামাল আহমেদ শিকদার। তিনি পাঁচটা চিঠি ইস্যু করেছিলেন আমি আর হাফেজ কালাম ছাড়া চিঠির প্রাপক ছিলো মোজাম্মেল আহমেদ, এইচ আর মেহবুব, নুরুল আতাহার আসিফ। শেষোক্ত দু'জন অবশ্য আলোচ্য মিটিং-এ ছিলোনা। মিটিং শেষ করে যখন ফিরছি তখন আমার মনে রাজ্যের বিস্ময়। জামাল শিকদার তাঁর পরিকল্পনা দিয়ে আমাকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন। সেদিন প্রথমবারের মত তিনি যে পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিলেন সেটাকে আমরা এখন শিশু কিশোর সমাবেশ হিসেবে চিনি। মাইজভান্ডারি দর্শন ও ঘরনার ভবিষ্যত সম্বৃদ্ধিতে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণের প্রয়োজনিয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনিই প্রথম। আর আমকে তিনি এনে দিয়েছিলেন বৈপ্লবিক ইতিহাসের সৃষ্টিলগ্নের স্বাক্ষি হওয়ার দূর্লভ সুযোগ। নিজ ক্ষুদ্রতার কারণেই তাঁর সেবারের পরিকল্পনায় আমি থাকতে পারিনি। তাতে অবশ্য তাঁকে থামানো যায়নি তিনি ঠিকই করে দেখিয়েছিলেন। তাঁর সাথে সেদিনের সেই আলাপ এবং পরবর্তিতে শিশু কিশোর সমাবেশ দেখে আমাদের ভাবনা জাগে দরবারি ঘরণার তরুণদের নিয়ে মুক্ত বুদ্ধির একটা যুব সংগঠনের যেটাকে পরবর্তিতে রাহবারে আলম মওলা হুজুর মাইজভান্ডারি (ক.) নাম দেন "তাজকিয়া"।
কিন্তু আমার মুগ্ধতা শিশু কিশোর সমাবেশের পরিকল্পনা শুনে হয়নি, আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম মাইজভান্ডারি দর্শনের তাঁর ইন্টারপ্রিটেশন এবং মওলার খেদমত করার তাঁর স্বকিয় পদ্ধতি দেখে। তিনি প্রগতিশীল ভক্তি চর্চার পুরোধা ব্যাক্তিত্য। তাঁর লেখনি, সংগঠন চিন্তা, হক মজ্ঞিলের বৈষয়িক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আশেককুলের মধ্যে সম্প্রিতি প্রতিষ্টা তাঁর লিগেসি হয়ে থাকবে।
জামাল শিকদার মাইজভান্ডার এসেছিলেন অসি-এ-গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভান্ডারির (ক.) চরনে। অসি-এ-গাউছুল আজম এর নিয়মতান্ত্রিকতা এবং সংঘবদ্ধতার প্রতি গুরত্বারোপ তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে এবং তাঁর জীবন দর্শন গঠন করে। তৎস্বত্বেও তাঁর ভক্তির সকল অর্ঘ্য তিনি মূলত সঁপে ছিলেন শাহানশাহ হযরত সৈ্য়দ জিয়াউল হক্ মাইজভান্ডারিকে (ক.)। শাহানশাহ মাইজভান্ডারির ভাবনা ছিলো তাঁর আনন্দ এবং তাঁর কথা প্রচার ছিলো তাঁর উপাসনা। পরমসাধকের পদচিহ্ন ধারণ করতে করতে তিনি যেনো নিজেই গুপ্ত সাধক। অন্ত:র্দৃষ্টি উন্মোক্ত এই অনাড়ম্বর প্রি্য় মানুষটি শেষ কটা বছর কাটিয়েছিলেন দৃষ্টিহীন। শান্তি কুন্জের তিন তলার কোনার রুমটাতে যখনই যেতাম দেখতাম তিনি আলাপরত আছেন কারো না কারো সাথে। তাঁর ব্যাক্তিগত পরিচারক বই-খবরের কাগজ পড়ে শোনাত তাঁকে আর জানালার পানে দৃষ্টিহীন চোখ মেলে তিনি চেয়ে থাকতেন কোন সূদূরে। সেই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তিনি চলে গেছেন তাঁর পরম প্রিয়ের কাছে।
তাঁর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
অন্তু নূর।
১৬/০৪/২০১৫।