somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি, অনূভুতি হয়ে ফিরে আসে যে মাসে।

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৪:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি বড় পোস্ট দেয়ার জন্য)!


অফিসের ঐ রুমে তারা তিনজন বসতেন। বাবা, তাঁর কলিগ এক বাঙালী ইনজ্ঞিনিয়ার এবং এক পাকিস্তানী ইনজ্ঞিনিয়ার। ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরবের টিএন্ডটি তে প্রচুর বাঙালী, পাকিস্তানি ও মিশরীয় ইনজ্ঞিয়ার কাজ করত। পেপারে একটি খবর এল, ইমরান খানের এক সাবেক মার্কিন বান্ধবী দাবী করছে যে তার ছেলের জনক ইমরান খান, যথারীতি ইমরানের অস্বীকার, এটা নিয়ে খবর গরম! পেপার পড়তে পড়তে ঐ বাঙালি ইনজ্ঞিনিয়ার পাকি কে বলে উঠলেন, "বাঃ, কি সুন্দর শিশু, ইমরান সাব তাকে অস্বীকার করছে কেন?" খোঁটাটা বুঝতে পেরে ঐ পাকি বলে উঠল,"তুমারা ছ্যাখ মুজিব.......", তার আর বাক্য শেষ হতে পারল না, সাথে সাথে গর্জে উঠলেন বাব ও তাঁর বন্ধূ! বাবা বললেন, "চুপ! আর একটা কথাও না! তুমি জান শেখ মুজিব কে? He is the founder of the Nation, Father of the Nation!! তুমি হাসিনা-খালেদা, এরশাদ নিয়ে যা ইচ্ছা বল! কিন্তু ঐ লোকের নামে না! আমরা কি তোমাদের কায়েদে আযম কে নিয়ে কিছু বলেছি? তাঁকে নিয়ে কিছু বললে তোমার কেমন লাগবে?...."
ঐ পাকি আর একটা কথাও বলে নি, রাগে গজরাতে লাগল।
এ ঘটনা শুনার পর বুঝতে পারলাম যে কেন


বেঙ্গল টাইগারের গর্জনের কাছে অন্য যে কোন বাঘের গর্জন মিউ মিউ ডাকের মত শুনায়।

ইনজ্ঞিনিয়ারিং পাশ করার পর বাবা প্রথম চাকরী শুরু করেন চট্টগ্রামের হাফিজ জুটমিলে। জয়েনের মাস দুয়েক পরই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। তখন দাদা এবং পুরো পরিবার গ্রামের বাড়ীতে, স্বন্দ্বীপ। ভাষণের পর দাদা বাবাকে একটি টেলিগ্রাম করেন, "তুমি এখনই বাড়ি চলে আস, খুব জরুরী!" বাবা ছিলেন তাঁর পরিবারের প্রথম সন্তান, সাধারণত তিনি দাদার কথার কখনও অমান্য করতেন না। খবর পেয়েই ছুট। যেদিন বিকালে তিনি বাড়ি যান, সেদিন রাতেই শুরু হয় মিলে বিহাড়ী-বাঙালি লড়াই! প্রচুর হতাহত হয়।

বাড়ী যাওয়ার পর তাঁর দিন গুলো কেটে যায় আর অন্য সব স্বাভাবিক বাঙালি যুবকদের মত। খবর সংগ্রহ-বিশ্লেষণ, মিটিং, সেই সুদুর ছোট্ট দ্বীপেও যা আছড়ে পড়েছিল। আমার দাদার বাড়ি ছিল ইনহেরিটেডলি রাজনৈতিক, দাদার বাবা ছিলেন ৩ ইউনিয়নের চেয়ারমেন, "হকুম মালাদার" নামে পুরো দ্বীপে যিনি ছিলেন বিখ্যাত, বিখ্যাত তাঁর ন্যায় বিচারের জন্য, রাজনীতির জন্য। কাজেই এমন একটি পরিবার তৎকালিন রাজনীতি চর্চার পীঠস্থান হিসেবে ঐ এলাকার কেন্দ্রবিন্দু ছিল!

২৫ মার্চের পর শুরু হয়ে যায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরার প্রস্তুতি। কিন্তু বাবার মন খারাপ। কারণ দাদার কাছ থেকে সরাসরি নিষেধ যুদ্ধে যাবার ব্যাপারে। দাদার মন কেমন কেমন করে, পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলে, সবার বাধ্য, একে কিভাবে তিনি ছাড়বেন। কিন্তু বাবা বসে থাকেন না! নতুন কাজ হাতে নেন। নিজে যুদ্ধে যেতে পারছেন না ত কি হয়েছে, তাঁর মত আরও ছেলেকে তো পাঠাতে পারেন! তাছাড়া শহরে তাঁর ভালই জানাশুনা আছে। কোথায় কখন পাঠাতে হবে। শুরু করে দিলেন বিচ্ছু সংগ্রহ, যারা বিষদাঁত গুড়িয়ে দিয়ে আসবে হানাদারদের। অনেককেই পাঠাতে লাগলেন, তার মাঝে তাঁর সমবয়সী চাচাও (দাদার ভাই) ছিলেন। এখান থেকে তৎপরতা চালানো সুবিধা ছিল, কারণ পাকিরা পানি খুব ভয় পেত। খুব সহজে দ্বীপে আসত না।
কিন্তু রাজাকাররা থেমে থাকে নি। 'ছবুর' সওদাগরের নেতৃত্বে পড়ে উঠল এক প্রভাবশালী রাজাকার বাহিনী। সে নিজেও বিশাল অর্থশালী এবং প্রভাবশালী ছিল! শুরু হল তার রোমহর্ষক অভিযান, কোন কোন পরিবার থেকে মুক্তি গিয়েছে, কারা এই মুক্তি সংগ্রহ করছে, তাদেরকে শহরে পাঠাচ্ছে। হিট লিস্টে প্রথম দিকেই এসে গেল বাবা, দাদা ও চাচাদের নাম!
এবার বাবা ও দাদার শুরু হল অন্যরকম এক যুদ্ধ! কোন প্রকার অস্ত্র ছাড়াই এই রাজাকারদের কাছ থেকে পালিয়ে চলা। ধরা খেলে নির্ঘাত মৃত্যূ। একদিকে রাতের পর রাত ঘরের বাহিরে থাকা, দিনের বেলা লুকিয়ে চলা, অপর দিকে 'বিচ্ছু-বাহিনী' সংগ্রহ। রাত কাটিয়ে দিতেন কোন এক গ্রামের পুকুর পাড়ে বা ঝোপের আড়ালে বা কবরস্থানের পাশে, কখনও বা মসজিদের বারান্দায়। আর দিনের বেলা লুকিয়ে থাকতেন কোন পরিচিত বাড়ির দরমায়, টিনের নীচে বেড়ারা যে আচ্ছাদন, যেখানে তখন শুকনো খাবার গুদামজাত করা হত! খেয়ে নাখেয়ে কাটত তাঁর দিন, মাস! আরেকবার ত প্রায় ধরাই খেয়ে গিয়েছিলেন। বাজারে অল্পের জন্য ছবুর সওদাগরের মুখোমুখি হন নি।

অবশেষ বিজয় এল। তাদের পাঠানো মুক্তি বাহিনী দলে দলে সশস্ত্র অবস্থায় গ্রামে ফেরা শুরু করল। এবার ছবুইরা যাইব কই! শুরু হল তার নর্তন-কুর্দন। এবার তার শুরু হল লুকিয়ে চলার পালা। কিন্তু একদিন ধরা খেল। প্রথমেই মাইর, এরপর যখন ফায়ার করবে, এমন সময় দাদা যেয়ে উপস্থিত হলেন। বললেন, "না, আইন নিজের হাতে তুলা যাবে না। তোমাদের কাজ তোমরা শেষ করছ, দেশ স্বাধীন, এদের ব্যাপারে রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিবে।"
অনেকেই অবাক হলেন, কেউ কেউ রাগে গজরাতে লাগলেন। অনেকে বললেন, "এই ছবুইরা আপনাকে বিগত ৯ মাস কম কষ্ট দিছে?" কিন্তু দাদা অটল। তাঁর এককথা, "ছবুর ভুল করছে, সে আমার ভাই। এখন তাকে মারতে হলে আমার লাশের উপর দিয়ে মারতে হবে।"
এরপর আর কোন কথা থাকতে পারে না। সবাই ফেরত গেল। আর ছবুর বেঁচে গেল।


তার বেশ কয়েক বছর পর.......
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সবাই এসে ধরল দাদাকে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু দাদার আর্থিক অবস্থা তখন ভাল না। তিনি দাঁড়াবেন না। তারপরও লোকজনের চাপে তাঁকে দাড়াতে হল। কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দী হল সেই ছবুর সওদাগর। একাত্তরে কথা তখনও মানুষ ভুলে নাই। কিন্তু ছবুর ভুলে গেল। অর্থ আর ক্ষমতার জোরে দখল করে নিল কয়েকটি কেন্দ্র। ফলাফল: দাদা হেরে গেলেন, এ পরিবার প্রথম বারের মত কোন নির্বাচনে হারল এক জীবন ভিক্ষা পাওয়া রাজাকারের কাছে।


ফ্লাশ ব্যাক:....................................


গত শীতের ঘটনা। এক মেজবানের দাওয়াতে গেলাম আব্বু সহ। অনেকর সাথেই পরিচয় ও কথা হল। পরিচয় হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ডক্টরেট অধ্যাপকের সাথে। ভদ্রলোকের তুখোড় মেধা আর অসাধারণ জ্ঞান, সেই সাথে বাচন ভঙ্গি আমাকে সহজেই ইসপ্রেস্ড করল। অনেক কথা হল তাঁর সাথে। সবে মাত্র ইনজ্ঞিনিংয়ারিং পাশ করেছি জেনে তিনিও ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক কথা বললেন। আরও বললেন যে তিনি এক কনফারেন্সে আমেরিকা যাবেন। তারাই তাঁকে যেচে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। ১ সপ্তার প্রোগ্রাম। এমবেসী ফেইস করার সময় যখন তারা জিজ্ঞাস করল কয়দিনের ভিসা লাগবে, তিনি বললেন, "১ সপ্তাহের!" তারা অবাক, কি বলে, যেখানে কেউই ৬ মাসের কম ভিসা দাবী করেনা সেখানে এই লোক কি বলে? কিন্তু তিনি অচল। তাঁর এর বেশী দরকার নেই! এক মার্কিন কর্মকর্তা বলল, "তুমি কি আমাদের দেশ অন্তত ঘুরেও ধেখবা না? অন্তত ১ মাসের আপিল কর!" কিন্তু ভদ্রলোকের জবাব, "তোমার দেশ ঘুরে আমি কি করব? কি আছে দেখার মত তোমার দেশে? সৌন্দর্যের কথা বললে ত আমার দেশ সবচেয়ে সুন্দর। আর ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা টেকনলজীর কথা বললে ইউরোপে অনেক ভ্রমণ করেছি, অনেক দেখেছি।"
"বরঞ্চ আমার দেশ দেখার শেকার অনেক কিছু আছে তোমার। আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা অনেক শক্ত, সুন্দর, আমি ৩ বছর বাহিরে থাকরেও আমার বউ মেয়েরা আমাকে ছেড়ে আর কারও হাত ধরে চলে যাবে না। এখানে শান্তি আছে,......." ঐ মার্কিন কর্মকর্তা অবাক। অবশেষ নিজ থেকেই তাকে ৩ মাসের ভিসা ইস্যূ করে দিল।
আমি ও অবাক, এরকম একজনের শিক্ষের সাথে আলাপ করতে পেরে। সেইসাথে গর্বিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে আমার দেশেও এরকম নীতিবান মানুষ আছেন যিনি সবার আগে দেশের কথা চিন্তা করেন।

বাসায় এসে বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে আব্বাকে জিগ্গাস করলাম ঐ লোকটা কে? ঐ যে বিম্ববিদ্যালয়ের টিচার? আব্বুর মুখে ছোট্ট একটু হাসি ফুটল, বললেন, এটা ছবুর সওদাগরের ছেলে!
ছোট্ট একটা নীরব দীর্ঘশ্বাস মনে হয় শুনলাম, তাঁর মুখ থেকে!
৩৯টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×