হাইতি, ইরান বা গুজরাটে যে ভূমিকম্প হল তার সিকিভাগও আমরা ঈদের দিন বা তার আগের রাতে অনুভব করি নাই। তবে, আমার জানামতে আমরা ব্লগারসকল কেউই এই যাবৎ বঙ্গদেশে এমন ঝাকি খাই নি। হতে পারে পরবর্তি ভূমিকম্পটি হবে একটু পরেই বা হয়ত শ্রীঘ্রই। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র। জীবনের এপর্যন্ত সব স্বপ্ন চিন্তা ভাবনা, যুদ্ধ, সংগ্রামের ইতিটেনে হয়ত পরে থাকতে পারি কোন দেওয়ালের নিচে পিষ্ট অবস্থায় অথবা ধ্বংসস্তুপে বসে আকাশ পানে বিদেশী ত্রানের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকতে পারি বেচে থাকবার আশায় ।কয়েকটি মাত্র সেকেন্ড পরিবর্তন করে দিতে পারে জীবনের মোড়। অথচ, আমরা রাতের পর রাত বা মাসের পর মাস অপেক্ষা করি এমন কিছু পাবার জন্য যা কিনা “লাইফ চেঞ্জিং” বলেই আমাদের ধারনা। কিছু কিছু ক্ষণ কত ভয়াবহ হতে পারে তা অনুভব। যদি ভয়াবহ কিছু হয় তখন হয়ত ভূমিকম্পের এই অভিজ্ঞতাটা কাউকে জানানো যাবে না। নিজের অভিজ্ঞতাটুকু লিখে রাখাই অনেকদিন পর ব্লগ লিখবার খানিকটা প্রয়াস।
ঈদের চাঁদ দেখা গেছে কাল ঈদ। ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলাম। ডিপার্টমেন্টের গ্রুপ মেইলে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে মেইলও দিলাম। হঠাৎ মনে হল ভূমিকম্প হল। নিশ্চিত ছিলাম না। ব্লগে ঢুকলাম। কেউ একজন দেখি পোস্ট দিয়ে ফেলেছেন। তিনিও আমার মতই অনিশ্চিত। তার সাথে সহমত প্রকাশ করলাম, “হ্যা আমিও বুঝতে পেরেছি ভূমিকম্প হয়েছে”। আর কারো মাঝে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না।
রাতে সোয়া এগারটার মত বাজে তখন। কি যেন করছিলাম, মনে হয় গুগলে মেইল চেক করছিলাম। হঠাৎ, বিল্ডিং কাঁপতে শুরু করল। মনে হল কে যেন ব্লিডিং এর উপরে হাত দিয়ে তালে তালে নাড়ছে। অন্য সময় রুমের দরজা বন্ধ থাকে। কি মনে করলাম জানি না, দ্রুত ল্যাপটপের সাথে লাগানো বিভিন্ন ইউএসবি কেবল পাওয়ার লাইন খুলে ফেললাম। হয়ত ভাবছিলাম, কোন কিছু হলে ল্যাপটপ সাথে নিয়ে দৌড় দেব। এর ভেতর আমার সব কিছুই আছে। এরপর দ্রুত চলে গেলাম ডাইনিং রুমে। বাবা ড্রইং রুমে টিভি ছেড়ে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। এদিকে মা দেখছি ছোট বোনের রুমে সোফা আকড়ে ধরে আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার শুরু করেছে। ওদিকে বাবা “ওরে বাবারে বলে চিৎকার দিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল” আর ডাইনিং রুমে এসে জিজ্ঞাসা করে, “কি হল কি হল”। আমি ডাইনিং টেবিল বা একটা চেয়ার ধরে সবাইকে ধমক দিয়ে শান্ত হতে বললাম। এ সবই মাত্র দশ কি বার সেকেন্ডের ঘটনা। থেমে গেল ভূমিকম্প।
শান্ত হলাম। বোঝা গেল ক্ষতি তেমন কিছু হয় নি। এখন প্রথম কাজ কি? প্রথমত, ফেসবুকে স্টাটাস আপডেট দ্বিতীয়ত ব্লগে পোস্ট। ততক্ষণে ব্লগে পোস্ট চলে এসেছে। আমিও একটা দিলাম। একের পর এক পোস্টে ভেসে গেল সামহোয়্যারের প্রথম পাতা। ফেসবুকে ব্লগার আইরিন সুলতানার সাথে কথা হল, জানলাম মিরপুরেও ভূমিকম্প হয়েছে। আমি থাকি টিকাটুলিতে। ব্লগ থেকে জানা গেল, ভূমিকম্প হয়েছে ঢাকা সহ বিভিন্ন জায়গায়। দ্রুতই ইউনাইটেড স্টেটস্ জিওলজিকাল সার্ভে সাইট থেকে পাওয়া গেল যাবতীয় সব তথ্য। তেমন কিছু না বুঝলেও জানতে পারলাম রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪.৬ এবং কেন্দ্র ছিল কুমিল্লার কাছে।
এরপর আবার বাবা মায়ের কাছে গেলাম। তারা ভীত, আমি প্রস্তাব তুললাম আমাদের চারজনেরই ভূমিকম্প কালীন কিছু প্লান থাকা দরকার। টেবিল চেয়ারের নিচে পিষ্ট হয়ে মরার চাইতে অন্য প্লান হিসেব করলাম। আমাদের বিল্ডিং ছয়তালা, আমরা থাকি পাঁচতলায়। আমাদের জন্য টেবিল চেয়ারের নিচে লুকানোর চাইতে ভাল হবে ছাদে চলে যাওয়া। মরলেও অন্তত খোলা আকাশের নিচে মরব।আর যাই হোক, বিল্ডিং এর ফাকে কোথাও আঁটকে থেকে না খেয়ে দেয়ে তিলে তিলে মরার সম্ভবনা কম। এরচে আত্মহত্যা হয়ত ভাল। এরপর শুরু করলাম এদিক সেদিক ফোন করা। অনেকেই ভূমিকম্পটের পেয়েছে। অদ্ভুত লাগল এই যে, কেউ কেউ আবার ঢাকাতে থেকেও ভুমিকম্পটের পায় নি। আজব!!
ভূমিকম্পের মাত্রা আরো বেশি হলে এই ঈদের দিনে নিজেকে কোথায় দেখতে পাই? হয় মৃত অথবা প্রিয়জন হারা অথবা সপরিবারে খোলা আকাশের নিচে। কোথায় ঈদের জামা? কোথায় ঈদের দাওয়াত? ঈদে যাদের যাকাতের কাপড় দেওয়া হল, দেওয়া হল ফিতরার টাকা তাদের সাথে এক কাঁতারে। আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটির রেজিস্টার ভবন যদি ধ্বসে যায় তবে আমার বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেটের কোন প্রমান আর থাকবে কি? জানি না তারা কিভাবে তাদের তথ্য রাখেন। প্রিয়জনদের যদি হারাই তবে মানসিক অবস্থারই বা কি হবে? থাকব কি স্বাভাবিক? জীবনের সব স্বপ্ন, চাকুরি, চাতুরি যাবে কোথায়? অনেকগুলো প্রশ্নে জর্জরিত। উত্তর হাতে নেই। কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। র্যা নডম বা ইতস্তত ব্যাপারগুলো তারই হাতে। তারই উপস্থিতিতে সব র্যা নডম ঘটনাই একটা কাহিনীর মালা গাঁথে। সেই কাহিনীর চরিত্র আমি আমার পরিবার, আমার বন্ধু, আমার পরিচিত অপরিচিত সব মানুষ। আল্লাহ সবাইকে ভাল রাখুক।
ইদানিং গান বাদ দিয়ে ইন্সট্রুমেন্টাল শুনছি। আনন্দ সংকরের মিউজিকগুলো ভাল লাগছে। সবার জন্য কিছু লিংক শেয়ার করলাম।