somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ চিনচিন করা ব্যাথা

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
ঘরে পিন-পতন নিরবতা । এসিটা যেন একটু বেশিই বাড়িয়ে দেওয়া আছে । এই গরমে ঘরের ভিতর যেন মাঘের শীত নেমে এসেছে । ঘরের ঠিক মাঝ খানে ৯২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কম্বল গায়ে দিয়ে।
নিচে নরম তুলতুলে গদির উপর সাদা ধরধবে চাদরের উপর বৃদ্ধ শুয়ে আছেন সেই সকাল থেকে । সকাল থেকে রাত অবধী তার শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই । বেডের ঠিক সামনেই দেওয়ালে একটা ৩২ ইঞ্চি এলইডি টিভি সেট করা । সেটা চলছে শব্দহীন ভাবে । সারা দিন এই টিভি চলে, তিনি কখনও চোখ মেলে দেখে আবার কখনও দেখে না ।
হাতের কাছে একটা সুইচ আছে । কোন কিছু দরকার পড়লেই তিনি সুইচ টিপেন । সঙ্গে সঙ্গে একজন নার্স এসে হাজির হন !

দুই
আব্দুল আজিজ সেই কখন থেকে হাটছেন । তার বাঁ পাটা নষ্ট । হাটতে হয় খুড়িয়ে খুড়িয়ে । লাঠিতে ভর দিয়ে হাটতে বেশ কষ্ট হয় এক ভাবে হাটতে ! কিন্তু কিছু করার নেই । তাকে বেঁচে থাকার জন্য হাটতে হয় ! এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম ।
শেষ গ্রামের শেষ বাড়িটা পার হয়ে এসেছেন সেই কখন, সামনের আর কোন বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন না ! পানির পিপাসা পেয়েছে বেশ ভাল ভাবেই কিন্তু আসেপাশে পানি খাওয়ার মত কোন উপায় নেই । আগের বাড়ি থেকে পানি খেয়ে আসলেই মনে হয় ভাল হত । এখন সামনে নতুন কোন বাড়ি না পাওয়া পর্যন্ত তাকে এই পিপাসা নিয়েই থাকতে হবে !
আজকের সুর্যটা বেশ ভাল ভাবেই তেজ দেখিয়ে চলেছে । শরতের এই সময়ে সুর্যের এতো তেজ থাকে তা তার জানা ছিল না !
তিনি এগিয়ে চললেন । ঐ তো সামনে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে । আব্দুল আজিজ নিজের এলুমিনিয়ামের থাকাটা নিয়ে এগিয়ে চলল ইটে ঘেরা সেই বাড়ির গেটের দিকে ।


তিন
৯২ বছর বয়সী বৃদ্ধের ঘুম ভেঙ্গেছে । তিনি চোখ মেলে তাকিয়েছেন । তিনি সামনের চলা টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন এক ভাবে । হঠাৎ তার মনে হল একটু মনে হয় পানি খাওয়া দরকার । তিনি বাঁয়ে তাকালেন । এক হাত বাড়ালেই তিনি পানির গ্লাস টা হাতে পান কিন্তু তিনি সেদিকে গেলেন না ! তিনি হাতের কাছে থাকা সুইচ টা টিপ দিলেন । যদিও তিনি নিজে কিছু শুনতে পেলেন না তবে ঘরের বাইরে থাকা একটা এলার্ম ঠিকই বেজে উঠলো ! এখনই হয়তো কেউ ছুটে আসবে । সেরকমই নিয়ম !

তিনি সেই নার্সের ছুটে আসার অপেক্ষা করতে লাগলো । তার চোখ তখনও টিভির দিকে । মুখে একটা কুটিলা হাসির উদয় হল টিভিতে দেখানো দৃশ্য দেখে ।


চার
আব্দুল আজিজ পরপর দুবার কড়া নাড়িয়ে দাড়িয়ে রইলো । ভেতর থেকে কোন প্রকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না । বাড়িটা সম্পূর্ন ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা । গ্রামের কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মনে হয় ।
আব্দুল আজিজ আরেকবার কড়া নাড়বেন কিনা চিন্তা করলেন ।
কিন্তু সাহসে কুলালো না । না জানি কি ভেবে বসে । এর থেকে অপেক্ষা করাই ভাল মনে করলেন ।

যখন মনে হল বাড়ির ভেতর থেকে আর কেউ বের হবে না ঠিক তখনই দরজার কড়া টা নড়ে উঠলো । কিছুক্ষন পর গেট খুলে একটা কম বয়সী মেয়ে উকি দিলো !
-কাকে চাই ।
-মাগো এক গ্লাস পানি দিবা ! বড় তিয়াস পাইছে ।
কম বয়সী মেয়েটা আব্দুল আজীজকে আপাদমস্তক একবার দেখলেন ! তারপর বললেন
-আচ্ছা আপনি একটু দাড়ান !
এই কথা বলেই কম বয়সী মেয়েটি বাড়ির ভেতরে চলে গেল !


পাঁচ
মিলির কাছে সব থেকে অপছন্দ এই ইমার্জেন্সি এলার্মের আওয়াজ টা । এমন না যে আগে সে এই কাজটা পছন্দ করতো না । কিন্তু এখন এই এলার্ম টা মানেই সেই লোকটার সামনে তাকে যেতে হবে । অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে তার হুকুম শুনতে হবে ! বড় স্যারকে অনেক বার বলেও তার ডিউটি অন্য কোথায় বদলানো যায় নি ।
একবার ভেবেছে চাকরী ছেড়ে দিবে কিন্তু চাইলেও তো চাকরী ছাড়া যায় না । বিশেষ করে মিলি যে পরিবার থেকে এসেছে সেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ গুলো চাইলেই সব কিছু করতে পারে না !

মিলির দরজা ঠেলে বিরক্ত মুখে ঘরে ঢুকলো । নাকে একটু গন্ধ আসলো সঙ্গে সঙ্গেই। যতবার মিলি এই ঘরে আসে ততবারই তার নামে শুকরের গন্ধ লাগে ! মিলি নাটকটা একটু কুঁচকে এসে বৃদ্ধির সামনে দাড়লো !
বৃদ্ধ চোখের ইশারায় পানির গ্লাসের দিকে ইংগিত করলেন !
মিলির মনটা আবার বিরক্তিতে ভরে গেল ।
শালার বুইড়া হাত দিয়ে পানিও ঢেলে খাইতে পারিস না ! মাঝে মাঝে মিলির মনে হয় পানির গ্লাস টা বুড়োর মাথায় ছুড়ে মারতে । কিন্তু চাইলেই তো আর সব কিছু পারা যায় না । মিলি বিরক্ত মুখে জগ থেকে পানি ঢালতে লাগলেন !
পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বুড়োর দিকে ধরতে মিলি দেখতে পেল বুড়োর চোখে মুখে শিয়ালের মত কুটিল হাসি । তার চোখ টিভির দিকে ।
টিভিতে যুদ্ধাপরাধী সাইদির রায় সম্পর্কে খবর দেখাচ্ছে !

মিলি খানিকটা হতাশ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো ! প্রিজন সেলের আরেকটা আরামদায়ক কক্ষ মনে হয় পূরন হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই । মিলি বুড়োর দিকে তাকিয়ে দেখলো বুড়ো তখন হেসে চলেছে ....

ছয়
আব্দুল আজিজ সামনে মেলামাইনের প্লেট ভর্তি গরম ভাত । পাশের বাটিতে রাখা এক বাটি ডাল এবং একটা বড় পাঙ্গাস মাছের পেটি !
তিনি বসেছেন গেরস্ত বাড়িটার বারান্দার ঠিক দক্ষিন পাশে !
কম বয়সী মেয়েটা তাকে কেবল পানিই এনে দেই নি তাকে ডেকে বাড়ির ভিতর নিয়েছে ! তাকে দুপুরের খানা দেওয়া হয়েছে । তিনি উপরওয়ালার কাছে প্রাণ খুলে দোয়া করলেন এই পরিবারটির জন্য !

খাওয়া শুরু করবেন ঠিক সেই সময় ঘরের ভিতর থেকে একজন যুবক বয়সী ছেলে বেরিয়ে এল । তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে সে চরম ভাবে রাগান্বিত এবং বিরক্ত ! আব্দুল আজিজ একটু সংকিত বোধ করলেন ! যুবকের বিরক্তির কারন তিনি কি না সেটা বোঝার চেষ্টা করলেন !
শেষে সাহস করে বললেন
-বাবা, শরীর ভালো ?
যুবক বলল
-চাচাজী, শরীর ভালো । তবে মন ভাল না !
-কেন বাবাজী ?
-এখন কি করতে মন চাইছে জানেন ? মন চাইছে একটা মেশিন গান নিয়ে বাঞ্চুদ রাজাকারটারে ঝাজরা কইরা দেই !
আব্দুল আজিজ কিছু কথা বা বলে যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলো !
যুবক বলল
-জানেন আজকে কি হয়েছে ? এই দেল্যু রাজাকারের ফাঁসি হয় নাই । %^&$পুত এখন আরাম কইরা প্রিজন সেলে বইসা বইসা আরাম করবে !
যুবক আরও কিছুটা সময় রাগ গজ জকরতে থাকে । কোন কিছুতেই তার রাগ যেন থামছে না ! মুখ দিয়ে আরও কিছু গালী বের হয়ে এল !

কিছু সময় পরে যুবক আব্দুল আজিজের দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখ বেয়ে পানি পরছে । যুবক খানিকটা অবাক হয়ে বলল
-চাচাজী আপনি ভাত খান ! বসে আছেন কেন ?
-না বাবা ! আজকা ভাত নামবো না আমার গলা দিয়া ! আমি যাই !
-সে কি ? কেন ?
-আমি যাই বাবা !

আব্দুল আজিজ আর দাড়ালেন না ! লাঠিতে ভর দিয়ে খুড়াতে খুড়াতে গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন ! তখনও তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছেই !
বুকের ভেতরে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করতে করতে তিনি সামনের দিকে হেটে চললেন !



পরিশিষ্টঃ

-আজিজ ভাই তোমার একি অবস্থা ?
সহ যোদ্ধার দিকে তাকিয়ে ব্যাথায় কাঁকিয়ে উঠলো আব্দুল আজিজ ! তার বাঁ পা টা তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে । আব্দুল আজিজ কোন রকমে একটা গামছা দিয়ে গুলি লাগা স্থান টা বেঁধে রেখেছেন । কিন্তু খুব বেশি লাভ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না !
-আজিজ ভাই তোমার তো গুলি লাগছে !
-ও কিছু না ! আইজকা ৬ পাকিরে দিছি হান্দাইয়া ! এক্কেবাড়ে জন্মের মত ! হাহাহাহা
এই বলে আব্দুল আজিজ হেসে ওঠেন ! হাসতে হাসতেই তিনি সহযোদ্ধার কোলে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান ! তখনও তার চেহারা জুড়ে একটা অচেনা প্রশান্তি খেলা করছিল !
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×