somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ বিকেলে রোদের আলো !

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মিতুর বিয়েটা ঠিক অন্যান্য মেয়েদের মত হয় নি । বাদ্য আর সানাই বাজিয়ে মিতুর বিয়ে হবে যে সেটা মিতু কোন দিন আশাও করে নি । একটা সময়ে এসে মিতুর মাঝে মাঝে মনে হত হয়তো ওর হাতে বিয়ের রেখা নেই । সেটার জন্য মিতুর খুব একটা দুঃখবোধও ছিল না । সংসারের দায়িত্বটা কাধে নিয়ে চলতে চলতে নিজের দিকে তাকানোর মত সময় ছিল না ওর । দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও চেহারায় একটা স্নিগ্ধ ভাবটা মিতুর ছিল । ঠিকঠাক মত পোষাক পড়লে দেখতে খারাপ লাগে না ওকে । যে কারো বউয়ের ভূমিকায় ওকে মানিয়েই যেত কিন্তু মিতুর মনে হয়েছিলো সবার ভাগ্যে সব কিছু থাকে না ।

মিতুর বাবা যখন মারা যায় তখন মিতু সবে মাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছে । ওরা এমন আহামরি বড় লোক ছিল না যে পায়ের উপর পা রেখে সব কিছু সামাল দেওয়া যাবে । নিজেদের নামে ছোট একটা ফ্ল্যাট বাসা আর একটা দোকান ছিল বলেই বোধহয় কোন রকমে টিকে গেছে । তবুও সংসারের অন্যান্য খরচ মেটানোর জন্য মিতুকে সেই অনার্স থেকে চাকরির দিকে ঝুকে পড়তে হয় । তারপর কিভাবে দিন চলে গেছে সেটা মিতু নিজেও জানে না । মা আর ছোট বোনটার দিকে তাকাতে তাকাতে নিজের দিকে আর ভাল করে তাকানোর সময় হয়ে ওঠে নি ।

পড়ালেখা শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটে বেড়ানো তারপর চাকরিতে প্রবেশ, এসব নিয়ে কখন যে আস্তে আস্তে মিতুর বিয়ের বয়স পার হয়ে যেতে লাগলো সেটা মিতু নিজেও লক্ষ্য করে নি । মিতু সব নিরবেই মেনে নিয়েছিল । নিজের জীবনে মা আর ছোট বোনটা ছাড়া আর কেউই ছিল না ওর । তবে মাঝে মাঝে যে মন খারাপ হত না তা নয় । দায়িত্ব পালন করতে করতে জীবনে অন্য পুরুষয়ের ভালবাসা আর পাওয়া হয়ে ওঠে নি কিংবা ও নিজেও সাহস করে নি সেদিকে পা বাড়ানোর । বিয়ের দিকে না এগোনোর আরেকটা কারন ছিল তার স্বামী তার মা আর ছোট বোন কে মেনে নিবে কি না সেই বিষয়টা ।

তারপর হুট করে মিতুর বিয়ে গেল রাশেদের সাথে । মিতু ঠিকঠাক মত বিশ্বাসও করতে পারে না যে আসলেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে । গত ২৬ বছরের একটা মেয়ে জীবন সম্পর্কে সব কিছুই শিখে ফেলে খুব ভাল ভাবে । আর সেটা যখন কঠিন পথে হয় তখন খুব বেশি বাস্তববাদী হয়ে তাকে । সেখানে মিরাকেল ঘটনার কোন সম্ভাবনা থাকে না । তারপরেও বলতে গেলে মিতুর জীবনে সেই মিরাকেলটাও ঘটে গেল । মিতু ঠিক ঠিক যে যে কারনে বিয়ের প্রতি আগ্রহ বোধ করে নি রাশেদের সেগুলোতে কোন সমস্যা নেই । মাত্র একদিনের দেখাতেও মিতুকে রাশেদ বলেছিল সে সব কথা । মিতু আর কথা বাড়ায় নি । বিয়ের পরেও যে মিতু ওর ফ্যামিলিকে পূর্ন সাপোর্ট দিতে পারবে সেটা যখন রাশেদ মেনে নিয়েছে আর কিছু বলারও প্রয়োজন ছিল না ।

কোন প্রকার আয়োজন ছাড়াই ওদের বিয়ে হয়ে গেল । বিয়ের পর কোন রকম আনুষ্ঠানিতা ছাড়াই মিতু রাশেদের বাসায় এসে উঠলো । ঘুমাতে লাগলো একই সাথে । এমন আচরন করতে শুরু করলো যেন বহুদিন থেকেই ওরা স্বামী স্ত্রী ।

বাসর রাতের কথা মিতু খুব ভাল করেই মনে পড়ে । কোন ঘর সাজানো হয় নি । আসলে রাশেদের তেমন কেউ ছিলও না । এক মামা কাছেই বড় হয়েছে ও । বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছে । মামাই ওকে বড় করেছে । পড়ালেখা শেষ করে বেশ ভাল একটা চাকরীও করে । এতো দিন কেন বিয়ে করে সেটা মিতুর মাথায় ঢোকে নি । যদি সন্দেহ ওর মনের ভেতরে আসে নি তা না তবুও মিতু মেনেই নিয়েছে । ওর মত মেয়ের জন্য সব কিছু ধরে বসে থাকলে চলে না । এদেশে মেয়েদের বিয়ে করতে গেলে অনেক হিসেব করতে হয় । অনেক কিছুই মিতু অনুকূলে ছিল না ।

বাসর ঘরে চুপ করে বসেই ছিল । রাশেদ আসলো, খাটের উপর বসে কিছুটা সময় চুপ করে বসে রইলো । মিতুর মনে হল যে কিছু বলতে চাচ্ছে আবার বলছে না । তারপর রাশেদ বলে উঠলো
-সামনে তাহলে আমার নতুন শুরু হতে যাচ্ছে ?
মিতু কোন কথা না বলে কেবল মাথা ঝাকালো ।
-দেখো আমি কথা খুব কম বলি ! মানুষের সাথে মিশিও কম । অন্যান্য স্বামীরা যেমন আচরন স্ত্রীদের সাথে করে তেমন টা হয়তো আমি করবে পাবো না !

অনেক কিছুই মিতু মেনে নিয়েছিল এটা আর মানতে কি এমন । রাশেদ আবার বলল
-আর আগেও যেমন টা বলেছি যে তোমার মা আর বোনের ব্যাপারে তুমি যেটা ভাববে সেটাই করবে । আমার কথা চিন্তা করতে হবে না । সেই সাথে যদি তাদের জন্য কোন কিছু দরকার হয় আমাকে নির্দ্বিধায় বলবে । এখন থেকে তারাও তো আমার ফ্যামিলি ! ইনফ্যাক্ট মাই ওনলি ফ্যামিলি । তাই না ?

এই কথাটা শুনে মিতুর কেন জানি খুব ভাল লাগলো । মনটা ভাল হয়ে গেল সাথে সাথেই । আরও কিছু আশা করেছিল কিন্তু রাশেদ আর কিছু না বলে ঘুমাতে চলে গেল । মিতু আরও কিছু টা সময় অপেক্ষা করে নিজেও শুয়ে পড়লো । যেরকম বাসররাত মানুষ আশা করে তার কিছুই হল না সেদিন । সারারাত ধরে গল্প সামনের জীবনের কত পরিকল্পনা আরও কত কিছু শুনে এসেছে কিন্তু এমন কিছুই হল না ।

সকাল থেকে ওদের স্বাভাবিক জীবন শুরু হয়ে গেল । যে যার মত অফিস চলে গেল । বিয়ের পরের দিন কেউ অফিস যেতে পারে মিতুর সেটা রাশেদ কে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস হত না । দুই সপ্তাহ যখন পার হয়ে গেল তখন মিতুর মনের একটা ধারনা হল যে রাশেদের নিশ্চয় অন্য কোন সমস্যা আছে । কেবল যে ওর বাবা মা নেই এই জন্য সে এতো দিন বিয়ে করে নি এটা তো হতে পারে না । বরং যাদের কেউ নেই তারাই জীবনটা অন্য কারো সাথে শুরু করার জন্য একটু তাড়াহুড়া করে, সঙ্গী খুজে বেড়ায় । তাহলে রাশেদ কেন এতো দেরি করলো । হিসেব মত রাশেদ ওর থেকে আরও ৫ বছরের বড় । চাকরী করে আরও ৬ বছর আগ থেকে । বেতনও ভাল তাহলে বিয়ের দিকে কেন এগোই নি ।

মিতুর মনে ধারনা জন্মালো যে রাশেদের নিশ্চয় শারীরিক কোন সমস্যা আছে । নয়তো মানুষ যতই নিশ্চুপ আর কথা কম বলুক বিয়ের পরেও কেন সে মিতুর দিকে আগ্রহ বোধ করে নি । যখন মিতুর একটা বদ্ধমূল ধারনা জন্মাতে শুরু করেছে ঠিক সেদিনই ঘটনা টা ঘটলো ।

অফিসের পর রাশেদকে যেমন দেখা সেদিন অন্য রকম লাগছিলো । একটু যেন বেশি গম্ভীর । খাবার সময় মিতু একটাবার জানতেও চাইলো ওর কিছু হয়েছে কি না । রাশেদ ব্যাপার টা এড়িয়েই গেল । রাতে ঘুমানোর জন্য যখন লাইট বন্ধ করলো তখনই রাশেদ ওর খুব কাছে চলে এল । এর আগে এমন টা কোন দিন হয় নি । মিতুর বুঝতে কষ্ট হল এখন কি হতে যাচ্ছে । মিতু কেবল অনুভব করলো যে ওর বুকের ভেতরে এক অচেনা অনুভুতি হচ্ছে ! এই অনুভুতির কোন ব্যাখ্যা নেই ওর কাছে । যে ধারনা টা ও করছে সেটা ভুল প্রমানিত হতে যাচ্ছে ।

ঐ সকাল বেলা একটু যেন দেরি করেই ঘুম ভাঙ্গলো মিতুর । তাকিয়ে দেখে রাশেদ ওর পাশে নেই । রান্না ঘর থেকে আওয়াজ আসছে । মিতু কেমন যেন একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিলো রাতের কথা মনে পড়ে তবে রাশেদের কাছে যাওয়ার জন্যও একটা তাড়না অনুভব করতে পারছিলো ভেতর থেকেই । যখন রান্না ঘরে ঢুকলো দেখলো রাশেদ সকালের নাস্ত বানাচ্ছে । কেবল অবাক হয়ে বলল
-কি করছো তুমি ?
-নাস্তা বানাচ্ছি । দেখতে পাচ্ছো না ? একা একা থেকেছি তো প্রায় দিনেই আমিই নাস্তা বানাতাম । এসব সব পারি আমি ।

রাশেদের বানানো গোল রুটির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । ওর নিজের বানানো রুটিও এতোটা গোল হয় না । কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাশেদের দিকে । গত কালকে রাশেদকে যতখানি গম্ভীর মনে হচ্ছিলো আজকে ততখানি মনে হচ্ছে না । বরং আগেও থেকেও কম গম্ভীর মনে হচ্ছে । মিতু কেবল অনুভব করলো যে ওর নিজের ভেতরেই একটা অন্য আনন্দময় অনুভুতি হচ্ছে । এমন কেন হচ্ছে সেটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হল না ।

রাশেদ ওকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
-আরে অফিস যাবা না তুমি ? জলদি ফ্রেস হয়ে আসো ।
মিতু তখনও অবাক ভাবেই তাকিয়ে আছে । ভাবছে অন্য কিছু ।

সকালে তৈরি হয়ে নাস্তা খাওয়ার সময় মিতুর কেবল একটা কথাই মনে যে ও রাশেষকে ভালবাসতে শুরু করেছে । জীবনে প্রথমে কাউকে ও ভালবাসাতে শুরু করেছে ।

তারপরের কদিন মিতু যেন খানিকটা ঘোরের মধ্যেই কাটানো । সদ্য প্রেমে পরা বালিকার মত আচরন করতে শুরু করলো । আকারে ইঙ্গিতে রাশেদকে বোঝাতে চেষ্টা করলো যে ও রাশেদের প্রেমে পড়েছে । কিন্তু রাশেদ যে সেটা ঠিক মত ধরতে পারছে না । মিতুর সব সময় রাশেদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে রাশেদও যেন ওকে সব সময় ফোন দিক ওর খোজ খবর নিক । কিন্তু রাশেদ সেই আগের মত হয়ে আছে । যদিও গাম্ভীর্য খানিকটা কমেছে তবুও আগের মতই আছে । একদিন অফিস থেকেই রাশেদ কে ফোন দিল ও ।

-হুম বল !
-তুমি কি বাসায় চলে গেছো ?
-না । কেন ?
-একটু আমার অফিসের সামনে আসবা ?
-দরকার খুব ?
-না মানে .........।

মিতু কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । মিতুর সকাল থেকেই কেন জানি রাশেদের সাথে খুব রিক্সায় চড়তে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু কি কারনে ও ঠিক মত বলতে পারে নি । কখন বলতে পারে না । একটা অদৃশ্য দেওয়াল সেই শুরু থেকেই ওদের মাঝে ছিল । মিতু সব সময়ও মনে হত যে রাশেদ তখনও ওর কাছ থেকে কিছ লুকিয়েই চলেছে । কিছু যেন বলছে না । মিতু যে ওকে ভালবাসতে শুরু করেছে এটা যেন ঠিক বুঝেো বুঝছে না ।

রাশেদ বলল
-আচ্ছা আমি আসছি ।

যখন ওদের দেখা হল রাশেদ বলল
-কি ব্যাপার এতো জরুরী তলব ?
-কোন কারন নেই । তোমার সাথে রিক্সা যেতে ইচ্ছে করলো আজ !
-হঠাৎ ?
মিতু মাথা নিচু করে বলল
-হঠাৎ না । প্রতিদিনই করে !
-তাই ? কোন দিন তো বলো নি ?
-সব কথা কি বলতে হয় ?
-আচ্ছা তাহলে কাল থেকে আমরা প্রতিদিন এক সাথে যাবো বাসায় ।
-না এটার দরকার নেই । এভাবে একসাথে যেতে হলে তোমাকে অনেক টা পথ ঘুরে যেতে হবে । প্রতিদিন দরকার নেই । মাঝে হলেই চলেবে !
-আচ্ছা তাই হবে !

রাশেদ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই ওর চোখে কি যেন বাঁধলো । মিতু স্পষ্ট লক্ষ্য করলো যে রাশেদের মুড অফ হয়ে গেছে মুহুর্তেই । রাশেদ রিক্সাওয়ালাকে রাস্তার পাশে দাড়াতে বলেই রিক্সা থেকে নেমে গেল । তারপর পেছনের দিকে তাকিয়ে রইলো কার দিকে যেন । মিতু তাকিয়ে ছিল ওর দিকে । কিছুই বুঝতে পারছিলো না । একটু পরে রাশেদ ফিরে এল । মুখ যেন আগের থেকেও বেশি গম্ভীর । আবার রিক্সা চলতে শুরু করলে রাশেদ আর একটা কথাও বলল না । কোথায় যেন হারিয়ে গেল ও ।

রাতের খাবার সময় মিতু কয়েকবার জানতে চাইলেও কোন কথা বলল না । চুপ চাপ খেয়ে উঠে গেল । মিতুর কেন জানি খুব বেশি কান্না আসতে লাগলো । বিকেল টা কি চমৎকার ভাবেই কাটছিলো আর মাঝ দিয়ে কি এমন হয়ে গেল ।

------

দুইবারের ধাক্কাতেই রাশেদের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । রাশেদ তাকিয়ে দেখি ওর বউ মিতু ওর দিকে তাকিয়ে আছে । ঘরের লাইট জ্বলছে। একটু আগে সম্ভবত মিতু কান্না কাটি করেছে । সেই জন্য চোখ একটু ফোলা ফোলা লাগছে ।
-কি হয়েছে ?
-তুমি বল কি হয়েছে ?
-কিছু হয় নি ।
-তাহলে বিকেলে ওরকম কেন করলে ?
-মিতু সকালে অফিস আছে ! ঘুমাও ।
-কাল ছুটির দিন । অফিস নেই । তুমি আমাকে বল কি হয়েছে ? এমন কি দেখলে তুমি ? এতো সুন্দর একটা সময় কাটছিলো কি এমন হল ?
-কিছু হয় নি ! ঘুমাও ।
-আজকে বলতেই হবে !
-ঘুমাও !

রাশেদ দেখলো মিতু ওর দিকে কেমন ব্যাথিত চোখে তাকিয়ে আছে । নিজেকে হঠাৎই কেন জানি রাশেদের একটু অপারাধী মনে হল । মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট কেন দিচ্ছে ও ! কেন ?
মিতু বলল
-আমি আমার জীবনে আমার মা আর ছোট বোন ছাড়া আর কাউকে কোন দিন ইম্পর্টেন্স দেই নি । সবাইকে ছেড়ে দিয়েছি ওদের জন্য । কিন্তু যখন তোমার সাথে আবার জীবন শুরু করলাম তখন আচ্ছে আচ্ছে অনুভব করলাম যে কেবল ওরাই নয় আমার কাছে তুমিও খুব জরুরী কিছু হয়ে উঠেছো । খুব বেশি জরুরী । তোমাকে যে কি পারিমান ভালবাসাতে শুরু করেছি তুমি কি সেটা বুঝতে পারো ? চেষ্টা করেছো কোন দিন ? তোমার এরকম সব কিছুতে নিরব থাকাটা আমাকে কি পরিমান কষ্ট দেয় জানো তুমি ?

রাশেদ কিছুটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মিতু দিকে । ওদের বিয়ে হয়েছে প্রায় মাস আড়াই পার হয়ে গেছে এই প্রথম বারের মত মিতুর দিকে এভাবে তাকিয়ে দেখলো ও । হঠাৎই অনুভব করলো ওর ভেতরে কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে । অদ্ভুদ ভাবে । হাত দিয়ে মিতুর চোখের পানি মুছে বলল
-এসো ঘুমাবে । কালকে বলবো সব । আজকে ঘুমাই ।

ঘুমানোর সময় মিতুকে নিজের বুকের উপরেই টেনে নিল ও ।
-এখানে মাথা রেখে ঘুমাও !

------
পরদিন দুপুর বেলা ।

মিতু ঠিক বুঝতে পারছে না ওকে এখানে কেন নিয়ে আসা হয়েছে । গতকাল রাতে যখন রাশেদের বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলো ওর মনের সেই কষ্টটা অনেকটাই কমে এসেছিলো, ওকে ভালবাসার কথাটা বলতে পেরে নিজের কাছেই একটু শান্তি শান্তি লাগছিলো । রাশেদ সেই রাতেই ওকে অনেক কথা বলেছিলো, যদিও সকালে বলার কথা ছিল । মিতু চুপচাপ শুনছিলো । ওর অতীত সম্পর্কে । কেন ও এরকম হয়ে গেল সেই সব ।
ঐ রাতেই মিতুর মনটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল রাশেদের জন্য । ছেলেটা সারা জীবন ধরে কেবল কষ্টই পেয়ে গেল এই ভেবে । প্রথমে বাবা মা মারা গিয়ে এর পর যে মানুষটাকে ভালবাসতো তার কাছ থেকে । নিজের কাছেই একটা প্রতিজ্ঞা করলো মনে মনে । আজকের পর থেকে এই মানুষটাকে আর কোন ভাবেই একা ছেড়ে যাবে না । একা থাকতেও দিবে না ।
সকাল বেলা হঠাৎ করেই কোথায় যেন চলে যায় তারপর দুপুরে ফিরে এসে মিতুকে বলল তৈরি হয়ে নিতে । ওকে নিয়ে বের এল গুলশানের দিকে । তারপর একটা অভিজাত বাসার ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে হাজির ।

ওকে নিয়ে বসার ঘরের অপেক্ষা করতে লাগলো ।
-এটা কার বাসা ?
-এটা অরিনের বাসা !

অরিন !

নামটা ও গতরাতেই শুনেছে রাশেদের মুখে । অরিন রাশেদের ভালবাসার মানুষটির নাম । যে মেয়েটি ওকে ইচ্ছে করে ছেড়ে গেছে তার উপর এখনও ওকে কষ্ট দিচ্ছে ।
রাশেদ বলেছিলো যে অরিন খুব ভাল করেই জানতো রাশেদ ওর প্রতি কতখানি মানষিক ভাবে দুর্বল । এটা জেনেই ও ইচ্ছে করেি রাশেদকে কষ্ট দিতো । আরও ভাল করে বললে অরিন মজা পেত ওকে কষ্ট দিতে । প্রত্যেক মেয়ের ভেতরেই নাকি এই ব্যাপার টা আছে । তারা তাদের জন্য কষ্ট পাওয়া মানুষ গুলোর কষ্ট দেখে একটা অচেনা আনন্দ পায় !

মিতুর মাথায় ঢুকছিলো না আজকে এখানে ওকে নিয়ে আসার কারন কি । আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করার পরে একটা মেয়ে বসার ঘরে ঢুকলো ! মেয়েটা যে অরিন সেটা মিতুকে বলে দিতে হল না । বলা চলে মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দরী ! বয়স ওর মতই হবে কিংবা ওর থেকে একটু বেশি । ঠোটে গাঢ় লিপস্টিপ দেওয়া ।

-তুমি ?
রাশেদের দিকে তারপর মিতুর তাকালো মেয়েটা । আবার চোখে গেল রাশেদের দিকে ।
-হুম ! এলাম !
-হঠাৎ ? আর সাথে কে এটা ?
-আমার বউ !
-বউ ! বিয়ে করেছো শুনেছিলাম ! তা আমার কাছে কি চাও ?

মিতু লক্ষ্য করলো অরিনের চোখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব রয়েছে । নিজের কাছে কেমন যেন একটু ছোট ছোট লাগতে লাগলো ওর ।
রাশেদের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাশেদ যেন ব্যাপারটা আমলে নিচ্ছে না ।

-অরিন ! আজকে আমার জন্য বেশ আনন্দের একটা দিন জানো ।
-মানে ?
-বুঝবে ! সব বুঝবে ।

এই বলে রাশেদ কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । তারপর মিতুর হাত ধরলো । মিতু তখনই লক্ষ্য করলো যে অরিনের চেহারা একটা হালকা পরিবর্তন এসেছে ।

রাশেদ বলল
-তুমি সব সময় আমাকে খুব তাচ্ছিল্য করে এসেছো । ইচ্ছে করে কষ্ট দিয়ে এসেছো ! তবুও আমি তোমার কাছে বারবার ফিরে গেছি । তুমি কিন্তু আমাকে কোন দিন একেবারে দুরে তাড়িয়ে দাও নি । বরং চেয়েছো যেন আমি তোমার কাছে ফিরে আসি আর তুমি আমাকে কষ্ট দিতে পারো । তাই না ? আমাকে কষ্ট দিতে পেরে তুমি আনন্দ পেতে । সবার উপরে আমার কাছে তোমার যে গুরুত্ব আছে এটা জেনে তুমি একটা মানষিক শান্তি পেতে ।

অরিন কোন কথা না বলে চুপ করে তাকিয়ে রইলো রাশেদের দিকে ।
-আমি জানি তোমার হাজব্যান্ডের সাথে তোমার সম্পর্ক খুব একটা ভাল নয় । তার কাছে তুমি খুব একটা গুরুত্ব পাও না । আর সেই জন্যই তোমার আমাকে দরকার ছিল । কষ্ট দেওয়ার জন্য । কারন আমার কাছে তোমার গুরুত্ব ছিল । কিন্তু গত রাতে একটা অদ্ভুদ ঘটনা ঘটেছে জানো ! আমার পাশের এই মেয়েটাকে দেখছো না ?

রাশেদ মিতুর দিকে তাকালো !
-এই মেয়েটা কি করেছে জানো ? তোমাকে আমার মনের ঘর থেকে বলতে গেলে লাঠি পেটা করে বের করে দিয়েছে । তারপর সেখানে নিজের দখল নিয়ে নিয়েছে । তুমি হাজার চেষ্টা করেও সেখানে আর ঢুকতে পারবে না ?

মিতু এই কথা শুনে একবার অরিনের দিকে তাকালো আরেকবার তাকালো রাশেদের দিকে । মেয়েটার চোখে একটু আগেও যে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল, মিতুকে সে ভাবে দেখছি এখন সেটা নেই । বরং মিতুর প্রতি মেয়েটা যেন একটা ক্রোধ অনুভব করছে ।

রাশেদ কথা বলছে হাসি মুখে । তোমাকে কেবল এই কথাটাই আজকে বলতে এসেছি । আজ থেকে আমি মুক্ত । আমার কাছে তোমার আর বিন্দু মাত্র মূল্য নেই । কেবল এটাই বলতে এসেছিলাম !

তারপর মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল
-চল ওঠা যাক ! আজকে তোমার সাথে রিক্সায় চড়ার দিন !
মিতু হাত ধরে যখন রাশেদ দরজার কাছে যাবে তখনই অরিনের কন্ঠ শোনা গেল ।

-রাশেদ তুমি কোন দিন আমাকে নিজের মন থেকে বের করতে পারবে না ! কোন দিন না !
মিতুকে রেখে রাশেদ অরিনের দিকে ফিরলো !
-তাই ?
এই বলে রাশেদ একটু হাসলো । তারপর বলল

-লুক এট মাই আইস ! আশা করি তুমি তোমার উত্তর তুমি পেয়ে যাবে !

মিতু তাকিয়ে দেখলো অরিন রাশেদের দিকে তাকিয়ে আছে । একটু আগের ক্রোধের ভাবটা কেটে গিয়ে অনেক টা অসহায়ত্ব্যের একটা ভাব ফুটে ওঠছে ।

-----
রাশেদ আর কিছু না বলে মিতুকে নিয়ে বের হয়ে এল । যখন রিক্সা করে ওরা যাচ্ছো তখনও মিতু কেবল রাশেদের কথা গুলো ভাবছে । মনের ঘরে দখল নিয়ে নিয়েছে । রাশেদ কথা বলে যাচ্ছে এক ভাবে । এতো গম্ভীর মানুষ এতো কথা বলতে পারে মিতু জানা ছিল না ।

-বল আজকে কোথায় যাবে ?
-কি বললে ?
-বলালম আজকে কোথায় যাবে বল ? আজকে তুমি যেখানে যেতে চাইবে সেখানেই যাবো ।
-বাসায় চল !
-সে কি কেন ?

মিতু কথাটা বলতে লজ্জা লজ্জা লাগছে । কেন ও বাসায় যেতে চাইছে । তারপর নিজের মনকেই ধকম দিল । বলল এই মানুষটার সামনে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই । মানুষটাকে তুমি ভালবাসে আর আজকে জানতে পেরেছো মানুষটাও তোমাকে ভালবাসে । বলে ফেল । বলে ফেল ।

রাশেদ আবার বলল
-এখন বাসায় কেন যাবে ?
-আসলে !! তুমি ওখানে যা বললে ......
-আই রিয়ালি মিন দ্যাট !
-আই নো, আই ক্যান ফিল ইট !
-তো !
-আসলে তখন থেকেই তোমাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে । এতো লোকজনে রসামনে সেটা করতে পারছি না !। তাই বাসায় চল । এখন তোমাকে আমি ঠিক-ঠাক মত জড়িয়ে ধরে চুম না খাই তাহলে শন্তি পাবো না ! প্লিজ চল !!

মিতুর দিকে তাকিয়ে রাশেদ হেসে ফেলল । ঠোঁটে আর চোখে সেই হাসি লেগেই থাকলো বেশ কিছুটা সময় তারপর বলল
-ঠিক আছে চল আজকে বাসায় ! তবে বাসায় গিয়ে আজকে তোমার খবর আছে বলে দিলাম । জড়িয়ে ধরার আসল মজা আজকে বুঝবে !! হাহাহাহা !!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৩১
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×