somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড়-গল্পঃ আরাত্রিকা

২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




এক


আরাত্রিকার মনে হল ও দিন শেষ হয়ে এসেছে । আর দৌড়াতে পারছে না । বুকের ভেতরে দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে । বারবার শ্বাস নিচ্ছে জোড়ে জোড়ে ! আর কোন ভাবেই ও বাঁচতে পারবে না । কিন্তু এভাবে বিভৎস মৃত্যু হবে ও কোন দিন ভাবতে পারে নি । ওর চোখের সামনেই ওর এতো দিনের সঙ্গীকে নৃসংশ ভাবে মেরে ফেলেছে চিতাটা । ও কেবল অবাক হয়ে দেখেছে ! একে বারে যেন জমে গিয়েছিলো । অন্য সবাই যেমন করে দৌড়াতে পেরেছে আরাত্রিকা তেমন করে পারে নি ।
একটা উচু ডালে পা বেঁধে পরে গেল আরাত্রিকা ! বুঝে ফেলল ওর দিন শেষ হয়ে গেছে । এখনই চিতাটা ওর উপর ঝাপিয়ে পড়বে । খুব সাহস করে ও চিতার দিকে ফিরে তাকালো ।
ঐ তো দৌড়িয়ে আসছে । মুখ দিয়ে চিৎকার করবে সেই শক্তিটুকুও ওর নেই ।
এই তো ওকে লক্ষ্য করে ঝাপ দিল সেটা ! আরাত্রিকা ওর বাবা আর মনে করলো । আর তাদের সাথে কোন দিন দেখা হবে না ! নিজের চোখ বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনই আরেকটা জিনিস আরাত্রিকার চোখে বাঁধলো । চিতাটা তখন শূন্যে ভেসে আছে । ঠিক ঐ জিনিসটাও শূন্য ভেসে আছে ।
আরাত্রিকার মনে হল সব কিছু যেন থেমে গেছে । চিতাটা যেখান থেকে লাফ দিয়েছিলো সেখান থেকে খুব আস্তে আস্তে ওর দিকে উড়ে আসছে তার ঠিক ডান দিকে আরেকজন মানুষও লাফ দিয়ে একই রেখা এগিয়ে যাচ্ছে চিতাটার দিকে । আরাত্রিকার নিজেরই বিশ্বাস হল না । চিতাটা ওর কাছে পৌছানোর আগেই সেই মানুষটার সাথে ওর সংঘর্ষ হল ৯০ ড্রিগ্রি কোণে । চিতাটা ছিটকে পড়লো দুরে । চিতাটা নিজেও ভাবতে পারে নি ওর সাথে এমন কিছু হবে । আরাত্রিকা তো ভাবতেই পারি নি !

কালো কাপড় পরা মানুষটাও মাটিতে ড্রাইভ দিয়ে পড়লো এবং পড়ার সাথে সাথে আবার উঠে দাড়ালো । তারপর আরাত্রিকাকে আড়াল করে দাড়ালো । আরাত্রিকা দেখলো ততক্ষনে চিতাটা আবারও উঠে দাড়িয়ে আবারও আক্রমন করার অবস্থান নিয়ে ফেলেছে । কালো পোশাকের আগন্তকের হাতেই একটা চকচকে তোলোয়ার উঠে এসেছে । আরাত্রিকা কেবল অপেক্ষা করছে যখন চিতাটা হামলা করবে !
সময় যেন থেমে গেছে । কে আগে কাকে আক্রমন করবে সেটাই এখন দেখার বিষয় । তবে আরাত্রিকা একটু আগে যেভাবে ভয় পেয়েছিলো সেটা একদম নেই । সামনে দাড়ানো মানুষটাকে সে কোন দিন দেখেনি কিন্তু ওর মনে হচ্ছে মানুষটা ওকে ঠিকই বাঁচিয়ে ফেলবে ।

ড. রেজাউল করিম পড়া থামিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালো । এতো সময় উনি আমার লেখা কাগজটা জোড়ে জোড়ে পড়ছিলো । আমাকে বলল
-এর পরের ঘটনা কি ঘটছে ?
আমি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললাম
-আমার জানা নেই । আমি এই পর্যন্তই দেখেছি !
-এই মেয়েটা সেই মেয়েটা তুমি নিশ্চিত !
-একদম ! আমি আগে যতগুলো স্বপ্ন দেখেছি এই মেয়েটাকেই দেখেছি । অন্যান্য মেয়েটার নাম ধরে অনেকে ডেকেছে । আরাত্রিকা ! আমার স্পষ্ট মনে আছে ।
-তোমার কি মনে হয় ! এই কালো পোষাক পরা আগন্তক কে ?
-জানি না ! তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা আমি নিজে হব !
-আমারও তাই মনে হয় । দেখা যাক সামনে কি হয় ! কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তুমি কেবল এই স্বপ্নটা পড়ানোর জন্য তুমি আজকে আমার কাছে এসেছো ! আমি বলেছিলাম সাত দিনের স্বপ্ন লিখে তারপর আসতে । এখানে কেবল একটা !
আমি আবারও একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললাম । তারপর বললাম
-জি আপনি ঠিকই ধরেছেন । আমি কেবল স্বপ্নের জন্য আপনার কাছে আসি নি ।
-তাহলে !
-গত কালকে এই আরাত্রিকার সাথে আমার দেখা হয়েছে !

ঘরের ভেতরে কেউ কোন কথা বলল না । আমি ডা. রেজাউলকে কি বলব, আমার নিজের কাছেই ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না । যে মেয়েটাকে আমি দীর্ঘ ছয় মাস ধরে স্বপ্ন দেখছি সেই মেয়েটা গতকালকে আমার চোখের সামনে এসে হাজির হয়েছে ।
তাও আবার আমি যে অফিসে চাকরি করি সেই অফিসেই । এটা আমার হজম করতে বেশ সময় গেলেছে । ডা. রেজাউলের হজম করতে বেশ সময় লাগলো ! অনেক সময় চুপ থাকার পরে তিনি বলল
-তোমার সাথে কথা হয়েছে তার ?
-না । কেবল চোখাচোখি হয়েছে । তবে .....
-তবে .... তবে কি ?
-তবে আমি তার চোখের দৃষ্টি দেখেই বুঝেছি যে আমি যেমন ওকে চিনতে পেরেছি মেয়েটিও আমাকে কোন ভাবে চিনতে পেরেছে । আমাকে সে চেনে এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই ।

ডাক্তার রেজাউল আর কোন কথা বললেন না । কিছু যেন ভাবছেন । এমনিতেই আমার কেসটা নিয়ে উনি বেশ ইন্টারেস্ট অনুভব করছেন আমি এটা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি ! আমি উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে চলে এলাম ! আমার মাথার ভেতরে তখনও আনিকা চৌধুরী অর্থ্যাৎ যাকে আমি ছয়মাস ধরে আমার স্বপ্নে দেখে আসছি, তার কথাই ঘুরপাক খেতে লাগলো ! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে খুব জলদি আনিকার সাথে আমার কোন একটা সম্পর্ক শুরু হবে !


দুই

আরাত্রিকাকে আমি ছয় মাস আগে থেকেই স্বপ্নে দেখা শুরু করি । কেমন করে দেখা শুরু করি কিংবা কেন দেখা শুরু করি সে বিষয়ে আমার কোন ধারনা নেই । প্রথম দিন আমি যেদিন দেখলাম সেদিন অবশ্য আমার অস্বাভাবিক কোন কিছু মনে হয় নি । কেবল দৃশ্যটা এমন ছিল যে আমি দেখলাম একটা মেয়ে বিশাল বড় কোন পুকুর পাড়ে বসে আছে । তার পা অর্ধেক পানিতে বসে আছে । মেয়েটার চেহারা দেখে কেমন বুকের মাঝে চিনচিন ব্যাথা করে উঠলো । স্বপ্নের কোথাও আমি ছিলাম না । মনে হচ্ছিলো আমি টিভি দেখছি । যাই হোক সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমি স্বপ্নটার কথা স্পষ্ট মনে করতে পারলাম এবং খানিকটা অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম যে দিন শেষে সন্ধ্যা বেলাতেও আমি মেয়েটার চেহারা পরিস্কার মনে করতে পারছি । এমনটা স্বাধারনত হয় না । আমি স্বপ্নের কথা ঘুম থেকে উঠেই ঠিক মত মনে রাখতে পারি না । তবে মেয়েটার চেহারা খুব বেশি সুন্দর ছিল বলেই হয়তো মেয়েটাকে আমার অবচেতন মন মনে রেখেছে ।

তবে যখন দ্বিতীয় দিনও আমি একই জনকে স্বপ্নে দেখলাম তখন খানিকটা নড়ে চড়ে বসতে হল । আগের দিনের ঘটনা থেকে আলাদা । এবার মেয়েটাকে আমি বড় একটা করিডোর দিয়ে হেটে যেতে দেখলাম । ঘরের সাজ সজ্জা দেখে আমার মনে হল যে এটা একটা রাজপ্রসাদ । কিন্তু তৃতীয় দিন আমি আবার যখন মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখলাম তখন মনে হল কিছু একটা ঠিক নেই । এমনটা হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন না কোন কারন আছেই ।
এভাবে দিনের পর দিন আমাকে আরাত্রিকাকে স্বপ্নে দেখতে লাগলাম । আস্তে আস্তে মেয়েটা সম্পর্কে আমি সব কিছু জেনে গেলাম । এবং মেয়েটার আসে পাশে যা কিছু ঘটছে সব কিছু আমার জানা হয়ে গেল । আমার কেবল মনে হত আমি যেন এই মেয়েটার উপর বানানো অটো বায়োক্রাফি সিনেমা দেখছি । আমার নিজের আবার কোন মানষিক সমস্যা হচ্ছে কি না সে জানার জন্য আমার পরিচিত এক সাইক্রাটিসের কাছে সব কিছু খুলে বললাম । ডা. রেজাউল খুব বেশি চিন্তিত হলেন না । আমাকে কিছু ঔষধ লিখে দিলেন আর বললেন এর পর থেকে আমি যেন সব কিছু লিখে রাখি । যা যা স্বপ্ন দেখি সব । ডাক্তার কাছে যাওয়ার ঠিক দুদিন পরেই সেই ঘটনা ঘটে গেল । আমি আরাত্রিকাকে বাস্তবে দেখতে পেলাম । একেবারে আমার অফিসে !


-স্যার বড় স্যার আপনেরে ডাকে !
আমি নিজের ডেস্কে কাজ করছিলাম । অফিসের পিয়ন এসে আমাকে এই খবর দিয়ে গেল । আমি বসে রুমে ঢুকতেই একটু অস্বস্থির মাঝে পড়লাম । কারন বসের সামনে আনিকা চৌধুরী বসে আছে । সপ্তাহ খানেক আগে আনিকা মানে আমার স্বপ্ন দেখা আরাত্রিকা এই অফিসে জয়েন করেছে । এবং এরই মাঝে অফিসের প্রত্যেকের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হয়েছে । হওয়ারই কথা । মেয়েটা দেখতে যে সুন্দর এটা কোন ভাবেই অস্বীকার করা যাবে না তবে মেয়েটার মাঝে অন্য আরও কিছু যেন আছে যেটা সবাইকে আকর্ষন করে । আমাকেও করে কিন্তু আমি নিজেকে কেন জানি মেয়েটার কাছ থেকে দুরে রেখেছি । কোন কারন নেই তবুও রেখেছি । কিন্তু খুব ভাল করেই জানি যে খুব বেশি দিন আমি সেটা রাখতে পারবো না । আজকেই হয়তো সেই দিন ।
-স্যার আসবো ?
-আরে এসো !
আমি আনিকাট ঠিক পাশের রুমেই বসে পড়লাম । একবারও তাকালাম না ওর দিকে । বস আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-শুনো তোমাকে একটা কাজ করতে হবে ।
-জি স্যার বলেন ।
-তোমাকে তো বলেছিলাম যে বনানী অফিসের অডিটের কথা । মনে আছে ?
-জি স্যার । আমি ফাইল রেডি করে রেখেছি । নিয়ে আসবো ?
-আরে আমাকে এখনই আবার একটু চট্টগ্রামে যেতে হবে । আমি ওখানে যেতে পারবো না । এই কাজটা আর কাউকে দিয়ে হবে না কারন কেউ বুঝবে না । ফাইলটা যেহেতু তুমিই তৈরি করেছো তাই কাজটা তোমাকেই করতে হবে । অফিসের গাড়ি নিয়ে এখনই রওনা হয়ে যাও । আর সাথে আনিকাকেও নিয়ে যাও । ও এখন থেকে তোমার আন্ডারেই কাজ করবে । ওকে সব কিছু শেখানোর দায়িত্ব তোমার !

আমি আনিকার দিকে তাকালাম । ও আমার দিকে তাকিয়ে কেমন চোখে হাসলো । আমিও কেবল হাসলাম । তবে এই হাসিতে আমি আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে এই মেয়ে আমাকে ঠিক ঠিক চেনে । অফিসের গাড়িতে উঠে আনিকা আমাকে প্রথম যে কথাটা বলল সেটা হল
-আপনি আমাকে পছন্দ করেন না কেন ?
আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-আমি আপনাকে অপছন্দ করি এই কথা আপনার কেন মনে হল ?
-না মানে অফিসে জয়েন করার পর থেকে সবাইকেই দেখেছি আমার কাছে এসে কথা বলতে । কেবল আপনিই একবারও আসেন নি । আমার খুব খারাপ লেগেছে ।

আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । চাইলেই তো আর বলা যায় যে আমি গত ছয়মাস ধরে তোমাকে স্বপ্ন দেখছি তোমাকে দেখলেই আমার কেমন জানি অস্বস্থি হয় । তাই আমি তোমার থেকে দুরে থাকি । এই কথাটা বলতে পারলে হয়তো ভাল হত কিন্তু বলা হল না । আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললাম
-আচ্ছা আপনি যে আমার সাথে অডিটে যাচ্ছে এটাতে কি আপনার কোন হাত আছে ? নাকি স্যার এমনিতেই আপনাকে আমার সাথে পাঠিয়েছে !
আনিকা কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল । তারপর বলল
-শুনুন মিস্টার অপু আপনি যা ভাবছেন তা একদম সঠিক ! এবং এও জেনে রাখুন যে আপনার পিছু আমি এতো সহজে ছাড়ছি না !

এই লাইনটা বলে খুব জোড়ে হাসতে লাগলো । আমার সত্যি সত্যিই কেন জানি একটু ভয় লাগতে শুরু করলো আনিকাকে । কি যেন এক অশুভ লক্ষন দেখতে পেলাম ! সামনে কোন এক ঝামেলাতে আমি পড়তে যাচ্ছি নিশ্চিত !


তিন

আমি ডা. রেজাউলের চেম্বারে সপ্তাহে একবার আসি । একেবারে শেষহ সময় । এই সময় খুব একটা ভীড় থাকে না । আমার ঠিক চিকিৎসা তিনি করেন না । বরং আমার সাথে গল্প করেন । আমার বড় মামার বন্ধু তিনি । তার রেফারেন্সেই আমি এখানে এসেছিলাম । আজকেও আমি যখন এসেছিলাম তখন দুজন রোগী অপেক্ষা করছিলো । তাদের বিদায় করে দিয়েই আমার সাথে বসলেন । আমি ঘরে ঢুকে দেখি আমার জন্য এক কাপ চা টেবিলের উপর রাখা । চা আগে থেকে বানানো ছিল ।
আজকেও পকেট থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে দিলাম । সেদিকে না গিয়ে দা. রেজাউল বলল
-আজকে লেখা গুলো পড়ে পড়বো । তার চেয়ে বরং তুমি নিজের মুখে বল কিছু শুনি !
-কি বলব বলুন ?
-তুমি যা যা দেখো । নিশ্চয়ই একটা প্যাটার্ন আছে । যদিও আমি বেশ কিছু বুঝতে পেরেছো তবুও আরও কিছু বল শুনি । আসলে আমার ঠিক মনে হচ্ছে না যে এই জন্য তোমার কোন প্রকার ভয় করার দরকার আছে । কেমল আমি ধরতে পারছি না তুমি এতো পরিস্কার ভাবে এতো কিছু কিভাবে জানতে পারছো ।
-আমার নিজের কাছেও সেটা অষ্পষ্ট ।
-তার উপর ঐ মেয়েটার সাথেও তোমার কিভাবে সত্যি সত্যিই দেখা হয়ে গেল ?
-আমিও অনেক ভেবেছি কিন্তু কিছুই বের করতে পারি নি ।

আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম । কি বলবো প্রথমে ঠিক মাথায় এল না । কারন অবস্থাটা এমন যে আমি নিজে ঐ জীবনটা যাপন করছি । এখন কাউকে যদি বলা হয় তুমি তোমার জীবনের গল্প শুরু কর তাহলে সে একটু ইতঃস্তর করবে কোথা থেকে শুরু করবে এই ভেবে ।

রাজ্যটার নাম আবীন্ড্রগড় । এর রাজার নাম ছিল আবীন্ড্র যে কিনা আরাত্রিকার বাবা । রাজ্যটা একটা ছোট রাজ্য এবং এর চারিপাশে ঘিরে ছিল একটা বড় রাজ্য । নাম "টুরানবে" । শক্তিতে টুরানবে আবীন্ড্রগড়ের থেকে অনেক বড় ছিল । মাঝে মাঝে এদের মাঝে যুদ্ধ হত তবে ছোট হলেও আবিন্ড্রগড়ের সামরিক শক্তি কিন্তু খারাপ ছিল না । তবে তার উপরে এই রাজ্যের আরেকটা শক্তি ছিল । এখানকার রাজ তান্ত্রিক । সে বেশ শক্তিশালী একজন মানুষ ছিল । বলা যায় রাজার পরেই তার সম্মান ছিল । টুরানবে যে আবীন্ড্রগড়ে আক্রমন করতো না তার অন্যতম কারনও ছিল এই রাজ তান্ত্রিক মশাই । অনেক জাদুটোনা সে জানতো ।
তবে আমি যখন থেকে সেখানকার সব কিছু দেখা শুরু করেছি তাতে বুঝতে পেরেছি হুব শীঘ্রই টুরানবে আবীন্ড্রগড়ে আক্রমন করবে এবং এবার রাজতান্ত্রিকের জাদুও সেই আক্রমন থেকে রাজ্যকে রক্ষা করতে পারবে না । সেই জন্যই রাজ তান্ত্রিক "জীবন-সুধা" বানানোর প্রস্তাব রেখেছে । কারন এক মাত্র জীবন সুধাই পারে রাজ্যের সব বিপদ দুর করতে ।

-জীবন সুধাটা কি ?
-এটা এমন একটা জাদুকরী ঔষধ সেটা যে পান করবে সে অনন্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাবে । কিন্তু চাইলেই যে কেউ এই জিনিস বানানে পারবে না । অনেক নিয়ম কানুন আর অনেক দুর্লভ জিনিস দরকার প্রয়োজন এই জিনিস বানানোর জন্য ।
ডা. রেজউলের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি আসলেই বেশ আগ্রহ বোধ করছেন । এমন কেস হয়তো এর আগে আর কোথাও পান নি । কেসের সমাধান না হোক, শুনতে মজা তো পাচ্ছেন ।





কালো কাপড় দিয়ে মোড়ে বোতলটা মহারাজ আবীন্ড্রর সামনে তুলে দু হাত দিয়ে তুলে ধরলো । মাথাটা খানিকটা নিচু করে সম্মান জানালো অনন । মহারাজ আবীন্ড্র নিজের আসন থেকে উঠে এসে অননের সামনের এসে দাড়ালো । তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি আজকে অনেক খুশি হয়েছেন ।
অননকে উঠে দাড়ানোর নির্দেশ দিলেন । অনন উঠে দাড়াতেই তাকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন । আজকে অনন তার জন্য এমন কিছু নিয়ে এসেছে যা অনেক দিন ধরেই তার কাঙ্খিত ছিল । অনেক কেই তিনি সেখানে পাঠিয়েছেন কিন্তু কেউ সেটা আনতে সক্ষম হয় নি ।

জড়িয়ে ধরেই অননকে বললেন
-আজকে তুমি আমাকে খুশি করে দিয়েছো বেটা ! সেদিন আমার মেয়েকে চিতার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে আজ এই কাঙ্খিত রক্তমনি নিয়ে এসেছে । তুমি কি চাও বল !
অনন কিছু না বলে কেবল হাসলো ।
মহারাজ বলল
-বল বল আজকে যা চাইবে তাই পাবে তুমি আমার কাছে ।
-আমার কিছুই চাই না মহারাজ । আপনার অনেক দয়া !
মহারাজ হাসলেন । তারপর বললেন
-তোমার যেমন ইচ্ছে ।
-মহারাজ আমি কি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি ?
-হ্যা হ্যা অবশ্যই । বল ।
-আপনি এই রক্তমনি দিয়ে কি করবেন ?
-আমার মনে হয় তুমি জানো আমি কি করবো ।
-কিন্তু আপনার মনে হয় না এটা করা ঠিক হবে না ?

মহারাজ অননের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । অন্য কেউ হলে এই প্রশ্ন করার সাহস পেত না হয়তো কিন্তু অননের কথা আলাদা । সবার সাথে তার তুলনা করা চলে না । মহারাজ বললেন
-তোমার কেন মনে হয় এটা ঠিক হবে না ?
-একটা ব্যাপার আপনি কি লক্ষ্য করছেন যে এটা প্রকৃতির নিয়মের বিপরীত । আপনি যদি রক্তমনি দিয়ে যে কাজটার জন্য ব্যবহার করতে যাচ্ছেন সেটা পেয়ে গেলে কি হবে একবার ভেবে দেখেছেন । আপনার কাছ মানুষ গুলো আপনার চোখের সামনে বৃদ্ধ হয়ে মারা যাবে কিন্তু আপনি বেঁচে থাকবেন । একটা সময় দেখবেন আপনার কাছে আর কেউ নেই । বেচে তো থাকবেন আপনি কিন্তু আপনার কাছের কেউ আপনার পাশে থাকবে না তখন ? আপনার হাতে অসীম ক্ষমতা থাকবে কিন্তু আপনি সেটা কার জন্য প্রয়োগ করবেন ? কাকে বাচাবেন তখন যদি কাছের কেউ বেঁচেই না থাকে ?

মহারাজ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন । কিছু যেন ভাবছেন । তারপর বলেলন
-হয়তো । কিন্তু এটা আমি নিজের জন্য না, আমার পুরো রাজ্যের জন্যই করতে চাই । একদিন হয়তো তুমি বুঝতে পারবে । আমার নিজের জীবন হয়তো দুর্বিশহ হয়ে পড়বে কিন্তু এই রাজ্যটা রক্ষা পাবে । এটাই কেবল আমার চাওয়া । একজন রাজা হয়ে নিজের থেকেও রাজ্যের কথা রাজ্যের মানুষের কথাটাই আগে ভাবা !
অনন আর কিছু না বলে চুপ করে গেল । এই দিকটা সে ভেবে দেখে নি । মহারাজ তারপর বলল
-আচ্ছা যাই হোক । এসব কথা এখন চিন্তা না করলেও চলবে । তোমার জন্য আরও কেউ অপেক্ষা করে আছে । তোমাকে আমি এই ভয়ংকর কাজে পাঠিয়েছি বলে আমার উপর সে রাগ করে বসে আছে । তুমি গিয়ে তার রাগ ভাঙ্গাও !

এই লাইণ বলেই তিনি হাসলেন । অননও হাসলো । তারপর বুঝতে কষ্ট হল না কে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে ।


চার

বাড়ি না বলে এটাকে বলা উচিৎ রাজপ্রসাদ । কিন্তু কিছুই আর ঠিক অবশিষ্ট নেই । চারিধারে বন জঙ্গলে ভরে গেছে । আমি শত ভাগ নিশ্চিত আমি এর আগে কোন দিন আসি নি, কিন্তু আমার কাছে সব কিছু কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে । আমি খুব ভাল করেই জানি যে এই যে বড় রাজপ্রসাদটা দেখা যাচ্ছে এটার ঠিক পিছনের একটা বিশাল বড় দীঘি আছে । দীঘির ঠিক ডান দিকেই একটা বড় জারুল গাছ থাকার কথা । জানি না আছে কি না ।

আমি গেটের কাছে দাড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুটা সময় । আনিকা কখন আমার পেছনে চলে এসেছে আমি লক্ষ করি নি । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এটাই হচ্ছে আমাদের পূর্ব পুরুষদের বসতবাদি । এক কালে এখানকার রাজা ছিলেন তারা ।



গতকাল রাতে আমি আনিকার সাথে এখানে এসেছি । একটু দুরে একটা সুদৃশ্য দুইতলা বাসা আছে ওর । ও গল্প করছিলো এই এলাকাটা নাকি সম্পূর্ণটাই নাকি ওদের । এবং এটার সব টুকুর মালিক ও একা । ওর নাকি আর কেউ ই নেই । একাই সব দেখাশুনা করে । সব টুকুই গ্রামের মানুষদের বর্গা দেওয়া আছে যার থেকে নাম মাত্র খাজনা ও নেয়, আর সেটা কিছুই না । বাড়ি দেখা শুনা করার জন্য লোক আছে । তারাই দেখা শুনা করে ।
তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম কাল আসার পর থেকেই যে ওকে দেখে ওর বাড়ির সবাই বেশ ভয় পায় । অন্তত ওদের চেহারা দেখে তো তাই মনে হল । একটা ২২/২৩ বছরের মেয়েকে এতো ভয় পাওয়া কোন কারন খুজে পেলাম না আমি । তার উপর মেয়ে যদি এতো সুন্দরী হয় ।
কেবল জসীম নামের এক লোক আছে সে সব সময় গম্ভীর মুখে আমাদের চারিপাশে গোরাফেরা করছে । সে আনিকাকে বেশ সমীহ করে চলে এটা বুঝতে পারলাম । আর রাতে কাজের লোক জনদের আর কেউ এখানে থাকে না । সবাই কাজ শেষ করে নিজেদের বাসায় চলে যায় । কেবল জসীম নামের কাজের লোকটা এই বাড়িতে থাকে ।

আমি গতরাত জমীমকে জিজ্ঞেস করলাম
-এতো বড় বাসা, চোর ডাকাত আসে না ।
কথাটা শুনে জসীম এমন ভাবে হাসলো যেন আমি খুব মজার কোন কথা বলেছি । বলল
এতো বড় বুকের পাটা এই এলাকার কেউ নাই যে এই বাড়িতে এসে চুরি করবে ।
কথাটা বলার মধ্যেই কেমন যেন একটা ভাব ছিল যেটা আমার মোটেও ভাল লাগলো না ।




আমি প্রথমে যেমনটা ভেবেছিলাম ঠিক তেমনই হয়েছে । আমি নিজেকে ওর থেকে কিছুইতেই দুরে রাখতে পারি নি । আনিকা অফিসে জয়েন করার পর থেকে আমার সাথে কেমন যেন আঠার মত লেগে থাকতো । ও আমার সাথে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেল । আমার সকাল থেকে শুরু করে একেবারে রাতের ঘুমানোর আগ পর্যন্ত মেয়েটা আমাকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না । আমার ওর আচরন দেখে মনে হতো আমি যেন অনেক দিন আগে ওর কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলাম তারপর আবার ফিরে এসেছি । ছয় মাসের ভেতরে ও আমার জীবনের এতো কাছে চলে আসবে আমি ভাবি নি । আমার নিজেরও ওর সাথে সময় কাটাতে ভাল লাগতো । সময় কেবল উড়ে উড়ে চলে যেতে লাগলো ।
আর আমিও সেই স্বপ্ন গুলো যেন ভাল করে দেখতে শুরু করলাম । আরাত্রিকার সাথে কি হয়েছে কখন হয়েছে কিভাবে হয়েছে । সব কিছু । আমি সকাল থেকে রাট পর্যন্ত আমার এই জীবন যাপন করতাম আর ঠিক রাতের বেলা চোখ বন্ধ করার পরপরই চলে যেতাম আরাত্রিকার সময়ে । সেখানে আমার চরিত্রের নাম ছিল অনন । বীর এক যোদ্ধা । যার কাছে অসাধ্য কিছু নেই । আরাত্রিকাকে সে ভালবাসে ঠিক যেমন টা ভাল বাসে আরাত্রিকা নিজেও ।

আমি অনেক চেষ্টার পরে একদিন আমার স্বপ্নের কথা ওকে বলেই ফেলললাম । বলার পরেই আনিকা আমার দিকে কেমন চোখে তাকাতে লাগলো । তারপর যা বলল সেটা শুনে আমি নিজেও অনেকটাই অবাক হয়ে গেলাম । ও নিজেও নাকি ঠিক একই ভাবে আমাকে স্বপ্ন দেখতো । নিজেকে সে রাজকুমরী আর আমাকে রাজ্যের এক বীর যোদ্ধারূপে দেখতো । ও যেদিন আমাকে প্রথম দেখেছিলো সেদিনই ও আমাকে চিনতে পেরেছিলো । তবে আমি ওর কথা শুনে হাসাহাসি করতে পারি এই কথা ভেবে ও আর বলে নি ।

এক দিন কথা বলতে বলতে ও নিজেই ওর পূর্ব পূরুষের কথা তুলল । তারপর বলল যে ওদের একটা রাজবাড়ি আছে । এখন যদিও সেখানে আর কেউ থাকে না তবে এখনও টিকে আছে সেটা । আমি যদি চাই তাহলে সেটা ঘুরে আসতে পারি । তখনই আমার মনে হল জায়গাটা আমার দেখা দরকার । আমার স্বপ্নের সাথে জায়গাটার যে মিল থাকবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম । তাই দুজনেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রওনা দিয়ে দিলাম ।

আজকে সকালে নাস্তার পরেই একখানে এসে হাজির হলাম । গাড়ি যখন চলছিল তখনই আনিকা ওর এই এলাকার সব ইতিহাত বলতে শুরু করলো কিন্তু আমি সেদিকে খুব বেশি মনযোগ দিলাম না । ও যা যা বলতেছিলো তার অনেকটাই আমি জানি । আমি কেবল চারি পাশে দেখছিলাম । হুবাহু আমার স্বপ্নে দেখা এলাকার মত । বারবারই মনেথতে লাগলো যে আমি এই এলাকাটা চিনি । খুব ভাল করেই চিনি ।
আমি বললাম
-চল তো ভেতরে যাওয়া যাক ।
আনিকা আমাকে তাড়াতাড়ি করে বলল
-না না খবরদার না । এটার অবস্থা একদম ভাল না । গত মাসে দেখ একপাসটা ধসে পড়েছে । একটু পড়াচড়া কিংবা জোড়ে বাতাস হলে বাকিটা ধসে পড়বে । ভেতরে কোন ভাবেই যেতে হবে না ।
-আরে কিছু হবে না ।
-জি না । মোটেই সেসব কিছু হবে না । ভেতরে যাওয়া হচ্ছে না মানে হচ্ছে না । তার চেয়ে বরং পাশ দিয়ে পেছন দিকটা যাই । ওখানে বসার জায়গা আছে ।
আমি আর কিছু বললাম না । আনিকার ভয়ের কারনটা আমার বুঝতে খুব একটা কষ্ট হল না । আসলেই রাজ প্রাসাদের অবস্থা মোটেই ভাল নয় । ভেতরে ঢুকলে খানিকটা ঝুকি নেওয়া হয়েই যায় !


আমার হাত ধরেই ও ভেতরে হাটতে লাগলো । হাটতে হাটতে যখন প্রসাদের পেছনে এসে হাজির হলাম তখনই পেছনটা আমার মনে হল এখানে আমি আগেও এসেছি । অনেকবার এসেছি । আমি আসি নি তবে অনন এসেছে ।
ঐ তো বড় পুকুরটা তবে সেটার চারিপাশে এখন কেবলই বনজঙ্গলে ভরপুর । তবে এক সময়ে এটা যে একটা বড় পুকুর ছিল সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না । ডান দিকে একটা গাছও দেখা যাচ্ছে । সেটার নিচে বসার জায়গাটা এখনও খানিকটা চেনা যাচ্ছে ।
আনিকা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আসো ওখানে বসি !
আমি চুপচাপ ওকে অনুসরন করতে লাগলাম ।

আমি আগেও আরাত্রিকার পাশে বসে থাকতাম এখানে । আরাত্রিকার পাশে । মেয়েটা সারাদিন বসে থাকতো একখানে । আমার সাথে তার কত কথা ।

আনিকা বলল
-আচ্ছা তোমার আর আমার কানেশনটা কি এখনই বের করতে পেরেছো ?
-জানি না ।
আমি ডাক্তার রেজিউলের কথা মনে পড়লো । আমি তার কাছে যাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছি । আমি তাকে আমার মত করে একটা ব্যাখ্যা বলেছিলাম তবে তিনি সেটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে । তিনি আমাকে এই স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা পেছনে যে কারনটা বলেছে সেটা বোগাস ছাড়া আর কিছু মনে হয় নি । সব কিছুকে অবচেতন মনের খেলা আর কিছুই নাম দিতে নারাজ ।

-কিন্তু তোমার সাথে আমার কানেকশনটা কি বল তো ?
-আমি নিজেও এটা বোঝার চেষ্টা করেছি । কিন্তু কোন কিছুই বের করতে পারি নি ।
-আমার কি মনে হয় জানো ?
-কি মনে হয় ?
-মনে হয় যে কোন এক অতীতে আমি তোমার প্রেমিকা ছিলাম । কিন্তু কোন এক কারনে আমরা এক হতে পারি নি । পরে আবারও আমার জন্ম হয়েছে ।
-পুনর্জনম বলছো ? এটাতে তোমার বিশ্বাস হয় ?
-হয় না । আধুনিক বিজ্ঞান সেটা বিশ্বাস করতে দেয় না কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার বাইরেও তো অনেক কিছু হয় । আসলে আমার কাছে এর থেকে ভাল ব্যাখ্যা আর কিছু নেই । অবশ্য আমার যে খুব একটা ব্যাখ্যা জানার দরকার সেটাও না । তোমার সাথে অতীতে আমার যোগাযোগ যাই হোক না কেন তুমি এখন আমার বর্তমান এবং তোমাকে আমি আমার ভবিষ্যৎ বানাতে চাই । আমি কেবল এই ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই । আর কিছু না !


পাঁচ

অন্ধকার নেমে এসেছে অনেক সময় আগেই । চারিদিকে শান্ত আর আর জনমানুষ শূন্য পরিবেশ । আরাত্রিকা দক্ষিনের দীঘির পাড়ে চুপ করে বসে আছে । একা । তবে সে জানে সে এখানে একা নেই । একটু দুরে দুরে বেশ কয়েকজন প্রহরী পাহারা দিচ্ছে । চারিদিকের অবস্থা মোটেও ভাল নয় । তার রাজ্যের খবর ভাল নয় মোটেও । গত কালকে তারা পাশের টুরানবের হামলায় প্রায় পরাজিত হয়ে গিয়েছিলো । কোনমতে এবারের হামলাটা সামলে নিয়েছে । তবে এটা সামনের বার হবে না সেটা মহারাজ যেমন জানে ঠিক তেমন রাজ্যের প্রতিটা মানুষ খুব ভাল করেই জানে । মহারাজ সহ রাজ্যের সবাই এটা নিয়ে চিন্তিত খুব বেশি ।

এমন সময় কারো আসার আওয়াজ হল । এখানে আসার কারো অনুমুতি নেই । যখন আরাত্রিকা এখানে থাকে তখন মহারাজ কিংবা মহারানী ছাড়া আর একজনই কেবল এখানে আসতে পারে ! আরাত্রিকা মুখে তুলে তাকাতেই কালো আধারের মধ্যে সেই পরিচিত অবয়বটা দেখতে পেল । এতো চিন্তার মাঝে একটু আন্দের রেখা পাওয়া গেল । আরাত্রিকা উঠে আননকে জড়িয়ে ধরে ধরলো ।
-তুমি এসেছো ?
-আমাকে তো আসতেই হত !
-আমার একদম ভাল লাগছে না । কেমন দম বন্ধ আসছে । চারিদিকে এতো বদ্ধ পরিবেশ । আমার একদম থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে ।
-আমি খবর নিয়ে এসেছি ।
-কি
-ভাল না । ওরা আবারও আক্রমন করবে । এবার ওরা ওদের পূর্ণ শক্তি নিয়েই আসবে । তখন আমাদের টিকে থাকা সম্ভব হবে না ।

আরাত্রিকার চোখে দিয়ে পানি বের হয়ে এল । অনন হাত দিয়ে সেই চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
-এখানে তুমি কিংবা আমি কিছুই করতে পারবো না । আমার উপর দায়িত্ব আছে আমি তোমাকে দুরে কোথায় নিরাপদ নিয়ে যাই ।আমিও তাই চাই
-না, আমি এই জায়গা ছেড়ে কোথায় যাবো না । কোথাও না ।
-তুমি বঝতে পারছো ওরা তোমাকে পেলে কি করবে ?
-মেরে ফেলবে তো ?
-মেরে ফেলবে ?
অনন হাসলো । তারপর বলল
-মেরে ফেলল সেটা তোমার জন্য আশীর্বাদ হবে । কিন্তু ওরা তোমার এমন অবস্থা করবে যে তুমি প্রতিটা মুহুর্ত মৃত্যু কামনা করবে কিন্তু ওরা তোমাকে মরতে দিবে না । আমি এটা হতে দিতে পারে না ।
-তুমি আমাকে রক্ষা করবে না ?
-আমি তোমাকে আমার জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত রক্ষা করে যাবো কিন্তু তারপর ? আমি মারা যাওয়ার পরে তোমার কি হবে ? ভেবে দেখেছো কি ?
-এক মাত্র জীবনসুধাই আমাদের রক্ষা করতে পারে ।
অনন চুপ করে গেল । কিছুটা সময় ভাবলো কি যেন । তারপর বলল

-আমারও তাই মনে হয় । যদিও আমার এতে মত নেই । মহারাজ কি প্রস্তুত ?
-হ্যা কিন্তু একটা বড় সমস্যা আছে । জীবন সুধা তৈরির জন্য সব কিছু জোগার হলে গেলেও এখনও আসল জিনিস টা ....
-পাওয়া যাচ্ছে না ? আমাকে বল আমি যাবো আনতে । আগের বারও আমি তো সব থেকে কঠিন জিনিসটা এনেছিলাম ।
-না ব্যাপারটা সেরকম না । জীবন সুধার তৈরির সব কিছু হাতের কাছে আছে । আর একটা জিনিস .....।
আরাত্রিকা থেমে গেল ।
-কি হয়েছে বল আমাকে । মহারাজও আমাকে কিছু বলল না এ ব্যাপারে ।
-আসলে ওটা তুমি আনতে পারবে না । ওটা আমার ভেতরে রয়েছে ।
অনন কিছুটা সময় হতবুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো । আরাত্রিকা বলল
-জীবন সুধার যার জন্য তৈরি হবে সে পাবে অনন্ত যৌবন আর অপার ক্ষমতা কিন্তু এতো কিছু তো আর বিনা ত্যাগে পাওয়া যাবে না । যার জন্য তৈরি করা হবে, তার সব থেকে প্রিয় জিনিসটা উৎসর্গ করতে হবে মহা দেবি ইউকিটাসের সমীপে ।

অননের বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগলো । তারপর বলল
-তোমার বাবা মানে মহারাজের সব থেকে প্রিয় সব থেকে ভালবাসার জিনিস হচ্ছো তুমি ?
আরাত্রিকা মাথা নোয়ালে !
অনন আর কিছু ভাবতে পারলো না । এখন ও কোন দিকে যাবে । ও আসলে আর কিছুই করার নেই । এতো বড় সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জেতা কোন ভাবেই সম্ভব নয় । আর যে একটা সম্ভবনা রয়েছে সেটা করতে গেলে হারাতে হবে তার ভালবাসাকে ।


ঘুম ভেঙ্গে গেছে অনেক আগেই । তবে এখনও সকাল হতে অনেক বাকি । এখানে আসার পর থেকে এই এক ঝামেলা হয়েছে । ঢাকাতে থাকার সময় ঘুমাতে দেরি হত । কারন সেখানে রাতে করার মত অনেক কিছুই ছিল । কিন্তু এই গ্রামে তেমন কিছুই করার নেই । নেটের স্পীড এতো স্লো যে কোন নেট ব্রাউজিংও করতে ইচ্ছে করে না । তাই জলদি জলদি ঘুমিয়ে পড়ি । আর তাই প্রতিদিনই এই সময়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় ।

আমি বাইরে বের হয়ে এলাম । পুরো বাড়িটা কেমন নিঝুম হয়ে আছে । কোথায় কোন আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না । এমন কি ঝিঝি পোকার ডাকও আমি শুনতে পাচ্ছি না । গ্রামে আমি এর আগেও অনেকবার গিয়েছি । সেখানে আর যাই হোক ঝিঝি পোকার আওয়াজ তো থাকে খুব । কিন্তু এই এলাকাটা যেন একেবারে শান্ত । আমি সামনে বারান্দার দিে হাটা দিলাম । যখনই আনিকার ঘরটা পার করতে যাবো তখনই দরজা নড়ে উঠলো । এবং তার সাথে সাথেই পর্দা সরিয়ে আনিকা বারান্দায় এসে দাড়ালো । আমার মনে হল ও যেন দরজার পাশের দাড়িয়ে ছিল । আমার ঘর থেকে বের হওয়ার অপেক্ষা করছিলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কোথায় যাও ?
-আরে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছো ? রাতে ঘুমাও না নাকি ? কারলকেও এমন করে বের হয়ে এলে !
-সরি । আসলে এখানে একদম নিশ্চুপ তো সব কিছু তাই একটু শব্দেই ঘুম ভেঙ্গে যায় !
-আসো ঐ উঠানে বসি ।

আমি আনিকার হাত ধরে হাতরে লাগলাম । বারান্দার শেষ মাথায় গিয়ে রোয়াকের উপর থেকে পা ঝুলিয়ে বসলাম দুজন । বললাম
-একটা কথা জানতে চাইবো ?
-হুম বল ।
-তোমার বাড়ির কাজের লোকজন তোমাকে এরকম ভয় পায় কেন বলতো ?
-তাই নাকি ?
-হ্যা । ওদের চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায় । তার উপর কাল যখন আমরা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখনই আমার ব্যাপারটা এরকম মনে হয়েছে । ওরা কেমন যেন ভয়ে ভয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলো ।

আনিকা হাসলো । বলল
-আসলে আমাদের রাজ পরিবার তো এখানে আদি কাল থেকেই এমন হয়ে যাচ্ছে । আমাদের দিকে কেমন ভয়ে ভয়ে তাকায় ওরা !

আমি আর কথা বাড়ালাম না । তবে আমার কেন জানি মনে হল আনিকা আমার কাছে আসল কথাটা বলল না ।


ছয়

অননকে আসতে দেখেই আরাত্রিকা ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো । সারাটা দিনই অনন যুদ্ধক্ষেত্রেই ছিল । সেখান থেকে জরুরী তলব দিয়ে তাকে ডেকে আনা হয়েছে ।

-কি হয়েছে ? আমাকে এভাবে ডেকে আনার মানে কি ?
-মহারাজ জীবনসুধা দিকে মত দিয়েছেন । তার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে ।
-না । মোটেই এমনটা হতে পারে না । আমি তোমাকে এমন করতে দিবো না
-একটু বোঝার চেষ্টা কর ।
-না তুমি বোঝার চেষ্টা কর । আমি কোন ভাবেই তোমাকে যেতে দিবো না ।


অনন জানে তার এই না বলাতে কিছুই হবে না । মহারাজ একবার যা ভেবেছেন তা করবেনই এবং এটাই এখন তাদের সামনে খোলা এক মাত্র পথ । অন্য কোন উপায়ে এই রাজ্যকে বাঁচানোর উপায় নেই । কিন্তু তারপরেও নিজের চোখের সামনে নিজের ভালবাসার মানুষকে এভাবে চলে যেতে দেখাটা অনেক কঠিন একটা কাজ ।
অনন কেবল অশ্রু সজল চোখে আরাত্রিকার দিকে তাকিয়ে রইলো । মেয়েটার চোখে মারা যাওয়ার কোন ভয় সে দেখতে পাচ্ছে না তবে সেখানে কিছু একটা হারানোর কষ্ট স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে । কাছের মানুষ গুলোকে ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে এই কষ্ট ।

-আমি কি আসবো তোমার সাথে ?
-হ্যা । আমি চাই তুমি আসো ।

অনন তারপরেই মত বদলালো । বলল
-না আমি আসবো না । আমি এটা দেখতে পারবো না । আমি দেখতে পারবো না । তুমি যাও ।
আরাত্রিকা অননের হাত ধরলো । তারপর বলল
-তুমি চল আমার সাথে । দয়া করে চল ।


রাজতান্ত্রিক মাজাহুরা আগে থেকে সেখানে উপস্থিত ছিল । সেই সাথে মহারাজ নিজে । আরও কিছু সৈন্য সেখানে পাহারা দিচ্ছে । এরা মহারাজের একান্ত কাছের যোদ্ধা । অনন চারিদিক দেখতে লাগলো । সব কিছুতেই কেমন অশুভ একটা ব্যাপার রয়েছে । খুব একটা দেবির মুর্তি দেখা যাচ্ছে । এটাই ইউকিটাসের মুর্তি । পুরো রাজ্যে কেবল এই একটা মুর্তিই নাকি আছে । অন্য কারো এখানে আসার অনুমুতি নেই ।

ইউকিটাসের মন্দিরটাও বানানো হয়েছে রাজ প্রাসাদের নিচে । কেবল রাজ প্রাসাদের ভেতরে দিয়েই এখানে আসা যায় । তাও যারা যারা এর পথ চেনে কেবল তারাই পথ চিনে আসতে পারবে । নয়তো কেউ সেই পথ খুজে পাবে না ।

হঠাৎ রাজতান্ত্রিক মাজাহুরা বলে উঠলো
-সময় হয়ে গেছে !


সাত

আনিকা তখনও আমার কাছেই বসে আছে আমাকে জড়িয়ে ধরে । আজকে ওর মনটা কেন জানি বেশ অস্থির মনে হচ্ছে । গত কাল রাতের দেখা স্বপ্নটা ওকে বলতেই ও কেমন যেন চুপছে গেছে । কোন কথা বলছে না ।
আমি বললাম
-আচ্ছা তোমাদের এই পুরানো প্রসাদের নিচে কি কোন গুপ্ত ঘর আছে ?
আমার কথা শুনে আনিকা কেমন যেন চমকে উঠলো । তারপর বলল
-কেন ?
-না কালকের স্বপনের কথা টা বললাম না ? আমার মনে হয় কিছু একটা আছে । চল খুজে দেখি ।
আনিকা বলল
-কি দরকার ? কত দিনের পুরানো প্রাসাদ তুমি জানো । যদি ভেঙ্গে পড়ে ?
-আরে কিছু হবে না । কোন সমস্যা নেই ।
-না । আমি তোমাকে ওখানে যেতে দিবো না !

আমি বললাম
-তার মানে তুমি জায়গাটা যেন !

আনিকা কি বলবে খুজে পেল না । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো অসহায়ের মত । ওর চোখ ফেটে যেন এখনই কান্না বেরিয়ে আসবে । আমি আর ওকে জোর দিলাম না । কিন্তু মনের ভেতরে কেমন একটা অনুভুতি চলতে লাগলো । মনে হতে লাগলো যে আমাকে ঐ জায়গাটায় যেতেই হবে । তাহলেই এই সব কিছুর সমাধান হবে ।

মনে মনে ঠিক করে রাখলাম যে রাতে আনিকা ঘুমিয়ে গেলে এখানে চলে আসবো একা একা । যদিও একট ভয়ের বিষয় তবুও খুব একটা সমস্যা হবে না

রাতের বেলা বের হতে কোন সমস্যাই হল না । আমি আগে থেকেই টর্চ যোগার করে রেখেছিলাম । একটু একটু ভয় ছিল যে আনিকা হয়তো টের পেয়ে যাবে । কিন্তু ওর দরজাটা পার করার সময় দেখলাম দরজা খুলে গেল না ।

বাইরে বেরিয়েই একটু সমস্যার ভেতরে পড়লাম । অনুভব করতে পারছিলাম যে বাইরে বেশ বাতাশ হচ্ছে । সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি । একবার মনে আবার ঘরে ফিরে যাই । এই বৃষ্টির ভেতরে বাইরে বের হয়ে লাভ নেই । তবে কি একটা অচেনা আকর্ষন আমাকে তখন পেয়ে বসেছে । বারবার বলছে সেই ঘরে যেতে । সেই তান্ত্রিকের ঘরে কিছু একটা আছে যেটা দিয়ে অনেক কিছুর জবাব হয়তো পাওয়া যাবে । মোট কথা আমাকে সেখানে যেতেই হবে । আমার কেন জানি দেরি সহ্য হচ্ছিলো না । আর একটু খানি পথ যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না ! একটু একটু ভয় ভয় করছিলো তবে সেটাকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না । খুব বেশি সময়ও লাগলো না সেই পুরাতন রাজপ্রাসাদে আসতে । কিন্তু রাজপ্রসাদে আসতে আস্তে একেবারে ঝড় নেমে গেল । আমি আগের এদিক ওদিক তাকিয়ে তারপর সোজা ঢুকে পড়লাম ভেতরে ।

টর্চের আলোতে কেমন ভুতুলে লাগছে সব কিছু তবে আমার কাছে সবই কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে । একদম হুবাহু আমি যেমন স্বপ্নে দেখেছি তেমন । আমি একটা পর একটা ঘর পার হতে লাগলাম । আমি ঠিক ঠিক জানি আমাক কোথায় যেতে হবে ।

এই তো এইটা রাজকুমারী আরাত্রিকার ঘর । এখানেই সে থাকতো । এর পাশেই তার স্নান কক্ষ । এর পেছনেই আছে তার প্রসাধনীর ঘর । আমার সব কিছু মনে হতে লাগলো । আমি একটা পর একটা ঘর পার হতে লাগলাম । এখন ঘর গুলো দাড়িয়ে আছে ভাবতেই আমার অবাক লাগছে । তবে এগুলোর অবস্থা খুব বেশি ভাল নয় । যে কোন সময় ধসে পড়তে পারে । আনিকা আমাকে আগেই সাবধান করেছিলো । কেন করেছিলো আমার বুঝতে কষ্ট হল না ।

আমি নির্ধারিত ঘরটাতে পৌছে গেলাম । এই ঘর দিয়েই নিচে নামতে হবে । একটা ছোট পাথর সরাতে হবে তাহলেই পথ পাওয়া যাবে । কিন্তু ঘরে এসে দেখলাম পথটা এমনিতেই খোলা এবং সেখান থেকে একটা আলোর আভা আসছে । সেই সাথে মৃদু কথা-বার্তার শব্দ । আমার শরীর টা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল । আমি আরেকবার নিজেকে সাবধান করার চেষ্টা করলাম । মনটা দুদিকে চলে গেল । এক দিক বলছে এখনই এখান থেকে চলে যেতে । এতো কৌতুহল মোটেই ভাল কিছু না । আরেক মন বলছে এখানেই থাকতে । ভেতরে কি হচ্ছে সেটা দেখে যেতে । কৌতুহলের কাছে সব কিছু পরাজিত হল । আমি আস্তে আস্তে ভেতরে পা দিলাম । কাউকে খোজার চেষ্টা করলাম কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম এই দেখে যে ভেতরে কেউ নেই ।
তাহলে একটু আগে যে কারো কথা বলার আওয়াজ শুনছিলাম সেটা কি ?
এই আগুন তো ঠিকই জ্বলছে ?
এটা কে জ্বালালো ?
এতো রাতে এখানে কি হচ্ছে ?

আমি আরেকটু ভেতরে ঢুকতেই ইউকিটাসের মুর্তিটা দেখতে পেলাম । আমি কিছুটা সময় মন্ত্র মুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলাম । কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম আমি নিজে জানি না । হঠাৎ বাইরে কোথাও যেন বজ্রপাত হল । পুরো প্রসাদটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো । আমি খুব ভাল করেই সেটা অনুভব করতে পারছি । আমার মন্ত্রমুগ্ধতার ভাবটা কেটে গেল । আমি আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম । আরও একটু কাছে যেতেই আমি দেখতে পেলাম দেবী মুর্তির ঠিক সামনে একটা কফিন টাইপের কিছু দেখতে পেলাম ।

আমি সেটা দেখার জন্য আরও এগিয়ে গেলাম । কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই আমার রক্ত হিম হয়ে গেল । কারন কফিনের ভেতরে একটা মানুষের লাশ । চামড়া অনেকটাই কুচকে গেছে কিন্তু তার চেহারা যে একদম আমার মত সেটা বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হল না । আমার মনের ভেতরে একটা অন্য রকম ভয় কাজ শুরু করলো । কেবলই মনে হল এখানে থাকলে আমার বিপদ হতে পারে । আমাকে এখান থেকে বের হতেই হবে ।

আমি যেই না ঘুরতে যাবো ঠিক তখনই আমার পেছন থেকে কেউ আমাকে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করলো । তারপরই আমার চোখের সমানে অন্ধকার হয়ে এল । আমার আর কিছু মনে নেই


আট

সব প্রস্তুতি সম্পন্ন । এখন কেবল বলি দেওয়ার পালা । অনন নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না । কেবলই মনে হচ্ছে তরবারি খুলে সবার গর্দান কেটে আরাত্রিকা কে নিয়ে যায় । আরাত্রিকা অননের খুব কাছে চলে এল । তারপর ওকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরলো । আরাত্রিকার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ।
অনন বলল
-আমি তোমাকে এভাবে মরতে দেব না । তুমি চল আমার সাথে ।
-আমি দুঃখিত অনন । আমি তোমাকে ভালবাসি, সব থেকে বেশি ভালবাসি ।
-আমি সেটা জানি । আমিও তোমাকে ভালবাসি ।
-কিন্তু আমি এই রাজ্যকেও ভালবাসি । আমি দুঃখিত । তুমি আমাকে মাফ করে দাও অনন ।

অনন প্রথমে বুঝতে পারলো কিছু একটা সমস্যা হয়েছে । ও যেমনটা ভেবেছিল তেমন টা হচ্ছে হচ্ছে না । আরাত্রিকা ওর কাছে ক্ষমা চাইছে কেন ? আরও কিছু ভাবতে যাচ্ছিলো ঠিক তখন পেছন থেকে ওর মাথায় কেউ আঘাত করলো । ও বাঁধা দিতে যাবে কিন্তু দিলো না । ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে এখন কি হতে যাচ্ছে ।
মহারাজ নিজের সব থেকে প্রিয় জিনিসটাকে উৎসর্গ করতে পারেন নি । তার প্রানপ্রিয় কন্যাকে সে বলি দিয়ে পারবে না । কিন্তু রাজকুমারী তার সব থেকে প্রিয় মানুষটাকে উৎসর্গ করতে রাজী হয়েছে ।


নয়

আমি চোখ মেলে তাকালাম । তাকিয়ে দেখি আমি এখনও সেই ঘরেও আছি । তবে এখন আমি আর আগের মত একা নেই । আমি তাকয়ে দেখি আনিকা রয়েছে আমার থেকে একটু দুরে । আমার থেকে একটু আরেকজন বসে আছে আছে । আনিকা বাসার কেয়ার টেকার জসিম ।
ওর সামনে একটা বড় হুকোর মত জিনিস রয়েছে । ওটা দিয়েই আমাকে মারা হয়েছে । আনিকা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি কেন এখানে এসেছো ?
-সত্যি জানতে ?
-জানতে পেরেছো সব ?
-হ্যা । আমি ঠিক ঠিকই সব জানতে পেরেছি আনিকা নাকি আমি বলব আরাত্রিকা । রাজকুমারী আরাত্রিকা ।

আমি আনিকার চোখে পানি দেখতে পেলাম ।
-আমি জানি । আমি দোষী কিন্তু সেই সময়ে আমার সামনে আরও কোন পথ ছিল না । আমার রাজ্যকে আমার রাজ্যের মানুষকে বাঁচানোর জন্য !

আমি আনিকা ওরফে আরাত্রিকার চেহারা দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়েটার আসলে কিছুই করার ছিল না । আর এটাও নিশ্চিত যে অনন তার সব থেকে প্রিয় মানুষ নয়তো জীবন সুধা কাজ করতো না আর সেও এতো দিন বেঁচে থাকতো না ।

আমি বললাম
-তারপর কি হল ? তুমি কিভাবে এতো দিন পার করলে ?
একটু কষ্টের হাসি হাসলো আরাত্রিকা । বলল
-তারপর যা হবার তাই হল । আমি অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠি । পুরো প্রকৃতি যেন আমার কথা শুনতে লাগলো । আমরা খুব সহজেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে গেলাম । তারপর আস্তে আস্তে এই পুরো এলাকা আমি জয় করে নিলাম । রাজকুমারী থেকে আমি মহারানী আরাত্রিকা হয়ে উঠলাম । কিন্তু আমি ভেতরে ভেতরে খুব একা হয়ে পড়েছিলাম । কাউকে আমি আর কাছে টানতে পারি নি । আমার এই একাকৃত্ব দেখে আমার রাজতান্ত্রিক আমাকে বলল আমি চাইলে আবারও অননকে জাগিয়ে তুলতে পারি । কিন্তু কাজটা অনেক কঠিন হবে । আমার মনে তখন আশার আলো জ্বলে উঠেছে । আর আমার কাছে অসম্ভব বলে তখন কিছুই নেই ।
কিন্তু তান্ত্রিক বলল অন্য কথা । সে বলল আরও সাড়ে চারশ বছর পরে অননের আবারও পুনরায় জন্ম হবে । তখন একই সেই নতুন অননের বুকের হৃদপিন্ডটা কেটে এই অননের বুকে লাগাতে হবে । তাহলে অনন আবারও জেগে উঠবে ।

আমি কি শুনলাম প্রথমে বুঝলাম না । মাথার ভেতরে একটা ধাক্কা খেলাম । তার মানে আনিকা মানে আরাত্রিকা আমাকে এখানে মেরে ফেলতে এসেছে । আমি উঠে দাড়ালাম । সাথে সাথে জসিমও আমাকে পাজা করে চেপে ধরলো । আরাত্রিকা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি পালাতে পারবে না অপু ! কোন ভাবেই না !
-আই উইল ট্রাই । আমি এভাবে মরতে চাই না ।
-মরবে কেন ? তুমি আবার জেগে উঠবে । কেবল এই দেহ ছেড়ে ঐ দেহে যাবে । আমার অনন হয়ে আসবে !
-নো, থ্যাংকিউ ।
-তোমাকে আমি কোন ভাবেই যেতে দিবো না এখান থেকে । তবে সুখে কথা হচ্ছে যে তোমাকে আজকে কিছু করবো না । সেই সময় আসে নাই এখনও ।

আমি তখন জসিমের কাছে থেকে নিজের ছাড়ানোর চেষ্টা করছি । কিন্তু শক্তিতে পারছি না । লোকটার গায়ে আসুরের শক্তি ।

ঠিক তখনই একটা আবারও কোথাও বাজ পরলো । এবং খুব কাছেই পড়লো । আগের যেভাবে কেঁপে উঠেছিলো এবারও আরও বেশি কেঁপে উঠলো । তবে এবার আর থেমে গেল না কাঁপাকাপি । বুঝতে পারলাম এবার এই পুরানো প্রসাদ টা ভেঙ্গে পড়বে । বলতে বলতেই বড় একটা পাথর খন্ড পরলো আমার ঠিক পাশে । আমাকে জসীম ছেড়ে দিলো । একটা দুরে যেতে আরেকটা পাথর জসীমের উপরে এসে পড়লো ।

আমি কেবল তাকিয়ে দেখি পুরো ঘরটা ধসে পড়তে শুরু করেছে ।
আমার সময় শেষ । বুঝতে কষ্ট হল না । উপরের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম এবার আমার উপর পাথর পড়বে । আমি উপর দিকে তাকিয়ে আবার আরাত্রিকার দিকে তাকিয়ে আবারও উপরের দিকে তাকালম । পাথরটা আমার দিকে পড়তে দেখলাম । আমি দুহাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে হাত ঢেকে ফেললাম কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম পাথর টা আমার থেকে ঠিক উপরে এসে থেমে গেল । আরাত্রিকার দিকে তাকালাম । ও যেন নিজের হাত দিয়ে কিছু ঠেকিয়ে রেখেছে বুঝতে অসুবিধা ।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-জলদি বের হয়ে যাও ।
-তুমি ?
-আমার কিছু হবে না । জলদি যাও !

আমি আর কিছু ভাবলাম না । আমি কেবল দৌড়াতে শুরু করলাম । চারিদিক থেকে কেবল পাথর ধসে পড়ছে দেওয়াল ধসে পড়ছে । আমি কিভাবে বাইরে এলাম আমি নিজেই জানি না । কিন্তু বাইরে এসে তাকালাম পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলাম । কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকাতে উঠলো । সেখানে সম্পুর্ন ধসে পরা প্রসাদটাকে দেখতে পেলাম ।

আনিকা এখনও ভেতরেই আছে । আমি আর দাড়ালাম না । আমার এখন ওকা বাঁচানোর জন্য লোকজন জড় করা উচিৎ কিন্তু আমি সেদিকে গেলাম না । কোন মতে আনিকার বাসায় ফিরে গেলাম । সেখান থেকে ব্যাগটা নিয়ে সোজা ফিরে আসার পথ ধরলাম । বেশ ভাল রকমের বৃষ্টি শুরু হয় তবে কোন কিছু গায়ে মাখলাম না ।
আরাত্রিকাকে এখন বাঁচাতে গেলে আমাকেই মরতে হবে । ও নিজের অননকে বাচানোর জন্য যে কোন কিছু করতে পারে । যে মেয়ে সাড়ে চারশ বছর অপেক্ষা করেছে সে আমাকে চোখের নিমেসে উৎসর্গ করে দিবে । নিজে বাঁচলে বাপের নাম ! আমি কেবল দৌড়াতে লাগলাম । আমাকে সবার আগে হাইওয়ের কাছে যেতে হবে । বাস ট্রাক যা পাই তাতে করে পালাতে হবে ।

আমি দৌড়াতে থাকি ।



কিছু বানান ভুল থাকবে, সে জন্য দুঃখিত

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:৩৯
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×