somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তৃপ্তির গল্প

২০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এয়ারপোর্টে থেকে বের হয়েই বুঝলাম শীত কাকে বলে! দেশের এই অঞ্চলে গরম যেমন পড়ে, শীতও। তাড়াহুড়ো করে আসতে হয়েছে তাই ঠিক মত শীতের কাপড়ও নিয়ে আসি নি। শীতের কাপড় বলতে গায়ে জড়ানো এই স্যুট খানা। আর ব্যাগে একটা চাদর রয়েছে। সামনের দুটো দিন কি অবস্থা হবে কে জানে!

এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে আসতেই দেখি আমার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইয়া বড় এক সাইনবোর্ডে আমার নাম লেখা । সেটা ধরে এক লোক দাড়িয়ে আছে । আমি সামনে যেতেই লোকটা বুঝে গেল যে আমিই সেই লোক যার জন্য সে দাড়িয়ে আছে । লোকটা আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল । তারপর আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল । আমি কিছু না বলে গাড়িতে চড়ে বসলাম। এখন রেস্ট হাউজে গিয়েই খাওয়া সেরে একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে। কাল আর পরশু অনেক ব্যস্ততার ভেতরে থাকতে হবে । তার আগে একটু বিশ্রাম দরকার।

কিন্তু বসেই যখন চোখে লেগে এসেছিলো আমি বুঝতেই পারি নি। তাকিয়ে দেখি গাড়ি থেমে গেছে। তবে সেটা কোন রেস্ট হাউজের সামনে থামে নি। একটা সুসজ্জিত বাড়ির সামনেই থেমে আছে। গেট খুলতে ড্রাইভার হর্ণ দিয়েছ তাতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। দারোয়ান গেল খুলে দিল।

আমার তখনই সন্দেহ হল যে আমি কি ঠিক গাড়িতে উঠেছি। ড্রাইভার আবীর হাসান নামের সাইনবোর্ড নিয়ে দাড়িয়েছিল। আমার নিজের নাম আবীর হাসান। আমাকে বলেও দেওয়া হয়েছিল যে আমার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করবে। কিন্তু এই গাড়ি নিশ্চয় অন্য কারো জন্য অপেক্ষা করছিলো। অন্য কোন আবীর হাসানের জন্য।

আমি ড্রাইভারকে কিছু বললাম না। ব্যাগ নিয়ে বের হতে যাবো তখনই এক চাকর গোছের লোক ছুটে এল। আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল।

আমি নিশ্চিত হলাম যে আমি ভুল জায়গাতে চলে এসেছি। কি করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । একটু পর দেখলাম বাড়ির ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে আসছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
-আসুন। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
-মানে..... আসলে মনে হয় একটু ভুল হয়েছে। আমি মনে হয় ভুল গাড়িতে চড়ে বসেছি। আমার নামও আবীর হাসান। আমার জন্যও গাড়ি থাকার কথা ছিল। আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই.....

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। তারপর বললেন
-আমি বুঝতে পেরেছি। ফোন এসেছিল আমার কাছে।
-আমার তাহলে চলে যাওয়া উচিৎ। এখান থেকে সরকারি রেস্ট হাউজটা যাওয়ার পথটা কোন দিকে একটু যদি বলতেন।
ভদ্রলোক বললেন
-আরে কি যে বলেন! ভুল করে হলেও আপনি আমার অতিথি। আজকের রাত টা এখানেই থেকে যান।

আমার কাছে কেমন যেন লাগছিল। এরকম ভাবে অচেনা অজানা একজন মানুষের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহন করতে। ভদ্রলোক আমার ইতস্তত ভাব দেখে বললেন
-আমার বাসাটা শহর থেকে অনেক দূরে। এখন থেকে কিছুই পাওয়া যাবে না। আমি আপনাকে এভাবে যেতে দিতে পারি না। আর রাতের বেলা অতিথি এসে কিছু না খেয়ে ফেরৎ যাবে এমন টা এই বাড়ির ঐতিহ্যের বিপরীত। দয়া করে আজকের রাত টা আমাদের আতিথেয়তা গ্রহন করুন।

আমার আর কিছু বলার রইলো না। ভদ্রলোক নিজে আমাকে দোতলার একটা গেস্ট রুমের ভেতরে নিয়ে গেলেন। সুজ্জিত রুমের দিকে তাকিয়ে আমার দ্বিধা কেটে গেল মুহুর্তের ভেতরে। সরকারি রেস্ট হাউজ যত ভালই হোক না কেন এর থেকে ভাল কিছুতেই হতে পারে না । যাওয়ার সময় বলে গেলে যে জলদিই খাওয়া দেওয়া হবে । আমি যেন ফ্রেশ হয়ে নিই । অবশ্য আমারও দেরি করার ইচ্ছে ছিল না । সারাদিন অফিস করার পরে বড় স্যার হঠাৎ করেই আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন । কালকে আমাকে এখানকার স্থানীয় অফিস পরিদর্শন করতে হবে । এখানে নাকি কি একসা সমস্যা হয়েছে । সেটা আসলে কি সেটা জানতেই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে ।


খাবার টেবিলে বসে আমার চোখ কপালে উঠলো । বিশাল টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে । যার আসার কথা ছিল সম্ভবত তার জন্যই এতো সব আয়োজন । সে আসে নি বলেই আমার কপালে এসব জুটেছে । আমি বললাম
-এতো কিছু ?
দেখলাম ভদ্রলোক হাসলেন । বললেন
-নিশ্চিন্তে এবং আরাম করে খাও ।


ভদ্রলোকের সাথে আমার একটু আগেই ভাল করে আলাপ হয়েছে । আমিই তাকে আপনি থেকে তুমি করে বলতে বলেছি । শুরু থেকে অবশ্য তিনি আমাকে আপনি করেই বলছিলেন । ভদ্রলোকের নাম আজিজুর রহমান । এখানেই থাকেন আপাতত । ঢাকা তাদের বড় ব্যবসা আছে । সেটা তার বড় দুই ছেলে দেখাশুনা করেন । তিনিও এতো দিন সেখানেই ছিলেন । তখন ছোট মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে এখানে থাকেন নিরিবিলি ! আমি চুপচাপ খেতে শুরু করলেই লক্ষ্য করলাম আশে পাশ থেকে কেউ একজন যেন একটু আধটু উকি দিচ্ছে । আমাকেই যে দেখার চেষ্টা করছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না ।
তাহলে আজিজুর রহমান কি এখনও বলেন নি যে আমি আসলে সেই মানুষ নই যার আসার কথা ছিল ?
হয়তো বলেছেন আবার নাও বলতে পারেন । অথবা যে কারো এমনি এমনি কৌতুহল হতেই পারে । দেখতে চাইতে পারে কোন এমন বেকুব আছে যে কি না অন্যের গাড়ি উঠে বসেছে ।

রাতে আর বেশি কথা হল না । আমিও সারা দিন ক্লান্ত ছিলাম বলেই আলাপ করার চেয়ে বিছানাতে ঘুমানোটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করলাম ।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গলো পাখির ডাকে । চারি দিকে এতো কিচিমিচির শব্দ যে আমি ঘুমাতেই পারলাম না । কতদিন পরে এমন পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো আমি বলতে পারলাম না । আমি ঘুম থেকে উঠে বারান্দার গিয়ে দাড়ালাম ।

সকাল তখনও পুরোপুরি হয় নি । বেশ শীত লাগছিলো তবুও কিছু না জড়িয়েই বাইরে এসে দাড়ালাম । তখনই আমার মনে হল আমি সম্ভবত জীবনের সব থেকে সুন্দর দৃশ্যটা দেখতে পেলাম ।

আজিজুর রহমানের ডান দিকে বিশাল ফুলের বাগান । ভদ্রলোকের যে টাকা পয়সার কোন অভাব নেই সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না । আর সে যে খুব সৌখিন একজন মানুষ সেটা আমি বাড়ি আর বাগান দেখেই বুঝতে পারছি । কিন্তু আমার চোখ আটকালো অন্য খানে । গেস্ট রুমের ডান দিয়ে কিছু খাচা রয়েছে । সেখানে বেশ কিছু খরগোস খেলা করছে । আমি তাকিয়ে আছি খরগোসের খাঁচার সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে । মেয়েটা একটা ধবধবে সাদা চাদর শরীরে জড়িয়ে আছে । আর একটা সাদা খরগোস কে জড়িয়ে আদর করছে ।

আমার মনে হল যে আমার কিছু সময়ের জন্য দম বন্ধ হয়ে এল । আমি আমার জীবনে এতো পবিত্র আর সুন্দর মুখ দেখেছি কি না বলতে পারবো না । সকালের শুভ্র আলোতে মেয়েটির দিক থেকে আমি চোখ সরাতে পারলাম না কিছুতেই । এক ভাবে তাকিয়ে রইলাম কেবল ।

মেয়েটি যে আজিজুর রহমানের ছোট মেয়ে সেটা বুঝতে পারলাম । মেয়েটিও কিছু সময়ের মধ্যেই বুঝে গেল যে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার দিকে তাকালো । দুজনের চোখাচোখি হতেই মেয়েটির চোখ যেন কেঁপে উঠলো । এতো দুর থেকেও আমি মেয়েটির চোখের সেই কাঁপন দেখতে পেলাম । মেয়েটি কেবল আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু । সেই হাসিতে কি ছিল আমি জানি না আমার কেবল মনে হল যে আমার সারা শরীর অবস হয়ে যাচ্ছে । ঠিক মত দম নিয়ে পারছি না ।

সকালের নাস্তার টেবিলে মেয়েটিকে আবারও দেখলাম । রাতে আমি আর আজিজুর রহমানই কেবল ছিলাম খাবার টেবিলে । তবে সকালের নাস্তায় দেখলাম পরিবারের সবাই আছে । আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি খুব ভাবেই বলল
-আপনার ঠান্ডা লাগে নি তো !
আমি কোন মতে বললাম
-ক্যা-কেন ?
-না মানে অতো ঠান্ডার সময় আপনি যেভাবে এক কাপড়ে দাড়িয়ে ছিলেন । ঠান্ডা তো লাগার কথা ।
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম তবে সেটা খুব একটা কাজ হল না । আজিজুর রহমান বলল
-তা তোমার কাজ কতদিনের !
-এই তো দুই দিন ।
-আমি বলি কি এই দুই দিন আমার এখানে থেকে যাও ।
-না আসলেও আমি এমনিতেও আপনাদের অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে । যদি আমি ....
আমাকে আমার কথা শেষ না করতে দিয়ে আজিজুর রহমান বলল
-আরে এটা কোন সমস্যাই না । অতিথি এলে আমাদের ভালই লাগে । এতো বড় বাড়ি । তৃপ্তিও একা একাই থাকে ।

বুঝলাম মেয়ের নাম তৃপ্তি । একদম মানান সই নাম । আজিজুর রহমান বলল
-আজকে রাতে তোমার জন্য বড় বোয়াল মাছ ধরতে বলেছি ।
-আরে আপনি এসব কি বলছেন ! এতো ঝামেলার কোন দরকারই নেই ।
-শুনো ছেলে আমি তোমার মুরব্বী । এতো কথা বলতে হবে না । যা বলছি শুনো । ঠিক আছে । কাজে এসেছো কাজ কর তবে রাতে এখানেই আসা চাই । আমি সময় মত গাড়ি পাঠিয়ে দিব ।

আমি আর প্রতিবাদ করতে পারলাম না । আসলে আমার ভেতরে থেকেই সেই প্রতিবাদটা এল না । এখানে দুটো দিন থাকা মানে হচ্ছে তৃপ্তিকে আরো দুটো দিন চোখের সামনে দেখতে পাওয়া । এটা যেন আমার কাছে অনেক বড় কিছু মনে হল ।

বিকেল বেলা যখন কাজ থেকে একটু নিজেকে আলাদা করতে পারলাম তখন একটা ছেলে আমার কাছে এসে বলল যে একজন নাকি আমার সাথে দেখা করতে এসেছে । আমি হাতের কাজটা শেষ করে বাইরে এসে দেখি আজিজুর রহমান আমার জন্য অপেক্ষা করছে বাইরে । আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম । আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক হাসলেন । বললেন
-তোমাকে পাকরাও করতে এলাম ।
আমি হেসে বললাম
-আমি কাজ শেষ করে আপনাদের বাসায়ই আসতাম । এতো আরাম ছেড়ে কেউ কি যেতে চায় বলুন । আমি তো ভাবছি আরও দুদিন আপনাদের এখানেই থেকে যাই ।
-থাকতে পারো ! কোন সমস্যা নেই তাতে !
বলেই লোকটা হা হা করে হেসে ফেলল । আমার কাছে কেন জানি মনে হল আজিজুর রহমান একটু যেন বেশিই আগ্রহ দেখাচ্ছে আমার দিকে । সত্যি যে তার আন্তরিকতায় বিন্দু মাত্র কৃত্রিমতা নেই । তিনি যা করছেন মন থেকেই করছেন তবুও আমি একজন বাইরের মানুষ । বাইরের মানুষের সামনে এমন আচরনটা আমার কাছে একটু অন্য রকমই মনে হল ।

আমার ধারনাই যে ঠিক সেটা প্রমানিত হল একটু পরে । ফিরে যাওয়ার পথে আজিজুর রহমান মাঝের একটা জায়গাতে গাড়িটা থামাতে বলেন । আমাকে বললেন যে সামনেই তার নাকি বিশাল বড় একটা পুকুর আছে । সেটা আমাকে দেখাবে ।

পুকুরের পাড়েই বসলেন তিনি । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
-তুমি নিশ্চয়ই আমার আচরনে খুব অবাক হচ্ছো ?
-একটু হচ্ছি ।
ভদ্রলোক কিছু সময় চুপ থেকে বলল
-তোমার জায়গায় কার আসার কথা ছিল তুমি জানো ?
-বলতে পারবো না । তবে স্পেশাল কেউ নিশ্চয়ই । সম্ভবত তৃপ্তিকে দেখতে আসার কথা ছিল । তাই না ?
-তুমি বুদ্ধিমান ছেলে । হ্যা । তোমার ধারনা ঠিক । আবীর আবার এক বন্ধুর ছেলে । ওরই আসার কথা ছিল । কিন্তু আসে নি ।
আমি কি বলব ঠিক বুঝতে পারলাম না । কিছু বলা ঠিকও হবে না । আজিজুর রহমান আবারও বলে চলল
-এই তিন চারজন ছেলে তৃপ্তিকে দেখতে আসার কথা দিয়েও পিছিয়ে গেল ।
এটা আমার কাছে একটু বেমামান মনে হল । তৃপ্তির মত মেয়েকে কেউ দেখতে আসছে রাজি না । এটা তো হতেই পারে না । আজিজুর রহমান যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন
-অবাক হচ্ছো তাই না ?
-হওয়ার কথা না ?
-আসলে আমার মেয়েটা ঠিক সুস্থ না ।
-মানে ?
আমি আজিজুর রহমানের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম তার চোখের পানি চলে এসেছে । তিনি সেটা মুছার চেষ্টাও করলেন না । আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলেন । আমি চুপ করে কেবল শুনতে লাগলাম ।

তৃপ্তি যখন স্কুলে পড়তো তখনই তৃপ্তির একটা বড় ধরনের এক্সসিডেন্ট হয় । আঘাত এতোই মারাত্বক ছিল যে জরায়ুর স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় । সোজা কথায় বললে তৃপ্তি আর কোন দিন মা হতে পারবে না । অনেক ডাক্তার দেখা হয়েছে কিন্তু ফলাফল শুন্য । এই কথা শুনে কোন পাত্রই ঠিক এগিয়ে আসে না । এমন কি ওকে দেখতেও আসে না । হয়তো আজিজুর রহমানের জন্য সরাসরি কিছু বলে কিংবা আসার কথা দেয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর আসে না । এবার ভেবেছিলো তার বন্ধুর ছেলে হয়তো আসবে কিন্তু শেষ মুহুর্ত সেও অযুহাত দেখিয়ে আসে নি ।

প্রতিবার যখন কেউ কথা দিয়েও আসে না তখন বাসার সবার মন খুব খারাপ হয়ে যায় । সব থেকে বেশি খারাপ হয় তৃপ্তির মনটা । নিজেকে বড় ছোট মনে করে সে । চাইলেই হয়তো এসব লুকিয়েই তৃপ্তিকে বিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু তৃপ্তি তাতে রাজি না ।

সব কিছু শুনে আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । আজিজুর রহমান বলল
-ওরা এখনও জানে না যে আসলে তুমি ভুল করে এসেছো । আমি ইচ্ছে করেই বলি নি । এই দুটোদিন তুমিও বল না । কেমন ! থাকো ঘুরে বেরাও তারপর চলে যেও । পরে আমি না হয় বলবো যে ওরা মানা করে দিয়েছে ।

আমি কিছু না বলে কেবল মাথা ঝাকালাম । কোন কথাই বলতে পারলাম না । কেবল অনুভব করলাম বুকের ভেতরে একটা তীব্র কষ্ট হচ্ছে আমার । আমার জন্য না তৃপ্তির জন্য । উপরওয়ালা এমন কেন করলেন ? কেন করলেন ?

ফেরার বাকিটা পথ আর কোন কথা হল না ।

রাতে সত্যি বোয়াল মাছের মাথা দিয়েই খাওয়া দাওয়া হল । আজকে অবশ্য রাতেও সবাই এক সাথে খাওয়া দাওয়া করলাম । আমার চোখ বারবার তৃপ্তির দিকেই চলে যাচ্ছিলো । কিছুতেই চোখ সরাতে পারছিলাম । কিছুটা যে লজ্জা লাগছিলো না সেটা বলবো না তবে না তাকিয়ে থাকতেও পারছিলাম না ।

রাতের বেলা বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলাম আর তৃপ্তির কথাই ঘুরে ফিরে ভাবছিলাম তখনই দেখলাম ও আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে । আমি ঠিক মত লক্ষ্য করে নি ।
-রাত আমার খুব প্রিয় জানেন ?
আমি চমকে তাকালম ওর দিকে !
-কি বললেন ? প্রিয় ?
-হ্যা । একা নিঃসঙ্গ ! নিস্তব্ধ ! তাই না ?
-হ্যা । আমারও রাত ভাল লাগে ।
-তাই ?

আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে তৃপ্তি বলল
-আপনি বাবার বন্ধুর ছেলে না, তাই না ? আপনি অন্য আবীর !
এভাবে ধরা পরে যাবো বুঝতে পারি নি । আমি বললাম
-হুম । আসলে ....
-ব্যাখ্যা দিতে হবে না । আমি জানি আপনি ভুল করে এসেছেন এখানে । তারপর বাবা নিশ্চয়ই আমাকে থাকতে বলেছে । তাই না ?
-হুম ।
-আমার বাবা মানুষটা নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবে জানেন ? ভাবে যে আমি কিছু বুঝি না । বলেই সে হেসে উঠলো । আমি এই হাসির মধ্যে একটা তীব্র হাহাকার খুজে পেলাম । আমার বুকের মাঝে সেই তীব্র কষ্ট টা আবার জেগে উঠলো । আমি বললাম
-আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই ?

তৃপ্তি চমকে উঠলো আমার কথা শুনে । অবশ্য সেটা সামনে নিল কিছু সময়ের মধ্যেই । তারপর বলল
-আবীর সাহেব জীবনটা গল্প না । আমি মাঝে মাঝে অনলাইনে এক লেখকের গল্প পড়ি । বুঝেছেন অপু তানভীর নামে । কি সব হাস্যকর গল্প । আপনি সেই গল্পের নায়কের মত কথা বলছেন । নয়তো আপনি আমাকে করুণা করতে চাচ্ছেন ।
আমি তখনই একটা অদ্ভুদ কাজ করলাম । তৃপ্তির হাত ধরে ফেললাম । তৃপ্তি সেটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না । আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম
-আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেন । আপনার কি মনে হচ্ছে আমি আপনাকে করুণা করছি !
তৃপ্তি কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-কদিন পরে আর এই ভালবাসা থাকবে না । আমি আর কারো সাথে জড়াতে চাই না । আপনি বাবার কথায় অভিনয় করছেন । করে যান । কাল যখন চলে যাবেন দেখবেন আমার কথা আপনার আর মনেও পড়ছে না ।
আমি তখনও তৃপ্তির হাত ছেড়ে দেই নি । বললাম
-আপনাকে আজকে আমি এই একটা কথা বললাম । যদি আপনাকে আমি বিয়ে না করতে পারি তাহলে জীবনে আমি আর কাউকে বিয়ে করবো না ।

তৃপ্তির আমার চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো । তারপর আমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য রওনা দিল । আমি পেছন থেকেই ওকে বললাম
-আপনার ঐ লেখকের গল্প আমিও পড়েছি । বললেন না তার গল্পের নায়কের মত কথা বলছি । তবে আরেকটা কাজ করি তার গল্পের নায়কের মত । যদি আপনি আমাকে কাজ ফিরে যাওয়া আগে না ফেরান তাহলে আমি আর কোন দিন আপনার সামনে আসবো না । আর কোন কোন মেয়েকে আমার জীবনে আসতেও দিব না ।


তৃপ্তি চলে গেল । আমি ওর পথের দিকে কিছুটা সময় চেয়ে থেকে বিছানার শুয়ে পড়লাম । কি বললাম এতো সময় আমার নিজেরই ধারনা ছিলনা তবে যেটা বলেছি সেটা যে মন থেকে বলেছি সেটা আমি নিজেও খুব ভাল করেই জানি । আর আমার কাছে মনেও হল যে তৃপ্তিও সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে ।


আমার আশা ছিল যে তৃপ্তি যাওয়ার আগে আমার ঠিকই আটকাবে । কিন্তু যখন শেষ দিন আমি গাড়িতে উঠলাম । সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম তৃপ্তি আমার সামনে এলোই না । সেই কষ্ট টা বুকের ভেতরটা যেন কেটে ফলা ফলা করে দিতে চাইলো । তবুও আমার আশা ছিল যে তৃপ্তি ঠিক আসবে । হয়তো এয়ারপোর্টে এসে আটকাবে । কিন্তু যখন প্লেনের ভেতরে বসে পড়লাম তখন মনে হল মেয়েটা আসবে না ।
সত্যিই মেয়েটা আসবে না । জীবনে আমি কোন মেয়ের জন্য এমন ভাবে কষ্ট অনুভব করেছি কি না আমি বলতে পারবো না । কেমন মনে হল আমার ভালবাসা অপূর্ণই রয়ে গেল ।
তৃপ্তি আসলেই ঠিকই বলেছিলো জীবন অপু তানভীরের গল্প না যে যেখানে গল্পের শেষে নায়ক আর নায়িকা একই হয়ে যাবে ।


পরিশিষ্টঃ

-স্যার আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?
এয়ার হোস্টের আমার দিকে এগিয়ে এল ।
-আমি যাবো না । আমার জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে ! এখনই আমাকে ফিরতে হবে !
-কিন্তু স্যার এখনই .....
-আপনি কি দরজা খুলবেন নাকি আমি নিজে খুলবো !
আমার কন্ঠে এমন একটা বেপরোয়া ভাব ছিল মেয়েটি কপপিটে গিয়ে ক্যাপ্টের সাথে কি যেন কথা বলল । তারপর দরজা খুলে দিল । তাকিয়ে দেখি সিড়িটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে । আমি সেটা আসার জন্য অপেক্ষা করলাম না । নিজেই লাফ দিয়ে নিচে নামলাম । তারপর দৌড়া রানওয়ে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম । আমার কেবলই মনে হল আমাকে যেভাবেই হোক এখন ঐ বাসায় যেতেই হবে । তৃপ্তিকে জড়িয়ে ধরে বলতে হবে আমি তোমাকে ছাড়া কোন ভাবেই থাকতে পারবো না । যখন এয়ার পোর্টের গেটে পৌছালাম তখন আমি জোড়ে জোড়ে দম নিচ্ছি । এতো দুর দৌড়ে এসে আমার সব দম যেন ফুরিয়ে গেছে ।

খানিকটা নিচু হয়ে দম নিচ্ছিলাম তখনই দেখি একজোড়া পা আমার সামনে এসে দাড়িয়েছে । দা জোড়া চিনতে আমার মোটেই কষ্ট হল না । আমি পায়ের মালিকের দিকে তাকালাম । তৃপ্তি ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । ওকে বললাম
-দেখলে তো কেবল গল্পে না বাস্তবে মানুষ অপু তানভীরের গল্পের মত কাজ করে বসে !

তৃপ্তির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো । আমার কাছে মনে হল আমি আমার জীবনেস সব থেকে চমৎকার দৃশ্যটা দেখতে পেলাম ! তৃপ্তির হাসিতেও যে একটা কষ্ট লুকিয়ে ছিল আজকে ওর কান্নাতে সেই কষ্ট দেখতে পেলাম । সেই কান্নাতে একটা তৃপ্তি ছিল । ভালবাসার তৃপ্তি ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১:২৩
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×