somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ বাউলার দীঘি

২২ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সকাল থেকে আকাশে মেঘ করে আছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। একটু আগে ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে। নিশ্চয় আসে পাশে কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

বৃষ্টির আগের এই সময়টা তৃষার খুব পছন্দের ছিল। এই সময়টা বাসায় থাকলেই দৌড়ে ছাদে চলে যেত। তারপর মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিত। তারপর বৃষ্টির পুরোটা সময় দৌড়াদৌড়ি করতো। কিন্তু এখন আর সেসব ভাল লাগে না। এখন আর বাইরে যাওয়া হয় না।
আজকে তৃষার মনটা আরও বেশি খারাপ। গতকাল রাতে আরিয়ানদের বাসা থেকে জানানো হয়েছে যে আরিয়ান কদিনের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। ওর পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব হবে না।
তৃষা জানে যে সরাসরি না বলে আরিয়ান এবং তার পরিবার বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছে। প্রথম যখন ওর রোগটা ধরা পড়লো, আস্তে আস্তে ওর কাছের মানুষ গুলো দূরে চলে যেতে শুরু করলো। ওর এতো দিনের বন্ধুত্ব রিদির সাথে, সেই রিদিও ওর থেকে দূরে থাকতে শুরু করলো। কাছে তো আসতোই না, ফোন করলেও কথা বলতে আগ্রহ দেখাতো না। এমন একটা ভাব দেখাতো যে কথা বললেই যেন রোগটা ওদের হয়ে যাবে।

প্রথম প্রথম তৃষার খুব খারাপ লাগতো। তবে ওর একটা বিশ্বাস ছিল যে আরিয়ান ওকে ছেড়ে যাবে না। দিন দিন ওর অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছিলো। বুঝতে পারছিলো যে ওর দিন ঘনিয়ে আসছে। তবুও আশা ছিল যে আরিয়ান ওকে ছেড়ে যাবে না।
কিন্তু আস্তে আস্তে সবাই ই ওকে ছেড়ে গিয়েছে । বাড়ির কাজের মানুষ গুলোও ওর কাছে আসতে ভয় পায় । কেবল মাত্র বাবা আর মা ছাড়া আর কাউকে ওর এখন ভাল লাগে না ।

আরেকজন মানুষ অবশ্য আছে । তবে তাকে ও সরাসরি কোন দিন দেখেনি । অনলাইনে পরিচয় । ছেলেটা কোথা থেকে যেন ওর নাম্বার সংগ্রহ করেছে । যখন ওর কাছ থেকে সবাই দুরে চলে গিয়েছে তখন ছেলেটার সাথে কথা বলতো ও । কত রকমের কথা যে ও বলতো ছেলেটার সাথে । ছেলেটাও যেন সব আগ্রহ নিয়ে কথা শুনো শুনতো । নক দিলেই উত্তর আসতো সাথে সাথেই । মন খারাপ থাকলে এখন ছেলেটার সাথেই তৃষার কথা হয় ।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটার ব্যাপারে কিছুই জানে না সে । এমন কি ছেলেটার নাম পর্যন্ত না । প্রথম প্রথম একটু চেষ্টা করতো তবে পরে আর চেষ্টা করে নি । কি হবে এতো চিন পরিচয় দিয়ে । ওর চেনা পরিচিত মানুষ গুলোকে তো ও দেখছেই এখন । কত সহজেই না চিরো চেনা এই মানুষ গুলো ওকে ছেড়ে চলে গেল ।

রিদির সাথে ঘনিষ্ঠতার কারনেই আরিয়ানের সাথে দেখা হয়েছিল ওর। যতবার ও রিদিদের ভাসায় গেছে ততবারই দেখতো আরিয়ান ওদের সাথে গল্প করতে এসে হাজির। গল্পের ছলে যে ওকেই দেখতে আসতো সেটা বুঝতে তৃষার কষ্টই হয় নি। আর বেস্ট ফ্রেন্ডের বড় ভাই ছিল বলে আরিয়ানের প্রতি একটা প্রশ্রয়ের ছাড়ও দিয়ে রেখেছিল। তারপর সেই ছাড় থেকে কখন সম্পর্কটা বিয়ের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, তৃষা সেটা বলতে পারবে না। সব কিছু স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙ্গতে সময় লাগলো না। ওর অসুখটা দেখা দেওয়ার পরপরই সব যেন বদলে যেতে শুরু করলো, ওর আসে পাশের সবাই যেন বদলাতে শুরু করলো।
কি এক অদ্ভুদ রোগ হয়েছে ওর। এই রোগের নাম কেউ বলতে পারছে না। কেউ শনাক্তই করতে পারছে না আসলে কি হয়েছে। আর যেখানে রোগই ধরতে পারছে না সেখানে চিকিৎসা করবে কি!

প্রথম তৃষার হাতে একটু গুটিগুটির মত উঠেছিল। চুলকাচ্ছিলো বেশ। তৃষার মনে হয়েছিল কোন চর্ম রোগ অথবা এলার্জি। সেই অনুপাতেই ডাক্তার ঔষধ দিল। কিন্তু কদিন পরেই দেখা গেল সেখানে মাংস শুকিয়ে গর্ত হয়ে যাচ্ছে। তারপর সেটা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। জায়গায় মাংশ শুকিয়ে যাচ্ছে। কয়েক স্থানে হাড়ে পৌছে গেছে।
দেশে বিদেশে অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু কেউ কিছু করতে পারে নি। দিন দিন ওসুখটা বাড়ছেই। গতকাল রাতেই তৃষা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে আর বেঁচে থাকবে না। নিজের জীবন সে আর রাখবে না।

তৃষা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। জানলাটা একটু আগে খুলে দিয়েছিল। তাই বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে গায়ে। অসুখটার কারনে শরীরে রোঁদ কিংবা পানি স্পর্শ করতে মানা করেছে ডাক্তার। কারনে এগুলো শরীরে এসে লাগলেই ক্ষতের পরিমান টা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তৃষার জানলাটা বন্ধ করতে ইচ্ছে করলো না। লাগুক একটু পানি। যখন মরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিয়েছে তখন আর এতো সাবধান হয়ে লাভ কি!

-এঞ্জেল !

তৃষা বাইরের বৃষ্টি থেকে ভেতরে চোখ ফেরালো। ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। খোলা জানলা দেখে একটা ধমক দিল ওকে। তারপর দ্রুর এসে জানলাটা বন্ধ করে দিল।
-তোমাকে কতবার বলেছি না জানলা না খুলতে!
-মম! আর ভাল লাগে না। যা হবার হবে!
-চুপ! এসব কথা একদম বলবা না। তোমার ড্যাড কি দৌড়াদৌড়ি করছে তোমার জন্য আর তুমি বলছো কি দরকার? এতোটা স্বার্থপর কেন? আমাদের কথা ভাববে না একবারও!
তৃষা খানিকটা সময় চুপ করে রইলো। আসলেই এই অসুখের কারনে সবাই ওকে ছেড়ে চলে গেলেও ওর বাবা আর মাকে আরো বেশি করে কাছে পাওয়া শুরু করেছে। তৃষার যে বাবা সারাটা দিন দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। যেখানে যা শুনতে পাচ্ছে সেখানেই চলে যাচ্ছে। তৃষা বলল
-সরি মম।
-হুম হয়েছে। আর সরি বলতে হবে না।
তারপর কিছুটা সময় তৃষার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-তোমার এক বন্ধ এসেছে।
তৃষা খানিকটা অবাক হল। ওর সাথে অনেকদিন কেউ দেখা করতে আসে না। তাহলে কে আসলো?
তৃষা বলল
-কে?
-এর আগে আসে নি ছেলেটা। আমি দেখি নি। বলল যে তোমার সাথেই নাকি পড়ে।
-নাম বলেছে?
-নাম বলেছে অপু। গোলগাল চেহারা।

তৃষা চট করেই অপুকে চিনে ফেলল। সেই সাথে খানিকটা অবাকও হল। ওদের ক্লাসে গোলগাল চেহারার একটা অপু আছে। ছেলেটার সাথে কোনদিন কথা হয় নি তবে চোখাচোখি হয়েছে অনেকবার। সেই অপু কি এসেছে?
তৃষা বলল, আচ্ছা এখানেই নিয়ে এস।

দরজা দিয়ে অপুর ঢুকলো । ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু । প্রতি উত্তরে তৃষাও একটু হাসলো । তৃষা আম্মু আর ঘরের ভেতরে ঢুকলো না । অপুর আস্তে আস্তে ঘরের চারিদিকটা একবার নজর বুলিয়ে বিছানার পাশে পেতে রাখা একটা চেয়ারে এসে বসলো ।

তৃষা অপুকে দেখে একটু অবাকই হয়েছে বলতে গেলে । ছেলেটার সাথে অনেক দিন দেখা নেই । যখন নিয়মিত ক্লাসে যেত তখনও ছেলেটা প্রতিদিন ক্লাসে আসতো না । অপু সবার সাথে ঠিক মত মিশতোও না । তৃষা আশা করে নি অপু ওর সাথে দেখা করতে আসবে । পরিচিত সবাই যখন ওর কাছে আশা ছেড়ে দিয়ছে তখন এই ছেলেটা কেন এল হঠাৎ করে !

অপু যখন রুমে ঢুকলো তখন বাইরের বৃষ্টি অনেকটাই থেমে গিয়েছে । অপু ওর দিকে তাকিয়ে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো । এমন একটা ভাব যেন এখানে ওর সাথে দেখা করতে এসে খানিকটা অপরাধই করে ফেলেছে । কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল
-এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই !
তারপরই অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো আবারও । তৃষার কেন অপুর এই হাসিটা বেশ ভাল লাগলো । মনটা ভাল হয়ে গেল মুহুর্তেই । বলল
-ভাল করেছো ? কফি খাবে ?
অপু কোন কথা না বলে কেবল মাথা ঝাকালো । সে খাবে । কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই তৃষা অবাক হয়ে আবিস্কার করলো যে অপু ছেলেটা অনেক কথা বলতে পারে । একের পর এক কথা বলেই চলেছে । তৃষার কেন জানি শুনতেও ভাল লাগছে খুব ।

হঠাৎ অপু বলল
-আসলে আজকে আমি তোমাকে সরি বলতে এসেছি ।
তৃষা বলল
-কেন ? তুমি আবার কি করলে ?
অপু কিছুটা সময় ইতস্তকর করে বলল
-আসলে আমি ইচ্ছে করেই তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি ।
-আমি জানি সেটা । আর এও জানি যে তুমি কিছু বলতে এসেছো । তাই না ?
-হুম ।
-আমি সম্ভত সেটাও জানি ।
-জানো ?
-সিওর না । তবে একটা গেস করতে পারি । বলব ?
-বল

তৃষা কিছুটা সময় অপুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-তুমিই হচ্ছে হোয়াটসের এপের ঐ ছেলেটা । রাইট ?
অপু কিছুটা সময় অবাক বিস্ময়ে তৃষার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-কিভাবে বুঝলে ?
-এমন কঠিন কিছু না । যাই হোক সেটা না বলি । আমি রাগ করি নি তোমার উপর । অন্তত তুমি ঐ চেনা পরিচিত মানুষদের মত তো নও । তোমার সাথে কথা বলে আমার ঐ রাত গুলো একটু হলেও ভাল কেটেছে । একটু হলেও কষ্ট গুলো শেয়ার করতে পেরেছি ।

অপু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তৃষার দিকে । অপু ভেবেছিলো হয়তো তৃষাকে এই কথাটা বলার পরেই তৃষা অনেক রাগ করবে কিন্তু এ ব্যাপারটা এতো সহজ হয়ে যাবে অপু সেটা ভাবতেও পারে নি ।


দুই

-কি বললে ?
-হ্যা । পুকুরটার নাম বাউলার দীঘি ।
-তার মানে তুমি বলতে চাও যে আমি যদি ঐ পুকুরে ডুব দেই তাহলে আমার এই রোগটা ঠিক হয়ে যাবে ?

অপু কিছু না বলে চুপ করে রইলো । সামনের কফির কাপটা তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিন । তারপর আবারও তৃষার চোখের দিকে তাকালো । তৃষার চোখ দেখে স্পষ্টই বুঝতে পারছে যে তৃষা কথাটা বিশ্বাস করছে না ।

ঐদিনের পর থেকে অপুর সাথে তৃষার সম্পর্কটা যে হঠাৎ করেই ভাল হয়ে গেছে । প্রায় প্রতিদিনই অপু তৃষার সাথে গল্প করতে আসে । তারপর আবার অনলাইনে কথা হয়ই প্রতিদিন । সব মিলিয়ে ওদের সময়টা কাটছে ভাল । তৃষার বাবা মাও ব্যাপারটাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে । বিশেষ করে তৃষা যখন হাসি খুশি তখন তাদের এই ব্যাপারে কোন আপত্তি নেই ।

তৃষা বলল
-তুমি এসব বিশ্বাস কর ?
-দেখো ব্যাপারটা যে গুজব তা কিন্তু নয় । আমি নিজে গিয়েছি সেখানে । লোকজন দীঘিটাকে ভয় করে আবার সম্মান করে কিন্তু অনেকেরই এই দীঘির পানিতে ডুব দিয়ে রোগ সেরেছে ।
-তাই ?
-সত্যিই তাই
-তাহলে তো দেশের সব ডাক্তার খানা ক্লিনিং হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা । তাই না ?
-ব্যাপারটা কিন্তু এতো সহজ না ।
-ডুব দেওয়া সহজ না ? অনেক গভীর পানি ?
অপু কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-না । আসলে আমরা যেমন ডাক্তার দেখিয়ে ভিজিট দেই । এই দীঘিও তেমন ভিজিট নেয় ।
তৃষার কাছে ব্যাপারটা বেশ মজাদার লাগলো । সত্যি হোক মিথ্যা হোক গল্প শুনতে তো দোষ নেই । বলল
-যেমন !
-মনে কর কারো জ্বর হল, সে তার যেন মূল্যবান জিনিস যেটা তার প্রিয় যেমন ধর একটা সোনার আংটি কিংবা খেলার জিনিস সেটা ডুব দেওয়ার সাথে সাথে পুকুরে ডুব দিল । যদি ঐ দীঘির মনে হয় যে সেটা বিনিময় যোগ্য তাহলে সোনার আংটিটা নেওয়ার বিনিময়ে রোগটা ঐ বাউলার দীঘি নিয়ে নেয় । বদলাবদলি ! এই বদলি থেকে সময় সাথে সাথে দীঘিটার নাম হয়েছে বাউলার দীঘি ।

তৃষা আরও কিছু সময় অপুর সাথে হাসি ঠট্টা করলো এটা নিয়ে । তবে অপু শেষ পর্যন্ত তৃষাকে ঠিকই রাজি করিয়ে ফেলল । তাছাড়া অনেক দিন বাইরে কোথাও বের হওয়া হয় না । ঠিক তিন দিন পরেই সন্ধ্যা বেলা ওরা সেই বাউলার দীঘির জন্য রওনা দিল । অপু আগেই সেখানে গিয়েছে । তাই সেই পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল । ঢাকা থেকে খুব বেশি দুরে নয় মুন্সিগঞ্জ জেলার একদম ভেতরে বসুল্লাহ গ্রামে আছে দীঘিটা । মানুষ জন এই দীঘিটাকে এড়িয়ে চলে সব সময় । আসে পাশে ঘন গাছ গাছাগাছিতে ভরে আছে । দিন দিন সেটা বাড়ছেই । মানুষজন সেগুলো পরিস্কার করার সাহস করে না । কারন সেটা পরিস্কার করতে গেলেই নাকি তাদের উপর বিপদ নেমে আসে ।

বাউলার দীঘি নিয়ে অনেক অনেক আগে থেকে এমন কথা প্রচলিত হয়ে আছে । কে এই দীঘি খনন করেছে কেউ বলতে পারবে না । লোক মুখে কত রকম কথা শোনা যায় । শোনা যায় যে ভরা পূর্নিমার সময় এই পুকুরের কাছে ঠিক মত কিছু চাইলে আর সেটার সঠিক মূল্য দিলে সেই ইচ্ছেটা নাকি পূরন হয় । অপু আরও যা যা শুনেছে সেগুলো তৃষাকে বলতে লাগলো । তৃষার কেন জানি ভাল লাগছিলো । ও জানে যে এখানেও কিছু হবে না । ওর শরীর ক্ষত গুলো দিন দিন বেড়েই চলেছে । সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে । আগে তো শরীরে খারাপ লাগতো না তবে এখন ও শরীরে ঠিক বল পায় না । ঠিক মত হাটতে ওর খানিকটা কষ্ট হয় । এর পরে হয়তো আর বিছানা থেকেও ও উঠতে পারবে না ।


দীঘির কাছে যখন পৌছালো তখন প্রায় এগারোটা বেজে গেছে । তৃষা সাবধানে বের হল । ওদের সাথে তৃষার বাবা মা আসে ন. অবশ্য বাবা মাকে বলেও নি যে ওরা এই রাতের বেলা পুকুরের পানিতে ডুব দিবে । এটা জানলে হয়তো ওকে আসতেই দিতো না । বলেছে অনেক দিন বাইরে যাওয়া হয় না । রোদ পড়লে শরীরের ক্ষতি হয় তাই রাতের বেলা বের হবে । একটা নাকি পুকুর আছে খুব চমৎকার । সেটা দেখতে যাবে । এই জন্য তারা রাজি হয়েছে । তারপরেই একা একা ছাড়তে রাজি হয় নি তৃষার বাবা । গাড়ির ড্রাইভারের সাথে একজন আর্মড বডিগার্ড এসেছে । বডিগার্ডকে আনার ইচ্ছে ছিল না তবে ওর বাবাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারে নি । অবশ্য শেষে আর না পেরে সাথে করে নিয়ে এসেছে ।

অবশ্য বডিগার্ড ওদের সাথে এল না । যদিও তৃষা জানে যে আড়াল থেকে বডিগার্ড ওদের দিকে ঠিকই খেয়াল রাখবে । তৃষা কেবল অপুর হাত ধরে এগিয়ে চলল । সাথে টর্চ ছিল তবে সেটা জ্বালানোর দরকার পরলো না । চারিদিকে জোঁছনার আলো থইথই করছে ।

যখন ওরা বাউলার দীঘির কাছে পৌছালো তৃষা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো । সানবাঁধানো বিশাল পুকুর সে । ভরা পূর্ণিমাতে সেদিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো কেবল কিছুটা সময় । এতো চমৎকার দৃশ্য সে কোন দিন দেখেছে কি না বলতে পারবে না । অপুর হাতটা আরও একটু শক্ত করে চেপে ধরলো । তারপর
-ইস কি সুন্দর !
-হুম !
-আসো আজকে সারা রাত এখানে বসে থাকি !

অনেক টা সময় সেই সান বাঁধানো পুকুরের পাড়েই বসে রইলো । অপুর একটা সময় মনে হল যে তৃষা কাঁদছে । তৃষার হাতটা ধরে অপু বলল
-কি হল ?
-জানি না । মানষিক ভাবে আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নিয়েছি । কিন্তু মাঝে মাঝে এতো চমৎকার কিছু দেখলে খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে অপু !

অপু হঠাৎ করেই তৃষাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর বলল
-তোমার কিচ্ছু হবে না । বিশ্বাস কর কিচ্ছু হবে না । তুমি ঠিক হয়ে যাবে ! আসো ...

তারপর তৃষার হাত ধরেই সিড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করলো । বুক পর্যন্ত পানিতে নেমে তৃষা অপুর দিকে তাকিয়ে দেখে অপু ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে । তৃষা হঠাৎ বলল
-এমন করে কি দেখছো ?
-তোমাকে ?
-কেন আর দেখতে পাবেনা ?
-হয়তো !
তারপর একটু হাসলো । অপুর ওর দিকে তারও কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে বলল
-এইবার একটা ডুব দাও । বিশ্বাস করবে যে তোমার রোগ ভাল হয়ে যাবে । ঠিক আছে ?
-আচ্ছা ।

তৃষা পানিতে নিজের মাথাটা পুরোপুরি ডোবালো । কিছু সময় কিছুই মনে হল না । অপুর হাতটা তখনই ধরা । তারপর হঠাৎ করেই তৃষার মনে হল ও যেন অন্য জগতে চলে এসেছে । ও যেন পুরো কোন রাজ প্রাসাদে চলে এসেছে । সেখানে অদ্ভুদ সব চেহারার মানুষ দাড়িয়ে বসে আছে । সবার চেহারাতেই একটা শুভ্র ভাব রয়েছে । তাদের পোশাকও সব ধবধবে সাদা ! বাঁ দিকে চোখ যেতে দেখতে পেল একটা ছেলেকে কয়েকজন সিপাহী গোছের মানুষ ধরে রয়েছে । ছেলেটার চোখের ভেতরে কি যেন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে । আরেকটা ভাল করেই তাকাতেই তৃষা সেই ছেলেটাকে চিনতে পারলো । সে আর কেউ নয়, অপু ।
ওকে ওরা কি করছে ?
তৃষা অপুর দিকে দৌড়ে যেতে চাইলো কিন্তু দেখলো ওর হাত আর পায়ে শিকল দিয়ে আটকানো ।
তৃষা চিৎকার করতে চাইলো তখনই ও অপনুভব করলো যে ওর মুখের ভেতরে পানি ঢুকে গেছে । তারপর জলদি করে পানি থেকে মাথা তুলে তাকালো । অপুকে খুজতে লাগলো । চিৎকার করতে চাইলো অপুর নাম ধরে কিন্তু কোথাও পেল না । আরেকবার ডাক দিয়ে চিৎকার করতে যাবে তখনই ওর পাশ থেকে অপু ভেসে উঠলো ।
-কি হল ?
তৃষার ইচ্ছে অপুকে একটা চড় মারতে । ভয় পেয়ে গিয়েছিলো । কিন্তু সেটা করলো না । তার বদলে অপুকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে ।
আরও বেশ খানিকটা সময় ওর দীঘিতেই কাটালো । তৃষা হঠাৎ বলল
-আরে একটা তো ভুল হয়ে গেছে ?
-কি ?
-পুকুরে না কিছু দিতে হয় । কিছুই তো দিলাম না । তাহলে তো আর ঠিক হবে না ।
অপু কিছু না বলে কেবল হাসলো । তারপর বলল
-চিন্তা কর না । সব ঠিক হয়ে যাবে !


তিন

ঐদিন রাতে ফিরেই তৃষা খুব জ্বর আসলো । তৃষাও ভেবেছিলো জ্বর আসতে পারে । ভেজা কাপড়ে অনেকটা সময় সেই পুকুর পাড়ে বসে ছিল । পানিও ছিল বেশ ঠান্ডা ।

দুদিন তৃষার জ্বরের প্রকোপে কোন হুশই থাকলো না । দুইদিন পরে যখন একটু একটু সুস্থ হল তখন আরও একটা ব্যাপার দেখে ও অবাক হয়ে গেল । ওর হাতের ক্ষতটা অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে । তীব্র বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর দ্রুত শরীরের অন্য সব ক্ষত গুলো পরীক্ষা করে দেখলো । সব গুলোরই অবস্থা এমন ! দুই দিনে অনকেটা ভরে গেছে সেগুলো ।

চিৎকার করে মা কে ডাকলো । মাকে দেখাতেই ওর সাথে সাথে ওর বাবাকে ফোন দিল. দুজনের চোখেই অবিশ্বাস । কি হচ্ছে তারা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না । তৃষাই তারপর ঐদিন রাতের কথা বলল । ওরা আসলে কেন সেখানে গিয়েছিলো সেটাও বলল । তৃষার বাবা অপুকে খবর দিতে বলল । কিন্তু তৃষা অপুকে ফোনে ফেল না । তৃষার মা কেবল বলল যে জ্বরের প্রথম দিন অপু ফোন দিয়ে খোজ নিয়েছিলো । এরপর আর ফোন দেয় নি ।

তারপর তৃষা আর চেষ্টা করেও কোন খোজ বের করতে পারলো না । পরের একটা মাস খুব দৌড়াদৌড়ি হল তৃষার । ওর বাবা ওকে আবারও সিঙ্গাপুর নিয়ে গেল । তারা তৃষা কে পরীক্ষা করে বিস্মিত হল । তৃষার শরীরের আর কোন ক্ষত নেই । কোন রোগ নেই । তৃষা একদম সুস্থ ।

সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে তৃষা অপুর খোজ করলো । কিন্তু কেউ ওর কোন খোজ বের করতে পারলো না । অপু নাকি ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিয়েছে । তার ফোনও নাকি বন্ধ । ও যে হলে থাকতো সেখানেও নাকি আর নেই । জিনিস পত্র নিয়ে চলে গেছে ও ।

তৃষার পুরানো বন্ধুরা আবারও ওর কাছে ফিরে এসেছে কিন্তু তৃষা কেন জানি আর তাদের সাথে আর মিশার আগ্রহ পাচ্ছেনা । মুখে মুখে কথা বলছে তবে সাথে আড্ডা দেওয়ার দরকার বলে প্রয়োজন বোধ করছে না । আরিয়ান বিদেশ থেকে আবার ফিরে এসেছে । সে এখন বিয়ে করতে প্রস্তুত । কিন্তু তৃষা এখন প্রস্তুত না । আরিয়ান ওকে অনেকবার রাজি করানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু তৃষা কিছুতেই রাজি হয় নি । তৃষার মন কেবল অপুকে খুজছে । কোথায় গেল ছেলেটা ?
এমন ভাবে হারিয়ে যাওয়ার মানে কি ?


পরিশিষ্টঃ

-কে এসেছে মা ?

তৃষা তাকিয়ে রইলো বারান্দায় বসে থাকা ছেলেটার দিকে । আরও দুটো মাস কেটে গেছে তৃষার গ্রামের বাসার খোজ পেতে । অপু কারো সাথে মিশতো না তাই তার গ্রামের বাসার খবর কেউ জানতো না । শেষে ডিপার্টমেন্ট থেকে অনেক চেষ্টার পর অপুর ঠিকানা বের করেছে। এখানে এসে শুনেছে সব থেকে বড় খবরটা ।
তিন মাস আগে একদিন হঠাৎ করেই নাকি অপু বাসায় ফিরে আসে । সে নাকি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না । তার মাস খানেকের ভেতড়ে অপু পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছে । অপুর মা ডাক্তার দেখানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন কাজ হয় নি । অপুও খুব একটা আগ্রহ দেখায় নি ।

তৃষা খবরটা শোনার পর সে কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারে নি । সেদিন ঐ পুকুর পাড়ে তৃষা বলছিলো যে ওরা তো কিছুই দিল না পুকুরটাকে তখন অপু বলেছিলো সে চিন্তা কর না । সব ঠিক হয়ে যাবে । তৃষা তখন বুঝতে না পারলেও এখন সেটা পরিস্কার বুঝতে পারছে সেদিন সে কি বিনিময় করে ছিল !

অপু বলল
-কে ? তৃষা ?
-মরে গেছে তৃষা !

আর কোন কথা বলল না । দক প্রকার দৌড়ে গিয়েই অপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । তারপর হুহু করেই কেঁদে উঠলো । কেবল একটা কথাই বলল
-তুমি খুব খারাপ । খুব বেশি খারাপ ! আই হেইট ইউ ।

প্রতিবার বার হেইট বলার সাথে সাথে তৃষার জড়িয়ে ধরার পরিমান যেন আরও একটু একটু করে বাড়ছিলো ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:১৭
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×