somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নায়রার গল্প

১৫ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




-ম্যাডাম আপনার বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলুন...

নায়রা চৌধুরীর চেহারা দেখেই পুরো হল রুমে নিরবতা নেমে এল। আমি স্টেজের কাছেই বসে ছিলাম তাই তার চেহারাটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার সাথে সাথে অনেকেই দেখতে সেটা দেখতে পাচ্ছিলো ।

দেশের ব্যবসায়ীদের সব থেকে বড় সংগঠনটা হচ্ছে এই সংগঠনটা। মোটামুটি বিশ পঁচিশটা বড় বড় বিজনেস ফার্ম দেশের এই পুরো ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রন করে। নিয়ন্ত্রন করে শেয়ার বাজারকেও। আর সেই সংগঠনের চেয়ারম্যান হচ্ছে নায়রা চৌধুরী। এতো কম বয়সী কেউ যে এমন একটা সংগঠনের চেয়ারম্যান হতে পারে সেটা কারো ধারনা ছিল না, তবে সে যে এই পদের যোগ্য গত এক বছরে সেটা খুব ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছে। তার বাবার থেকেও ব্যবসাটা ভাল আর শক্ত হাতে এগিয়ে নিচ্ছে।

পুরো দেশের মানুষ তাকে চিনে। একজন ব্যবসায়ী হয়েও টিভি স্টারদের মত জনপ্রিয়তা তার। ফেসবুকে তার প্রোফাইলে প্রায় পাঁচ লক্ষ্যের উপর ফলোয়ার। সেখান থেকেই আমরা জানতে পেরেছি যে নায়রা চৌধুরী বিয়ে করেছে। কিন্তু কাকে বিয়ে করেছে সেই ব্যাপারে কিছুই বলে নি সে। আর আজকে এই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করে বসলো।

নায়রা চৌধুরীর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম যে সে রেগে যাচ্ছে। তবুও নিজেকে খানিকটা নিয়ন্ত্রন করে বলল
-আমরা এখানে কথা বলছি দেশের ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এটা একটা বিজনেস কনফারেন্স। এর আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করা কি যুক্তিযুক্ত?
সাংবাদিক এবার খানিকটা আমতা আমতা করে বলল
-না মানে আসলে আপনি বিয়ে করেছেন....
-তো? ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাদের কি কাণ্ডজ্ঞান কোনদিনই হবে না?
তারপর কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে বলল
-এই সিকিউরিটি কে আছেন, এই ছাগলটাকে এখান থেকে বের করেন। আজকের যত ফুটেজ সে নিয়েছে সে গুলো সব সব ডিলিট করবেন, প্লাস এর পরের আমাদের আয়োজিত কোন অনুষ্ঠানে এই ছাগল কিংবা এই ছাগল যে মিডিয়া থেকে এসেছে সেই মিডিয়া যেন ঢুকতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।

তখনই দেখলাম পাশ থেকে দুজন সিকিউরিটির লোক এগিয়ে এল। সাংবাদিককে নিয়ে বাইরে চলে গেল। কিছু সময় পরে আবারও স্বাভাবিক হয়ে হল রুমের আবহাওয়া!

আমার পাশ থেকে দবির ভাই বলল
-সাব্বির, দেখছো, বিয়ে হইছে কিন্তু এখনও ম্যাডামের টেজ কমে নাই।
আমি দবির ভাইকে বললাম
-বিয়ে করলে পুরুষ মানুষ সিংহ থেকে ভেজা বিড়াল হয়, মেয়েরা না।
দবির ভাই একটু হতাশ কন্ঠে বলল
-খোঁচা দিলা? দাও, বিয়ে তো কর নাই, আগে কর তারপর টের পাবা!

আমি কেবল হাসলাম। আমার চোখ তখনও নায়রা চৌধুরীর দিকে । এই মেয়ের তেজ কোন দিন কমবে বলে মনে হয় না । অবশ্য সেটা তার স্বামী বুঝবে । সামনে তার জীবনে কি অপেক্ষা করছে সেটা সে ভাল করেই জানে ।

কনফারেন্স শেষ করেই আমাদের ডিনারের ব্যবস্থা ছিল। আমরা বুফেতে ডিনার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দেখছিলাম নায়রা চৌধুরী সবার সাথে ঘুরে খোজ খবর নিচ্ছিলেন। ঘুরতে আমার সামনে এসেও হাজির হলেন। মৃদু হেসে বললেন, সাব্বির সাহেব ঠিক মত খাচ্ছেন তো!
আমি কেবল একটু হেসে বলল, জি!
আরও কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু বলা হল না। নায়রা চৌধুরী আমার দিকে কেমন চোখে তাকালো। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। আমি আবারও খাওয়ায় মন দিতে গিয়ে দেখি দবির ভাই আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর বলল
-সাব্বির তুমি নায়রা চৌধুরী কে চিনো?
আমি খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম
-হ্যা চিনবো না কেন? আপনিও তো চিনেন। চিনেন।
-আরে দুরও! মানে নায়রা চৌধুরী তোমাকে চিনে?
আমি একটা মাংসের টুকরো মুখে নিতে নিতে বললাম
-হ্যা চিনে খানিকটা!
-কিভাবে!
-আরে আপনি বুঝেন নি? আমার আর তার বাসা একই এলাকাতে। আরও ভাল করে বললে নায়রা চৌধুরীর ঠিক উল্টো দিকের বাসায় আমি থাকি। যখন ছোট ছিলাম তখন ওদের লনে খেলা করতে যেতাম।
দবির কথাটা শুনে বেশ অবাকই হলেন। আমি অবশ্য আর কিছু বললাম না।

ছোট বেলা থেকেই আমি নায়রা কে চিনতাম। নায়রার আম্মু আর আমার আম্মু একই কলেজে পড়াশুনা করেছে। সেই সুবাদেই ওকে চিনতাম। মাঝে মাঝে আম্মু নায়রার আম্মুর সাথে গল্প করতে যেত বিকেল বেলা। আমাকেও নিয়ে যযেত সাথে করে। আম্মুরা গল্প করতো আর আমাকে পাঠাতো নায়রার সাথে খেলা করতে। তখন দেখতাম ওদের লনে আরও কয়েকজন বাচ্চা খেলা করছে, যার মধ্যমনি হয়ে থাকতো নায়রা।

তবে ছোট বেলার সেই স্মৃতির সাথে একটা তিক্ত স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। পড়াশুনাতে বরাবরই ভাল ছিলাম বলে স্যারেরা পছন্দ করতেন বেশ। ক্লাস টেস্টে ভাল করার জন্য স্যার খুশি হয়ে আমাকে একটা চমৎকার কলম উপহার দিয়েছিল। লিখতে গেলেই আলো জ্বলে। একদিন বিকেলে আম্মুর সাথে গিয়েছিলাম নায়রাদের বাসায়। লনে খেলা করছিলাম, এমন সময় আমার পকেট থেকে স্যারের দেওয়া কলম টা পরে গেল। আমি তুলতে যাবো তখনই নায়রার চিৎকার দিয়ে উঠলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে কলম টা কেড়ে নিল তারপর আমাকে চোর বলে মারতে লাগলো। আমি এতোটাই অবাক হয়ে গেলাম যে মুখ দিয়ে একটা কথাও বলতে পারলাম না।
নায়রার চিৎকার শুনে ওর মা ছুটে এল, সেই সাথে আমার আম্মুও। নায়রার কথা শুনে সবার আগে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এল। আম্মু আমাকে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে এল। আমি যতই আম্মুকে বলার চেষ্টা করলাম যে আমি নায়রার জিনিস নেই নি, স্যার আমাকে দিয়েছে আম্মু কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করলেন না। ঐটুকু বয়সেই আমার তীব্র রাগ গিয়ে মজা হল নায়রার উপরে। পরে স্যারের সাথে আম্মুর কথা বলিয়ে যখন তাকে নিজের কথার পেছনে প্রমান দিলাম আম্মু কিছু করলেন না। বললেন যে যা হবার হয়ে গেছে এখন কিছু বলার দরকার নেই। নায়রার নিশ্চয় একই রকম একটা কলম ছিল আমার দেখে সে নিজের টা মনে করেছে। তাই আমি যেন আর কিছু না করি।
যতই সেটা ভুল হোক তবুও সবার সামনে আমাকে চোর ডাকাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না।

পার্টি চলছে, আমরা খাওয়া দাওয়াতে ব্যস্ত এরই মাঝে আরমান সাবেরকে দেখতে পেলাম পার্টিতে উপস্থিত হতে। মুহুর্তের ভেতরেই পার্টির চেহারা বদলে গেল। এই অর্গানাইজেশনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হচ্ছে এই আরমান সাবের বাবা আদিল সাবের । হয়তো এখন যে চেয়ারে নায়রা চৌধুরী বসে আছে একটা সময়ে সেখানে এই আরমান সাবেরের বসার কথা ছিল । একটা সময় মনে করা হত এদেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের সব থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তি হচ্ছে এই আদিল সাবের। যদি সেদিন ঐ ঘটনাটা না ঘটতো তাহলে আজকে নায়রার জায়গাতে আরমান সাবেরই হয়তো চেয়ারম্যান হত।

আমি তখন সাবের গ্রুপেই চাকরি করতাম। একটা সময় খবর বাতাসে উড়তে লাগলো যে আরমানের সাথে নায়রা চৌধুরীর বিয়ের কথা চলছিল কিন্তু নায়রাই নাকি বেঁকে বসেছে। কিছুতেই নাকি সে আরমানকে বিয়ে করবে না। কেন করবে না সেটা অবশ্য কেউ বলতে পারে না। এই অপমান আরমান কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। কিভাবে নায়রা এবং তার কোম্পানীর ক্ষতি করা যায় সেটাই ছিল আরমানে এক মাত্র লক্ষ্য। যখন কোন কিছুতেই পেরে উঠছিল না তখন আরমান নায়রার জন্য ফাঁদ পাতলো ।

আমার অবশ্য এই সব কিছুই জানার কথা না। আমি মাঝারি লেভের একজন কর্মকর্তা। কিন্তু ঘটনা ক্রমে আমি অনেক কিছুই জেনে গেলাম।

ঐদিন আমাদের কমন ওয়াশরুমটা ব্যস্ত থাকার কারনে আমি আমাদের কনফারেন্স রুমের ওয়াসরুম টা ব্যবহার করতে গিয়েছিলাম। ওয়াশ রুমে থাকা অবস্থায় টের পেলাম কনফারেন্স রুমে কয়েকজন মানুষ ঢুকছে। একটু মনে করার চেষ্টা করলাম যে আজ কোন মিটিং হওয়ার কথা কি না। কিন্তু আমার জানা মতে আজকে কোন মিটিং হওয়ার কথা না। তারপরই তাদের কথা বার্তা আমার আসতে লাগলো। তাদের একজন যে আরমান সাবের সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। আমি চুপ করে তাদের কথা শুনতে লাগলাম। যা শুনতে পেলাম তাতে আমার কান গরম হয়ে গেল। ওরা আসলেই নায়রার জন্য ফাঁদ পাতছে। ভুয়া একটা কোম্পানি খুলতেছে এবং সেটার শেয়ার দাম হু হু করে বাড়ানোর ব্যবস্থা করতেছে। এমন ভাবে নায়রার সামনে উপস্থাপন করা হবে যাতে নায়রা সেটা কিনতে আগ্রহী হয়। আর যদি কিনেই গেলে তাহলে কোম্পানির মালিক টাকা নিয়ে গায়েব হয়ে যাবে আর সব দায় এসে পড়বে নায়রার উপরে।

আমি ওয়াশরুমের ভেতরে চুপ করে বসে রইলাম। এদের কেউ যদি এখন ওয়াশ রুমের ভেতরে ঢুকতে চায় তাহলে বুঝে ফেলবে যে ভেতরে কেউ আছে। অবশ্য সেটা খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না। আমি এই ওয়াশ রুমে চলে আসতেই পারি! মনে মনে ঠিক করে নিলাম যদি আমাকে এখানে আবিষ্কার করেও ফেলে তবুও আমি এমন একটা ভাব করব যে আমি এখানে কেবলই প্রকৃর ডাকে সাড়া দিতে এসেছি। অন্য কোন কারনে নয়। তবে তারা কেউ ওয়াশ রুমের দিকে এলো না। তারা চলে যাওয়ার পরেও আমি আরও বেশ খানিকটা সময় অপেক্ষা করলাম। তারপর বের হয়ে এলাম।

তারপর পরের কয়েকদিন শেয়ার বাজারের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম সেই অখ্যাত কোম্পানি টির শেয়ারের দাম হুহু করে বাড়ছে। আর কেউ সেগুলো ঠিকই কিনে নিচ্ছে। কিন্তু কে কিনে নিচ্ছে সেটা কেউ বলতে পারছে না। আমার অবশ্য বুঝতে কষ্ট হল না কি হচ্ছে। নায়রা চৌধুরীর চোখ এদিকে পড়বেই পড়বে। আর আমি শান্তিতে থাকতে পারলাম না। আমার মনে হল একটা অন্যায় হতে চলেছে। সেটা থামানোর ক্ষমতা আমার আছে।

ঐদিন বিকেল বেলা আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। জানি হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তবুও বেপথে চলা মানুষদের সাথে আমি নেই। যদি সোজা পথে নায়রা চৌধুরীর সাথে আরমান সাবের প্রতিযোগিতায় নামতো তাহলে আমিও তাকে সাহায্য করার জন্য সব কিছু নেমে পড়তাম। যেহেতু এই কোম্পানীতে চাকরি করতাম তাই সেই কোম্পানির ভাল মন্দ দেখা আমার দায়িত্বের ভেতরে পড়ে কিন্তু আরমান সাবের অন্যায় পথে সেই পথ থেকে আম নিজেকে সরিয়ে নিলাম।

পরদিন সকাল বেলাতেই হাজির হলান নায়রার অফিসে। ওর সেক্রেটারি কে দিয়ে খবর পাঠালাম আমার পরিচয় দিয়ে। ভেবেছিলাম হয়তো আমাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে স্বয়ং নায়রা নিজে এসে হাজির হল আমাকে নিয়ে যেতে। ওর চোখ মুখ দেখেই আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে নায়রা বেশ অবাক হয়েছে।
ওর অফিসে গিয়ে যখন বসলাম তখনও খানিকটা অবাক চোখেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই এতো গুলো বছর পরে এই প্রথম আমি নায়রার মুখোমুখি হয়ে বসলাম। ঐদিনের ঘটনার পর আমি আর কোন দিনই নায়রার সামনে আসি নি। খানিকটা অস্বস্তি তাই আমারও লাগছিল।
নায়রার প্রথম কথা বলল
-কেমন আছো?
আমি মৃদু হেসে বললাম
-ভাল।
-কাজ কর্ম কেমন চলছে?
নায়রার কাছে খবর থাকার কথা যে আমি সাবের গ্রুপে চাকরি করি। যদিও চাকরিটা ছাড়ার কথা ওর জানার কথা না। খানিক নিরব থেকে বললাম
-চলছে না। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।
নায়রার মুখে আবার সেই অবাক হওয়ার ভাব দেখতে পেলাম। নায়রা বলল
-সেকি! কেন?
-যাক। অনেক কারন আছে। আমি যে জন্য এসেছি, সেটা বলি!

কথাটা বলে আমি নায়রার দিকে সরাসরি তাকালাম। তারপর বললাম
-তুমি কি আর এন্ড আর কোম্পানির সব শেয়ার কেনার কথা ভাবছো?
নায়রা খানিকটা সময় চুপ থেকে বলল
-এই প্রশ্ন? হঠাৎ?
-ওটা তোমার জন্য একটা ফাঁদ!
-মানে?

তারপর আম ওকে সব ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলাম। সব শুনে নায়রা কেবল গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। আমার মনে হল আমার কাজ শেষ হয়েছে। এখন আমার চলে যাওয়া উচিৎ। আমি উঠতে যাবো তখনই নায়রা বলে উঠলো,
-আমাকে তুমি এসব কেন বললে?
-জানি না। আমার মনে হয়েছে যে একটা অন্যায় হয়েছে। অন্যায়টা আমি থামাতে পারি। এই জন্যই হয়তো
-তুমি তো আমাকে পছন্দ কর না। চাইলেই আমার ক্ষতি করতে পারতে, ছোট বেলার সেই ঘটনা প্রতিশোধ নিতে পারতে....

আমি নায়রার দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে বলল
-আমি এখনও প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু সেটার জন্য অন্যায় পথ আমি বেঁছে নিব না। আমি তোমাকে কোন দিন ক্ষমা করি নি, করবোও না।
-আরেকটা কথা!
-কি?
-তুমি তো চাকরি ছেড়ে দিয়েছো। এই কোম্পানি তে চাকরি করবা?
-না।

আর কিছু না বলেই আমি উঠে চলে এলাম। দেখলাম ও আমার পেছন পেছন উঠে এল। শেষবারের মত ওর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল ও আমাকে আরও কিছু বলতে চাইছে।

তারপর নায়রা আরমান সাবেরের পেছনে উঠে পড়ে লাগলো। আরমানের প্লান ছিল নায়রা কোম্পানি কেনার পর কোম্পানির মালিক গায়েব হয়ে যাবে কিন্তু তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হল না। নায়রা আগে থেকেই তাকে পাকরাও করে ফেললো। তারপর ভয় ভীতি দেখিয়ে স্বীকার করালো যে আসলেই এই সবের পেছনে আরমান সাবেরই ছিল। ব্যস এটাই দরকার ছিল নায়রার। এটা যখন ফলাও প্রচার হল তখন আরমানের উপর সব ব্যবসায়ীদের একটা বিরূপ মনভাব সৃষ্টি হল। নানান দিক থেকে নানান চাপে আরমানের বাবা নিজেও খানিকটা বিব্রত বোধ করতে লাগলো। শেষে আর না পেরে আরমানকে দেশের বাইরেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনায় নায়রার আরও একটা লাভ হয়েছিল। ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচনে ওর কোন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। ও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে গেল। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ঐদিন যদি ঐ কথা গুলো না জানতে পারতাম আর ওকে না বলতাম তাহলে আজকে নায়রা এখানে হয়তো নাও থাকতে পারতো।


আমি দবির ভাইয়ের সাথে গল্প করছিলাম আর এসব নিয়েই টুকটাক গল্প করছিলাম। দবির ভাই আমাকে চোখের ইশারায় একদিকে তাকাতে বলল। তাকিয়ে দেখি আরমান সাবের নায়রার সাথে কথা বলছে। তবে নায়রার চেহারা দেখে মনে হচ্ছি ও কথা বলতে চাচ্ছিলো না। হঠাৎ আরমান নায়রার হাত চেপে ধরলো। আমার মনে নায়রাকে শাসাচ্ছে। নায়রা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আমি আপনা আপনিই সেদিকে এগিয়ে গেলাম।

এতো গুলো মানুষ দেখছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসার সাহস করছে না। কেন করছে না সেটা অবশ্য বুঝতে কষ্ট হয় না । কিন্তু আমার ব্যাপারটা অন্য রকম । আমি সোজা গিয়ে আমি খপ করে আরমানে হাত চেপে ধরলাম। তারপর নায়রার হাতটা ছাড়িয়ে দিলাম। আমার হাত চেপে ধরা দেখে নায়রার চেহারাতে আমি একটু প্রসন্নতা দেখতে পেলাম। কিন্তু আরমান সাবের খানিকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমার মত একজন সাধারন এপ্লয়ী তার হাত চেপে ধরে নায়রার হাত ছাড়ালো, এটা যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মি?

আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নায়রার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি ঠিক আছো? আর এ ছাগলটা তোমাকে ব্যাথা দিয়েছে?
নায়রা কিছু বলল না। তবে অপলক চোখে চেয়ে থাকাই অনেক কিছু বলে দিল। আমি এবার তাকালাম আরমান সাবেরের দিকে। তার হাতটা আমি এখনও ছেড়ে দেই নি। আর আমি একদম খুব বডিবিল্ডার না হলেও একটা সময় নিয়মিত আমি জিমে যেতাম । আমার উচ্চাতাও আরমানের থেকে কয়েক ইঞ্চি লম্বা । বললাম
-অন্যের বউয়ের হাত ধরার খুব শখ ?
এই বলে তার হাতটা খানিকটা মুচড়ে দিতে লাগলাম। ব্যাথায় কালিয়ে উঠলো আরমানের মুখ তবে তার থেকে তার চেহারাতে যেটা আমি দেখতে পেলাম সেটা হচ্ছে বিশ্ময়। কোথা থেকে দেখলাম আরমানের বাবা এসে হাজির। আমাকে তিনি আগে থেকেই চিনতো কারন তার কোম্পানিতে চাকরি করতাম
আমার কাছে এসে বলল
-সাব্বির কি হচ্ছে এসব? কি করছো তুমি? ছাড় ওকে?
আমি তবুও আরমানের হাত না ছেড়ে দিয়ে সাবের সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম
-আপনার সামনে যদি আপনার স্ত্রীর গায়ে হাত দেয় তাহলে তাকে কি করা উচিৎ? আপনার এই গুণধর ছেলে আমার সামনে আমার বউয়ের হাত ধরে তাকে ব্যাথা দিয়েছে।

পুরো ঘরে যেন বোমা ফাঁটলো। সবাই কেবল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি একটু আগে যা বললাম সেটা কারও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কেউ ভাবতেই পারে নি যে নায়রার সাথে আমার বিয়ে হতে পারে।



নায়রার কাছে ঐদিন যাওয়ার মাস খানেক পরের কথা। তখন দবির ভাইয়ের ফার্মে জয়েন করে ফেলেছি। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে অবাক হয়ে গেলা। বাসায় ঢুকেই বুঝতে পারছিলাম কেউ এসেছে। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু নিজের ঘরে ঢুকেই দেখলাম নায়রা আমার বুকশেলফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঢুকতেই একটু হাসলো। আমি কি বলব খুজে পেলাম না। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না নায়রা এখানে কি করছে।
আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল
-বাহ তুমি তো অনেক বই পড় ?

এই প্রশ্নের কোন জবাব দিলাম না । কি জবাব দিবো সেটাই বুঝতে পারছি না । নায়রা আবার বলল
-তুমি আমার এতো বড় উপকার করলে আর একটা ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ দিলে না !
-আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নেই । তুমি না হলে অন্য যে কেউ হলেও আমি কাজটা করতাম ।
-তবুও ! আমার আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে তুমি আমাকে তো বাঁচিয়েছোই সেই সাথে সামনে আরও কত উপকার যে করেছো সেটা তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারবো না !
-বুঝলাম । এখন ?
-আমাকে কিছু তো করার সুযোগ দাও !
আমি খানিকটা বিরক্ত মুখে বললাম
-কি করবে তুমি শুনি ? আমার তোমার কাছে কিছুই চাওয়ার নেই । যদি কিছু করতেই চাও ছোট বেলার সেই দিনটা বদলে দাও । সেই দিনে কোন অপরাধ না করেও করেও কেবল তোমার ভুলের কারনে আমাকে তীব্র ভাবে অপমানিত হতে হয়েছিলো । সেটা ভুলিয়ে দিতে পারবে ?

নায়রা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো । আমি আবার বললাম
-পারবে না । সো বেটার নট ট্রাই । দয়া করে এখান থেকে চলে যাও । তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার । তোমার প্রতি আমার মনভাব কোন বদলাবে না । কোন দিনই না ।

নায়রা তবুও কিছুটা সময় দাড়িয়ে রইলো । তারপর দেখলাম ও ব্যাগের ভেতরে থেকে কি যেন বের করে আমার পড়ার টেবিলের উপরে রাখলো । আরেকটু ভাল করে তাকাতেই দেখলাম সেটা একটা কলম ।
সেই দিনের সেই কলাম টা !

নায়রা বলল
-ঐদিন আমার ভুল হয়েছিলো । মাস ছয়েক পরে আমি আমার কলম টা খুজে পাই । তখন বুঝতে পারি যে ভুল করেছিলাম । বিশ্বাস কর কতবার যে তোমার সাথে দেখা করতে গেছি, চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি । তুমি যেমন ঐ কথাটা মনে করে এতোদিন আমাকে ঘৃণা করেছো আমিও এতোটা দিন নিজেকে ঘৃণা করে গেছি । আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না ? প্লিজ ! মাত্র একটা ! তুমি যা বলবে আমি করবো ! যা বলবে ....

আমার কি হল আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমি খানিকটা হেসে উঠে বললাম
-তাই ? যা বলবে করবে ?
-হুম !
-ওকে এক কাজ কর ! আমাকে বিয়ে কর তারপর বাকি জীবন আমার বউ হয়ে আমার সেবা করতে থাকো ! পারবে ?

নায়রা সম্ভবত ভাবতেও পারে নি আমি এমন একটা কথা বলতে পারি । আমি আবার বললাম
-এদেশের কিছু পুরুষ মানষ আছে বউয়ের উপর নির্যাতন করে তেমন তোমার উপর এই বিশ বছরের ঘৃণার প্রতিশোধ নিবো আমি এবং তুমি সেটা সহ্য করবে । তারপর হয়তো তোমাকে ক্ষমা করতে পারি ! পারবে !

নায়রা আমার দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে তারপর নিঃশব্দে আমার ঘর ছেড়ে চলে গেল । আমি জানতাম এমন কিছুই হবে । আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্যওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়ালাম ।

আমি ভেবেছিলাম নায়রা ততক্ষণে নিজের বাসায় ফিরে গেছে । কিন্তু ফ্রেশ হয়ে যখন রাতের খাবারের জন্য ড্রয়িং রুমে ফিরে এলাম প্রবল বিশ্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে নায়রা তখনও আমাদের ড্রয়িং রুমে বসে আছে । এবং কেবল সেই না তার বাবাও বলে আছে । আমার বাবার সাথে গল্প করছে । রান্নাঘর থেকে কথা ভেসে আসছে । বুঝতে কষ্ট হল না নায়রা মা আর আমার মা সেখানে আছে ! আমি কিছুটা সময় বুঝতেই পারলাম না যে কি হচ্ছে !

নায়রার বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো । তারপর বলল
-আরে এসো এসো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম !
আমার তখনই বিশ্বাস হচ্ছিলো না কি হচ্ছে !
আমি সোফার উপর বসতে বসতে নায়রার দিকে তাকালাম ।নায়রার চোখ দেখেই মনে হল সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে । আমি কেন ঐ কথাটা বললাম ! আমি ভেবেছিলাম এই কথাতে নায়রা কোন দিন রাজি হবে না কিন্তু এই মেয়ে দেখি সত্যিই রাজি হয়ে গেছে ।

কাজি এল রাত দশটার দিকে । রাত সাড়ে দশটার দিকে আমার সাথে নায়রার বিয়ে হয়ে গেল । ঠিক হল সঠিক সময় এলে অনুষ্ঠান করা হবে ।



আমি আরমান সাবেরের হাতটা ছেড়ে দিলাম । তখনই লক্ষ্য করলাম নায়রা এসে আমার হাত ধরেছে । আমি কেবল আরমান দিকের তাকিয়ে বললাম
-এরপর আমার বউয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাস তুই, একদম চোখ তুলে ফেলবো !
আরমান কিংবা তার বাবা আদিল সাবের তখনই ঠিক মত বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে আমি সত্যিই সত্যিই নায়রার স্বামী । তবে সে পরিস্থিতি সামলে নিল । দেখলাম আমার শ্বশুর মশাইও এসে হাজির হয়েছে ।

আমি নায়রা কে নিয়ে এগিয়ে গেলাম দবির ভাইয়ের দিকে । বেচারা একটা ভাল শক খেয়েছে । কাছে যেতেই বললাম
-তুমি মিয়া তলে তলে এতো দুর ! একবার বললাও না !
আমি হাসলাম কেবল ! নায়রাও হাসলো । তখনই একজন সাংবাদিক আমাদের কাছে এসে
-স্যার একটা ছবি কি তুলতে দিবেন ? প্লিজ !
নায়রা কিছু বলার আগেই বললাম
-আসুন তুলুন । সবাই যখন জেনেই গেছে আর লুকিয়ে রেখে লাভ কি !

দেখলাম সাংবাদিকেরা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো ছবি তোলার জন্য !
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:০১
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×