somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ শত্রু শিবিরের কন্যা

১৭ ই মে, ২০১৯ রাত ১০:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নোভা শেখ বাড়ির সামনে এসে আরেকবার ভাবলো। বাড়ির ভেতরে সরাসরি চলে যাওয়াটা মোটেই ভাল কাজ হবে না। কাউকে দিয়ে ভেতরে খবর পাঠিয়ে আরিফকে ডেকে আনাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু সেটা করাও সমীচিন হবে কিনা বুঝতে পারছে না।
শেখ বাড়ি আর ওদের সৈয়দ বাড়ির ভেতরে দা কুমড়া সম্পর্ক অনেক দিন থেকে। নোভা জন্ম থেকে শুনে আসছে এই শত্রুতা। বাপ দাদার আমল থেকেই এই শত্রুরা চলে আসছে। একেবারে সঠিক কারন টা নোভার জানা না থাকলেও এটা জানে যে শত্রুতা শুরু হয়েছিল জমিজমা নিয়ে। তারপর সেটা গ্রামোআধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে।
নোভা শুনেছে তার দাদার আমলে নাকি প্রায়ই মারামারি বাঁধতো দুই পরিবারের মাঝে। দুই পরিবারের পোষা লাঠিয়াল বাহিনী ছিল।
সময়ের সাথে সেই মারামারি শেষ হলেও শত্রুতা শেষ হয় নি৷ এখনো দুই পরিবার একে অন্যের পথ মারায় না। একই মসজিদে নামাজ পর্যন্ত পড়ে না। আলাদা মদজিদ বানিয়ে নিয়েছেন তারা৷

নোভার এসব ভাল লাগেনা। সে এইসব মানেও না। শেখ বাড়ির এক মাত্র ছেলে আরিফ তার সাথেই ঢাকায় পড়াশুনা করে। নোভা এই ব্যাপার টা খুব ভাল করে জানে আরিফ কারনেই দে ঢাকায় গিয়ে পড়াশুনা করতে পারছে। দুই পরিবারের মধ্যে রেসারেসি ছাড়াও পাল্লা দেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। ওর ছেলে ঢাকায় পড়ে আমার মেয়ে কেন পড়বে না, এই মনভাব থেকেই নোভা ঢাকায় গিয়ে পড়ার পথটা আরও সহজ হয়েছে। অবশ্য এটা না হলেও নোভা ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে ফেলতো। ছোট বেলা থেকে খুবই জেদি স্বভাবের মেয়ে৷ যা চেয়েছে, তাই করেছে।

ঢাকায় গিয়ে আরিফের সাথে সম্পর্ক টা হঠাৎ ভাল হয়ে যায় ওর। একটা সময় সেটা কখন প্রেমে রূপান্তর হয়ে যায় সেটা নোভা কিংবা আরিফ কেউ ই বলতে পারবে না। কেবল ওদের কাছে মনে হয়েছে একে অন্যকে ছাড়া ওরা কোন ভাবেই থাকতে পারবে না।

আজকে যেমন নোভা ছটফট করছিল আরিফের সাথে কথা বলার জন্য৷ গ্রামে ওরা একই সাথে এসেছে। একই ট্রেনে। স্টেশন থেকে আলাদা হয়েছে। স্টেশনে নোভাকে নিতে ওর বাবা হাজির ছিল। আরিফের সাথে কথা বলতে বলতে যখন নোভা নেমে এল সেটা দেখে সে মোটেও খুশি হলেন না। যদিও মুখে কিছুই বললেন না। কারন কিছু বললে ফল অন্য রকম হতে পারে।
তার আগের বছর যখন নোভার বাবা বশির আলী নোভার সাথে আরিফের মেলামেশার কথাটা জানতে পারলেন তখন সে রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েকে তখনই বিয়ে দিয়ে দিবেন অন্য ছেলের সাথে, বলে দিলেন তার ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ। আর ঢাকায় যেতে দিবেন না।
নোভা কোন কথা বলল না। ঘরে গিয়ে দরজা আটকালো তারপর চাকু দিয়ে হাতের রগ কেটে ফেলল। বিরাট রক্তারক্তি অবস্থা। কোন মতে সেবার নোভাকে বাঁচানো গিয়েছিল৷ শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গিয়েছিল৷ তারপর থেকে বশির আলী এই ব্যাপারে কোন কথা বলেন না। শত্রুর ছেলের সাথে মেলামেশা করে এটা জেনেও মেনে নিয়েছেন। আর তারা দুজনেই ঢাকা থাকে বলে চোখের সামনে এসব দেখতে হয় না। তিনি সহ্য করে নেন।

এই যে আজকে নোভা আরিফদের বাসায় এসেছে এটা ঠিকই তার বাবার কানে পৌছাবে৷ হয়তো সরাসরি কিছু বলবেন না তবে অসন্তুষ্ট ঠিকই হবেন৷ কিন্তু নোভা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি। আজ দুই দিন থেকে আরিফের মোবাইল বন্ধ। কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছে না। ওর কি হল সেটা জানার জন্য ছটফট করছে ওর মন। তাই চলে এসেছে কাউকে কিছু না বলে।
অবশ্য এখন সন্ধ্যার সময়। এখনই মাগরিবের আযান দিবে। তাই লোকজনের দেখা সাক্ষাত নেই। এটা ওর জন্য ভালই হয়েছে।

শেখ বাড়ির গেটের কাছে এক দারোয়ান বসে ছিল। ওকে দিয়েই খবর পাঠালো ভেতরে। বলল আরিফকে যেন ডেকে আনে। তারপর গেটের কাছেই অপেক্ষা করতে লাগলো।
নোভা আরিফের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো৷ কিন্ত ওকে অবাক করে দিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে এল আরিফের বাবা আলিম শেখ। কিছুটা বিস্ময় আর অবাক হওয়ার চোখ নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো নোভার দিকে। সৈয়দ বাড়ির কেউ তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তারই ছেলের সাথে দেখা করতে এসেছে এটা যেন সে ঠিকঠাক বিশ্বাস করতে পারছে না।



নোভার সাথে আরিফের পরিচয়টা হয়েছিলো খানিকটা অদ্ভুদ ভাবে । তখন সবে মাত্র ক্যাম্পাসে যাওয়া আসা শুরু করেছে । ঢাকার পরিবেশের সাথে নিজেকে কোন ভাবেই মানিয়ে নিতে পারে নি । ঢাকার ভীড় ওর একদম ভাল লাগে না । হলেই উঠেছে বিধায় ভিড়ওয়ালা বাসে ওকে খুব একটা উঠতে হয় না ।
সবে মাত্র রমজান শুরু হয়েছে । ক্যাম্পাস তখনও ছুটি হয় নি । দুদিন ও হলে ইফতারি করেছে কিন্তু হলের খাওয়া ওর ঠিক পছন্দ হচ্ছে না । একদিন ঠিক করলো যে বাইরে গিয়ে একা একা ইফতার করবে নিজের পছন্দমত । ওদের হলের অনেকেই তাই করে । নোভার তখনও পরিচিত মানুষ হয়ে ওঠে নি । যে কয়জনকে চিনে তারা সবাই নিজের দের বাসায় থাকে । হলে অনেক মানুষের সাথে বসে বসে ইফতার করলেও কেমন যেন একা একা লাগে ওর । বাসার জন্য মন কাঁদে । আর খাওয়াও খুব একটা ভাল না বলে খেয়ে একদম তৃপ্তি পায় না । তাই ঠিক করলো এবার একা একা বাইরে গিয়ে একটু শান্তিমত ইফতার করবে । নিজের পছন্দমত খাবার কিনে খাবে !

কিন্তু সেই আশা ভঙ্গ হতে খুব একটা দেরি হল না । ওদের ক্যাম্পাসে ইফতারি কেনার দোকান গুলোর সামনে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সেখানে ও কিছুতেই ঢুকতে পারছে না । এতো এতো মানুষ সেখানে ভিড় করে আছে যে ওর পক্ষে কোন ভাবেই ভেতরে ঢোকা সম্ভব হচ্ছে না । প্রায় আধা ঘন্টা চেষ্টা করেও ও কিছুই কিনতে পারলো না । খানিকটা হতাশ বোধ করলো । এবং এও বুঝে গেল ওর পক্ষে এই ভিড়ের ভেতর থেকে কিছু কেনা সম্ভব হবে না । শেষে কি আবার হলেই চলে যাবে ?

ঠিক এই সময়ে কেউ একজন ওর পাশে এসে দাড়ালো । ওকে অবাক করে দিয়ে বলল
-টাকা দাও দেখি ।
নোভা ডান দিকে তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখতে পেল । প্রথমে কিছু সময় চিনতে পারলো না । তবে তারপরই চিনে ফেলল একদম । শেখ বাড়ির ছেলে । আরিফ ! এর আগে ছেলেটাকে দেখেছে ও । নাম শুনেছে অনেক বার ! নোভা এও জানে আরিফ ওর ক্যাম্পাসেই পড়ে । ওর থেকে এক বছরের সিনিয়র । নোভা কোন কথা না বলে ব্যাগ থেকে ১০০ টাকা বের করে দিল । নোভার সামনেই আরিভ ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল । ফিরে এল কিছু সময় পরেই । হাতে একটা পলিব্যাগ ।

নোভার হাতে ব্যাগ টা দিতে দিতে বলল
-মোট ৫০ টাকা নিয়েছে । এই নাও বাকি টাকা !
তারপর নোভাকে আর কিছু বলার সুযোগ না নিয়ে আবার হাটা শুরু করলো । নোভা কিছু সময় বোকার মত দাড়িয়ে রইলো । কি করবে ঠিক বুঝতে পারছিলো না । নোভা তাকিয়ে দেখলো কিছু দুরে গিয়ে আরিফ খোলা মাঠের মধ্যে বসে পড়লো । সেখানে ও আগে থেকেই বসে ছিল । আগেই ইফতার নিয়ে বসেছিলো হয়তো । খোলা মাঠে আরও অনেকেই বসে আছে ইফতার করার জন্য । বেশির ভাগই দল বেঁধে নয়তো, জোড়ায় জোড়ায় । সামনে ইফতার সাজিয়ে গল্প করছে । কেবল আরিফ একা একা বসে আছে ।
নোভা ঘড়ির দিকে তাকালো । আর কিছু সময় পরেই আযান দিনে । ওর নিজেরও কোথাও বসে যাওয়া উচিৎ ! নোভা কিছু না ভেবে পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল । তারপর আরিফের সামনে গিয়ে মৃদ্যুর স্বরে বলল
-আমি আপনার পাশে বসবো ?
আরিফ মুখ তুলে তাকালো । তারপর একটু হেসে বলল
-তুমি শত্রু শিবিরের কন্যা । আমার সাথে বসা কি ঠিক হবে ?
-আপনিও তো শত্রু শিবিরের বালক । তবুও তো আমার সাহায্য করলেন ?
-আমরা শেখ বংশ না ! মন খুব বড় !
-ইস আসছে আমার বড় মনওয়ালা !

নোভা হেসে ফেলল ! তারপর আরিফের সামনে বসে পড়লো । নিজের ইফতারের প্যাকেট টা সামনে রেখে বলল
-আমি এখানে আপনাকে দেখবো ভাবি নি ।
-আমিও ভাবি নি ।

তারপর আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলো । নোভার কাছে কেমন যেন লাগছিলো । ওদের দুই পরিবারের মধ্যে কি যে দা কুমড়া অবস্থা লেগে আছে সেই কত বছর থেকে । এখন যদি কেউ ওদের এভাবে এক সাথে বসে গল্প করতে আর ইফতার খেতে দেখে তাহলে নির্ঘাত সে হার্টএটাক করবে ।
তারপর থেকে প্রতিদিন একটা রুটিন দাড়িয়ে গেল যে প্রতিদিন ওরা এক সাথে ইফতার করে । তারপর বেশ খানিকটা সময় ধরে আরিফের সাথে গল্প করে সময় পার করে । একদম হঠাৎ করেই আরিফের সাথে ওর সম্পর্ক ভাল হয়ে গেল । দেখা সাক্ষাৎ ছাড়াও রাতে ফোন কিংবা ম্যাসেঞ্জারে কথা চলতে লাগলো । সেবার ঈদেও বাসায় গিয়েছিলো ওরা এক সাথে । এমন কি কৌশলে ফিরেও এসেছিলো এক সাথে । প্রথম প্রথম আরিফের সাথে মেলা মেশার কথাটা ও লুকিয়েই রাখতো সবার কাছ থেকে । তারপর একটা সময় ও কেবল বুঝতে পারলো যে আরিফ নামের মানুষটাকে ছাড়া ওর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব না । তখন আর রাখঢাকের ধার ধারে নি ।


শেখ বাড়ির সামনে দাড়িয়ে নোভার ঠিক এই কথা গুলো এখন মনে আসছে । সামনে দাড়ানো আলিম শেখকে দেখে মনের ভেতরে খানিকটা অস্বস্তির অনুভূতি হচ্ছে । এখন আলিম শেখ নোভা তাড়িয়ে দিতে পারেন, হুংকার দিয়ে বলতে পারে বেরিয়ে যেতে কিংবা আরও ভয়ংকর কিছু করতে পারেন । কি করবেন সেটা নোভা কিছু বুঝতে পারছে না ।

আলিক শেখ তখনও দাড়িয়ে আছে এক জায়গাতে । নোভার মনে হল এখনই এখান থেকে চলে যায় । কিন্তু সেটা আর যেতে হল না । আলিম শেখের পেছনে হঠাৎ আরিফ কে দেখা গেল । সে আলিম শেখকে পাশ কাটিয়ে খানিকটা ধীর পায়ে এগিয়ে এল নোভার দিকে । ওর চোখে স্পষ্ট কৌতুহল । ও যেন বলার চেষ্টা করছে ওকে বিপদে ফেলার জন্য এখানে না এলেই কি হত না ! ওর সামনে এসে দাড়ালো ও । বলল
-কি ব্যাপার এখানে ? সব কিছু ঠিক আছে ?

নোভা আস্তে করে কেবল মাথা নাড়ালো । কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না । নোভা যাই বলুক না কেন সেটা আলিম শেখ খুব স্পষ্ট ভাবেই শুনতে পাবে । তার সামনেই নিশ্চয়ই বলা যায় না যে তোমাকে খুব মিস করছিলাম । তাই চলে এসেছি । নোভা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে আলিম শেখের কথা শুনতে পেল । আলিম শেখ বলল
আরিফ তোমার বন্ধুকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাও । এই ভর সন্ধ্যায় বাইরে দাড়িয়ে কথা বলা ঠিক না । আর তোমার আম্মাকে বলল যে মেহমানের জন্য নাস্তা বানাতে ।


এই বলে আলিম শেখ আর দাড়ালেন না । তিনি মাগরিবের নামাজের জন্য বের হয়েছিলেন । নোভাকে দেখে দাড়িয়ে পড়েছিলেন । তিনি আরিফ আর নোভাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত মসজিদের দিকে রওনা দিলেন ।

নোভা গেটের সামনেই কিছু সময় দাড়িয়ে রইলো । ভেতরে তখনও পা রাখে নি । সম্ভবত গত পঞ্চান ষাট বছরের ভেতরে নোভাই প্রথম সৈয়দ বাড়ির মানুষ যে কি শেখ বাড়ির এই চৌকাঠ পার হতে যাচ্ছে । আরিফ বলল
-এই যে শত্রু শিবিরের কন্যা ভেতরে ঢুকবে না ?
নোভা একটু হাসলো । একটু নার্ভাস লাগছে ওর কাছে । আরিফ হঠাৎ করেই ওর হাত ধরলো । তারপর বলল
-আসো ভেতরে । তোমাকে মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ।

নোভা শেখ বাড়ির ভেতরে পা বাড়ালো । বহু বছরের নিয়ম ভেঙ্গে নোভা শেখ বাড়িতে ঢুকে পড়লো ।



আরিফদের বাড়িটা ওদের বাড়ির মতই পুরানো। অনেক দিনের বাড়ি। তবে ডান পাশে নতুন করে বানানো হয়েছে। বাড়ির বাম দিকটা অনেক দিন ধরে সংস্কারের কাজ চলছে। সে দিকে এখন কেউ থাকে না।

নোভাদের বাড়ির মতই আরিফদের বাড়িতেও আগে বাড়ি ভর্তি মানুষ ছিল। কিন্তু নানান রোগে শোকে দুই পরিবার থেকেই অনেক মানুষ মারা গেছে। নোভারা বাবা বংশের একমাত্র ছেলে অন্য দিকে আরিফের বাবার আরেকটা ছোট ভাই আছে কেবল।

নোভা আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে হাটতে লাগলো। ওর মনে অদ্ভুদ একটা আনন্দ হচ্ছে। কেন হচ্ছে সেটা ও ঠিক বুঝতে পারছে না৷ ও শেখ বাড়িতে প্রথম বারের মত ঢুকেছে, নাকি আরিফের সাথে দেখা হল এটা সেই খুশির কারন!
নোভা হাটতে হাটতেই বলল, কি ব্যাপার তোমার ফোন বন্ধ কেন শুনি?
আরিফ বলল, আর বল না, গত পরশু পুকুর পাড় দিয়ে হাটার সময় পা পিছলে পুকুরের ভেতরে পড়ে গেছি। পকেটে মোবাইল ছিল। ভিজেটিজে একাকার। কি যে অবস্থা। আর সেই ফোন চালু হয় নি।
নোভা খানিকটা অভিমানের সুরে বলল, তা এটা আমাকে জানাবা না? আমার কত টেনশন হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো তোমার বাবা হয়তো তোমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিছে৷

কথাটা শুনে আরিফ হোহো করে হেসে উঠলো। ততক্ষণে ওরা ঘরে পৌছে গেছে। ওর হাসি শুনে একজন মাঝ বয়সী মহিলা ঘরে প্রবেশ করলো। তারপর নোভার দিকে তাকিয়ে রইলো অভাক চোখে। একটু এগিয়ে এসে বলল, এটা কে রে আরিফ? বশির ভাইয়ের মেয়ে মনে হচ্ছে!
আরিফ হাসতে হাসতে বলল, হ্যা মা শত্রু শিবিরের মেয়ে। তোমার জন্য নিয়ে এলাম।

আরিফের মা আরিফকে একটা ধমক দিয়ে বলল, কি সব কথার শ্রী।
তারপর এগিয়ে এল নোভার দিকে। নোভা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারছিলো না কি বলবে। আরিফের মা একটু কাছে আসতেই সে সালাম করলো। আরিফের মা নোভাকে অনেকটা সময় ধরে দেখলো। তার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না সৈয়দ বাড়ির মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা দেখতেও কি সুন্দর হয়েছে।
আরিফের মা নোভাকে বলল, তোমার সাহস আছে মা!
নোভা কিছু বলার আগেই আরিফ বলল, থাকবে না! শেখ বাড়ির বউ হতে চলেছে। সাহসী তো হতেই হবে!

নোভা খুবই লজ্জা পেল আরিফের কথা শুনে। অন্য সময় হলে অবশ্য লজ্জা পেত না কিন্তু এখন আরিফের মা রয়েছে সামনে।

সন্ধ্যাটা নোভার খুবই চমৎকার কাটলো। এতোদিন শেখ বাড়ির মানুষ গুলো সম্পর্কে কি ভয়ংকর কথা শুনে এসেছে কিন্তু পুরো শেখ বাড়ির মানুষ তার সাথে চমৎকার ব্যবহার করছে। আলিম শেখ নামাজ থেকে এসে তার সাথে বসেই চা খেল। তার পড়ালেখার খোজ খবর নিল।

রাতে আরিফকে বলল যেন নোভাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসে৷ সেই সাথে এও বলে দিল এখন থেকে যখন ইচ্ছে সে এই বাড়িতে আসতে পারে।
ফেরার পথে ওরা গ্রামের রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাটছিল৷ নোভা বলল, তোমার বাবা এতো সহজে আমাকে মেনে নিবে ভাবি নি।
আরিফ হাসলো। তারপর বলল, গতবছর তুমি যে কান্ড করেছিলে সেটা আব্বার কানে গিয়েছিল। সৈয়দ বাড়ির এক মেয়ে তার ছেলের জন্য হাতের রগ কেটে ফেলেছিল এটা জানার পরে তার মন খানিকটা নরম হয়ে গেছে। আগে তিনি আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করতো যে বিয়ে তার পছন্দমতো ই করতে হবে। তবে আমাকে জোর করতে পারে নি কোন দিন। গত বছরের পরে সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে।
নোভা বলল, আমার বাবা এখনো রাজি না। মুখে কিছু বলে না ঐ ঘটনার পরে কিন্তু বুঝতে পারি যে সে অখুশি।

হঠাৎ রাস্তার মাঝে থেমে গেল। তারপর নোভার হাত ধরে বলল, ধরো তোমার আব্বা যদি কোনদিন রাজি না হয়!
নোভা কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। তারপর বলল, আমি জানিনা কি করবো। তোমাকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনাই করতে পারি না। আবার বাবাকে ছাড়াও না৷ কি করবো জানি না।
আরিফ বলল, টেনশন নিও না। রোমিও জুলিয়েটের মত আমাদের গল্প শেষ হবে না নিশ্চিত থাকো। আমাদের দুজনের মধ্য দিয়েই এই শত্রুতা শেষ হবে।

নোভা বলল, তাই যেন হয়। তারপর আবারও হাটতে লাগলো বাড়ির দিকে।



বিকেলের নামাজ শেষ করে বশির আলী সাধারনত বাজারের দিকেই তার আড়তে বসে সময় কাটান । দিন শেষের হিসাব পত্র দেখেন আর পরিচিত মানুষের সাথে গল্প গুজব করে সময় কাটান । কিন্তু আজকে নামাজ শেষ করেই তিনি বাসার দিকে রওনা দিলেন । তার মাথায় আজকে চিন্তার ঝড় চলছে কিছুতেই একটা ব্যাপার তিনি মেলাতে পারছেন না । বারবারই কেবল মনে হচ্ছে যে এর ভেতরে নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা আছে । নিশ্চয়ই আলিম শেখ নতুন কোন চাল চালছে । নয়তো কেসটা সে তুলে নিবে কেন এতো দিন পরে । এই কেস তুলে নেওয়ার ফলে বশির আলীর হাতে কম করে হলেও সাতে এরারো বিঘা জমি চলে এসেছে । আলিম শেখ আসলে কি চাচ্ছে ?

যখন প্রথম কেস তুলে নেওয়ার খবর তার কানে এল সে কিছুতেই বিশ্বাস করে নি । শহরে গিয়ে নিজে সে আজকে খোজ নিয়ে এসেছে এবং সত্যিই সত্যিই দেখেছে যে আলিম শেখ জমির কেস তুলে নিয়েছে । সেই সাথে এও বলে এসেছে যে তার আর ঐ জমির উপর কোন দাবি নেই । বশির আলী কিছুতেই এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না । এতো গুলো বছর সে এই জমির জন্য লড়াই করলো আজকে এমনি এমনি ছেড়ে দিল ? কিন্তু কেন ?

বাড়ির পথে হাটতে হাটতেই সে কারন টা ভাবতে লাগলো । তখনই তার কানে হাসির আওয়াজ এল । হাসিটা তার খুব পরিচিত । নোভা হাসছে ! চুপচাপ নয় বরং খিল খিল করে হাসছে । বশির আলী আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল । আওয়াজটা আসছে পুকুর পাড় থেকে ।

বড় পুকুর সৈয়দ বাড়ি আর শেখ বাড়ির মাঝামাঝি পড়েছে । শেখ আর সৈয়দ বাড়ি গ্রামের একবারে শেষ মাথার দিকে । দুই বাড়ি থেকে দুইটা রাস্তা চলে গিয়েছে বাজারের দিকে । বাজার পার হয়েই গ্রাম । পুরো গ্রামের উল্টো দিকে ওদের দুটো বাড়ি । গ্রামের আর বিভিন্ন দিকে দুই পরিবারের অনেক জমি জমা রয়েছে । বাজারে দুজনেরই আড়ত রয়েছে তা ছাড়াও শহরেও কিছু দোকান আর সম্পত্তি আছে দুজনেরই ! কিছু জমি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে ঝামেলা অনেক দিনের । আগে যখন লাঠিয়াল বাহিনী ছিল তখন প্রায়ই মারামারি বাধতো । কিন্তু এখন আর মারামারি খুব একটা হয় না । এখন চলে টাকার খেলা । আর মামলা । বেশ কিছু জমি নিয়ে দুজনের মাঝে মামলা চলছে অনেক দিন । কোন সমাধান হচ্ছে না ।

বশির আলী নিজেকে খানিকটা আড়াল করেই পুকুর পাড়ের উকে দিলেন । যা ভেবেছিলেন তাই । তার মেয়ে নোভা শেখ বাড়ির ঐ ছেলের সাথে বসে গল্প করছে । ঐ ছেলে কিছু বলতে আর নোভা হেসে গড়িয়ে পড়ছে । বাবা হিসাবে এই দৃশ্য দেখার সাথে সাথেই তার মাথায় আগুন লেগে যাওয়ার কথা । তারও হয়তো লেগে যেত কিন্তু তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নিলেন । নিতে বাধ্য হলেন । ঐ ঘটনার পরে নোভাকে কিছু বলতে তার সাহস হয় না । বিশেষ করে আরিফের ব্যাপারে কিছু তো নয়ই ।

তারপর বশির আলীর হঠাৎ নোভার চেহারার দিকে চোখ গেল । ছোট বেলাতে যখন সে নোভাকে কোন কিছু নিয়ে আদর করতো কিংবা মজার মজার কথা বলতো তখনও নোভা ঠিক এই ভাবে খিলখিল করে হাসতো । অনেক দিন সেই হাসি তার দেখা হয় না । বশির আলীর খুব ইচ্ছে হল জানতে যে ছেলেটা এমন কি বলছে যে নোভা এভাবে হাসছে । কিছু সময় হাসির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সে । তারপর পেছন ঘুরে হাটা দিল ।

কয়েক দিন আগে নোভা শেখ বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিলো এই কথা তার কানে গেছে । প্রথমে সে ভেবেছিলো হয়তো আলিম শেখ তখন বাসায় ছিল না । কিন্তু আলিম শেখ তখন বাসাতেই ছিল । নোভাকে সে বাসায় ঢুকতে দেখেছে । সেই ই নাকি নোভাকে ভেতরে নিয়ে যেতে বলেছে তার ছেলেকে । এসব গল্প নোভা তার মায়ের কাছে করেছে । সে আড়াল থেকে শুনেছে । যদিও মা মেয়ের গল্প আড়াল থেকে শোনা তার ঠিক হয় নি কিন্তু তিনি কৌতুকল দমন করতে পারেন নি ।

বাড়ির দিকে হাটতে হাটতেই বশির আলির বুঝে ফেললেন আলিম শেখ কেন তার জমি ফেরৎ দিয়ে দিয়েছে । তার প্রশ্নের জবাব তার সামনেই রয়েছে । সে যেমন তার সন্তানের কাছে খানিকটা অসহায় । শত্রুর ছেলের সাথে বসে বসে গল্প করছে জেনেও যেমন সে কোন কিছু না বলে চলে এল আলিম শেখও ঠিক একই ভাবে কিছু বলতে পারে নি । সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে তার ছেলেকে সে আটকাতে পারবে না । নোভার থেকে দুরে রাখতে পারবে না । এই জন্যই কি আলিম শেখ নমনীয় হয়ে এসেছে ? ঝামেলা সব মিটিয়ে ফেলতে চাইছে ? আচ্ছা কাল যদি এই আলিম শেখ নোভার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তাহলে সে কি করবে ?
এক টা ব্যাপার তার কাছেও পরিস্কার যে সে না চাইলেও নোভা ঐ ছেলেকেই হয়তো বিয়ে করবে । যে কোন ভাবেই ! তাহলে তার কি করা উচিৎ !

এই সব ভাবতে ভাবতেই সে নিজের বাড়িটা গেটের কাছে পৌছে গেলেন । বাড়িটা অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে গেছে অনেক । ঠিক করা হয় না । বাড়ির গেট টাও খানিকটা ভেঙ্গে গেছে । বাড়ির অবস্থাও খানিকটা করুন । এবারই কাজে হাত দেবেন ঠিক করলেন । তা ছাড়া বাড়িতে এখন লোকজন একদম কম । আগে একটা সময় অনেক মানুষ জন থাকতো । কিন্তু তাদের বংশ ছোট হতে হতে অনেক ছোট হয়ে এসেছে । তার কোন ছেলেও হয় নি । নোভার পরে তারও দুজন সন্তান এসেছিলো তার কিন্তু তারা কেউ বাঁচে নি । নোভার শরীর ভেঙ্গে যাওয়ার তিনি আর চেষ্টাও করেন নি । সেদিন থেকে তার বাসার মানুষ জন অনেক কম এখন । তাই বাড়ির নিরাপত্তা একটু বাড়ানো দরকার । ফসল বিক্রির কাজ টা প্রায়ই শেষ হয়ে এসেছে । এই সময়ে গ্রামে সবার হাতেই একটু টাকা পয়সা আসে । তাই এই সময়ে গ্রামে মাঝে মাঝে চোরের আনাগোনা বেড়ে যায় । আগে এই সময়ে প্রায়ই বাড়িতে ডাকাত পরতো । এখন অবশ্য সেই ভয় নেই ।
তবুও তিনি ঠিক করলেন সামনের সপ্তাহ থেকেই বাড়িটা ঠিক করার কাজে হাত দিবেন !




রাত কয়টা বাজে সেটা আলিম শেখের হিসাব নেই হঠাৎ তার মনে কেউ তার ঘরে ঢুকেছে । চোর এল কিনা এটা ভাবার আগেই ঘরের আলো জ্বলে উঠলো । আলিম শেখ চোখ মেলে দেখলো তার ছেলে আরিফ ঘরের ভেতরে । তার কাছে দ্রুত এগিয়ে এল সে ! তারপর বলল
-আব্বা আপনার বন্দুক টা কোথায় ?

আলিম শেখ কিছু বুঝতে পারলেন না । চোখ গেল দেওয়াল ঘড়ির দিকে । তাকিয়ে দেখেন সেখানে রাত একটার কিছু বেশি বাজে । এই সময় তার ছেলে বন্দুকের খোজ কেন করছে সেটা বুঝতে পারছে না । তিনি কোন মতে বললেন
-কেন কি হয়েছে ?
-আব্বা নোভাদের বাসায় ডাকাত পড়েছে । কোথায় বন্দুক ?

আলিম শেখ কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না । পাশে তার স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে গেছে । তার কিছু বলার আগেই তার স্ত্রী বলল
-আলমারিতে রাখা !
-চাবি কোথায় ?
আলিম শেখ যন্ত্রের মত চাবিটা বের করে দিলেন । তার সামনেই আরিফ আলমারি থেকে বন্দুক বের করে আবার দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন । আরিফ যাওয়ার পরে তার টনক নড়লো । তিনি কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না কিছুটা সময় । তার মনে কেমন একটা দ্বিধা কাজ করছে । যে কাজটা করতে মন চাচ্ছে কিন্তু মস্তিস্ক চাচ্ছে না ।

বশির আলী দরজা আটকে বসে আছেন । বাইরে বেশ চেঁচামিচি হচ্ছে । ঠিক কতজন তার বাসার ভেতরে ঢুকেছে সেটা সে বলতে পারবে না । তবে কম করে হলেও চার পাঁচজন তো ঢুকেছেই । সদর দরজা ভেঙ্গেই ভেতরে ঢুকে পড়েছে । তিনি এখন নিজের শোবার ঘরে বন্ধি হয়ে আছেন । এবং আশার কথা হচ্ছে নোভা আর নোভার মাও তার সাথেই রয়েছে । নোভার মা একেবারে ভয়ে কুকড়ে গিয়েছে । ভয় তিনিও পাচ্ছেন । ঘরের এই দরজা কত সময় ডাকাতদের আটকে রাখবে সেটা তিনি ঠিক বলতে পারছেন না ।
টাকা পয়সা নিয়ে যায় যাক, সেটা নিয়ে তার খুব একটা চিন্তা নেই । তার যত চিন্তা তার মেয়েকে নিয়ে । ডাকাতরা যদি নোভার কোন ক্ষতি করে । তাহলে ? নোভার দিকে তাকিয়ে তিনি খানিকটা অবাকই হলেন । মেয়েটার যে পরিমান ভয় পাওয়ার কথা সেই পরিমান ভয় সে পাচ্ছে না । এক ভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে ।

বশির আলী বলল, শোন ওরা যদি দরজা ভেঙ্গে ফেলে তোরা দুইঝন খাটের নিচে চলে যাবি । বুঝেছিস ? আমি আলমারির চাবি ওদের দিয়ে দিবো । ওরা টাকা পয়সা নিতে ব্যস্ত থাকবে ! তোরা কিন্তু কোন আওয়াজ করবি না !
নোভা বশির আলীর দিকে তাকালো । তারপর বলতে গেল, বাবা.....
কিন্তু লাইণটা শেষ করার আগেই দরজায় ধাক্কা পরলো খুব জোড়ে । ওপাশ থেকে আওয়াজ শোনা গেল
-দরজা খোলেন বশির মিয়া । যদি ভাঙ্গতে হয় তাইলে কিন্তু খবর আছে ! তোমার মাইয়া আছে না ঘরে .....

বশির আলীর গলা শুকিয়ে গেল । সে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না । সদর দরজা ভেঙ্গে ডাকাত দল এতো দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়লো যে তিনি কি করবেন ঠিক বুঝতেই পারলেন ন । মোবাইল দিয়ে যে কাউকে ডাক দিবে তারও উপায় নেই । তার মোবাইলে খুব একটা কথা বলার দরজার হয় না । রাতে মোবাইল বাজলে বিরক্ত লাগে বলে সে মোবাইল সব সময় বসার ঘরে রেখে আসেন । আজকে এই কাজটার জন্য নিজেকের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করলো । মোবাইলটা কাছে থাকলে অন্তত কাউকে জানানো যেত ।

গ্রামের একেবারে শেষ দিকে বাড়ি হওয়ার কারনে কেউ হয়তো টেরও পাবে না এখানে কি হচ্ছে । বশির আলী ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতা লাগলেন দরজার দিকে । নোভা তাকে আটকালো । তারপর বলল,
-দরজা খুলো না বাবা ! সাহায্য আসছে !
-কে !

নোভা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল না । দরজার ওপাশে কিছু সময় ছুটোছুটি শোনা গেল । তারপর আবারও একটা গুলির আওয়াজ । তারপর একেবারে সব নিশ্চুপ !

বশির আলী কিছু বুঝতে পারছে না । প্রথমে একদল ডাকাত এল তারপর কারা গুলি করলো ! কি হচ্ছে এখানে ! হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ শোনা গেল ।
-নোভা ঠিক আছো তোমরা ?
নোভা বিন্দু মাত্র দেরি না করে বলল
-হ্যা আমরা ঠিক আছি ।
তারপর নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দিল । বশির আলি দেখতে পেলেন দরজার সামনে আরিফ দাড়িয়ে আছে বন্দুক হাতে । নোভা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
-যখন ডাকাত আসে আমি ওর সাথে কথা বলছিলাম ফোনে !

বশির আলি তখন তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আরিফের দিকে । তবে সে আরিফ কে দেখছে না । সে তাকিয়ে আছে আরিফের পেছনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে !
আলিম শেখ একটা বড় দা নিয়ে দাড়িয়ে আছে । আলিম শেখ তার বাসায় এসে হাজির হয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্য ! পেছনে আরও কয়েক জনকে দেখা গেল । আলিম শেখের ছোট ভাইও আছে তাদের মাঝে ! বাদ বাকি ওদের বাসার চাকর বাকর ! পুরো বাহিনী নিয়ে এসেছে ।

ঘরের ভেতরে অদ্ভুদ নিরবতা নেমে এল কিছুটা সময় । কেউ কোন কথা বলছে না । কেবল একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে । নিরবতা ভাঙ্গলো আলিমই শেখই । সে সামনে এগিয়ে এসে বলল
-ওরা পালিয়েছে । আর আসবে না সম্ভবত । তবুও সাবধান থাকা দরকার বাড়ির চাকরদের একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছিলো । ওদের সাথে আমাদের বাসার দুজনকে রেখে যাচ্ছি ।
তারপর আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল
-চল আরিফ ! বাসায় যাওয়া যাক !

আলিম শেখ যখন ঘর থেকে বের হতে যাবে তখনই বশির আলী বলল
-আলিম ভাই, আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব আমি বুঝতে পারছি না ! এক গ্লাস শরবত খেয়ে যান !
আলিম শেখ বলল
-এখন অনেক রাত হয়েছে । আপনারা ঘুমান । এতো ঝামেলা করতে হবে না !
-না না কোন ঝামেলা না !
তারপর নোভার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-জলদি রান্না ঘরে যাও । জামিলাকে ডাকো জলদি ডাকো !


আধা ঘন্টা পরে সৈয়দবাড়ির পরিবেশ পুরোপুরি বদলে গেল । একটু আগে যে এই বাড়িতে ডাকাতেরা হামলা করেছিলো সেটা কারো মনেই থাকলো না । সব থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বশির আলী নিজে । কিভাবে আলিম শেখকে আপ্যায়ন করবে সেটা তিনি ঠিক বুঝতে পারছে না ।

একটু দুরে দাড়িয়ে রয়েছে নোভার আর আরিফ । তার বাবা আর চাচাদের কান্ড কারখানা দেখছে । নোভা হঠাৎ আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল, তো মিস্টার বীর পুরুষ আপনার তো একটা পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেল ।
আরিফ বলল, কি পুরস্কার শুনি ?
নোভা বলল, সেটা নিতে হলে আপনাকে সবার চোখের আড়ালে যেতে হবে । এ এমন এক পুরস্কার যে সবার সামনে দেওয়া যাবে না ।
আরিফ বলল, এটা তো আমি পাবোই । অন্য কিছু হলে বল ।
-ইস কত শখ । আমি না দিলে কিভাবে পাবা শুনি ?
-সেটা দেখা যাবে । আগে বিয়ে হতে দাও তারপর দেখা যাবে !
-ইস ! আসছে আমার বীর পুরুষ । আমি না চাইলে কোন দিন পাবা না । বুঝছো !

আরিফ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই আলিম শেখের ডাক শোনা গেল । সে আরিফ কে ডাকছে । বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে । যাওয়ার সময় আবারও আলিম শেখ বশির আলীকে বলল সাবধানে থাকতে । আর যে কোন দরকারে ডাক দিতে । তাদের পারিবারিক যে শত্রুতা বছরের পর বছর চলে এসেছে সেটা শেষ করার সময় চলে এসেছে । প্রাথমিক কাজটা হয়ে গেছে এখন কেবল দুজনের সৎইচ্ছা থাকলেই সেটা একেবারে শেষ হয়ে যাবে !


পরিশিষ্টঃ


আজকে গ্রামের কারো বাড়িতে রান্না হয় নি । পুরো গ্রাম নোভা আর আরিফের বিয়ের ভোজ খেয়েছে পেট পুরে । কেবল দুপুরের খাবারই নয় রাতের খাবারও তারা খেয়েছে সৈয়দ আর শেখ বাড়িতে । সবার চোখে সামনের বহু বছরের পুরানো শত্রুতা ভুলে তারা আজকে এক হয়ে গেছে ।
ঐ রাতের পরের দিনই বশির শেখ নিজে গিয়ে হাজির হয়েছিলো শেখবাড়িতে । পুরো শেখ বাড়ির মানুষকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছিলো । ঠিক তার দুদিন পরে আলিম শেখও একই কাজ করলো । রাস্তায় দুজনকে দেখা গেল কথা বলতে বলতে বাজারের দিকে এগিয়ে যেতে । গ্রামের মানুস অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল কেবল । তারা যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না । জমিজমা নিয়ে যত ঝামেলা ছিল সেগুলো নিজেরা বসেই সমাধান করে ফেলল এক দিনের ভেতরে । তারপরই নোভা আর আরিফের বিয়ের কথা উঠলো । যদিও তাদের পড়াশুনা এখনও শেষ হয় নি তবুও বিয়ে এখনই হবে ঠিক হল । পড়াশুনা চলবে পড়াশুনার জায়গাতে এখন বিয়ে হয়ে থাকুক ।

সব ঝামেলা শেষ করে যখন আরিফ বাসর ঘরে ঢুকলো তখন প্রায় মধ্যরাত । নোভাও ক্লান্ত ছিল তবে দুজনের কারো চোখেই ঘুম নেই । নোভা কেবল নিজের পছন্দের মানুষটাকেই আপন করে পায় নি বরং অনেক দিনে একটা শত্রুতাও শেষ করে দিয়েছে । ভাগ্যিস সেদিন নোভার মাথায় বুদ্ধিটা এসেছিলো । নয়তো এই সব এতো জলদি হতো না ।

নোভাদের বাসায় ডাকাতের হামলাটা পুরোপুরিই একটা সাজানো নাটক ছিল । যে ৫ জন মুখোশধারী নোভাদের বাসায় এসেছিলো সেটা জোগার করেছিলো আরিফ নোভার বুদ্ধিমত । নোভার কেবল চাওয়া ছিলো যে আরিফ রাতের বেলা হাজির হবে বন্দুক নিয়ে এতেই ওর বাবার কাছে আরিফের গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে । ব্যাস এই টুকুই চাওয়ার ছিল । ওদের দুজনের কারোই ধারনা ছিল না যে আরিফের বাবাও এসে হাজির হবে সাহায্যের জন্য । যে ঘটনা আশা করেছিলো তার থেকেও ভাল ফল পেয়ে গেল ওরা ।

আরিফ খাটের উপর বসতে বসতে বলল, কি শত্রুশিবিবের কন্যা তাহলে বউ হয়েই গেলে শেষ পর্যন্ত ?
নোভা মুখ বাঁকিয়ে বলল, কার বুদ্ধি শুনি !
আরিফ খানিকটা হাত তুলে বলল, স্বীকার করছি । এখন দেখি আমার পুরস্কার কোথায় ? ঐদিন দিতে চেয়ে ছিলে !
-ইস ! আজকে না !
-আজকে না মানে ! এতো দিন অপেক্ষা করেছি । আর না আর !
-এই খবরদার বলছি ! আমি সৈয়দবাড়ির মেয়ে
-দাড়াও তোমার সৈয়দবাড়ি বের করছি ......

এই গল্প এখানেই শেষ । তারপর কি হল সেটা অন্য কোন গল্প !
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৯ রাত ১০:৪৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×