somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ লাইমা

৩১ শে মে, ২০১৯ রাত ৯:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-সাত নাম্বার ওয়ার্ড টা কোন দিকে বলতে পারেন ?

আমি প্রশ্নটা শুনে বাঁ দিকে ঘুরে তাকালাম । ঘুরে তাকাতেই ধাক্কাটা খেলাম । আমার থেকে কয়েক হাত দুরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে । মেয়েটির পরনে কালো রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ । কালো ওড়না সব কিছুই কালো । টানা টানা চোখ, নাকটা খাড়া । পাতলা লাল ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমার সাথে তার আগে থেকেই পরিচয় আছে । অনেক দিন পরে দেখা এমন একটা ভাব । কিন্তু এই সু্ন্দরীকে আমি কিছুতেই চিনতে পারছি না । আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুটা সময় । এরকম নিখুঁত সুন্দরী আমি অনেক দিন দেখি নি ।

একটা সময় যখন অনলাইনে খুব বেশি সময় কাটাতাম, তখন রাস্তা ঘাটে প্রায় সব মেয়েকেই আমার পরিচিত মনে হত । মনে হত মেয়েটা নিশ্চয়ই আমার ফ্রেন্ড কিংবা ফলোয়ার লিস্টে আছে । চলতে পথে আমার সাথে দেখা হয়ে গেছে । এখনই ভাইয়া ভাইয়া বলে গদগদ করতে করতে এগিয়ে আসবে । কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এমন করে কেউ কোন দিন এগিয়ে আসে নি ।

কিন্তু এই সুন্দরী এতো মানুষ রেখে হঠাৎ করে আমার কাছে সাত নাম্বার ওয়ার্ডে খোজ করতে লাগলো কেন ? আমাকে দেখে কি হাসপাতালের দারোয়ান কিংবা গার্ডদের কেউ মনে হচ্ছে কোন দিক দিয়ে ?
আমি নিজের পরিহিত কাপড়ের দিকে আরেকবার ভাল করে তাকিয়ে নিলাম চট করেই । নাহ, সেগুলো তো বেশ ভালই মনে হচ্ছে । নাকি ডাক্তার কিংবা হাসপাতালের অফিসার দের কেউ মনে করতেছে ?

আমি নিজেই এতো সময়ে গোবেচারা হিসাবে এই হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছি । রাকিবকে দেখতে এসেছি । ও আট নাম্বার ওয়ার্ডের কোথাও আচে । আমি কয়েকবার এদিক ওদিক হাটা হাটি করলাম কিন্তু আট নাম্বার ওয়ার্ডটা কোথায় খুজে পেলাম না । আর এই মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতেছে যে সাত নাম্বার ওয়ার্ডটা কোথায় ?

আমি খানিকটা লজ্জিত হাসি দিয়ে বললাম
-আসলে আমি নিজেই কত সময় ধরে আট নাম্বার ওয়ার্ডটা খুজে বেড়াচ্ছি । খুজে পাচ্ছি না । মনে হচ্ছে কোন হাসপাতালে না গোলক ধাঁধার ভেতরে ঢুকে পড়েছি ।
মেয়েটির মুখের হাসি এবার একটু বাড়লো যেন । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা সমস্যা নেই । আসুন দুজন মিলে খুজে বের করি ! ঐতো ঐদিকে মনে হয় !

এই বলেই মেয়েটি আমাকে সামনের ডান দিকে হাটার জন্য বলল । আমিও মন্ত্র মুগ্ধের মত মেয়েটির পাশে পাশে হাটতে লাগলাম । মেয়েটির শরীর থেকে একটা চমৎকার সুগন্ধ বের হচ্ছে । মেয়েটির সাথে দেখা হওয়ার আগে হাসপাতালের সেই চিরো পরিচিত গন্ধটাই কেবল নাকে এসে লাগছিলো কিন্তু এখন সেই হাসপাতালের গন্ধ বলতে কিছু নেই । মেয়েটির শরীরের সুগন্ধটা যেন চারিদিকে মওমও করছে ।
আমরা আবারও কিছু সময় এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করতে লাগলাম । মেয়েটি আমার পাশে পাশে হাটছে । আমি মাঝে মাঝে তার চেহারার দিকে ফিরে তাকাচ্ছি । কেমন একটা অদ্ভুদ অনুূভূতি হচ্ছে । নিজের ভেতরেই কেমন অন্য রকম লাগছে । বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটি এতো মানুষ থাকতে এই মেয়েটি কেন আমার কাছেই জানতে চাইলো ওয়ার্ডটা কোন দিকে । এমন কি আমি যখন বললাম যে আমি নিজেও চিনি না তখনও অন্য কারো না গিয়ে আমাকে নিয়ে হাতে লাগলো ।
এর ভেতরে কি অন্য রকম কিছু আছে ? অন্য ঘটনা ?
মেয়েটি কি আমাকে চিনে ?

আমি তো মেয়েটিকে কোন ভাবেই চিনতে পারলাম না । এই মেয়েটিকে এর আগে কোন দিন দেখেছি কি না আমার মনে পড়ে না । হঠাৎ করেই আমরা সাত নাম্বার ওয়ার্ড পেয়ে গেলাম । মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এই তো পেয়ে গেছি । আপনাকে ধন্যবাদ !
আমি বললাম
-আরে আমি কি করলাম ? আপনিই তো খুজে পেয়ে গেলেন । আর ধন্যবাদ তো আমার দেওয়া উচিৎ ! ঐ দেখুন আট নাম্বার ওয়ার্ডটা !

আমি সত্যিই এতোটা সময় এই করিদর দিয়ে কত বার হাটাহাটি করেছি সেটা আমি নিজেই বলতে পারবো না । কিন্তু এই ওয়ার্ডটা এতো সময়ে এখানে ছিল না ।মেয়েটি আমার দিকে আমার কথাতে যেন খুব মজা পেল । তারপর বলল
-আচ্ছা আসি । ভাল থাকবেন !

এই বলে মেয়েটি সাত নাম্বার ওয়ার্ডে ঢুকে গেল । আমি সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে থকে রাকিবের খোজ করতে লাগলাম । রাকিব হচ্ছে আমার সম্পর্কে মামাতো ভাই । আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি । তবে বিষয় আলাদা । আজকে সকালে আমাকে রাজিবের বাবা মানে আমার বড় মামা ফোন করে বলল যে রাজিব হাসপাতে ভর্তি হোয়ে আছে আমি যেন তাকে দেখতে আসি ।

আমি হাসপাতাল জিনিসটা সারা জীবনই এড়িয়ে চলি । কখনই সেখানে যেতে চাই না । তবে রাকিব আমার কাছ মানুষদের একজন ।ওকে দেখতে না আসাটা খুবই খারাপ দেখায় । তাই এখানে হাজির হতে হল । এখন মনে হচ্ছে এখানে না এলে মেয়েটির সাথে দেখাই হত না ।

দরজার কাছে দাড়িয়েই আমি রাকিবকে দেখতে পেলাম । মোবাইলে কি যেন টেপাটেপি করে যাচ্ছে । এখান থেকে দেখে ওকে আর যাই হোক অসুস্থ মনে হচ্ছে না । আমি ওর বেডের কাছে গিয়ে দাড়াতেই ও আমার দিকে চোখে তুলে তাকালো । তারপর একটু মুচকি হেসে বলল
-এতো সময় লাগলো ?
-ওয়ার্ড খুজে পাচ্ছিলাম না ।
-কই কিছু আনিস নি ?
আমি কিছু না বুঝতে না পেরে বলল
-কিছু কি আনার কথা ছিল ? তুই তো কিছু আনতে বলিস নি ।

রাকিব কপট রাগ দেখিয়ে বলল
-আমি কিছু আনতে বলি নি বলে আনবি না ? তুই না রুগী দেখতে এসেছিস ?

আমি বললাম
-হায়রে আমার রোগী ! তোকে দেখে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে না । এখন আবার মোবাইল টিপছিস । আসল কাহিনী কি বলতো ? আমার তো মনে হচ্ছে কাহিনী অন্য । সত্য করে বল ।

রাজিব একবার চারিপাশে তাকালো । কাকে যেন খুজতেছে । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আব্বা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলো । বাসায় বন্দী করে রেখেছিলো । কোন ভাবেই বের হতে পারছিলাম না । তাই এই ঢং করে বের হয়েছি !
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম
-সত্যি নাকি ?
-হুম । আব্বা কারো সাথে যোগাযোগও করতে দিচ্ছি না । এই ফোন দেখছিস এখানে কোন সিম নেই ।

আমি বড় মামাকে খুব ভাল করেই চিনি । একবার যদি ঠিক করে থাকে যে রাকিবকে সে বিয়ে দিবে তাহলে সেটা হবেই । রাকিব কোন ভাবেই সেটা আটকাতে পারবে না । রাকিব আমার দিকে তাকিয়ে বললাম
-তুই এখন আমাকে পালাতে সাহায্য করবি ।
আমি চিৎকার করে উৎলাম । তারপর বললাম
-মাথা খারাপ ! বড় মামা আমাকে আস্তে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে !
-কোন কথা শুনতে চাই না । যদি না সাহায্য করিস তাহলে ফুফা কে কিন্তু বলে দিল ঐ কথা !

আমি বিরক্ত নিয়ে রাকিবের দিকে তাকালাম । বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেক সিক্রেট থাকে । আর রাকিব তো বলতে গেলে ছোট বেলা থেকেই আমাদের বাসাতেই মানুষ হয়েছে । আমার ব্যাপারে এমন কিছু নেই ও জানে না । ওর ব্যাপারে এমন কিছু নেই যা আমি জানি না । এমন কিছু সিক্রেট ও জানে ! আমি বললাম
-দেখ ব্লাকমেইল করবি না !
-আরে বাবা কি বিপদে পরেছি দেখছিস না কেন ? তুই কেমন ভাই ?
-আচ্ছা দাড়া । দেখি করি করা যায় ! আগেই এতো উতলা হস কেন ?

আমি আরও কিছু বলতে যাবো তখনই একটা তীব্র হাহকারের আওয়াজ পেলাম । একজন মহিলা চিৎকার দিয়ে কান্না করছে । তার কি হবে এই জাতীয় কথা । আওয়াজটা আসছে দেওয়ালের ওপাশ থেকে । ওয়ার্ডে আর সবাই কান্নার চিৎকারটা লক্ষ্য করতে লাগলো । কেউ কেউ আবার উঠে গিয়ে দেখতে গেল কি হয়েছে ।
এমন সময় দেখলাম বড় মামা আমাদের সামনে এসে হাজির হল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এসেছিস ? যাক ভাল ।
রাকিব বড় মামার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে ? এভাবে কাঁদছে কে ?
বড় মামা বলল
-এটা হাসপাতাল তো ! এখানে মানুষ মারা যায় প্রায়ই । সাত নাম্বার ওয়ার্ডের একজন রোগী মারা গেল একটু আগে । তারই মা কাঁদছে ।

আমার মনটা খানিকটা বিষণ্ণ হয়ে গেল সাথে সাথেই । এই জন্যই আমার এই হাসপাতাল ভাল লাগে না । এখানে মানুষ যেমন সুস্থ হয়ে ফিরে যায়, তেমনি অনেকে এখান থেকেই চলে যায় না ফেরার দেশে । সেই হাহাকার অনেকটা সময় আটকে থাকে এই হাসপাতালের বাতাসে ।

হাসপাতাল থেকে ফিরে আস্তে আস্তে বেশ সময় লেগে গেল । হল থেকে বের হওয়ার সময়ই ঠিক করে রেখেছিলাম যে হাসপাতাল থেকেই আমি টিউশনীতে যাবো । স্টুডেন্টেদের বাসার লিফটে উঠতে গিয়ে আমাকে আবার চমকাতে হল । লিফট থেকে সেই মেয়েটা নামছে ! আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটাও খানিকটা চমকে উঠলো । তারপর মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো । আমি বলল
-আপনি !
-আপনি এখানে ?
আমি একটু হাসলাম । তারপর বললাম
-আমি এখানে পড়াই ।
-ও আচ্ছা ।
-আপনি ?
-আমি একটা কাজে এসেছিলাম । কাজটা শেষ হয়ে গেছে । এখন চলে যাচ্ছি ।

এই বলে মেয়েটা হাটতে যাবে তখনই আমার কেন জানি মনে হল কিছু একটা বলা দরকার । আমি বললাম
-এই যে শুনুন !
মেয়েটা দাড়িয়ে পড়লো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কিছু বলবেন ?
-একই দিনে দুই দুইবার আমাদের দেখা হল । আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আবারও আমাদের দেখা হবে ।
-দেখা তো হতেই পারে ?
-নাহ ! আমার সাথে এই রকম একদমই হয় না । এই ঢাকা শহরে রাস্তা খাটে চলাচলের সময়ে আমার একদমই কারো সাথে দেখা হয় না । আপনার সাথে পরপর দুইদিন দেখা হল তার মানে অন্য কিছু !
মেয়েটা এবার হেসে ফেলল । পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁটে মেয়েটার হাসির দিকে আমি বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটি বলল
-আচ্ছা এর পরে যদি আমাদের দেখা হয় তাহলে সত্যিই ভেবে নিবো যে আমাদের মধ্যে কিছু একটা রয়েছে । ঠিক আছে ?
আমি হাসলাম । তারপর বলল
-আচ্ছা ।

মেয়েটি আবারও বিদায় নিয়ে নিল । আমি তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির চলে যাওয়া পথের দিকে । মেয়েটি গেট দিয়ে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়েই রইলাম । মনের ভেতরে একটা আশ্চর্য আনন্দ অনুভব হতে লাগলাম । কেন হতে লাগলো আমার জানা নেই । স্টুটেন্টের বাসার ঢুকতে গিয়ে দেখি তাদের বাসার দরজা আগে থেকেই খোলা, পাশের ফ্ল্যাটটার দরজার খোলা । আমি অবশ্য খুব একটা চিন্তিত হলাম না । সম্ভবত কোন একটা সমস্যা হয়েছে । আমার অবশ্য এতো চিন্তা নেই । আমি দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম । আমার মাথায় তখনও মেয়েটির সেই হাসি মাখা মুখের চেহারা ভাসছে ।

আমি পুরো সময়টা মেয়েটার কথাই ভাবছিলাম । এমন কি যখন হলে ফিরে যাচ্ছি তখনও কেমন মেয়েটির কথাই আমার মনে পড়ছে । রিক্সার উপর বসে বসে থাকতে একটা সময় অনুভব করলাম যে রিক্সা আর সামনে এগোচ্ছে না অনেকটা সময় । একটু অবাক হতে হল কারন এই রাতের বেলা করে এই রাস্তায় এতো জ্যাম থাকার কথা না । তারপরই শুনতে পেলাম সামনে নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে । পুরো রাস্তা জ্যাম ।

আগত্যা রিক্সা থেকে নেমে এলাম । এই জ্যামের পথ টুকু হেটে আবার রিক্সায় উঠতে হবে । হাটতে হাটতেই জানতে পারলাম না একটা বাস নাকি একটা রিক্সার উপর তুলে দিয়েছে । অবশ্য ঢাকা শহরে এই সব খুব স্বাভাবিক ঘটনা । প্রায়ই এসব ঘটে । আমি কোন দিন আগ্রহ নিয়ে সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করি নি । মানুষের মৃত্যু আমার একদমই ভাল লাগে না ।

আমি ভীড় থেকে বের হয়ে এলাম । দাড়িয়ে আছি রিক্সার অপেক্ষায় । তখনই আমার নাকে সেই সুগন্ধটা এসে লাগলো । তারপর আমার কাধে মৃদু স্পর্শ পেলাম । তাকানোর আগেই আমি টের পেয়ে গেলাম আমার পাশে কে এসে দাড়িয়েছে । আমার সত্যিই খানিকটা অবাক লাগছিলো । আমার বিশ্বাস ছিল যে মেয়েটার সাথে আবারও আমার দেখা হবে তবে আজকে রাতেই যে আবার দেখা হয়ে যাবে সেটা আমি মোটেই ভাবতে পারি নি ।

মেয়েটা আমার সামনে এসে দাড়ালো । মেয়েটার মুখে আমি কেমন যেন প্রশ্রয়ের হাসি দেখতে পেলাম । সে বলল
-তো দেখা যাচ্ছে যে সত্যিই আমাদের মাঝে কিছু একটা আছে । আজকে দিনে তিনবার আমাদের দেখা হল ।
আমি বললাম
-আমি আপনাকে আগেই বলেছি ! বলি নি !
-তাই তো দেখছি ! তো আমার মনে হয় .....

মেয়েটা কথাটা শেষ করলো না । আমি বললাম
-কি মনে হয় ?
মেয়েটি হাসলো । তারপর বলল
-থাকুক মনের কথা মনেই । আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন ?
-এই তো যাবো কাটাবনের দিকে ।
-চলুন আপনার সাথে যাওয়া যাক ।

তারপর মেয়েটির সাথে রিক্সায় চড়ে বসলাম । সত্যিই বলতে কি আজকের দিনে এমন একটা ঘটনা ঘটবে আমি ভাবতেও পারি নি । সকালে প্রথমবারের মত দেখা মেয়েটি যে রাতের বেলা আমার সাথে রিক্সাতে উঠে বসবে সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিল । রিক্সাতে চলার পথে আমাদের মাঝে অনেক কথা হল । মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে আমার কথা শুনতে লাগলো । তবে নিজের কথা খুব একটা বলল না । কেবল বলল যে তার নাম লাইমা । একটা কোম্পানীতে চাকরি করে । সেই চাকরির জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ণ স্থানে তাকে যেতে হয় । অনেক মানুষের সাথে দেখা করতে হয় । আজকে অনেক গুলো এপোয়েন্টমেন্ট ছিল । এমন তিনটা এপোয়েন্টমেন্টের জায়গাতে আমার সাথে লাইমার দেখা হয়ে গেছে । এরকম নাকি তার সাথেও আগে হয় নি আগে । দিনে কখনও একজনের সাথে একবারের বেশি দেখা হয় নি ।

আমাকে হলের সামনে নামিয়ে দিয়ে ও রিক্সা নিয়ে চলে গেল । আর বলে গেল আমাদের যোগাযোগ হবে নিয়মিত ।


তারপর থেকেই লাইমার সাথে আমাদের নিয়মিতই যোগযোগ হতে লাগলো । আমরা পার্কের বেঞ্চ থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টের আবছায়া টেবিলের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে গল্প করতাম । কত কথা মেয়েটার যে জানতো । আমার মাঝে মাঝে মনে হত মেয়েটা হয়তো আগে কোন দিন কারো সাথে এতো কথা বলার সুযোগ পায় নি কিংবা বলতে পারে নি । বেশির ভাগ সময়ই ও বলতো ওর কত মানুষের সাথে দেখা করে । যদিও ও কখনই আমাকে বলে নি আসলে ওর কোম্পানীর কাজটা কি ? ও কেবল বলেছে ও বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা করে তারপর তাদের কাছ থেকে একটা জিনিস সংগ্রহ করে অফিসে পৌছে দেয় । এটাই হচ্ছে ওর কাজ । আমি আর গভীরে যাই নি ।

তবে মাঝে মাঝে বেশ কয়েকদিন ওর খোজ পাওয়া যেত না । পরে যখন ফিরে আসতো তখন বলতো কাজের চাপে ও আসতে পারে নি । একদিন একটা অদ্ভুদ কাজ করে ফেললাম । সেদিন আমার জন্মদিন ছিল । সন্ধ্যাবেলা লাইমার সাথে দেখা হয়েছে । ও আমাকে আগেই বলেছিলো যে ওর হাতে সময় খুবই অল্প । দেখা করলেও খুব বেশি সময় ও আমার সাথে থাকতে পারবে না । তবে আমার ইচ্ছে ছিল পুরোটা সন্ধ্যা ও আমার সাথেই কাটাবো । এমনই ইচ্ছে ।

কিন্তু ও যখন চলে যেতে চাইলো আমি মন খারাপ করে বসে রইলাম । তখনও কেক কাটা হয় নি । আমি ঠোঁট ফুলিয়ে রইলাম । ও খুব অস্থির হয়ে গেল যাওয়ার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যেতে পারলো না । পুরো সন্ধ্যা ও আমার সাথে কাটালো । যখন যাওয়ার সময় হল ও আমাকে বলল যে এই কাজটা আমি মোটেই ভাল করি নি । ও ভাগ্যে এরপর কি আছে সেটা ও নিজেই জানে না ।

পরদিন আবার যখন দেখা হল তখন দেখলাম ও মুখ খানিকটা সুপ্রসণ্ণ । আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলল
-এরকম কাজ যেন আমি আর না করি । ও ভুলটা ও করেছিলো সেটা আজকে সকালে ঠিক করে নিয়েছে । কিন্তু আমি যেন এই কাজ আর না করি । কারন ওর কাজে সময়নুবর্তিতা ব্যাপারটা খুবই জরুরী !

আমি অবশ্য কেবল হাসলাম । তারপর বললাম যে আমি ওকে আমার ফ্যামিলির সাথে পরিচিয় করিয়ে দিতে চাই । এবং সেটা করতে চাই খুব জলদিই । কথাটা শুনে ওর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল । আমি বললাম
-সামনের সপ্তাহেই আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে । সেখানে আমার মা বাবা সবাই আসবে । আমি সেখানেই তোমাকে পরিচয় করিবে দেব !

লাইমা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । কিছু যেন বলতে গিয়েও বলল না । তারপর কোন মতে বলল
-আচ্ছা, বিয়ে আগে হোক তারপরে না হয় !
-কেন সমস্যা কি ? তুমি যাবে না আমার সাথে ?
-আমি উপস্থিত থাকবো । এটা বলতেছি । ঠিক আছে । তবে আগে থেকে তোমার বাবা মাকে কিছু বলার দরকার নেই । কেমন !

আমি লাইমাকে কিছুটা চিন্তিত দেখলাম । কিছু একটা নিয়ে ও যেন একেবারে চিন্তিত । তবে কি ও আমার বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক নয় । আমাকে বিয়ে করতে চায় না ?


তারপরের দিন গুলো খুব দ্রুতই কাটতে লাগলো । আমি রাকিবের বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । যদিও রাকিবের সামনে ঠিক পড়ি না । ও কাছে পেলে আমাকে একেবারে চিবিয়ে খাবে । আমাকে ও দায়িত্ব দিয়েছিলো বিয়ে টা যেন না হয় আর আমি ওকে বিয়ের দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছি । ওর বিয়েটা হলে আমার বিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে বলতে পারি ।

বিয়ের দিন চলে এল । বর যাত্রী নিয়ে আমরা যাওয়ার জন্য তৈরি । বেশ কয়েকটা মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে । বেশ খানিকটা পথও যেতে হবে । সবার সমানে থাকবে আমাদের গাড়িটা । বরের গাড়িতে কেবল আমি আর রাকিব থাকবো । আমাদের পেছনে সব গুলো থাকবে ।

আমি তখনও লাইমার আসার অপেক্ষা করছি । এদিক ওদিক খোজ করছি । কয়েকবার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু ফোনই ঢুকলো না । এদিকে গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে । তবে একেবারে শেষ সময়ে লাইমা এসে হাজির হল । ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল ওর মনটা কোন কারনে খারাপ । আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম
-এতো দেরী !
লাইমা কোন কথা বলল না । আমাকে সবার থেকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল । তারপর হঠাৎ করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো । আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না । মনে মনে একটু ভয় হল । আমি ওকে বলল
-কি হয়েছে ? এমন কেন করছো ?
ও আমাকে না ছেড়ে দিয়েই বলল
-কিছু হয় নি । তুমি ভাল থাকবে সব সময় । কেমন ?
-কি বলছো এসব ?
আমার কথায় কান না দিয়ে লাইমা আবার বলল
-আচ্ছা তোমার কি আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে আছে ?
-হ্যা । ঐ তো হাসপাতালে ! ঐদিন আমার সাথে দেখা হওয়ার পরপর কি হয়েছিলো মনে আছে ?
আমি একটু মনে করার চেষ্টা করলাম । আমি ওয়ার্ড খুজে পাচ্ছিলাম না । লাইমাও তাই । তারপর আমরা দুজন মিলে খুজে পাই । ও চলে যায় সাত নম্বর ওয়ার্ডের ভেতরে । আমি চলে আসি আট নাম্বারে রাকিবের কাছে ।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । লাইমা বলল
-আমি যে কাজটা করি সেটা আমি ইচ্ছে করি না । প্রত্যেকের একটা সময় আছে । সেই সময়েই তার সাথে আমার দেখা করতে হয় !
আমি এবার খানিকটা ধৈর্য্য হারা ভাবে বললাম
-তুমি এসব কি বলছো ?
-সব বুঝতে পারবে । তারপর আমাকে আর আমি আগের মত থাকবো না ।
-আমি কিন্তু সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না ।
-আমার নামের অর্থটা খুজে নিও । তাহলেই বুঝতে পারবে । তারপর আমাদের প্রথম দেখা সেটার সাথে সম্পর্ক যুক্ত ! কেমন !
আমি কিছুটা সময় বোকার মত তাকিয়ে রইলাম । লাইমা বলল
-যাও । দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
-তুমি আসবা না ?
-তোমাদের সাথে না । তবে আসবো ।

আমার মাথায় কিছু ঢুকছিলো না । লাইমা এসব কি বলছে । রাকিবের সাথে গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিলো । একেবারে শেষের গাড়িতে আমার বড় মা,মা বাবা আর আম্মু বসেছে । আর সবার প্রথমেরটাতে যাচ্ছি আমি আর রাকিব ।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাকিব বলল
-বিয়ে হচ্ছে আমার তুই এমন চুপ করে বসে আছিস কেন ?
-লাইমা আজকে কেমন যেন অদ্ভুদ আচরন করলো ।
রাকিব বিরক্ত হয়ে বলল
-তোর এই প্রেমিকাকে আমার সব সময়ই অদ্ভদ মনে হয়েছে । যখনই তোর সাথে দেখা হয় কেউ না কেউ মারা যায় । মনে আছে ঐ হাসপাতালে ....

ব্যাপারটা তখনই আমার মাথায় ধাক্কা মারলো । সত্যিই তো । ঐদিন হাসপাতালে লাইমা সাত নম্বর ওয়ার্ডে পরপরই একজন রোগী মারা গেল । তারপর যখন স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম, ঐদিন দরজা খোলা দেখেছিলাম । পরে শুনেছি ঐদিন সন্ধ্যায় ওদের পাশের বাসার আঙ্কেল মারা গেছে । রাতে এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল দুই জন । আমার বুকের ভেতরে কাঁপতে থাকলো ।
আমি চট জলদি মোবাইল বের করলাম । তারপর গুললে লাইমা লিখে সার্চ দিতেই লাইমা নামের সাথে উইকি লিংক আসলো । লাইমা হচ্ছে ভাগ্যের দেবী । জন্ম মৃত্যু আর বিয়ের নির্ধারন করে সে !

আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই কাঁপতে লাগলো । সেই সময়েই পেছন থেকে একটা তীব্র সংঘর্ষের আওয়াজ পেলাম । আমাদের ড্রাইভার সাথে সাথেই গাড়ি দাড় করি ফেলল । আমাদের পেছনের একটা গাড়ি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে একটা গাছের সাথে ধাক্কা মেরেছে ।

আমাকে বলে দিতে হল না । তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম কোন গাড়িটা ধাক্কা মেয়েছে । আমি কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৯ রাত ৯:৪২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×