somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈদ স্পেশাল ছোট গল্পঃ অতৃ আর অর্থির ঈদ

৩১ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৯:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



তৃষা খানিকটা বিরক্ত চোখে অতৃর দিকে তাকালো । তারপর তাকালো নিজের বাবার দিকে । আমি এক পাশে চুপ করে বসে আছি । এসব ব্যাপারে আমার কথা বলার কোন দরকার নেই । এই ঝামেলার ভেতরে আমি পড়তে চাই না ।

তৃষা আমার শ্বশুর মশাইয়ের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ওকে কেন নিয়ে গিয়েছো হাটে ?
শ্বশুর মশাই কাচুমচু করে বলল, আরে যেতে চাইলো তাই নিয়ে গেলাম !
-এই যে এখন কাঁদছে ! এটার কি হবে শুনি ?
-ঠিক হয়ে যাবে!
-হবে না ! আমি ওকে খুব ভাল করে চিনি । সারা সময় ও কেবল মুখ ভার করে বসে থাকবে !
-কি করবো?
-জানি কি করবা কিচ্ছু জানি !

এরপর আমার দিকে তাকিয়ে তৃষা বলল, তুমি আবার এই ভাবে বসে আছো কেন শুনি ! সারা দিন কেবল মোবাইল আর মোবাইল ! অন্য কোন কাজ নেই?
আমি বললাম, আরে ঈদের ছুটিতে বাসায় এসেছি । এখানে কি কাজ করবো ?
-না তা করবা কেন ! তোমরা তো নবাব ! তোমরা ঈদের ছুটিতে বাসায় এসেছো আমি কি ছুটিতে আসি নি !
-তাহলে তুমিও মোবাইল টেপো আমার মত । মানা করেছে কে !

তৃষা কিছু সময় আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে গেল দরজা দিয়ে । আমি এবার একটু অতৃর দিকে এগিয়ে গেলাম । মেয়েটা একটু একটু যেন ফোঁফাচ্ছে । আমি অতৃকে কোলের উপরে তুলে নিয়ে বললাম, কি হয়েছে ? আমাকে বল ?
-আমরা ওদের গরুটা কেন নিয়ে এলাম বাবা ! মেয়েটা কি রকম কাঁদছিলো !
-কোন মেয়েটা ?

এই প্রশ্নের জবাব দিল শ্বশুর মশাই । তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হল অতৃকে নিয়ে শ্বশুর মশাই গিয়েছিলো স্থানীয় হাটে গরু কিনতে । যদিও এই বছরের কুরবানীর গরু আগেই কেন হয়েছে । তবে ঈদের পরে অতৃর আকিকা দেওয়া হবে । এই জন্য শশুর মশাইয়ের মনে হল গরু একটা কম কেন হয়েছে । আরেকটা কেনা দরকার । দাদু হাটে গরু কিনতে যাবে শুনে অতৃও বায়না ধরে গরুর হাটে যাবে । দাদুর হাত ধরে হাটে গিয়ে পৌছালো তারা ।
গরু পছন্দ করা হল । কেনাও হল । গরু নিয়ে যখন চলে আসবে তখন একটা ঘটনা ঘটলো । গরুটা যার তার সাথে তার নিজের নাতনিও এসেছিলো হাটে । গরুটা আর নাতনির বয়স অনেকটাই কাছাকাছি । মেয়েটা নাকি নিজ হাতে গরুটাকে লালন পালন করেছে । নিজে ঘাষ খাইয়েছে । এক সাথে খেলা করেছে । মেয়েটার খেলার সাথী সে । সেই গরুটাকে যখন নিয়ে আসছিলো মেয়েটা শেষ বারের মত গরুটাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে দিল । লোকজন জড় হল মেয়েটার কান্না দেখে । অতৃ এই কান্না দেখে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । বারবার কেবল বলছে মেয়েটার গরুটাকে আমরা কেন নিয়ে এলাম ! কেন তারা গরুটাকে বিক্রি করে দিল !
মেয়েটাকে কিভাবে বুঝাই যে আমরা কিনে না আনলেও অন্য কেউ ঠিকই কিনে আনতো !

অতৃ এক রকম কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়লো আমার কোলে । মেয়েটার জন্য আমার কেমন মন খারাপ হল ! টাকা পয়সার জন্য এই রকম কত কিছু আমাদের ছেড়ে দিয়ে হয় । আজকে মনে হয় সেই মেয়েটির ঘুম আসবে না আর । কালকের ঈদে কি মেয়েটা ঠিক মত আনন্দ করতে পারবে । এক সময় হয়তো মেয়েটা সব ভুলে যাবে কিন্তু মেয়েটির ছোট্ট মনে বারবার আমাদেরকে নিষ্ঠুর এক চরিত্র হিসাবেই মনে করবে যারা তার পছন্দের খেলার সাথীকে নিয়ে গেছে ।

রাত তখন আট টা বাজে । অতৃর পাশে আমিও শুয়ে রয়েছে । আমার নিজের মনটা খানিকটা বিষন্ন লাগছে । বারবার মনে হচ্ছে গরুটা ফিরিয়ে দিয়ে আসি । কিন্তু আজকে আমরা গরু ফিরিয়ে দিলে অন্য কেউ ঠিকই কিনে নিয়ে যাবে । লাভটা হবে কি !

এমন সময় তৃষা ঘরের ভেতরে ঢুকলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ও কি ঘুমিয়েছে ?
-হুম !
আরও একটু কাছে এসে মেয়ের গালে চুমু খেল একটা । চোখের পানি শুকিয়ে গেছে অতৃর গালে । সেটা মুছিয়ে দিল । তারপর বলল, ওকে জাগাও !
-কেন ? ঘুমাচ্ছে ঘুমাক !
-না জাগাও । ওকে জাগাও । এক জায়গাতে যাবো !
-আজ থেকেই শুরু !
-অপু ! এতো কথা কেন বল শুনি !

আমি অতৃকে জেগে তুললাম । তারপর তৃষাই ওর হাত মুখ ধুইয়ে দিল ।

যখন বাসা থেকে বের হলাম আমি তৃষাকে বললাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি বলবা ?
-গেলেই দেখতে পাবা !

পনের মিনিটের মাথায় একটা গেরস্থ বাড়িতে এসে হাজির হলাম । দুই পাশে ছোট দুটো টিনের বাড়ি । শেষের দিকে বেশ বড় একটা টিনের ঘর । মেঝে মাটির । মাঝে বড় উঠান ! বাড়ির ঠিক মাঝে বেশ কিছু মানুষ বসে গল্প করছে । আমরা ঢুকতেই আমাদের দিকে তাকালো সবাই । বুঝতে পারলাম আমাদের এই ভাবে এখানে আশা করে নি এখানে ! এক বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এল আমাদের দিকে । তৃষাকে চিনতে পারলো সম্ভবত । একটু হাসি মুখেই বলল, তুমি চেয়ারম্যান সাহেবের নাতনি ?
-জি ! অর্থিকে ডাক দিবেন একটু ?

দেখলাম একটা মেয়ে উঠানের মানুষ গুলোর ভেতর থেকেই উঠে এল । কলা পাতা রংয়ের একটা জামা পরে আছে । মুখ শুকনো ! অতৃর থেকে মেয়েটা কয়েক বছর বড়ই হবে ! মেয়েটাকে দেখে অতৃ বলে উঠলো, বাবা এর গরুই আমরা নিয়ে গিয়েছি !

সাথে সাথেই আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম । তৃষা কেন আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে সেটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না । আমি খানিকটা অবাক চোখে তৃষার দিকে তাকালাম । তৃষা এমন একটা ভাব করলো যেন এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা । অবশ্য তৃষার জন্য খুবই স্বাভাবিক !

তৃষা অর্থিকে বলল, তোমার মন খারাপ মামনি ?
মেয়েটা কেবল মাথা ঝাকালো ।
তৃষা হাসলো । তারপর বলল, তোমার মন আমি এক বারে ভালা করে দিতে পারি ! দিবো ?
মেয়েটা কেবল কৌতুহল নিয়ে তৃষার দিকে তাকালো । ঠিক এমন সময়ই তৃষাদের বাড়ির কাজের ছেলেটা গরুটা নিয়ে উঠে প্রবেশ করলো । অর্থি গরুটাকে দেখে এক দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো । গরুটাও যেন পরিচিত মানুষের ছোঁয়া পেয়ে হাম্বা করে ডেকে উঠলো ।


অতৃকে দেখলাম আস্তে আস্তে গরু আর মেয়েটার কাছে গিয়ে হাজির হল । তারপর বলল, এটা তোমার গরু ! ঠিক আছে !
তৃষাও মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল, তোমার গরু তোমার থাকবে ।

এতো সময় বৃদ্ধলোকটা কথা বলে উঠলো, আপনারা কি গরু ফেরাই দিতেছেন ?
তার মুখে সংঙ্কাটা আমি বেশ ভালই টের পেলাম । তৃষা বলল, গরু ফেরৎ দিচ্ছি না । আমার মেয়ে এই গরুটা অর্থিকে উপহার দিল ।
তীব্র বিস্ময় নিয়ে বৃদ্ধ লোকটা আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো । দেখলাম বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে । তৃষা বলল, গরুটা আমার মেয়ের আকিকার জন্য কিনেছিলাম কিন্তু মেয়ের কান্না দেখে আর সেটা মন চাইলো না । আসলে পোষা পশু পাখির প্রতি মানুষের ভালবাসাটা সব থেকে নিঘাত । এই ভালবাসার মূল্য দেওয়া সম্ভব না !

অর্থিকে দেখলাম তখনও গরুকে জড়িয়ে ধরেই আছে । আদর করে যাচ্ছে । তৃৃষা এবার বৃদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল, এই গরুকে দয়া করে বিক্রির চেষ্টা করবেন না । কথাটা যেন মনে থাকে ।
তারপর অর্থিকে ডেকে বলল, এটা আজ থেকে তোমার গরু ! তোমার । এটা কেউ জোর করে বিক্রি করতে গেলে সোজা আমাকে খবর দেবে ! মনে থাকবে !

মেয়েটা কেবল মাথা কাত করে সম্মতি জানালো !

আমরা চলে আসার জন্য পা বাড়াতে যাবো তখনই বৃদ্ধ লোকটা বলল, তোমরা একটু ভেতরে আইসা বস !
-না না । এখন এসবের সময় নেই । কাল সময় পেলে আসবো !
-সত্যিই আইবা তো!
-অর্থিও দাওয়াত রইলো আমাদের বাসায় । ও যেন আসে !


ফিরে আসার সময় দেখলাম অতৃ মায়ের কাছে বসেছে । মাকে জড়িয়ে ধরে আছে । সে আজকে মায়ের উপর খুব খুশি ! এবারের ঈদ কেবল একটা নয় আরও একটা পরিবারের সকল সদস্য নিয়ে আনন্দের সাথে পালিত হবে । সবার মুখে থাকবে হাসি !



-০-


গল্প লেখার এই একটা মজা। নিজের ইচ্ছে মত এন্ডিং দেওয়া যায় । প্রথম আলোর এই খবরটা পড়ে, অর্থি নামের এই ছোট্ট মেয়েটির কান্নার ছবি দেখে, কেন জানি আমার নিজের চোখ দিয়েই পানি বের হয়ে এল । অর্থির জন্য আমার নিজের কষ্ট হতে লাগলো খুব । এই কষ্ট কোন ভাবে ভাষার প্রকাশ করা সম্ভব না । জীবন গল্প গুলোর মত হয় না । জীবনে অর্থের কাছে বারবার মানুষকে পরাজিত হতে হয় ! বার বার ।


সবাইকে ঈদ মোবারক!
আপনার ঈদ ভাল আনন্দে কাটুক !




সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৯:২৯
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×