প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আমি হয় বই পড়ি নয়তো কিছু দেখি ল্যাপটপে। গত পরশু রাতে নেটফ্লিক্সে কি দেখবো ভাবছি, তখন একটা ডকুউমেন্টারি চোখ পড়লো । House of Secrets :The Burari Deaths । ডকুউমেন্টারি আমার সব সময়ই পছন্দের একটা বিষয় । তিন পর্বের একটা সিরিজ । ভেবেছিলাম ঐদিন এক পর্ব দেখে বাকিটা পরের দিন দেখবো । কিন্তু ব্যাপারটা এতোই ইন্টারেস্টিং যে এক বসায় দেখে শেষ না করে উঠতে পারলাম না ।
কাহিনী শুরু হয় ভারতের দিল্লীর বুরারী এলাকার এক সকালে । সময়টা ২০১৮ সালের জুলাই মাস । ভাটিয়া পরিবারের আসে পাশে থাকা তাদের প্রতিবেশীরা খেয়াল করলো যে ভাটিয়াদের বাসার সামনে যে ব্যবসার দোকার রয়েছে সেটা যখন খুলে যাওয়ার কথা তখনও সেটা খুলে নি । এমনটা স্বাধারনত হয় না কখনও । কৌতুহল নিয়ে একজন প্রতিবেশী দরজার কড়া নাড়তে যায় । গিয়ে দেখে দরজাটা আগে থেকেই খোলা । ভেতরে ঢুকে যখন সে নাম ধরে ডাকতে থাকে তখন কুকুর ডাকার আওয়াজ কানে আসে । সে আস্তে আস্তে সিড়ি দিয়ে উঠতে থাকে উপরে তখনই সে এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পায় । সে দেখতে পায় ভাটিয়া পরিবারের ১০ জন সদস্য এক সাথে সিলিং থেকে ঝুলে রয়েছে । পরিবারের সব থেকে প্রবীন সদস্য নিজের ঘরে মেঝেতে মরে পড়ে আছে । পরিবারের ১২ নম্বর সদস্য কুকুরটি দোতলায় চেন দিয়ে আটকানো এবং সে ডেকে চলেছে ।
এই বাড়িতে মোট তিন প্রজন্মের বাস ছিল । বাড়ির প্রধান নারায়নী দেবী বয়স ৮০ । তার দুই ছেলে এবং তাদের স্ত্রী । এক মেয়ে । এবং বাকি ৫ জন হচ্ছে তাদের সন্তান । মোটে এগারোজন মানুষ একই দিনে মারা গেছে ।
কেবল একবার দৃশ্যটা ভাবার চেষ্টা করুন । একই পরিবারের সকল মানুষ একই সাথে মরে পরে আছে । ব্যাপারটা কোন ভাবেই স্বাভাবিক কিছু না । পুলিশকে খবর দেওয়া হল । ঘটনা দুইটা হতে পারে । সবাইকে কেউ হত্যা করেছে অথবা সবাই এক সাথে আত্মহত্যা করেছে । ঘটনা যাই হোক কোনটাই স্বাভাবিক কোন ব্যাপার না ।
পুলিশ তদন্ত শুরু করে । প্রথমে খুন মনে হলেও, খুনের কোন আলামত তারা খুজে পায় না । বাসায় জোর করে প্রবেশের কোন প্রমান পাওয়া যায় না । যদি কেউ তাদের খুন করে থাকে তাহলে এতোটা নিশ্চুপ ভাবে তাদের কোন ভাবেই খুন করে ফেলা সম্ভব না । এক সময় পুলিশের কাছে সিসিটিভি ফুজেট আসে । সেটা পরীক্ষা করে তারা নিশ্চিত হয় যে কোন ভাবেই এটা খুন না। তাহলে একটা অপশনই থাকে সেটা হচ্ছে আত্মহত্যা । এখন পরিবারের সবাই এক সাথে আত্মহত্যা করবে?
প্রশ্নটা হচ্ছে কেন?
প্রতিবেশীদের ভাষ্যমত তাদের জীবনে এমন কোন বড় ঘটনা ঘটে নি যার কারণে পরিবারের সবাইকে এক সাথে এইভাবে এক সাথে দিতে হবে । কদিন আগেই পরিবারের এক সদস্যের বিয়ের এঙ্গেইজমেন্ট হয়েছে । হাসিখুশি একটা পরিবার । তারা কেন এক সাথে সবাই মারা যাবে আত্মহত্যা করে। পুলিশের মাথায় কিছু ঢুকে না । এদিকে মিডিয়া যেন পাগল হয়ে উঠেছে । নানান মানুষের মনে নানান থিউরী ভেসে আসছে । কেউ কেউ মনে করছে এর ভেতরে কোন জাদু মন্ত্রের ব্যাপার আছে । একজন তান্ত্রিক মহিলার নামও সামনে চলে আসে ।
তারপরেই পুলিশের কাছে একটা রেজিস্টার খাতা আসে । খাতাটা পরিবারের ছোট ছেলে লালিট । মূলত এই এন্টি খাতা থেকেই এই পারিবারিক আত্মহত্যার রহস্য খানিকটা পরিস্কার হয় ।ছোট ছেলে লালিটই মূলত পরিবারের প্রধান ছিল তার বাবার মারা যাওয়ার পরে । সেই পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহন করতো । এটা প্রতিবেশীরাও নিশ্চিত করে বলেছে । পরিবারের অন্য সব মানুষরাও লালিটকে পরিবারের প্রধান বলে মেনেও নিয়েছিলো । খাতা পরীক্ষা করে জানা যায় যে খাতায় লেখা কথা বার্তা গুলো মূলত লালিট এবং তার মৃত বাবার কথোপকথন । লালিট তার পরিবারের সদস্যদের বলে যে তাদের বাবা স্বপ্নে তার কাছে আসে এবং তাকে নানান রকম কথা বলে সেই মোতাবেকই কাজ করতে বলে । পরিবারের সবাই সেটা মেনেও নেয় । এবং সেই মোতাবেক কাজ করে । কয়েক বছর ধরেই লালিট একই ভাবে তার বাবার কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে থাকে । এবং পরিবারের সব কাজ কর্ম সেই মোতাবেগই চলতে থাকে । কে কোন কাজ করবে কার দায়িত্ব কি হবে সব কিছুই খাতায় লেখা ছিল
লালিট পরিস্কার ভাবে মানসিক সমস্যাতে ভুগছিল । বেশ কয়েক বছর আগে লালিটের জীবনে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছিলো । সে যেখানে কাজ করতো তার মালিকের সাথে ঝামেলা হয়েছিলো । তখন মালিক এবং তার লোকজন তাকে মেরে একটা ঘরে বন্দী করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো । সেই ঘটনার পরে লালিট বেশ ট্রমাটাইজ হয়ে যায় । প্রায় আড়াই বছর তার মুখ দিয়ে কোন কথা বলতে পারে নি । তারপর থেকে অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে যায় ।
পুলিশ শেষে বের করে যে এই ঘটনা যে ঘটেছিলো এটা আসলে কোন আত্মহত্যা ছিল না । খানিকটা দুর্ঘটনা ছিল । তারা যে কাজটা করেছে তারা নিজেদেরকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে কাজটা করে নি । খাতার শেষ এন্ট্রি গুলো দেখলে বোঝা যায় যে এমন একটা ঘটনার প্রস্তুতি তারা নিচ্ছিলো অনেক দিন থেকেই । তারা তাদের মৃত বাবার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য । ঘটনাটা এমন ঘটনার কথ ছিল যে সবাই যখন এমন করে ঝুলে পড়বে তখন তাদের বাবা এসে তাদের সাথে মিলিত হবে এবং সবাইকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে । এই বিশ্বাস থেকেই তারা এই কাজ করতে রাজি হয়েছিলো ।
পরিবারের ছোটদের সবার হাত এবং পা বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো । মুখে টেপ এবং চোখও বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো । পুলিশের মতে এই কাজটা সম্ভবত লালিটই করেছিলো । কারণ সবার মাধ্যে কেবল ললিট এবং তার স্ত্রীর হাত পা খুব বেশি ভাল করে বাধা ছিল না ।
এটা আসলে আত্মহত্যা না । কারণ তাদের মনে বিশ্বাস ছিল যে তারা মরবে না । এবং তাদের বাবা তাদের কাছে ফিরে আসবে ।
এটা বাড়িতেই তারা থাকতো ।
পরিবারের সদস্য
যাদের কাছে সময় আছে তারা আরও বিস্তারিত জানার জন্য নেটফ্লিক্সের লিমিটেরড সিরিজটা দেখতে পারেন ।
এখানে ট্রেইলরটা দেখতে পারেন।
নেটফ্লিক্স সিরিজ দেখতে না চাইলে ইউটিউবে অনেক গুলো রিভিউ ভিডিও বের হয়েছে ইতিমধ্যে । সেগুলোর একটা দেখতে পারেন । তাহলে কাহিনী পরিস্কার বুঝতে পারবেন আশা করি ।
ঠিক এমন একটা ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটেছিলো ২০০৭ সালের দিকে, ময়মনসিংহে । সেখানে পরিবারের মোট নয়জন সদস্য একই সাথে ট্রেনে কাটা পরে মারা গিয়েছিলো । ঘটনা খোজ করতে গিয়ে বেরিয়ে আরও আরও ইন্টারেস্টিং কিছু । এই পরিবারের লোকজন আদম ধর্ম নামের এক নতুন ধর্মের অনুসারী ছিল । এই ধর্মের প্রচারক ছিল ঐ পরিবারের প্রধান আবদুল আদম যে কিনা মারা গিয়েছিলো কয়েক বছর আগে । এবং এই আত্মহত্যার ব্যাপারটা মূলত ছিল তার সাথেই পরিবারের অন্য সদস্যদের মিলিত হওয়ার একটা ঘটনা ।
এই নিয়ে ব্লগার ইমন জুবারের একটা পোস্ট আছে । পোস্ট টি এখান থেকে পড়ে আসতে পারেন ।
অনলাইন একটা চমৎকার আর্টিকেলও আছে । এইখান থেকে পড়ে আসতে পারেন ।
এই দুইটা ঘটনাতে একটা ব্যাপার পরিস্কার সেটা হচ্ছে দুই পরিবারের সদস্যরা একটা মানসিক ভারসাম্যহীনতার ভেতরে দিয়ে যাচ্ছিলো । বাইরের দিক থেকে সবাই স্বাভাবিক মনে হলেও এদের মানসিক অবস্থা কিছুটা বিঘ্নিত ছিল । এই জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আমাদের আরও বেশি মনযোগী হতে হবে । এর সাথে এটাও পরিস্কার যে কোন কিছুর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস কোন ভাবেই ভাল কিছু বয়ে আনে না । কোন ভাবেই না । কারো প্রতিই অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন তৈরি করা ঠিক না ।
তথ্য সুত্রঃ
নেটফ্লিক্স সিরিজ
The Tragic True Story Behind Netflix's 'House Of Secrets' Documentary
House of Secrets The Burari Deaths
ছবি সুত্র 01 02
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২১ বিকাল ৩:৪৭