অনলাইন সমাজে নিজেকে স্মার্ট প্রমানের অনেক উপায় আছে । তাদের ভেতরে একটা উপায় হচ্ছে হুমায়ূন সাহিত্যকে গাল মন্দ করা । নিজেকে এলিট শ্রেণীর প্রমাণ করতে, নিজেকে জ্ঞানী পাঠক গবেষক প্রমাণ করতে এই কাজটা করাটা বেশ কাজের । এমন পাবলিকও আছে হুমায়ূন আহমেদের একটা কিংবা দুইটা বই পড়েই বিজ্ঞের মত মতামত দিয়ে দেয় । সেও অবশ্য ভাল কেউ কেউ তো এমনই আছেন জীবনে কোন বই না পড়েই সাহিত্য বিশারদ হয়ে বসে আছেন ।
আমি অবশ্য সাধারণ পাঠক । নিজেকে এতো জ্ঞানী গুণী প্রমানের ইচ্ছে আমার কোন কালেই ছিল না । আজও নেই । আর বই পড়ার ক্ষেত্রে সেটা তো একদমই নেই । যা পড়তে আমার ভাল লাগে যা পড়ে আনন্দ পাই সেই জিনিসের ভক্ত আমি । সেই হিসাবে যার বই পড়ে আমি জীবনে সব থেকে বেশি আনন্দ পেয়েছি, যার বই আমাকে আনন্দের খোরাক জুগিয়েছি, নিঃসঙ্গ আর একাকী সময় গুলোর সাথী হয়েছে তার ভক্ত না হয়ে কি পারা যায় ?
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বইটা আমি পড়েছিলাম সম্ভবত ক্লাস ফোর/ফাইভে থাকার সময় । বইটার নাম ছিল বোতল ভুত । তখন আমরা থাকতাম যশোরে । কোন একটা উপলক্ষে নানী বাড়ি এসেছি । তখন সেখানে আমার অনেক গুলো কাজিন থাকতো । এমনই একজন কাজিনের নাম লুপা আপা । তার কাছে বইটা ছিল । তবে এতোটুকু মনে আছে যে বইটার প্রথম কয়েকটা পাতা ছিল না । বই পড়া শুরু করলাম । শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগলো না । তখন আসলে কেমন যে লেগেছিল বইটা পড়া পরে সেটা এখন আমার ঠিক মনে নেই । তারপর অনেক দিন হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের কোন সন্ধান আমি পাই নি । আসলে তখন ক্লাসের বই বাদ দিয়ে অন্য কোন বইয়ের খুব কাছে যেতে পারি নি ।
ক্লাস সেভেন ওঠার পরে জেলা পাবলিক লাইব্রেরীর সন্ধান পেলাম, মানে সেখানকার সদস্য হয়ে গেলাম । তারপর থেকে আমার পড়ুয়া জীবন শুরু হল । তখন ছোট ছিলাম বিধায় কিশোর ক্লাসিক আর তিন গোয়েন্দা আর ভুতের বই পড়া হত বেশি । একদিন ভুতের বই নিতে গিয়ে লাইব্রেরিয়ান আমার হাতে কুটু মিয়া নামে একটা বই ধরিয়ে দিল । সেটাই বলা চলে আমার পড়া হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পূর্নাঙ্গ বই ছিল । তারপর থেকে আর অন্য বইয়ের দিকে আমি খেয়াাল দিই নি । পরের একটা দুটো বছর কেবল তার বই পড়েছি । বই পড়তে পড়তে প্রায়ই আমি হেসে উঠতাম । আমার হাসি শুনে আমার বাবা মায়ের ধারণা জন্মালো যে বই পড়তে পড়তে আমার মাথা হয়তো খারাপ হয়ে যাচ্ছে । হাসতাম যেমন তেমন প্রায়ই চোখ ভিজে উঠতো ! এই কান্না অবশ্য কেউ কোন দিন দেখেনি । তখন সেই কিশোর বয়সে এই বই গুলো যে কিভাবে আমাকে তীব্র ভাবে আন্দোলিত করেছিলো সেটা কোন ভাবেই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না ।
সেই সময়ে তার বই পড়ার কারণে আমার চিন্তা ভাবনাতে অনেক বড় পরিবর্তন আসে । যদি তার বই না পড়া হত তাহলে হয়তো আজকে আমি যেমন মানুষ তেমন না হয়ে অন্য রকম কোন মানুষ হতাম । হয়তো একজন লেখকের সব থেকে বড় সার্থকতা এখানেই । নিজের লেখা দিয়ে মানুষকে নতুন ভাবে ভাবতে শেখানো চিন্তা করতে শেখানো ।
প্রথম হিমু পড়ার পরে আমার মনে এক অদ্ভুত চিন্তা এসে ভর করলো । আমার এক স্যারও তাঁর লেখার ভক্ত ছিলেন । তিনি মাঝে মাঝে হুমায়ূন আহমেদের গল্প বলতেন । স্যার বলতেন যখন প্রথম বের হয় তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । তিনি দেখেছেন তাদের ক্যাম্পাসের অনেক ছেলেরাই নাকি তখন হলুদ পাঞ্জাবী খালি পায়ে রাত বিরাতে ঘুরে বেড়াতো । সব চেয়ে অবাক হয়েছিলাম যে গল্পটা শুনে সেটা হচ্ছে মানুষ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে রাস্তায় নেমেছিলো । একটা ফিকশনাল চরিত্র, যার ফাঁসি হচ্ছে অন্যায় ভাবে সেটা ঠেকাতে মানুষ আন্দোলন করছে ! এর থেকে অন্তত এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে তার লেখা কী পরিমান মানুষকে প্রভাবিত করেছিল ।
হুমায়ূন আহমেদের সব কিছু আমার পড়া । একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত । কেবল একটা বই আমি পড়ে শেষ করি নি । বইটার নাম হচ্ছে ''কোথাও কেউ নেই'' । এমন না যে বইটা আমার কাছে নেই । আমার সংগ্রহেই আছে । চাইলেই বইটা শেষ করতে পারি এখনই কিন্তু কেন জানি শেষ করি নি । বই পড়তে আমার ক্লান্তি নেই এবং তার বইয়ে তো আরও নেই । কিন্তু বইটা শেষ করা হয় নি । এখন আরও শেষ করতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় এই বইটা পড়ে ফেললেই সব কিছু পড়া শেষ হয়ে যাবে অথচ তিনি আর নতুন করে কিছু লিখবেন না । এখন একটা অনুভূতি আছে যে কিছু একটা এখনও পড়া বাকি আছে । সামনে পড়বো কোন একদিন ।
হুমায়ূন আহমেদ কেমন লেখক সেটা নিয়ে আসলে আমি কোন কথা বলতে চাই না । একজন পাঠকের কাছে একজন কেমন লাগবে সেটা একান্তই পাঠকের নিজের ব্যাপার । তবে হুমায়ূন আহমেদের কারণেই বাংলার মানুষের মাঝে বিশেষ করে মধ্য বিত্ত সামজে প্রচুর পাঠক তৈরি হয়েছে । ফেসবুকের একজন বন্ধুর একটা কথা এখানে উল্লেখ করি। হুমায়ূন আহমেদের কারণে ওপার বাংলার সুনীল সমরেশরা বাংলার পাঠক সমাজকে কেড়ে নিতে পারে নি । উনি আমাদের তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন । আবার দয়া করে ভুল বুঝবেন না যে সুনীল সমরেশ দের আমি খারাপ কিছু বলছি । তারা ভাল লেখক । যদি হুমায়ূন আহমেদ যদি না থাকতেন তাহলে কলকাতার লেখকরা আমাদের পাঠক সমাজে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠতো । পাঠক তখন সেই সব গিলতো । কেবল মাত্র হুমায়ূন আহমেদের কারণে সেটা হয় নি । কথাটা আমার কাছে খুব যেন সত্যি মনে হল ।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে কিছু বলা আমার পক্ষে মুসকিল । অনেকেই আমার কাছে জানতে চায় যে হুমায়ূন আহমেদের কোন বইটা আপনার সব থেকে বেশি প্রিয় । এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমি আজও দিতে পারি নি । কারণ কোনটা রেখে আমি কোনটা বলবো ! এতো গুলো বইয়ের মাঝে একটা নাম বলা কোন ভাবেই সম্ভব না । তবে একটা ছোট গল্প আমার সব থেকে বেশি পছন্দ । গল্পের নাম ''রূপ'' রূপা নামে তার একটা বইও আছে । তবে এটা ছোট গল্প । গল্পের লিংক যুক্ত করে দিলাম । চাইলে পড়ে আসতে পারেন । গল্পটা যতবার পড়ি ততবার মনটা কেমন যেন করে ওঠে ।
আর কি লিখবো বুঝতেছি না । প্রতিবার লেখার আগে কত কিছু ভাবি অথচ সেই কথা গুলো আর বলা হয়ে ওঠে না ।
শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ । আপনি হয়তো কোন দিন জানবেনও না যে আপনার লেখা আমার জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলেছে ।
Picture source
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪৪