নওসাবা শক্ত করে কিছু সময় মীমকে জড়িয়ে ধরে রাখলো । কতদিন পরে যে দুই বান্ধবীর দেখা হয়েছে সেটা বলা মুশকিল । ইন্টারের পরে নওসাবা চলে গিয়েছে ইংল্যান্ডে ওর বড় মামার কাছে । সেখান থেকে পড়াশুনা তারপর চাকরি । বাবা মা পরের বছরেরই সেখানে চলে যাওয়ার পরে এই দেশে আর আসাই হয় নি নওসাবার । এখন এতো বছর পরে আবারও স্বপরিবারে দেশে এসেছে । মুল কারণ অবশ্য নওসাবার বিয়ে দেওয়া । নওসাবার অবশ্য তাতে খুব একটা আপত্তি ছিল না । দেশে এসে পুরানো বন্ধুদের সাথে দেখা করা শুরু করেছে । মীম ছিল নওসাবার সব থেকে কাছের বন্ধু । অবশ্য বিদেশ যাওয়ার আগে মীম আর নওসাবার ভেতরে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো । নওসাবা এমন একটা কাজ করেছিলো যাতে মীম রেগে গিয়েছিলো । নিজ থেকে দুরে চলে গিয়েছিলো । তবে এতো বছর পরে বন্ধুর ফিরে আসার পরে মীম আর রাগ করে থাকে নি । বিশেষ করে নওসাবা যখন নিজেই মীমদের বাসায় এসে হাজির হয়েছে তখন তো আর রাগ করে থাকার কোন কারণ থাকতে পারে না !
দিনভর দুই বন্ধু গল্প করলো । বিকেল বেলা হঠাৎ করে নওসাবা জিজ্ঞেস করলো, হাসানের কী খবর ? জানিস কিছু ?
মীমের মুখটা একটু মলিন হয়ে গেল । তবে সে কাটিয়ে উঠলো সাথে সাথে । এই ব্যাপারটা নিয়ে আর নওসাবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না । মূলত এই হাসানের কারণেই মীম নওসাবার উপরে রাগ করেছিলো । মীম হাসানকে পছন্দ যে করতো ব্যাপারটা কিন্তু সেই রকম না ।
নওসাবা আর মীম অনেক আগে থেকে ঢাকার লালমাটিয়াতে বাসবাস করে । ওদের এলাকাতে হাসানও থাকতো । মীম জানতো যে হাসান নওসাবাকে পছন্দ করে কিন্তু ছেলেটা অতিরিক্ত ভদ্র হওয়ার কারণে কখনই নওসাবার সামনে আসতো না কিংবা কোন প্রকার কিছু বলার চেষ্টাও করতো না । আর নওসাবার এই দিকে স্বভাব ছিল ছেলেদের সাথে টাইমপাস করা । ছেলেদের সাথে কিছু সময় কাটালো তারপর তাকে ছেড়ে দিলো । এইভাবে কত ছেলের সাথেই যে নওসাবার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেটা নওসাবা নিজেও জানে না । ঠিক এমন ভাবে নওসাবার কি মনে হল যে হাসানের সাথেও কিছু সময় টাইমপাস করা যাক ।
টাইমপাস করেও ছিল । তারপর যখন হাসানের সাথে ব্রেক করলো তখন মীম খানিকটা রেগে গিয়েছিলো । মীম ওকে শুরুতেই বলেছিলো যে হাসানের সাথে এই কাজটা না করতে । কিন্তু নওসাবা শোনে নি । সে ঠিক ঠিক হাসানের সাথে টাইম পাস করতে চলে গেল । ব্রেক আপের পরে হাসান অনেকটাই ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলো । বিশেষ করে মীম যখন হাসানকে একদিন গাছের আড়ালে দাড়িয়ে কাঁদতে দেখেছিলো সেদিন মীমের মনে একটা তীব্র অনুশোচনা বোধ জেগেছিলো । নওসাবাকে অনেক অনুরোধ করলো যাতে আবার ফিরে যার হাসানের কাছে । শেষে রাজি না করাতে পেরে হাসানকে সরি বলতে বলে । নওসাবা তাতেও রাজি হয় না । সেদিন মীম অনেক রাগারাগি করেছিলো নওসাবার সাথে ।
মীম নওসাবার দিকে তাকিয়ে বলল, মাস ছয়েক আগে দেখা হয়েছিলো ।
-এখনও কি এখানেই থাকে ?
-না ! ও কুয়েটে চান্স পাওয়ার পরে ওর বাবা মাও খুলনা চলে গিয়েছিলো । ওর বাবার সরকারি চাকরি তো জানিসই । খুলনা বদলি নিয়ে ছিল ।
-ও !
মীম একটু চুপ করে থেকে বলল, এখন ঢাকাতে আছে । আমার অফিসের নিচে একটা রেন্টুরেন্ট আছে । ওখানে ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলো । সেদিন দেখা হয়েছিলো ।
-ম্যাজিস্ট্রেস হয়েছে নাকি?
-হ্যা । ভাল ছাত্র ছিল জানিসই তো !
নওসাবা একটু থামলো । কী যেন ভালবো । তারপর বলল, তুই এখনও রাগ করে আছিস আমার উপরে ওর জন্য !
-নাহ ! এখন আর রাগ থাকবে কেন ! ঐ হাসান কাঁদতে দেখে এমন কষ্ট লেগেছিলো ! একটা মানুষ তোকে হারিয়ে কাঁদছে, কী তীব্র একটা অনুভূতি যদি তুই বুঝতিস !
-আমি জানি আমি ঐ কাজ গুলো একদম ঠিক করি নি । একদম না । আই শ্যুড হ্যাভ সেইড সরি !
মীম এবার নওসাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আরেকটা ব্যাপার কী জানিস ?
-কী ?
-হাসান এখনও মুভ অন করতে পারে নি !
-মানে?
-মানে ও এখনও তোকে মন থেকে বের করতে পারে নি ।
-কী বলছিস ?
-হ্যা ! যখন দেখা হল কথা হল, এক সময়ে জানতে চাইলাম বিয়ে করেছে কিনা ! কি বলে জানিস?
-কী?
-বলে কিনা তোমার বান্ধবীকে কোন দিন মন থেকে সে বের করতেই পারে নি । কোন দিন পারবেও না ! ভাবতে পারিস ব্যাপার টা !
নওসাবা কি বলবে খুজেই পেল না । এতোদিন পরে মনের ভেতরে সত্যিই একটা তীব্র অপরাধ বোধ জেগে উঠলো ! নওসাবা বলল, ওর সাথে দেখা করা যাবে?
-দেখা করে কী করবি?
-সরি বলবো?
-তাতে কী লাভ? কিছু যাবে আসবে?
-না আসুক । তবুও ...
-বিয়ে করবি ওকে?
-বিয়ে ?
-হ্যা । বিয়ের জন্যই তো এসেছিস? ওকেই কর !
-ও রাজি হবে?
-হবে না মানে ? দৌড়ে চলে আসবে । একবার বলেই দেখ না ! তাহলে আমি ওকে বলি । একটা কার্ড আছে আমার কাছে । ও দিয়েছিলো ।
পরের সাতদিনের ভেতরে সব কিছু কেমন দ্রুত হয়ে গেল । নওসাবা দেখা করলো । হাসান যে এখনও ওকে মন থেকে বের করতে পারে নি সেটা ওর কাছে সত্যি মনে হল । নিজের কৃত কর্মের জন্য অনুশোচনা হল খুব বেশি । হাসান ঠিক আগের মতই লাজুক রয়ে গেছে । তবে দেখতে আগের থেকেও আরও সুন্দর সুদর্শন হয়েছে । নওসাবার সত্যি সত্যি পছন্দ হল হাসান কে । এমন কি নওসাবার বাবা মারও পছন্দ হল খুব । বিয়ে কথা বার্তা ঠিক হতে সময় লাগলো না খুব একটা । দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে এল !
নওসাবা বৌ সাজে অপেক্ষা করতে লাগলো বরযাত্রীর আসার জন্য । দুপুরে যখন বরযাত্রীর আসার কথা তখন নওসাবার ফোনে একটা ফোন এসে হাজির হল । হাসান ভিডিও কল দিয়েছে । ফোনটা রিসিভ করতেই একটু অবাক হল । দেখতে পেল মীম ফোনের ওপাশে । ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, তোকে তো সুন্দর লাগছে রে !
নওসাবা বলল, তুই না এখানে আসবি ! হাসানের কাছে কেন ?
মীম হাসলো । তারপর বলল, বাহ আমি হাসানের সাথে থাকবো না তো কে থাকবে ! একটু আগে আমরা বিয়ে করেছি !
নওসাবার প্রথমে মনে হল মীম সম্ভবত ওর সাথে ঠোট্টা করছে । মীম বলল, সরি দোস্ত, প্রতিশোধ না নিয়ে পারলাম না । হাসানের ঐ দিন গুলোতে আমি ওর সাথে খুব বেশি মিশে গিয়েছিলাম । কাছ থেকে দেখেছি যে ও কতটা কষ্ট পেয়েছিলো । তখনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে সুযোগ আসলে একটা প্রতিশোধ নিবোই । যাই হোক তোকে বলি সেই তখন থেকেই হাসানের সাথে আমার বন্ধুত্ব । তারপর ওর সাথে প্রেম ।
নওসাবা যেন চোখ বড় বড় করে কেবল তাকিয়ে রয়েছে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে । কোন কথাই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না । মীম বলল, যদিও হাসান এসব কিছুই করতে চায় নি কিন্তু আমি ওকে রাজি করিয়েছি । যাই হোক, এখন রাখি । আমাদের ফ্লাইট একটু পরে । হানিমুনের ছবি পাঠাবো তোকে । টাটা !
মোবাইল স্ক্রিন অফ হয়ে গেল । নওসাবা অবাক হয়ে কেবল সেদিকে তাকিয়ে রইলো । ও সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছে না । এমন একটা ঘটনা ওর সাথে ঘটেছে !
এখন কী করবে ও !
বাইরে মানুষ জন ভর্তি । সবাই অপেক্ষা করছে । ওর বাবার এতো বড় অপমান হবে ! আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখাবে কিভাবে ?
সব থেকে বড় কথা যে হাসানকে সত্যিই এবার ও অনেক মনে ধরেছে ! বিয়ের আগে ওরা বেশ কয়েকবার দেখা করেছে, গল্প করেছে । সময় গুলো এতো ভাল গিয়েছিলো । আর এখন কী হয়ে গেল !
কৃত কর্মের ফল পেল ও !
তখনই কানে একটা হইচই কানে এল !
নওসাবা শুনতে পেল, বর এসেছে বর এসেছে বলে কয়েকটা মেয়ে চিৎকারে উঠলো !
বুকের ভেতরে একটা তীব্র উত্তেজনা কাজ করলো সাথে সাথে । দরজা খুলে বের হতে যাবে তখনও দেখতে পেল দরজার ঠিক বাইরে মীম দাড়িয়ে আছে । ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে । এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, সরি রে, এই কাজটা না করে পারলাম না ! হাসান যদিও প্রথমে একদমই রাজি হচ্ছিলো না ওর ফোনটা দিতে । ও কখনো তোর উপরে রাগ করে নি । তোকে কেবল তীব্র ভাবে ভালোবেসেছে কষ্ট পেয়েছে !
নওসাবা অনুভব করলো ও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে । মীম ওকে জড়িয়ে ধরে খানিকটা আদর করতে করতে বলল, বুঝতে পেরেছিস তো ভালোবাসার মানুষ যখন কষ্ট দেয় তখন সেটা কতটা তীব্র ভাবে আঘাত করে !
-হুম !
-আর কখনও কষ্ট দিবি না হাসানকে ! বুঝেছিস ?
-হুম !
-চল এখন চোখ মুছে ফেল । আজকে তো বিয়ে ! মনে নেই সেটা !
নওসাবার সত্যিই যেন কোন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না । যখন মীম প্রথমবার ফোন দিয়েছিলো তখন একটা তীব্র বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছিলো । সত্যিই কাছের মানুষ যখন ধোকা দেয় তখন সেটা কোন ভাবেই সহ্য করা যায় না । সেই সময় হাসানকে সে কী রকম কষ্ট দিয়েছিলো তার কিছুটা হয়তো সে আজকে অনুভব করতে পারলো ! মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করলো যে এরপরের জীবনে সে হাসানে ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু পূরণ করে দিবে !
গল্পটা নিজেস্ব সাইটে প্রকাশিত । আর ছবিটা মিডজার্নি দিয়ে আঁকা