
গালিনা ব্রেজনেভা । ক্রেমলিন রাজনকুমারী । যদিও সেই সময়ে রাজা রানীর ব্যাপারটা ছিল না, তারপরেও সে ছিল রাজকুমারী । সারা জীবনে সে ছুটেছে নিজের স্বাধীনতার পেছনে, কিন্তু যখন সে সেটা অর্জন করেছে তখন হারিয়েছে সব কিছুই ।
গালিনার পড়াশুনার পেছনে মনযোগ ছিল না একদমই । সে সব সময় চাইতো মুক্ত স্বাধীন বিচরণ । কোন বাঁধা ধরা নিয়ম সে পছন্দ করতো না । তার পছন্দ ছিল ফূর্তি । আর এই ফুর্তির ভেতরে ছিল মদ,পুরুষ, সেক্স আর হীরা ! তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়াতে সকল তরুন তরুণীর কমসোমলের সদস্য হওয়াটা একপ্রকার বাধ্যতামূলক ছিল । কিন্তু গালিনা কোনদিনই কমসোমলের সদস্য হয় নি । গালিনার পিতা পার্টি প্রধান ছিল বিধায় এটা নিয়ে তাকে খুব একটা বিপদে পরতেও হয় নি । সে ব্যস্ত থাকতো তার আপন জগতে ।
গালিনার সার্কাস সো বেশ পছন্দ ছিল । বাইশ বছর বয়সে তার থেকে দ্বিগুণ বয়স্ক একজন সার্কাস শিল্পীকে সে বিয়ে করে পালিয়ে । এতে গালিনার পিতা কমরেড ব্রেজনেভ কষ্ট পান তবে মেয়ের অপরাধ ক্ষমা করে দেন, সব কিছু মেনে নেন । সংসার টিকে থাকে বেশ কিছু দিন ।তবে ৩৩ বছর বয়সে গালিনার বিয়ে ভেঙ্গে যায় । এরপর আবার বিয়ে করেন তার থেকে ছোট ২৫ বছরের এক সুদর্শন যুবককে। বিয়ের কথা পিতাকে জানানোর পরে কমরেড ভয়ংকর রেগে যায় । এবং কেজিবি লাগিয়ে গালিনার বিয়ে ভেঙ্গে দেন কয়েক দিনের মাথায় । তবে গালিনাও দমবার পাত্রী নয় । সে গোপনে সেই সুপুরুষের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেন কয়েক বছর । এরপর গালিনা আবারও বিয়ে করেন । এবার এক আর্মি মেজর কে । যদিও আর্মির সেই মেজর গালিনার থেকে বয়সে ছোট এবং বিবাহিত ছিল । তার সন্তানও ছিল । তারপরেও বিয়ে হয় । এখানে স্বয়ং কমরেড ব্রেজনেভও সেই আর্মি মেজরকে পছন্দ করতেন । তাকে সে প্রমোশন দিয়ে আরও উপরের পদে নিযুক্ত করেন । পিতা ভেবেছিলো এবার বুঝি মেয়ের একটু সুমতি হবে । কিন্তু হায় ! স্বামী সংসার রেখে গালিনা আবারও মেতে উঠলো তার চিরায়িত চরিত্রে । রাতের পর রাত সে বাইরে থাকতো অন্য পুরুষের সঙ্গে । সময় কাটতো নাচ গান আর সুদর্শন পুরুষ ।

Leonid Brezhnev dancing with his daughter Galina, Photo by V.Egorov (ছবিটা ফেসবুক থেকে নেওয়া)
বরিস জিপসি নামে এক থিয়েটার গায়ককে এই সময়ে দেখা যেত গালিনার আশে পাশে । গালিনার কারণেই এই বরিসের সর্বত্র প্রবেশাধিকার ছিল । গালিনার সকল অপকর্মের সঙ্গীও ছিল সে ।
গালিনার আরেক দুর্বলতা ছিল ডায়মন্ড । সেই সময়ে ডায়মন্ড দোকানে বিক্রি হত না । চোরাচালানী কিংবা অবৈধভাবে ধরা পড়া ডায়মন্ড ধরা পড়লে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হত তবে সেগুলো কখনই রাষ্ট্রের ভল্টে জমা পড়তো না । সেগুলো পরে শোভা পেত পার্টির নেত্রীত্বে থাকা ব্যক্তিদের স্ত্রী কন্যা কিংবা প্রেমিকাদের গলাতে । এমন এক সন্ধ্যায় গালিনা সার্কাস দেখতে গেছে । সেই সময়ে সে দেখতে পেল এক সার্কাস শিল্পীর গলাতে বিশাল বড় এক ডায়মন্ডের নেকলেস ঝুলছে । সেই ডায়মন্ডটা তার নিজের গলায় ডায়মন্ড থেকে বড় ছিল যা তার ইগোতে আঘাত দেয় । সে এতো বড় রাজনৈতিকের কন্যা । তার তার থেকে সামান্য এক সার্কাস শিল্পীর গলাতে তার থেকে বড় ডায়মন্ড থাকতে পারে না । সাথে সাথে সে বরিসেকে ডেকে বলেন যে যে কোন ভাবেই তার ঐ ডায়মন্ডটি চাই ই চাই ।
পরদিনই ঐ সার্কাশ শিল্পীর ঘরে কে বা কারা ঢুকে নেকলেসটি চুরি করে নিয়ে যায় । রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এই চুরির খোজ খবর করতে গিয়ে খোজ পান এক আন্তর্জাতিক ডায়মন্ড চোরাচালানী চক্রের যেটা কিনা বরিশের হাত ধরে চলে যায় স্বয়ং রাজকুমারী গালিনার দিকে ।
কমরেড ব্রেজনেভের তখন শেষ সময় । শরীর খারাপ, ঠিকঠাক মত কথাও বলতে পারেন না । পার্টি অফিসে একদল তাকে পদত্যাগ করতে বলেছে কয়েকবার আবার একদম তাকে ক্ষমতায় রাখতে এখনও মরিয়া । এই সময়ে কেজিবির প্রধান ছিলেন আন্দ্রোপভের । এই মসয়ে আন্দোপভের গালিনার প্রিয় পাত্র বরিশ জিপসিকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায় । এবং গালিনাকে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় । এই খবর কিভাবে জানি বাইরে চলে আসে । এবং সাধারণ জনগন মনে করতে থাকে যে আন্দ্রোপভেরই তাদের রক্ষা কর্তা । দুর্নীতির জালে অতিষ্ট দেশকে রক্ষা করতে পারে এই আন্দ্রোপভেরই । সেই সময়ে কমরেড ব্রেজনেভ মারা যান । পার্টি প্রধান হয়ে উঠেন আন্দ্রোপভ ।
ক্ষমতায় এসেই সে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন । বড় বড় রুই কাতলদের জেলা ঢোকানো হয়। দুর্নীতির দায়ে জেলে ঢোকানো হয় গালিনার স্বামী চুর্বানাভকেও । গালিনা তাকে ডিভোর্স দেয় এবং আস্তে আস্তে জনম্মুখ থেকে গায়েব হয়ে যায় কিছুদিনের জন্য । এদিকে আন্দোপভ তার অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে । তবে শরীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে থামতে হয় । আন্দ্রোভ মারা যাওয়ার পরে চেরনোনকো নতুন নেতা হন এবং একই ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিজান চালিয়ে যান তবে একটু শিথিল ভাবে । এই সময়ে গালিনা আবারও জনসম্মুখে ফিরে আসে এবং তার বিরুদ্ধে চলা চোরাচালানী মামলা বন্ধ হয়ে যায় ! শোনা যায় ৬৪ বছর বয়সে সে আবারও বিয়ে করে আবারও বিয়ে করে একজন ২৯ বছর যুবক কে । তবে সেই যুবকের নাম জানা যায় না । পরবর্তিতে গালিনা নিজেকে মদের নেশায় বুদ করে ফেলে এবং মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ে । তার মেয়ে তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করায় এবং ৬৯ বছর বয়সে গালিনা সেখানেই মৃত্যু বরণ করে ।
কদিন থেকে রাশিয়ার সম্পর্কে নানান কিছু পড়ছি । কয়েকটি বই হাতে এসেছে। এর ভেতরে একটা বইয়ের নাম ''ককেশিয়ার দিন রাত্রি'' । লেখক শাহাব আহমেদ । সেই বইয়ের একটা অংশে গালিনা সম্পর্কে আলাদা ভাবে লেখা । সেটা পড়েই এই লেখা টুকু লেখা লিখলাম ।
pic source
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



