একটা সপ্তাহ আগে মায়ের সাথে দেখা হল । যদিও এবার দেখা হওয়াটা অনেক দিনের ব্যবধানে নয় তারপরেও মনে হল যেন কতদিন পর তাকে যেন দেখলাম । আরও সপ্তাহখানেক আগে সে এসেছিলো বিক্রমপুরে । বিক্রমপুরের আমাদের পৈত্রিক বাড়ি রয়েছে । মায়ের পৈত্রিক মাত্রিক সব বাড়িই এই বিক্রমপুরেই । কিছু কাজ ছিল আর অনেক দিন সে আসে না তাই মায়ের দুই বো আর বড় মামা মামী এবার এসেছিলেন । যাওয়ার দিন আমাকে জানায় নি । একেবারে পৌছে তারপর ফোন দিয়েছে যে তারা পৌছে গেছে । বড় মামা ছিল সাথে তাই আর অন্য কারো দরকার হয় নি ।
গত বুধবার ফোন দিয়ে জানালো যে তারা বাসায় ফেরৎ যাবে । আমি তাদের গুলিস্তান থেকে গাবতলি পৌছে দিতে পারবো কিনা । বড় মামা নাকি আরও কয়েকদিন থাকবে । আমার কোন সমস্যা ছিল না । ঠিক যে শুক্রবার সকালে তারা বিক্রমপুর থেকে রওয়ানা দিবে আমি তাদের গুলিস্তানে রিসিভ করে গাবতলি পৌছে দিবো ।
বৃহস্পতিবার সকালে আমি নিজের কাজে ব্যস্ত । বারোটার দিকে মায়ের ফোন এসে হাজির । তারা নাকি ইতিমধ্যে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছেন । মুক্তারপুর চলে এসেছেন । আমি বললাম এই না বললে শুক্রবার আসবে । মা জানালো যে ছোর খালার বাসা থেকে নাকি বড় চাপ দিচ্ছে আজই যেতে হবে ।
হাতের সব কাজ কর্ম বাদ দিয়ে তখনই রওয়ানা দিলাম । মনে হচ্ছিলো যেন এখনই তারা গুলিস্তান পৌছে যাবে যদি আমি এখনই সেখানে গিয়ে না হাজির হই । আমি যখন গুলিস্তান পৌছালাম তখন প্রায় দুইটা বেজে গেছে । বৃহস্পতিবার এই এলাকায় ছন্নছাড়া জ্যাম থাকে । তবে আশার কথা হচ্ছে তারা এখনও এসে পৌছাই নি । কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক এটা আমার মোটেই ভাল লাগে না । আমি আমার সারা জীবন ভর সব সময় সব স্থানে সময়ের কিছু আগে গিয়ে পৌছেছি । আমার জন্য নয় বরং আমি সবার জন্য অপেক্ষা করেছি ।
তাদের আসতে আসতে সাড়ে তিনটা বাজলো । গত ডিসেম্বরে গিয়েছিলাম বাসায় । এই কদিনেই মায়ের চেহারা কেমন যেন হয়ে গেছে ! নাকি আমি এই কদিন পরে দেখলাম বলে এমন মনে হচ্ছে ।
খুব ইচ্ছে ছিল যে মাকে উবারে করে গাবতলি নিয়ে যাবো । এপে ডাক দিলাম । বেটা ২৭ মিনিট রিচ টাইম দেখাচ্ছে । এই সময়ে গুলিস্তানে ২৭ মিনিট অপেক্ষা করা কি সম্ভব । কয়েকবার ক্যান্সেল করে নতুন করে রাইড রিকোয়েস্ট দিলাম । প্রতিবারই একই সময় দেখাচ্ছে । আর কোন উপায় না দেখে সিএনজিই নিতে হল ।
আমি ঢাকাতে থাকি জ্যাম ঠেলে চলাচলে আমার অভ্যাস আছে । কিন্তু মা খালাদের এই অভ্যাস নেই । সিএনজির ভেতরে যদি হাসফাস করে এই কারণেই খুব চাচ্ছিলাম যে উবার পেয়ে যাই কিন্তু কপালে না থাকলে যা হয় আর কি । তবে আমাদের ভাগ্য ভাল বলতে হবে । গুলিস্তানে কিছুটা জ্যাম পরলেও আর কোথাও তেমন জ্যাম পেলাম না । এক ঘন্টার কিছু বেশি সময়ে পৌছে গেলাম গাবতলি । বাসের টিকিট আগে থেকেই আমি ম্যানেক করে রেখেছিলাম । এই বৃহস্পতিবারে আমাদের এলাকার বাস গুলোতে প্রচুর লোক হয় । তারা বৃহস্পতিবার বাসায় গিয়ে রবিবার একেবারে সকালের বাসে ঢাকা এসে অফিস ধরে ।
খালা বললেন তিনি ভাত খাবেন । মা কিছু খাবে না । সে ফলমুল খাবে। ফলমুল কিনে নিয়ে এলাম । বাসে গিয়ে বসলাম কিছু সময় পরে । তাদের সিটের সামনেই দাড়িয়ে রইলাম । হঠাৎ আমার কেন জানি মন খারাপ হতে শুরু করলো । ঠিক তিন চার বছর আগে একই ভাবে মাকে বাসে তুলে দিয়েছিলাম ষেদিনও ঠিক একই রকম অনুভূতি হয়েছিলো।
বাস ছাড়বে আর কিছু সময় পরেই । হঠাৎ মা আমার হাতে একটা এক হাজার টাকার নোট গুজে দিল । বলল, কিছু কিনে খাইস ।
আমার কেন জানি হাসি চলে এল । আমি প্রায় পনের বছর ধরে বাসা থেকে একবারে টাকা পয়সা নেওয়া বন্ধ করেছি । এখন আমার নেওয়ার সময় নয়, দেওয়ার সময় । তাই করি । কিন্তু আজকে আমার আমার হাতে এক হাজার টাকা গুজে দিল । ঠিক আগেরবার মানে ৩/৪ বছর আগে যখন তাকে তুলে দিতে এসেছিলাম সেবারও একই ভাবে টাকা দিয়েছিলো ।
আমি নিতে চাইলাম না । খালা বললেন, নে, মা খালা কিছু দিলে নিতে হয় ।
টাকাটা হাতেই রইলো ।
আর কিছু সময়ের ভেতরে বাসের ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল । একটু নড়ে উঠলো বাসটা । সেই সাথে আমার বুকের ভেতরটাও । আমি বাস থেকে নেমে পড়লাম । নামার আগে বাসের সুপারভাইজারকে বলে দিলাম যেন তাদের দিকে খেয়াল রাখে । নিচে নেমে দাড়ালাম কাছেই । জানালা খুলে আমার মা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । বলল যেন সাবধানে ফিরে যাই বাসায় ।
একটা সময়ে বাসটা সত্যিই চলতে শুরু করলো । আমিও চলতে শুরু করলাম । যত সময় জানালা দিয়ে মায়ের চেহারা দেখা যায় তত সময় সে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে । আমিও তাই করলাম । বাসটা একেবারে চোখের আড়াল চলে যাওয়ার পর বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা অনুভূতি হল । শূন্য শূন্য অনুভূতি !
আমার মা প্রায়ই আমাকে ফোন করে বলে যে আমার মনে আসলে দয়া মায়া কম । মাঝে মাঝে আমার নিজেরও তাই মনে হয় । মানুষের জন্য আমি খুব একটা চিন্তা করি না । আমার সকল চিন্তা চিন্তা আমাকে নিয়ে আর আমাকে ঘিরে আমার মানুষ গুলোকে নিয়ে । অন্য মানুষকে নিয়ে ভাবি না বলেই কাছের মানুষ গুলোকে নিয়ে আমার ভাবনা সব সময় বেশি । কিন্তু আমি কখনই আমার এই ভাবনা তাদের জানাতে পারি না । কিসে যেন আটকে যাই । আমার বড় ভাই আবার একেবারে উল্টো । সে ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজের ভালোবাসার কথা জানান দেয় । আমার মনের কথা মনেই রয়ে যায় । বলতে পারলে হয়তো ভাল লাগতো । কিছুটা শান্তি লাগতো ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২৩ রাত ১১:৪১