রোজার সময়টা আমাদের বাসার পরিবেশ সব সময় আলাদা হত । রান্না বান্নার দিক থেকে একটা আলাদা আবহাওয়া তৈরি হয়ে যেত আপনা আপনি । রমজানে আমাদের বাসাতেই সব সময় ইফতার তৈরি করা হত । হয়তো কালে ভাদ্রে বাজার থেকে অন্য কিছু কিনে আনা হত তবে সব সব কিছু বাসাতেই আমার মা তৈরি করতো । ছোট বেলা থেকেই এই খাবার খেয়ে আমরা অভ্যস্ত । তাই যখন ঢাকায় এলাম প্রথম তখন সব কিছু কেমন অন্য রকম ঠেকলো । কারণ তখন উঠেছি মোহাম্মাদপুরের একটা ছেলেদের মেসে । সেখানে কোন কিছুরই ঠিক নেই । যে যার মত থাকছে খাচ্ছে ঘুমাচ্ছে । আমা বড় অস্বস্তি লাগতো । তবে কি আর করা থাকতে তো হবেই ।
রমজান মাস শুরু হল । ঢাকাতে সেটাই ছিল আমার প্রথম রোজা । পরিবার ছেড়ে প্রথম রোজা । রোজার একটা স্মৃতি আমার এখনও খুব ভাল করে মনে পড়ে । আমাদের রোজার শুরুর প্রথম দিন মেসের সবার মাঝে মিটিং হল । ঠিক হল যে রোজার সন্ধ্যা রাতে আমরা একটু কম খাবো আর শেষ রাতে ভাল খাবো । কম খাবো মানে হচ্ছে তরকারির মান কম থাকবে । শেষ রাতে ভাল তরকারি হবে । সবাই রাজি হল আমি আর আলাদা ভাবে কী বলবো ।
রাতে যখন ভাত খেতে গেলাম দেখলাম সেখানে কেবল আলুভর্তা আর ডাল রাখা হয়েছে । খাবার মানে যে কেবল আলুভর্তা আর ডাল হতে পারে এটা তখনও আমার মাথাতে আসে নি । আমার জীবনে বলতে গেলে সেটাই ছিল শুধু আলুভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া । ছোটবেলা থেকে আমাদের বাসায় ডাল রান্না হত বারো মাস । এটা তাই আলাদা কোন তরকারি হিসাবে গন্য হত না । এখনও হয় না । আমি কোন মতে অর্ধেক ভাত খেয়ে উঠে পড়লাম । এই কথা মাঝে মাঝে আমি এখনও ভাবি । তবে শেষ রাতের খাওয়া ভাল ছিল । মুরগির মাংস । খাওয়া শেষ করে আমরা সবাই মিলে নামাজ পড়তে গেলাম এক সাথে । সেই অন্ধকার সিড়িয়ে নামার দৃশ্য আমার চোখে এখনও ভাসে ।
এরপর অবশ্য আমি আর মেসের খাবারের জন্য বসে থাকি নি । নিজেই বাইরর হোটেল থেকে খেয়ে আসতাম । আমার হোটেল থেকে খাওয়ার অভ্যাস তখন থেকেই শুরু হয়েছে । এখনও সেই অভ্যাস আছে ।
এরপর আসি ইফতারের কথায় । ঢাকায় প্রথম ইফতারের জন্য আমরা মেসের কয়েকজন গিয়ে হাজির হলাম মোহাম্মাদপুরের তখনকার সব থেকে বড় হোটেলে । ক্যাফে বাগদাদ নাম হোটেলটার । হোটেলটা এখনও বেশ চমৎকার ব্যবসা করে যাচ্ছে । সেই হোটেলে প্রথম ইফতারটা করলাম । প্লেট প্রতি দাম ছিল ৪৫ টাকা । আর যদি শরবত খাওয়া হয় তাহলে সাথে দশটা যোগ হবে । আপনাদের কাছে হয়তো মনে হচ্ছে ৪৫ টাকার আবার কীসের ইফতার সেই সময়ে এই ৪৫ টাকা অনেক বেশি ছিল ।
ঢাকার সেবারের আরও একটা কথা মনে পড়লো । আমি যখন যশোর ছিলাম তখন আমার এক মেয়ে বন্ধু ছিল । মেয়ে বন্ধু মানে প্রেমিকা টাইপের কিছু না । বন্ধুই । বলা যায় আমার জীবনে এই মেয়েটির সাথেই আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিলো । ক্লাস ফাইভের পরে অবশ্য আমার সাথে ওর আর দেখা হয় নি । এই মেয়েটিও তখন ঢাকাতে এসেছিলো । কিভাবে যেন মেয়েটির কাছে আমার নম্বর গিয়ে হাজির হয় কিংবা আমার কাছে ওর নম্বর এসে হাজির হয় । ফোনে যোগাযোগ হয় । এবং প্রায় সাত বছর পরে আবার আমাদের দেখা হল । দুপুরের দিকে কোচিংয়ের দিকে জিয়া উদ্যানে দেখা হল । সেখানেই বসে গল্প করলাম বেশ কিছু সময় । তারপর ওকে নামিয়ে দিতে গেলাম ফার্মগেটে । ও তখন সেখানকার একটা হোস্টেলে থাকতো । ততক্ষনে ইফতারের সময় হয়ে এসেছে । ওকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম । দেখি অনেকেই এসে হাজির হয়েছে । আমি জীবনের প্রথম এমন কাঁচে ঘেরা এসিওয়ালা রেস্টুরেন্টে খেতে ঢুকলাম । ইফতার এল । আমরা তাজা আমের জুস খেয়েছিলাম এটা আমার মনে আছে । সেই সময়টা চমৎকার ছিল । তারপর অবশ্য আরো অনেকবারই দেখা হয়েছে ওর সাথে । এখনও নিয়মিত যোগাযোগ আছে ।
এরপর ঢাকাতে আমি খুব বেশি দিন থাকি নি । যদিও কোচিং চলছিলো আমি তার মাঝেই বাসায় চলে আসি । বাসায় এসে বাসার খাবার খেয়ে একটু শান্তি আসে মনে । তখন মন বারবার বাড়ির দিকে চলে আসতো । একটু সুযোগ পেলেই আমি বাড়িতে দৌড় দিতাম ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে প্রতি রমজানে একটা কাজ আমার খুব পছন্দ ছিল । সেটা হচ্ছে আমাদের বন্ধুদের কয়েকজন মিলে একসাথে ইফতার করা । বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ১২/১৩ জনের একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছিলো । আমরা এক সাথে পড়াশোনা ট্যুর দিয়ে বেড়াতাম । প্রতি রমজানে আমরা একসাথে ইফতার করতাম । কোন হোটেলে ঠিক না । ইফতার কিনে এনে খোলা জায়গা ইফতারের ব্যবস্থা হত । নিজেরাই সব কিছু করতাম । খাওয়ার থেকে এই এক সাথে সব কিছুর প্রস্তুতি করাটাই সব থেকে চমৎকার ব্যাপার ছিল । পড়াশোনা শেষ করার পরে আর সেই একসাথে ইফতার করা হয় নি । এখন অবশ্য কেউ ঢাকাতে নেই । আমরা কয়েকজন আছি । সবাই নিজের নিজের কাছে ব্যস্ত । আমিও সম্ভবত সামনের রোজা আর ঢাকাতে করবো না ।
রোজা এলে আমার রুটিনের সব এলোমেলো হয়ে যায় । সব কিছুর বারোটা বেজে যায় । কোন কাজ কর্ম হয় না ঠিক মত । অনেক দিন পরে পরে আমার ঘুমানোর সময়ের একটা যুতসই টাইম টেবিলে এসেছিলো । সকাল সকাল ঘুমিয়ে যেতাম আর ঘুম থেকে উঠতাম একেবারে আযানের সময়ে । এই রুটিন চালু হয়েছিলো । কিন্তু রোজার কারণে আবার সব এলোমেলো হয়ে গেল । রোজা চলে যাওয়ার পরে আবারে ঐ রুটিনে ফেরা কষ্টকর হয়ে যাবে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২৩ দুপুর ২:৩৯