আমি সব সময় সবার প্রথমে মানুষকে অবিশ্বাসই করি। যাকে চিনি না তাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ আমার কাছে নেই । তারপরেও ঠকে যাই । বিশ্বাস করবো না করবো না করে শেষে যাকে একটু বিশ্বাস করে দেখা যায় সেই ঠকিয়ে দিয়েছে । এর আগেই বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়ার গল্প বলেছি আজকে আবারও ঠকে যাওয়ার গল্প । তবে এবার একটু কম ধরা খেয়েছি ।
কয়েক দিন ধরে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল কেনার চেষ্টায় আছি । এখন প্রায় প্রতিদিন শান্তিনগরে যেতে হচ্ছে । সেখানে দীর্ঘ সময়ে থাকতে হচ্ছে । কয়েকদিন গিয়েছিলাম বাসে তবে বাসে করে গেলে ফেরার সময়ে খুব ঝামেলা হয় । সাইকেল ছাড়া উপায় নেই আর সাইকেল বিল্ডিংয়ের গ্যারাজে রাখলে মনের ভেতরে একটা ভয় কাজ করে । ঢাকা শহরে সাইকেল চুরি ঠেকিয়ে রাখা বেশ মুস্কিল একটা কাজ । আর বর্তমান সাইকেলের সাথে একটা আলাদা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে । এই সাইকেলটা কোন ভাবেই হারাতে চাই না । তাই ঠিক করলাম যে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড কমদামী সাইকেল কিনবো । যদি হারায় তাহলে কম দামীটাই হারাক ।
ফেসবুকেও বিভিন্ন সাইকেল কেনা বেচার গ্রুপ আছে, এছাড়া মার্কেট প্লেসও আছে । সেখান থেকেই সাইকেল খোজ করতে লাগলাম । একটা পেয়ে গেলাম । একটু দামাদামী করতেই সেলার খুব সহজেই রাজি হয়ে গেল ৫ হাজারে দিয়ে দিতে । তবে শর্ত হচ্ছে সে ঢাকার বাইরে থাকে । বাড়ি নওগা । সাইকেল আসবে কুরিয়ারে । আমি কুরিয়ার চার্জ বহন করতেও রাজি । সাইকেল পাঠানো হবে কন্ডিশনে । সাইকেল হাতে পাবো তারপর টাকা দিয়ে নিবো । এই হিসাবে দুইজনই সেফ । টাকা না পেলে সাইকেল নেই ।
এই রকম লেনদেনে কখনই অগ্রিম টাকা দিতে হয় না । তাহলে বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় টাকা নিয়ে জিনিস পত্র দেয় না । সেলার আমাকে জানালো যে আমি যেন কেবল কুরিয়ার চার্জটা আগে পাঠাই । তার কাছে নাকি কোন টাকা নেই । কুরিয়ার চার্জ পাঠাতে আমার কোন সমস্যা ছিল না । সে খোজ খবর নিয়ে জানালো যে পাঠাও কুরিয়ার সব থেকে ভাল হবে । একেবারে আমার বাসায় চলে আসবে ।
আমি কেবল কুরিয়ার চার্জ পাঠালাম । ঘন্টা দুয়েক পরে সে আমাকে একটা মেসেজের স্ক্রিনশট দেখালো । উপরে পাঠাও এর নাম দেখা যাচ্ছে । আমার আসলে তখনও পর্যন্ত কোন কিছুই সন্দেহ হয় নি । সব ঠিকই চলছিলো । রাতের বেলা প্রথম মনে একটা খটকা লাগলো । আমি সাইকেলটার মডেল গুগলে সার্চ দিলাম । বেশ লিংক চলে এল । এবং তখনই আমার মনে প্রথম সন্দেহ জাগলো । সাইকেলটা একটা কাস্টম বিল্ড সাইকেল । যদি সেকেন্ড হ্যান্ডও কেউ বিক্রি হয় তাহলেও কম করে বিশ হাজারের নিচে কোন ভাবেই বিক্রি হবে না । আর এই সাইকেল কিনা আমাকে মাত্র ৫ হাজারে দিচ্ছে ।
আচ্ছা দেখা যাক কী হয় । পরদিন শুক্রবার ছিল । আমি সকালে গিয়েছিলাম শান্তিনগরে । ফেরার পথে আমার নম্বরে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল এল । পরিচয় দিল যে সে পাঠাও কুরিয়ারের লোক । আমার নামে একটা সাইকেল এসেছে । আমার ঠিকানা কনফার্ম করলো । কত টাকা সেও কনফর্ম করলো ।
এরপর বলল যে আমাকে সাইকেল নিতে হলে নাকি আগে ওদের কাছে পেমেন্ট করতে হবে । এটাই নাকি তাদের কোম্পানির নিয়ম । তবেই আমার বাসায় পৌছে দিবে । কন্ডিশনে আমি আগেও জিনিস পত্র নিয়েছি । আগে পেমেন্ট দিতে হবে এমন আগে শুনি নি । বিশেষ করে হোম ডেলিভারির ক্ষেত্রে । আমি তখন রাস্তায় ছিলাম । পরিস্কার ভাবে বলে দিলাম যে শুনেন ভাই আমি কোন ভাবেই আগে পেমেন্ট করবো না । ঐ লোক বেশ দম্ভের সাথেই ফোন রেখে দিল ।
আমি সেলারকে ফোন দিলাম । এবং তাকেও পরিস্কার ভাবেই জানালাম যে কোন ভাবেই সাইকেল আমার বাসার সামনে না আসলে আমি নিজ চোখে সাইকেল না দেখলে টাকা দিবো না । নামাজের পরে আরো কয়েকবার সেলার আমাকে ফোন দিল । খুব নরম ভাষার বলল যে আসলে এটাই নিয়ম কী করবেন বলেন । এমন হয় আমিও বুঝি নি । এখন আমি না নিলে তার জরিমানা হবে । ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আমি তখন বললাম যে আমি তাহলে ওদের অফিসে যাই । সেখানে গিয়ে সাইকেল নিয়ে আসি ।
কিছু সময় সেই কুরিয়ারওয়ালা আবার ফোন দিল । আমি তাকে অফিসে আসার কথা বললাম, তখন সে চট করে কথা ঘুরিয়ে ফেলল । বলল যে আজকে শুক্রবার । অফিস খোলা তবে কেউ এখানে এসে কোন পন্য নিতে পারবে না । এখানে কেবল মাল খালাস হচ্ছে আর হোম ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে ।
যখনই সে অফিসে আসতে মানা করলো তখন আসলে আমি পুরোপুরি কনফার্ম হয়ে গেছি যে এরা আসলে ফেইক । আমি এবার বললাম যে আচ্ছা আজকে না ছুটির দিন পরের দিন আমি এসে নিয়ে যাবো । তখন আবার বলল যে না এটাও হবে না । আজই নিতে হবে নয়তো সাইকেল আজই ফেরৎ চলে যাবে ।
এটা আবার কেমন নিয়ম ভাই !
এটাই নাকি তাদের পলিসি ।
তারপর একটু পরে সেলার ফোন দিল । সে জানালো যে পুরো টাকা না দিতে চাইলে হাফ পেমেন্ট করেও নাকি হোম ডেলিভারি নেওয়া যাবে । এই সিস্টেমও তাদের আছে । সেলার ফোন রাখার কিছু সময় পরে সেই কুরিয়ারওয়ালা আবার ফোন দিল । সেই আমাকে জানালো যে আমি হাফ পেমেন্ট করে চাইলে নিতে পারি । আমার তখন আর কিছুই করার ইচ্ছে নেই । ব্যাপারটা ওরাও বুঝতে পেরেছে । তাই প্রাইস কমিয়ে দিয়েছে হাফে নিয়ে এসেছে যদি রাজি হই । তাকে বললাম যে আমি কোন ভাবেই আগে টাকা দিবো না ।
এবার শেষবারের মত সেলার আমাকে ফোন দিল । ফোন দিয়ে বলল যে তার আসলে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল । আমি সাইকেল টা নিলাম না তাকে এখন জরিমানা দিতে হবে । আমি বললাম চিন্তা করবেন যে যে জরিমানা দিতে হবে সেটা একটা রসিদ তো আপনাকে দিবে । সেটা আমার কাছে ছবি তুলে পাঠাবেন । আমি টাকা পাঠিয়ে দিব । পরে অবশ্য আর যোগাযোগ করে নি ।
মার্কেট প্লেসে আমি সেদিন সন্ধ্যার দিকে আবার সাইকেল খোজ করতে করতে দেখলাম একই সাইকেল কয়েকটা রয়েছে । এর ভেতরে একটার দাম লেখা ১৯ হাজার অন্যটার ২৪ হাজার আর একটার ছয় হাজার । এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৯ হাজারের পোস্টে ঠিক যে যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে ছয় হাজারের পোস্টেও একই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে । দুটো ছবি মিলিয়ে দেখলাম । একদম এক । ১৯ হাজারের টা হয়তো আসল সেলার । তার কাছ থেকে ছবি নিয়ে আবারও ফাঁদ পাতা হয়েছে ।
সত্যি বলতে কি প্রথমজনের সাথে যখন কথা বললাম, এতো ভদ্র মোলায়েম ব্যবহার যে আমার সত্যি বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিলো যে এই লোকটা আসল মানুস । ঠকাবে না । এমন কি আমি যখন কুরিয়ার চার্য পাঠানোর জন্য বললাম ৬৫০ টাকা দিই তখন সে আমাকে বলল না না ভাই ৬১০ টাকা লাগবে আপনি চার্য সহ ৬২০ টাকা পাঠান । আহা কতই ভাল মনে হয়েছিলো ।
আবার শিক্ষা হল ।
অনলাইনে সরাসরি কোন মানুষের কাছ থেকে কিছু কিনতে গেলে, বিশেষ করে যখন কুরিয়ারের মাধ্যমে জিনিস পত্র নিতে হবে এমন পরিস্থিতি হলে কোন ভাবেই আগে টাকা দেওয়া চলবে না । যতই মিষ্টি কথা যতই নিয়ম নীতির দেখাক না কেন, কোন ভাবেই অগ্রিম পেমেন্ট নয় । যদি মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়ে পেমেন্ট করে দেন শতকরা ৯৫ ভাগ সম্ভবনা থাকবে যে আপনার টাকা সে মেরে দিবে ।
হ্যা আগে কেবল কুরিয়ার চার্য করা যেতে পারে । তবুও মনে এই ধারণা রাখতে হবে যে এই কুরিয়ার চার্জ মাইর হয়ে যেতে পারে । অনলাইনে কাউকে বিশ্বাস করবেন না কখনই । যে বলবে ক্যাশ অন ডেলিভারি বা সরাসরি বা কনডিশনে দেওয়া যাবে না তার কাছ থেকে জিনিস কিনবেন না ।
আরেকটা ব্যাপার সব সময় খেয়াল রাখবেন যে জিনিস সেকেন্ড হ্যান্ড হলেও ভাল জিনিসের দাম বেশি হবেই । আমার এই ঘটনার উদাহরনই যদি দিই । যে সাইকেলটা ছিল তার দাম কখনই ১৫ হাজারের নিচে নামবেই না । ৫ বছর পরে বিক্রি করলেও ১৫ হাজারের নিচে সেলার দাম ঠিক করবে না । আসল সেলার হলে । অন্য দিকে যারা বাটপার তারা অস্বাভাবিক কম দাম রাখবে অথবা একটু দামাদামী করতেই আপনার পছন্দমত দামে রাজি হয়ে যাবে ।
আমার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা খেয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলো ওরা । শেষ পর্যন্ত পারে নি । তবে কুরিয়ার চার্য বাবদ যে টাকা আগে দিয়েছিলাম সেটা গেল । অল্পের উপর দিয়ে গেল ।
আবারও একবার শিক্ষা হল যে মানুষকে বিশ্বাস করা যাবে না । কোন ভাবেই অনলাইনের মানুষকে বিশ্বাস করা যাবে না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ৮:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




