somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামপন্থী রাজনীতির বয়ান এবং জামাতের গাজওয়াতুল হিন্দ-এর প্রস্তুতি

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও, ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শের বিপরীতে "গোরা" নামে একটি চরিত্র তৈরি করেন। গোরা খুব কট্টরপন্থী হিন্দু যুবক। হিন্দু পরিচয়ে বড় হলেও, আসলে সে আইরিশ দম্পতির সন্তান, কিন্তু এটা তার জানা নেই। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতে ব্রিটিশ বিরোধিতা ও স্বদেশপ্রেমের ধারনাগুলো তুলে ধরতেই রবীন্দ্রনাথ গোরাকে গোঁড়া হিন্দুর ভূমিকায় দাঁড় করান। তবে গোরার গোঁড়ামি ও গল্পের শেষে গোঁড়ামি মোচনের পেছনে ছিল রবীন্দ্রনাথের অসামান্য যুক্তিবোধ।

এখন বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কট্টর মুসলিম দৃষ্টিতে ভারতের আধিপত্যবিরোধিতা এবং স্বদেশপ্রেম অর্থ বহন করে কি না, তা যাচাইয়ের প্রয়োজন আছে। জামাতের পাকিস্তানপন্থি মতাদর্শ এত দুর্বল যে এগুলো আমার মতে, আলোচনার যোগ্যই নয়। মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে তারা সলিমুল্লাহ খান বা বদরুদ্দিন উমরের নামে উদ্ধৃতি দেয়, যেগুলোর অধিকাংশই মিথ্যা। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে জহির রায়হানের নামে গল্প বানায়। আবার ভারত বিরোধীতার নাম করে জগাখিচুড়ি মিলিয়ে কতগুলো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হাজির করে। যে ঘটনাগুলো ভারতীয় আধিপত্য হিসেবে আলোচনার কথা ছিল (যেমন: পানিবণ্টন চুক্তি, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্য ঘাটতি, সীমান্তে মাদক ব্যবসা এবং অসম বাণিজ্য চুক্তি ইত্যাদি), সেগুলো নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই। ভারতকে বিরাট শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করে "গাজওয়াতুল হিন্দ" নামে আজগুবি গল্প বানিয়ে ধর্মান্ধ মানুষকে উত্তেজিত করাই তাদের উদ্দেশ্য।

এ প্রসঙ্গে জামাতের আমির ডা. তাহেরের অক্টোবর মাসে নিউ ইয়র্কে প্রদত্ত ভাষণের কথা মনে করুন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে তারা গাজওয়াতুল হিন্দ-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাঁর দাবি, ভারতের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধে অন্তত ৫০ লাখ যুবক অংশ নেবে, যারা গেরিলা কৌশলে এবং বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তার এই ধরনের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় ভারতীয় আধিপত্য ঠেকাতে পাকিস্তান নামক একজন মুসলিম ত্রাণকর্তার দরকার হয়ে পড়ে।

প্রসঙ্গক্রমে ইসলামপন্থিদের কিছু যুক্তি এখানে আলোচনা করা প্রয়োজন। একটি যুক্তি হলো প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, উদীচী ও ছায়ানটের ওপর হামলাকে সাব-অল্টার্ন বা ক্ষমতাহীনদের জাগরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা। এই হামলা নাকি দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করা সেকুলার এলিটদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, যেটা বিস্ফোরিত হয়েছে। এই যুক্তি অনুযায়ী, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার আওয়ামী লীগের সময়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে সমর্থন ও বৈধতা দিয়েছিল। যেমন, শাপলা চত্বরের মতো রাষ্ট্রীয় হত্যার ঘটনায় তারা নীরব ছিল।

প্রথমত, হেফাজতকে সাব-অল্টার্ন বা ক্ষমতাহীন মানুষের রাজনীতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই তত্ত্বের প্রবক্তা বোধহয় ফরহাদ মজহার। তিনি বিভিন্নভাবে হেফাজতের রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এমনকি হেফাজতের উত্থানের সময় তাদের ১৩ দফার কোন কোনটি তার লেখা, এমনটা শোনা যায়। সাব-অল্টার্ন বলতে বোঝানো হয় সেই প্রান্তিক মানুষদের যারা খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী। যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই এবং যাদের কোন কথা বা দাবী দাওয়া রাষ্ট্রের কানে পৌঁছায় না। রাষ্ট্রের কোনো পরিকল্পনা বা আলোচনায় এই মানুষদের কখনো রাখা হয়না।

বাংলাদেশে ক্ষমতাহীন মানুষ কারা? দিনমজুর, রিকশাচালক, গার্মেন্টস কর্মী, কৃষক নাকি কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা। মানুষের যাকাত বা দানের টাকায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ও নেটওয়ার্কের অংশ যারা, তারা ক্ষমতাহীন নাকি তাদের চেয়েও নীচে আরেকটি যে শ্রেণি আছে, তারা? হেফাজতের কর্মীরা কি শ্রমিকের চেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী নয়? আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করুন, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা হয়তো প্রান্তিক, কিন্তু যখনই তারা রাজনীতির অংশ হয়ে গেল, তখন আর তারা ক্ষমতাহীন মানুষের দলে থাকল না। শাহবাগ অন্দোলনের মুখোমুখি তাদের দাঁড় করানো কি অভিজাত বনাম প্রান্তিক মানুষের সম্পদ ও ক্ষমতা বণ্টনের লড়াই, নাকি মিথ্যা তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে শাহবাগ অন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন বানিয়ে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর আস্তিক-নাস্তিকের কাল্পনিক দ্বন্দ?

শাপলা চত্বরের ঘটনা নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের অপরাধ। কিন্তু সেই ব্যর্থতাকে ব্যবহার করে পরবর্তী সব জঙ্গি সহিংসতাকে রাষ্ট্রীয় নাটক বলা, কদর্য রাজনৈতিক কৌশল। একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধের বিচার না হওয়া মানে, পরবর্তীতে তৈরি হওয়া কোন সহিংসতা বৈধ হয়ে যাওয়া নয়।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে জঙ্গি দমন নাটকের অংশ হিসেবে দেখানো ইসলামপন্থি শক্তিগুলোকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পরিকল্পনা। এটা সংবাদপত্রগুলোকে ভয় দেখানো যে, এ ধরনের রিপোর্ট করলে তোমাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হতে পারে। জঙ্গি ঘটনাগুলো আছে বলেই মিডিয়া এই নিয়ে খবর প্রচার করে। এখন মিডিয়াকে জঙ্গি ঘটনার কারণ বানানো মানে কারণ ও ফলাফল উল্টে দেওয়া।

গত কয়েক বছরে পিনাকী গং ইসলামপন্থিদের বুঝিয়েছে যে, ছায়ানট ও উদীচী হলো আওয়ামী সেকুলারিজম-এর প্রতীক। রবীন্দ্রসংগীত, পহেলা বৈশাখ পালন - এই সবকিছুই তাদের দৃষ্টিতে অপরাধ।

একইভাবে সহিংস ইসলামপন্থার সমালোচনাকে ইসলামবিদ্বেষ বা ওয়ার অন টেররের দোসর বলে চিহ্নিত করাও কারণ ও ফলাফলকে উল্টে দেওয়াই হলো। ওয়ার অন টেররের নামে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বোমাবর্ষণ ও সামরিক হামলা চালিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের দ্বারা পরিচালিত, এবং তারা সারা বিশ্বেই নৃশংসতা, আগ্রাসন ও দমনমূলক হস্তক্ষেপ চালিয়েছে।

এখন মার্কিনি আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে জঙ্গিবাদ এবং ইসলামের নামে সহিংসতাকে সমর্থন করা বা অস্বীকার করা যায় না। এই সমালোচনাকে ইসলামবিদ্বেষ বলার অর্থ ধর্মকে ঢাল বানিয়ে সহিংস রাজনীতিকে রক্ষা করা। যেটা উগ্রপন্থিরা করতে গিয়ে, সাধারন ধর্মপরায়ন মুসলিমদের দেশে এবং বিদেশে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৪১
১৩টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খাম্বার পরবর্তী অধ‍্যায় ,নাকি ১০% বদল হবে‼️অমি খোয়াব ভবনে ঘুমিয়ে , হাওয়া ভবনের আতঙ্কে আতঙ্কিত॥

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৮



খালেদা জিয়ার অসুস্থতার নাটক ছিল তারেক জিয়ার দেশে ফেরার রাজনৈতিক ট্রাম্পকার্ড। কথায় আছে,' দুষ্টু লোকের মিষ্টি ভাষা '। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দূর্নীতিবাজ ও মাফিয়া গডফাদার তারেক রহমানের দেশে ফেরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদার ১টি প্ল্যান ছিলো, মহা-ডাকাতের ১টি প্ল্যান আছে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:২৩



২০১৪ সালের ভোটের আগে খালাদা বলেছিলো যে, তার কাছে ১টা প্ল্যান আছে, যা ১ বছরের মাঝে বেকার সমস্যা ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে দিবে। তিনি প্ল্যানটি প্রকাশ করেননি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোর কথা তুই লিখে সত‍্যতা প্রমান কর।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৪১



ব্লগ মনে হয় কারো কারো বাপ দাদার জমিদারি হয়ে গেছে। সব পোস্ট দালাল , রাজাকার, জঙ্গিদের অথবা লালবদরদের স্বপক্ষে হোতে হবে। সত‍্যের আগমনে মিথ্যা বিস্মৃতির অবসান হয় ।আদর্শের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে গুমের ঘটনা: শেখ হাসিনার শাসনকালের একটি কালো অধ্যায়

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৯

বাংলাদেশে গুমের ঘটনা: শেখ হাসিনার শাসনকালের একটি কালো অধ্যায়

গুমের শিকার ব্যক্তিদের অতি ক্ষুদ্র কক্ষের ছবিটি বিবিসি ডটকম থেকে নেওয়া।

পরিচিতি

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামপন্থী রাজনীতির বয়ান এবং জামাতের গাজওয়াতুল হিন্দ-এর প্রস্তুতি

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০


গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও, ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শের বিপরীতে "গোরা" নামে একটি চরিত্র তৈরি করেন। গোরা খুব কট্টরপন্থী হিন্দু যুবক। হিন্দু পরিচয়ে বড় হলেও, আসলে সে আইরিশ দম্পতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

×