somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশে ইহুদী ইতিহাস

২৫ শে অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ১২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের দেশী লোকজনদের যদি প্রশ্ন করা হয় যে কয়জন ইহুদী ধর্মের মানুষের সাথে আপনার পরিচয় হয়েছে, তাহলে সেই প্রশ্নের জবাবে কয়জন যে 'হ্যা' বলবে সেটা বলা মুস্কিল । যারা কোন দিন বাংলাদেশের বাইরে যায় নি, তারা বোধ করি কেউই হ্যা বলবে না । তবে হ্যা, যারা ইন্ডিয়া সহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমন বা কাজ করেন, তারা হ্যা বলতে পারেন ।

আমাদের দেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান বাদে অন্যান্য ধর্মের মানুষ থাকলেও ইহুদী খুজে পাওয়া যাবে না একদম । যদিও ধারণা করা হয় যে এখনও আমাদের দেশে কয়েকজন ইহুদী বসবাস করেন । সংখ্যায় তারা অনেক কম এবং নিজেদের আসল পরিচয় গোপন করেই এখানে বসবাস করেন । কারণটা বুঝতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না ।

বাংলাদেশে ইহুদীদের ইতিহাস খুজতে লেগে খুব বেশি তথ্য খুজে পাওয়া যাবে না । অনলাইনে তো আরো কম তথ্য রয়েছে । যা রয়েছে তার সব গুলোতেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মুলত একই কথা লেখা । বাংলাদেশের ইহুদী কমিউনিটির সাথে যে নামটি সবার আগে যুক্ত সেটি হচ্ছে শ্যালোম কোয়েন । তার জন্ম ১৭৬২ সালে । তিনি ছিলেন বাগদাদী ইহুদী। মূলত তিনি প্রথম এই উপমহাদেশে ইহুদীদের কমিউটিনি চালু করেন । ১৭৯৮ সালে তিনি ইন্ডিয়ার সুরাটে বিয়ে করেন । তিনি ব্যবসার কাজে ঢাকাতে আসেন । এবং এখানে ব্যবসা শুরু করেন । মূলত তিনি কাপড় রেশম আর মসলিনের ব্যবসা করতেন । সেই সময়ে ইউরোপে মসলিন কাপড়ের খুব চাহিদা ছিল । তার কয়েকজন ইহুদী কর্মচারি এখানে রেখে যান ঢাকাতে ব্যবসার কাজে।
১৮১৭ সালে কোয়েনের বড় মেয়ের বিয়ে হয় জনৈক ব্যবসায়ী মোজেস ডিউকের সাথে । মোসেজ পরিবারসহ ঢাকাতে আসে ব্যবসার জন্য । পরিবারটি ঢাকাতে পাঁচ বছর বসবাস করে । এই সময়ে মোজেস ঢাকাতে একটা প্রার্থনা হলও প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তান সরকারের আমলে এই প্রার্থনা হলটি সরকারি করন করা হয় বলে শোনা যায় । এর পরবর্তি সময়ে অনেকে ইহুদী পরিবার ঢাকাতে বসবাস করতে এসেছে যদিও তার প্রধান কারণ ছিল ব্যবসা । ব্যবসার মুল কেন্দ্র ছিল কলকাতায় । এবং ঢাকাতে তার শাখা স্থাপন করা হয়েছিলো ।

দেশ ভাগের সময় ইন্ডিয়াতে বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গে মোটামুটি চার হাজার ইহুদীর বসবাস ছিল যার বেশিভাগই ছিল কলকাতায় । অন্য দিকে পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩৫ ।
এই সময়ে ঢাকাতে থাকা বেশ পরিবার গুলো মূলত ছিল ব্যবসায়ী । তবে এদের মাঝে কেউ কেউ হোটেল রেস্তোরাও চালাতো । বলা হয়ে থাকে ঢাকাতে বনেদী রেস্তোরা গুলোর সুত্রপাত এই ইহুদীদের হাত ধরেই । গুলিস্তান এলাকার হোটেল রিজ কয়েকজন ইহুদী মিলে তৈরি করে। সেই সময়ে ঢাকাতে ভাল রেস্তোরা না থাকার কারণে সরকারি বেসরকারি নানান অনুষ্ঠান এই হোটেল গুলোতে আয়োজিত হত । হোটেল রিজে কবি সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু এসেছেন ১৯৫০ সালে।

ষাটের দশকে বাংলাদের কয়েকটি ইহুদী পরিবার এদেশে বসবাস করতো । তবে ক্রমেই তারা এদেশ ছেড়ে ইসরায়েল, আমেরিকা এবং বিশেষ করে ইন্ডিয়াতে চলে যায় । স্বাধীনতার পরে দুটি পরিবার বাংলাদেশে ছিল বলে জানা যায় তবে পরিবার দুটির একটি ১৯৭৩ সালে এবং অন্যটি ১৯৭৫ সালে ভারতে চলে যায় । এছাড়া ''ঢাকাই কথা ও কিচ্ছা'' বইয়ের তথ্য অনুসারে এখনও ঢাকতে দুইটি শরও কম ইহুদী পরিবার বসবাস করেন । আবার ২০১৮ সালে ফরেন পলিসি ব্লগে প্রকাশিত এক পোস্ট থেকে জানা যায় যে ঢাকায় এখনো চারজন ইহুদি বসবাস করছেন, তবে নিজের পরিচয় গোপন করে। যদিও এই দাবির পক্ষে জোরালো তথ্য নেই ।

এছাড়া আরেকটি অসমর্থিত সুত্র বলে যে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আরেকটি ইহুদী পরিবার বসবাস করতো । জোসেফ এডওয়ার্ডের জন্ম চট্টগ্রামে। ১৯৮৬ সালে সে কানাডায় পাড়ি জমায়। তারা বাবা রাহামিম ডেভিড বারুক ও চাচা এজরা বারুকের জন্ম কলকাতায় । পরে তারা চট্রগ্রাম চলে আসেন এবং নিজেদের পদবী বলতে এডওয়ার্ড রাখেন । তারা জাহাজ শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন । রাহামিম বিয়ে করেন এক ক্যাথলিক মেয়েকে এবং চাচা এজরা বিয়ে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এক চাকমা রাজকন্যাকে। বর্তমানে তাদের আত্মীয় স্বজনেরা কানাডা আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছে।
এছাড়া ইহুদী বংশভুক্ত দুটি পরিবার এখনও ঢাকাতে বসবাস করছে। তারা অবশ্য এখন আর ইহুদী নেই । তারা স্থানীদের সাথে বিয়ে করে ক্যাথলিক ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে।


বাংলাদেশে ইহুদীদের খোজ করতে গেলে যে নামটি সবার আগে উঠে আসে সেটি হচ্ছে মর্ডিকাই হাইম কোহেন । তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ঘোষক এবং প্রথম সংবাদ পাঠক । মা কলকাতার ইহুদী হওয়ার কারণে মর্ডির জন্ম হয়েছিলো কলতাকায়।

তবে তার বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে । সেই সময়ে সকলেই মর্ডির বাবাকে চিনতো । তার বাবার ছিল সাইকেল রিক্সার দোকান । সেই সময়ে রাজশাহী মূলত সাইকেল রিক্সার শহর ছিল । মর্ডি প্রথমে রাজশাহীর এক রেডিও স্টেশনে যোগদান করেন । পরে তিনি ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংবাদ পাঠক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন । বাংলা ইংরেজি আর উর্দু, তিন ভাষাতেই তিনি সংবাদ পাঠ করতেন । এছাড়া তিনি সেই সময়ে অভিনয়ও করেছেন নানান মুভিতে । খান আতাউর রহমান পরিচালিত সিরাজদ্দৌলা মুভিতে ফরাসি সেনাপতির চরিত্রে সে অভিনয় করেন। ১৯৬৭ সালে আরব ইসজারেল যুদ্ধ শুরু হলে তার এই দেশে থাকা কিছুটা কঠিন হয়ে ওঠে । ১৯৬৮ সালে তিনি পরিবারসহ কলকাতায় চলে যান । এবং সেখানেই ২০১৫ সালে মারা যান । ২০১৪ সালে বিটিভির সূবর্ণ জয়ন্তিতে তাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয় । তখন শেষবারের মত বাংলাদেশে আসেন । বাংলাদেশ থেকে চলে গেলেও বাংলাদেশের স্মৃতি তিনি সব সময় বুকে আগলে রাখতেন । তিনি নিজেকে সব সময় ''বারেন্দ্র জু'' বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন । এছাড়া তার মামা তৎকালীন ইন্ডিয়ান আর্মির জেনারেল জ্যাবকের সাথে তো আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস জড়িয়ে আছে ।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে আরেকজন ইহুদীর নাম জড়িয়েছে । তার নাম অ্যালেক্স অ্যারনসন । তার জন্ম হয়েছিলো জার্মানীতে । তিনি শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতেন এবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন । যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার তাকে জার্মানীর গুপ্তচর হিসাবে সন্দেহ করে গৃহবন্দী করে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মুক্তির জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেও সেই অনুরোধ রাখা হয়নি । ১৯৪১ সালে অ্যালেক্স অ্যারনসন ঢাকাতে আসে এবং নবাব নাজিমুদ্দিনের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন । আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পি জি হার্টগ ছিলেন ইহুদী পরিবারের সন্তান । বাংলাদেশের নামের সাথে আরেক বিখ্যাত ইহুদীর নাম জড়িতো । তিনি হলেন লুই আই কান । আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের আর্কিটেক্ট ছিলেন তিনি ।

বাংলাদেশে ইহুদীদের একটি রহস্যময় ক্লাবের সন্ধান পাওয়া যায় । নাম ''ফ্রিম্যাসন্স হল-১৯১০''। এটি পুরাতন পল্টনে অবস্থিত।



রিচার্ডসন বেনেটের বই হতে জানা যায় যে এটি মূলত সেই সময়ে ঢাকাতে বসবাসকারী ইহুদীদের একটি ক্লাব ছিল । তারা সেখানে অবসরে মিলিত হতেন আড্ডা দিতেন । তবে বর্তমানে ওই ভবনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অনলাইনে থাকা আর্টিকেল পড়ে মোটামুটি বাংলাদেশের ইহুদীদের সম্পর্কে এই তথ্য জানতে পারলেন । যাই হোক আরেকটা তথ্য দিয়ে লেখা শেষ করি । আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ১৯৭১ সালের ৭ই ডিসেম্বর ইজরাইল বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ।

ব্লগে ফিচার প্রতিযোগিতার সময় ব্লগে আরইউ এই ফিচারটি লেখার জন্য আমাকে বলেছিল । সেই সময়ে কিছু রিসার্চ করে লিখে রেখেছিলাম । আজকে পুরোটুকু লিখে শেষ করলাম ।


তথ্য সুত্রঃ
The extraordinary story of the Bangladesh Jews
History of the Jews in Bangladesh
The Unknown Jews of Bangladesh: Fragments of an Elusive Community
The silent Jewish population in Bangladesh
ঢাকায় ইহুদিদের রহস্যময় ক্লাব
ইহুদীরাও ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে
বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া ইহুদি পরিবার

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ১:০০
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×