আপনারা জেনে অবাক হবেন যে আমাদের বর্তমান সরকার ঢাকার যান চলাচল উন্নত করতে ১৩৫০০০ কোটি টাকা খরচ করেছে । সামনে আরো করবে আশা রাখা যায় । কিন্তু এতো এতো উন্নয়ের ফলে ঢাকার যান চলাচলের অবস্থার তো কোন উন্নয়ন হয়ই নি, বরং ঢাকা এখন পৃথিবীর সব থেকে ধীর গতির শহরে পরিণত হয়েছে । ২০০৭ সালে ঢাকা শহরের গড় গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২১ কিলোমিটার আর এতো এতো উন্নয়নের ফলে ২০২৩ এসে সেটা ঘন্টার ৪.৮ কিলোমমিটারে ঠেকেছে ! আপনাদের বলে রাখি যে মানুষের হাটার গড় গতি ঘন্টার ৬ কিলোমিটার ।
যাইহোক, এখন এখন কী করা যাবে বলেন ! তবে কিছুই যে একেবারে করার নেই সেটাও কিন্তু না । কেবল তো উন্নয়ের আশায় বসে থাকলে চলবে না।
আমি চুয়াডাঙ্গাতে থাকতে আজীবন সাইকেলই চালিয়েছি । স্কুল কলেজ সব স্থানেই সাইকেল নিয়ে গিয়েছি । ঢাকাতে আসার পরে পড়লাম বেশ বিপদে । বাসে চড়তে বিশেষ করে ভীড়ওয়ালা বাসে চড়তে বেশ কষ্ট হত । আর জ্যামের কথা তো বাদই দিলাম । তখন আসলে খুব চাইতাম সাইকেল চালাতে । কিন্তু এতো এতো গাড়িঘোড়ার ভীড়ে ভয় লাগতো একটু । তারপরেও একবার চেষ্টা করেছিলাম । এবং সেদিনই বাসের সাথে আমার সাইকেলের ধাক্কা লাগে । এবং আমার মনে ভয়টা আরো বেশি পাকাপক্ষ হয় । তারপর অনেক দিন সাইকেলে চালানোর কথা মাথায় আসে নি । কিন্তু তারপর আবার একদিন মনে হল যে সাহস করে আরেকবার চেষ্টা করাই যাক । এবার আরেকটু সাবধান হওয়া যাক !
এক বানিজ্য মেলা থেকে দুরন্তের একটা সাইকেল কিনে ফেললাম । দামটা এগারো হাজারের মত নিল । এই সাইকেল নিয়ে আমি খুব সাবধানে যাতায়াত শুরু করলাম । সেই সময়ে একেবারেই আমি প্রধান প্রধান সড়কে বিশেষ করে যে সড়কে বাস চলে সেগুলোতে চলতাম না । গলির ভেতর ভেতর দিয়ে চলতাম । যেমন মগবাজার যাওয়ার জন্য আমি লাল মাটিয়ার ভেতর দিয়ে ধানমন্ডির দিকে যেতাম । তারপর মিরপুর রোড টা ক্রস করে চলে যেতাম গ্রিন রোডের দিকে তারপর পরিবাগ ! এভাবে ভেতর ভেতর দিকে চলতাম । তবে এক সময়ে সেই ভয় কেটে গেল ! আমি নির্ভয়ে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম ! এবার আসি এই সাইকেল চালানোর ফলে আমার জীবনে কী কী লাভ হল সেটা আপনাদের বলি !
আমি তখন মগবাজারে তিনটা টিউশনি করতাম । ঘুরে ফিলে সপ্তাহে ছয়দিন আমাকে যেতে হত মগবাজার ! আমার গল্পের বেশির ভাগ বিয়ে গুলো হত মগবাজারে । এখান থেকেইআসলে সুত্রপাত ! যাই হোক, বাস ভাড়া ছিল ২০ টাকা । যাওয়া আসা ৪০ টাকা । এবং এক টিউশনি থেকে অন্য টিউশনিতে যাওয়ার জন্য আবার মাঝে ৩০/৪০ টাকা রিক্সা ভাড়া লাগতো । তার মানে হচ্ছে প্রতিদিন আমার পকেট থেকে ৭০ টাকা খরচ হত এই যাতায়াত বাবদ । এটা এড়ানোর কোন উপায় আমার কাছে ছিল না । কিন্তু আমার সাইকেল কেনার ফলে এই টাকাটা পুরোটা সেফ হল । মাসের হিসাবে সেটা ১৭শ টাকার বেশি ।
আমি সাইকেল কিনেছিলাম জানুয়ারিতে এবং সেটা ডিসেম্বরে বিক্রি করে দিই । এই পুরো সময়ে আমার এই সাইকেল চালানোর জন্য আমার পকেট থেকে ১৭ হাজার টাকার কম খরচ হয়েছে । আমার সাইকেলের দাম ছিল ১১ হাজার !
এটা তো গেল আর্থিক লাভ । এটা বলা যায় সব থেকে ছোট লাভ ! সব থেকে বড় সে ফলটা আমি পেয়েছি তা হচ্ছে সময় ! আগে আমার যেখানে সময় লাগতো দেড় থেকে দুই ঘন্টা সেখানে আমার সময় কমে এল আধা ঘন্টায় । ৩০ মিনিট থেকে ৪০ মিনিট । যদি খুব বেশি জ্যাম থাকে । তবে আমি ওলিগলির রাস্তা দিয়ে গেলে জ্যামে পড়ি কম । আগে যেখানে আমাকে ছয়টার টিউশনি ধরতে চারটার সময় বাসা থেকে বের হত সেখানে আমি ৫টা পনেরোর সময়ই বের হতে পারছি । ধীরে সুস্থ হেলতে দুলতে !
ঢাকার বাস গুলোতে আপনারা যারা চড়েছেন তারা জানেন কী এক ভয়ংকর অবস্থা সেখানে । আমাকে সেই চাপাচাপির ভেতরে আর যেতে হয় না, বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না কিংবা যুদ্ধ করে বাসে উঠতে হয় না । সকালে যারা অফিসে যাওয়ার সময় দেখি মানুষজন ফার্মগেটে তীর্থের কাকের মত বাসের জন্য অপেক্ষা করে আছে, একটা বাস এলে সেখানে হুড়মুড় করে ওঠার চেষ্টা করছে আমি তাদের দিকে তাকিয়ে আড়াম করে এগিয়ে যাই সামনের দিকে !
এরপর আরেকটা ব্যাপার আছে । এই যেমন হরতাল অবরোধের সময় যখন সব পরিবহন বন্ধ আমাকে তখন চিন্তা করতে হয় না এসবের । এছাড়া বাস ভাঙ্গচুর কিংবা বাসের আগুনের ভয় থেকেও আমি মুক্ত ।
তবে হ্যা সাইকেল চালানোর অভ্যাস যদি তৈরি হয়ে যায় তখন একটা বিপদে আপনাকে পড়তে হবে । আপনি তখন আর বাসে কিংবা রিক্সাতে চড়তে পারবেন না । যখন বাস গুলো থেমে থেমে যাবে কিংবা রিক্সা আস্তে যাবে আপনার মন মেজাজ চরম খারাপ হয়ে উঠছে । সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে যা এখন আমি অনুভব করি যদি কোন কারণে আমাকে বাসে বা রিক্সাতে চড়তে হয় ।
এখন প্রচুর মানুষ সাইকেল চালায় । আমার সাথে অফিসের একটা ছেলে আছে । থাকে ঢাকা উদ্যান । শান্তিনগরে বাসে করে যেতে কম করে হলেও আড়াই তিন ঘন্টা লাগবে যেখান ওর সাথে ৩০/৪০ মিনিট । ও খুব দ্রুত সাইকেল চালায় !
এছাড়া সাইকেল চালানোর আরেকটা সমস্যা রয়েছে। সাইকেল চুরি । যদি বাসায় বা অফিসে সাইকেল রাখার ভাল ব্যবস্থা না থাকে তাহলে এটা চুরির সম্ভবনা রয়েছে খুব বেশি । আপনি যত ভাল তালাই লাগান না কেন সেটা আপনার সাইকেলকে কোন ভাবেই রক্ষা করতে পারবে না যদি সাইকেল পাহাড়ার ব্যবস্থা মানে গ্যারেজে দারোয়ানের ব্যবস্থা না থাকে !
যাই হোক যা বলছিলাম, ঘন্টার পর ঘন্টা এভাবে সময় নষ্ট না করে আজই সাইকেল কিনে ফেলুন । যদি দূরত্ব ১০/১২ কিলোমিটারও হয় তবুও সাইকেল চালানো ভাল । একবার সাইকেল চালানো শুরু করলে আপনি এর আসল মজা বুঝতে পারবেন ।
ছবি নেট
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:০৫