ধরুন, আপনি জানতে পারলেন যে আপনার দেশের সরকার দেশের নিরাপত্তার অযুহাতে দেশের সকল নাগরিকের ফো ল্যাপটপে আড়ি পাতে । আড়ি পাতে বলতে আপনি ফোনে কার সাথে কথা বলেন, কী কথা বলেন কী ছবি পাঠান কাকে পাঠান সে সব কিছু সরকার দেখতে পায় । এবং আপনার ফোনের ক্যামেরার মাধ্যমে আপনার সকল কর্ম কান্ডের উপরে ২৪ ঘন্টা নজর রাখতে পারে তারা !
ভাবুন একবার ব্যাপারটা !
এমন ঘটনাই আমেরিকাতে ঘটেছিল । নাইন ইলেভেনের হামলার পরে মার্কিন সরকার দেশ এবং দেশের বাইরের মানুষহের সাইবার স্পেস গুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিতে শুরু করে । কেবল প্রতিপক্ষ দেশ, রাজনীতিবিদই নয়, তারা সাধারণ মানুষদের একেবারে ব্যক্তিগত জীবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে । কে কার কাসে কী নিয়ে কথা বলছে কী করছে সেই সব কিছুর উপর তারা নজরদারী শুরু করে । এবং এটা করে জন সাধারণকে না জানিয়েই ।
ঠিক এই ব্যাপারটাই পছন্দ হয় নি এডওয়ার্ড স্নোডেনের । এই গোপন নজরদারীর ব্যাপারটা পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসে ! এটা নিয়ে একটা মুভি বের হয়েছে । মূলত আসল কাহিনীর উপর ভিত্তি করে মুভিটি তৈরি করা হয়েছে !
আগে আমরা স্নোডেনের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানি । স্নোডেনের জন্ম নর্থ কেরোলিনা রাজ্যে । তার পরিবারের সাথে মিলিটারি কানেকশন অনেক পুরানো । তারা দাদা বাবা সবাই এই পেশার সাথে যুক্ত । ছোট বেলা থেকে তাই স্নোডেনের ইচ্ছে ছিল মিলিটারিতে যোগ দেওয়া । তবে ছোট একটা দুর্ঘটনাতে স্নোডেনের সেই স্বপ্ন নষ্ট হয়ে । মিলিটারি থেকে ছিটকে পড়ে সে ।
এরপর সে ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রিসার্স ফার্মের সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নেয় । মূলত এটি আমেরিকার এনএসএর একটি কাভার প্রোগ্রাম ছিল । এরপর স্নোডেন ২০০৬ সালে সিআইএর সাথে কাজ করা শুরু করে । তার কোন আনুষ্ঠানিক কোন ডিগ্রি না থাকলেও কম্পিউটারের উপরে তার ছিল সহজাত দক্ষতা । সে সিআইএ ট্রেনিংয়ের সব পরীক্ষা একের পর সফলতার পার করে । মুভিতে এই এই ব্যাপারটা খুব চমৎকার ভাবে দেখানো হয়েছে ।
ট্রেনিং শেষ করার পরে স্নোডেনকে পাঠানো হয় জেনোভাতে কূটনৈতিক হিসাবে । তবে সেখানে তার মূল কাজ ছিল সিআইয়ের সাইবার সিকিউরিটি দেখা শোনা করার জন্য । এরপর সে জানতে পারে এক্সকিস্কোর নামে এক প্রোগ্রামের কথা । এই প্রোগ্রাম মূলত ছিল সাধারণ মানুষের বব্যাপারে সব খোজ খবর জানার একটা প্রোগ্রাম। এর মাধ্যমে যে কারো ইমেল পড়া যেত, চ্যাট ফোনকল সব শোনা যেত। ওয়েবে কে কী সার্চ করতে কে কী বলছে এমন কি সেটা যদি ব্যক্তিগত মেসেজেও হয় তবুও এই সার্চইঞ্জিতে উঠে আসতো ! এক্সকীস্কোর নিয়ে উইকির এই পেইজটা পড়ে আসতে পারেন ! উইকি থেকে কয়েকটা লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি কেবল । !
বিশ্বের যে কোন ব্যক্তি যারই একটা ইমেল এড্রেস আছে, তার ইমেল আপনি পড়তে পারবেন । ইমেলটা কোথা থেকে পাঠানো হচ্ছে আর কোথায় যাচ্ছে সেটাও জানতে পারবেন। যে কেউ কোন কম্পিউটারের সামনে বসলে আপনি তাকে দেখতে পারবেন । যে ল্যাপটপটি আপনি ট্রাক করছেন তার সকল গতিবিধি আপনি জানতে পারবেন । ....
বুঝতেই পারছেন সাধারন জনগন কোন ভাবেই নিরাপদ ছিল না । এটাই মূলত স্নোডেনের মূল্যবোধে বিপরীত ছিল । সে তাই সিআইএর থেকে ইস্তফা দেয় । এরপর সে যোগ দেয় এনএসএতে । তাকে জাপানে পাঠানো হয় এনএসএ এবং সিআইএর ভেতরে একটা সমন্বয় প্রোগ্রাম তৈরি করতে। জাপানে এনএসএতে হেডকোয়াটারে স্নোডেন এপিক সেল্টার নামে একটা প্রোগ্রাম তৈরি করে যেখানে আমেরিকার হয়ে সব ডাটার ব্যাকআপ রাখার তৈরি করা হয়েছিলো । তবে এক সময়ে সে মূলত বুঝতে পারে সে এখানেও সেই একই কাজ করা হচ্ছে । এখানে এসে স্নোডেন দেখতে পায় যে মার্কিন সরকার কেবল নিজের দেশেই নয় বরং তাবৎ দুনিয়ার মানুষের উপরে নজর রাখতে । এদের ভেতরে যেমন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যামেরন রয়েছে ঠিক তেমন নি ভাবে রয়েছে জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল । মূলত তখন মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ এমন এক ম্যালওয়্যার প্রোগ্রাম তৈরি করছিলো যেটা দিয়ে কিনা যে কোন দেশের যে কোন সাইবার সেক্টর বিকল করে দেওয়া সম্ভব ।
স্নোডেন আবারও কাজের থেকে ইস্তফা দেয়। এরপর ২০১১ সালে সে আবার সিআইতে যোগ দেয় ডেলের হয়ে প্রাইভেট সাব-কন্ট্রাক্টর হিসাবে । এবার তাকে পাঠানো ওয়াহুতে । সেখানে এসে তার পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা যায় । এখানে এসে স্নোডেন খেয়াল করে তারই বানানো এপিক সেল্টার প্রোগ্রাম আরো ভয়ংকর ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে । সে তখন সিদ্ধান্ত নেয় যে এই পুরো গোপন ব্যাপারটা সে তুলে ধরবে জনসাধারণের উপরে । তবে এই সব তথ্য সে কিভাবে বাইরে নিয়ে আসবে । তার কর্মস্থলে প্রবেশ এবং বের হওয়ার গেট দিয়ে কোন কর্মী কোন মাইক্রো চিপ পর্যন্ত বাইরে নিয়ে যেতে পারতো না। স্কেনে সব ধরা পরে যাবে তা যেখানেই লুকানো হোক না কেন !
মুভিতে এই ব্যাপারটা খুব চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো । সে তার সকল তথ্য একটা মেমোরিকার্ডে কপি করে নিল । তারপর সেটা একটা রুবিসকিউবের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল । যখন যে স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই সে তার রুবিসকিউবটা সিকিউরিটি গার্ডের দিকে ছুড়ে দিল । সিকিউরিটি সেটা ঘুরাতে ঘুরাতে স্ক্যানের বাইরে দিয়ে নিয়ে গেল । এদিকে স্নোডেন গেটের ভেতর দিয়ে বের হয়ে গেল । কোন কিছু ধরা পরলো না । সে সব ডাটা নিয়ে বের হয়ে এল । এভাবেই মার্কিন সব গোপন তথ্য তাদের অফিস থেকে বের হয়ে এল ।
এরপর সে হংকং এ চলে আসে শারীরিক চিকিৎসার অযুহাতে । সেখান থেকেই সে কোডেড ম্যাসেজের মাধ্যমে আমেরিকা একজন আমেরিকার সাংবাদিক এবং একজন ডকিউমেন্টারি ফিল্ম মেকারের সাথে যোগাযোগ করে । তারা হংকং এ হাজির হয় স্নোডেনের সাথে দেখা করতে । এরপর আসে ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকার একজন সাংবাদিক । চারপাঁচদিন ধরে ডকিউমেন্টারি তৈরি হয় সেই হোটেল রুমে বসেই। তাদের হাতে সকল তথ্য তুলে দেয় স্নোডেন ।
গার্ডিয়ান পত্রিকাতে সেই সংবাদ সিরিজ আকারে প্রকাশিত শুরু করে।
কিভাবে আমেরিকার সরকার নাগরিক ফোন নম্বর যোগার করছে, কিভাবে ফেসবুক এপেল গুগল কোম্পানি গুলোর কাছ থেকে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য জোর করেই নিচ্ছে ।
সংবাদ গুলোর লিংক দিলাম নিচে ।
NSA Prism program taps in to user data of Apple, Google and others
NSA's Prism surveillance program: how it works and what it can do
Microsoft handed the NSA access to encrypted messages
পুরো বিশ্ব যেন নড়ে উঠলো । এই সংবাদ গুলোর প্রকাশের পরে স্নোডেন নিজের চেহারা প্রকাশ করে একটা ছোট ভিডিও ডকিউমেন্টারি বের করলো । সবাই স্নোডেনের চেহারা দেখে ফেলল । সবাই বলতে মার্কিন সরকারও । মার্কিন সরকার তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করলো ।
হংকংয়ের হোটেল থেকে স্নোডেন পালিয়ে গেল । তার প্লান ছিল সে রাশিয়া হয়ে ইকুয়েডর যাবে । সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করবে । কিন্তু স্নোডেন যখন মস্কোতে পৌছালো তখন মার্কিন সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করে দিল । মস্কোর এয়ারপোর্টে সে প্রায় দেড়মাস আটকে ছিল । এরপর পুতিন সরকার তাকে এক বছরের ভিসা দেয় । সেই ভিসা পরে তিন বছর বাড়ানো হয় । এরপর এক সময়ে সে রাশিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে যায় । এখন সে তার বউ এবং সন্তানের সাথে রাশিয়াতেই রয়েছে ।
অবশ্য সে আমেরিকাতে ফেরৎ যেতে চেয়েছিল তবে তার শর্ত ছিল যেন তার বিচার কার্য নিরোপেক্ষ ভাবে করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয় । তবে সেই নিশ্চয়তা সে পায় নি । তার ফেরৎ যাওয়াও আর হয়ে ওঠে নি ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্নোডেন যা করেছে তা ভাল ছিল নাকি খারাপ ? সে কি দেশদ্রোহী নাকি হিরো?
আমার কাছে তার কাজ জাস্টিফাইড !
সিকিউরিটি বা টেরোরিজমের দোহাই দিয়ে সরকারের কোন অধিকার নেই সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে আড়ি পাড়া, ব্যক্তিগত ছবি ভিডিও দেখা ফোনালাপ শোনা ! কোন অধিকার নেই ।
ইউটিবে একটা পুরো ডকিউমেন্টারি আছে । দেখতে পারেন ! পোস্ট লেখায় ভিডিও গুলোর সাহায্য নিয়েছি।
Edward Snowden - Full Documentary
NSA
Edward Snowden
এছাড়া আরো কয়েকটা আর্টিকেল পড়তে পারেন। এই আর্টিকেলের কিছু পড়েছি।
Edward Snowden: the whistleblower behind the NSA surveillance revelations
Edward Snowden
Wiki - Edward Snowden
আর সব না পড়তে চাইলে এই কাহিনীর উপরে বেজ করেই একটা মুভি আছে । সেটা দেখতে পারেন ।
মুভির ট্রেইলার মুভিটা নেটফ্লিক্সে আছে। সেখান থেকে দেখে নিতে পারেন। মূলত এই মুভিটা দেখার পরেই আমি পোস্টটা লিখতে বসেছি ।
পিক সোর্স
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৩:২৩