আমার জীবনে আমি সরাসরি প্রাকৃতিক দূর্যোগের ভেতরে পড়েছি বলে আমার মনে পড়ে না । ২০১৯ সালের ঘটনা। ঘূর্ণিঝড়ের নাম সেবার ছিল সম্ভবত বুলবুল ! সেটা যখন আসছিল তখন আমি ছিলাম সুন্দরবনে । আমাদের লঞ্চ যখন করমজল পার করল তখনই নির্দেশ এল যে ঘুর্ণিঝড় আসছে । সব লঞ্চকে ফেরৎ যেতে হবে । আমরা অবশ্য ফেরৎ গেলাম না । রাতে সুন্দরবনের এক খালের ভেতরে ঢুকে পড়লাম । তবে তখনও ঝড় আসে নি । পথে রয়েছে । পানি তখনও শান্ত । তবে মনের ভেতরে একটা ভয় ঠিকই ছিল। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন দেখি আমাদের লঞ্চ তীব্র বেগে ছুটে চলছে খুলনার দিকে । বাকি ট্যুর সেখানেই শেষ । বাকি দিন গুলো আমরা খুলনা লঞ্চঘাটেই পার করলাম । ঝড়ের সাথে এটাই আমার সব থেকে কাছের এনকাউন্টার ।
আমার বাড়ি দেশের সব থেকে উচু স্থানে । ৮৮ কিংবা ৯৮ সালের বন্যাতে যেখানে দেশের প্রায় সব অঞ্চলে ডুবে গিয়েছিলো, সেখানে আমাদের হোম টাউনে ডুবে নি । যদিও ৮৮র কথা আমার দেখার কথা না তবে ৯৮ সালে নিজের চোখেই দেখা । প্রতিদিন বিটিভিতে আমরা দেখতে সারা দেশ কিভাবে পানিতে ডুবে গেছে কিন্তু আমাদের এলাকাতে কোন পানি নাই ।
প্রতিবার যখন কোন ঘুর্ণিঝড় আসে আমি সব সময়ই নিরাপদই থেকেছি । মজবুত নিরাপদ বাসস্থানের ভেতরে কেবল শো শো আওয়াজই শুনেছি । আমাদের সিড়িঘড়ের কাঁচ প্রায়ই খুলে ভেঙ্গে যেত । সেগুলো সময় মত ঠিক করানো হত না । এমন যদি কোন ঝড় আসতো তাহলে সেই কাঁচ দিয়ে বৃষ্টির পানি নামতো । সেটা যদিও ঘরে ঢুকত না । কেবল সিড়ঘর ভিজিতে দিত ।
একেবারে যখন ছোট তখন বেশ কিছুদিন আমরা যশোরে ছিলাম বাবার কাজের কারণে । আমাদের ভাড়ার বাসা গুলোর ভেতরে একটা ছিল টিনের ঘর । যখন বর্যায় বৃষ্টি আসতো তখন সেই টিনের ফুটো দিয়ে পানি পড়ত । আমরা সেই ফুটোর স্থানে কোন বালতি বা হাড়ি বসিয়ে দিতাম । সেই পানি পড়া দেখলেও মজা লাগতো !
তখন স্কুলে পড়ি। আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে রাস্তার ওপাশে কয়েকটা মাটির ঘর ছিল । এক ঝড়ের দিনে সেই মাটির ঘরের টিন উড়ে গেল । সব থেকে কাছের বাড়ি আমাদেরটাই । সেখানকার বাসিন্দরা তাদের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে দৌড়ে আমাদের সিড়িঘরের নিচে এল । এভাবে বেশ কয়েক দফায় তাদের ঘরের কিছু জিনিসপত্র আমাদের সিড়িঘরের নিচে এনে রাখল । মা গেট খুলে দিলেন । সেখানেই ওরা রাত ভর থাকল বসে । আমি বসে বসে তাদের দেখছিলাম। তাদের মনে অবস্থা আমি তখন বুঝতে পারি নি । কিংবা বোঝার চেষ্টাও করি নি । সেই বয়সই ছিল না।
আমার দাদা বাড়িতে আগে প্রতি বর্ষায় পানি উঠে যেত । একেবারে নাকি বাড়ির উঠোন পর্যন্ত পানি আসতো । আমি কয়েকবার বর্যায় পরে দাদা বাড়িতে গিয়েছি । সেই সময়ে পুরো এলাকা থাকতো পানির নিচে । বাড়িগুলো সব দ্বীপের মত মনে হত । যদিও তখন উঠনে পানি থাকতো না। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাওয়ার জন্য নৌকা ব্যবহার করতে হত। বাজারে যেতে হলেও নৌকা নিচেই যেতে হত । প্রতিটা বাড়িতেই ৪/৫টা নৌকা থাকতো বাড়ির সদস্যদের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে । আমার বেশ মজা লাগতো । তবে বর্যায় যখন একেবারে উঠনে পানি উঠতো সেই সময়ে আমি কখনও দাদা বাড়ি যাই নি । তবে ছোট বেলাতে যাওয়ার অনেক ইচ্ছে ছিল । এখন অবশ্য নেই আর !
এখন মোবাইল ক্যামেরার কল্যানে উপকূলের ছবি ভিডিও আমরা দেখতে পাই । একটু আগে একটা ভিডিও দেখলাম যেখানে পুরো একটা বাড়ি পানির নিচে চলে গেছে । কেবল টিন দেখা যাচ্ছে । বাড়ির বাসিন্দরা পাশের উচু রাস্তার উপরে বসে রয়েছে ছাতা মাথায় দিতে । ওটা সম্ভবত ঝড়ের পরবর্তী কিংবা আগের সময় । আমি ভিডিওটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম । ভাবার চেষ্টা করলাম ওদের মনে অবস্থা ? আমি যদি ওদের অবস্থানে থাকতাম তাহলে আমার অবস্থা কী হত ?
এই যে এখন বাইরে তীব্র বাতাস হচ্ছে । আমার ঢাকার ঘরের জানাল গুলোর কাঁপছে । আমি আরাম করে বসে কফি খাচ্ছি আর ব্লগ লিখছি । আজকের সকালের উঠে ঠান্ডা বাতাসে মনে হচ্ছিলো যে কতই না চমৎকার সকাল আজকে । অথচ উপকূলীয় মানুষদের জন্য আজকের সকাল কতই না বিভিষীকাময় ছিল !
আপনার প্রকৃতিক দুর্যোগের অভিজ্ঞতা কেমন?