somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শহীদ আনোয়ার পাশার ''রাইফেল রোটি আওরাত''

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার যতদুর মনে পড়ে ঢাকার নীলক্ষেত থেকে আমি প্রথম যে বইটা কিনেছিলাম সেটার নাম রাইফেল রোটি আওরাত। আনোয়ার পাশার লেখা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস। বইটার কথা আমি জেনেছিলাম সাধারণ জ্ঞান বই থেকে। আমি ছোট বেলা থেকে জিকে পড়ার বেশ শখ ছিল। সেখান থেকেই আমি এই বইটার কথা জেনেছিলাম।
ঢাকায় এসে যেদিন প্রথম নিলক্ষেত গেলাম, চারিদিকে এতো এতো বই দেখে মাথা খারাপ হওয়ার মত অবস্থা। অথচ পকেটে টানা নেই। তখনও টিউশনি শুরু করি নি, তাই পকেটে খুব স্বল্প পরিমান টাকা হাত খরচের জন্য। তবে আশা কথা ছিল যে নিলক্ষেতে কমদামী সেকেন্ডহ্যান্ড বইয়ের অভাব নেই। রাস্টার ফুটপাথেও প্রচুর বই পাওয়া যায়। তখন বিশ ত্রিশ টাকাতেও ভাল ভাল বই পাওয়া যেত। আমি সেদিন সেই ফুটপাথ থেকে বই দেখছিলাম তবে মনের ভেতরে একটা সঙ্কা কাজ করছিল। কারণ তখন ঢাকায় নতুন। আমি যে নিলক্ষেতে এসেছি একা একা, কিভাবে বাসায় যাবো, কোন বাসে উঠব, সেটাও আমি নিশ্চিত ভাবে জানি না। কী বই কিনবো না কিনবো ভাবছি তখনই আমার এই বইটার নাম মনে হল। নামটা মনে হওয়ার একটা কারণ ছিল যে জেলা পাবলিক রাইব্রেরিতে এই বইটা খোজ করেছিলাম। বইটা খাতায় তালিকা ভুক্ত থাকলেও লাইব্রেরিয়ান জানিয়েছিল যে বইটা একজন নিয়ে আর ফেরৎ দেয় নি। নতুন ভাবে আর কেনাও হয় নি। তখন থেকেই বইটা পড়ার একটা আগ্রহ ছিলাম আমার। নিলক্ষেতে এসে সেই ইচ্ছেটা পূরণ করতে মন চাইল। আমি সামনে দাড়ানো মামাকে বইটার নাম বললাম। একবার ভেবেছিলাম হয়তো সে নামটা শুনে নাও থাকবে। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে মামা বলেছিল বইটা আছে। তবে দামটা একটু বেশি। ২০০ টাকা লাগবে। সেই সময়ে সত্যি বলতে কি একটা বিয়ের পেছনে ২০০ টাকা খরচ করা আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিল। তখন মোহাম্মাদপুর থেকে বাসে নিলক্ষেত ভাড়া ছিল তিন টাকা। তাহলে বুঝেন ২০০ টাকার মান কত খানি ছিল। দুইশটাকার দাম শুনে একটু দমে গেলা বটে কিন্ত পকেটে টাকা ছিল। তাই মামাকে বললাম যে নিয়ে আসতে। সে আমাকে সেখানে রেখেই নিলক্ষেতের ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল একটু পরেই। লালচে টাইপের বইটা নিয়ে ফিরে এল।
সেদিন আমি আর কোন বই কিনি নি। এই একটা বই কিনেই ফিরে এসেছিলাম।
আমি সাধারণ একটা বই একবার পড়ে ফেললে সেই বই আর নিজের কাছে রাখি না। যারা বই পড়ে তারা নিজেদের সংগ্রহে থাকা বই গুলো খুব যত্ন করে রাখে। আমার কাছে একবার একটা বই পড়ে ফেললে, তার ভেতরের কাহিনী আমি জেনে গেলে সেই বই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সেই বই আমি দ্বিতীয়বার খুলেও দেখি না। নন-ফিকশন বইয়ের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। পড়া বই আমি মানুষজনকে দিয়ে দিই। আমার অসংখ্য বই আমার বন্ধুদের কাছে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কেনা কোন বই-ই বলতে গেলে আমার কাছে নেই। তবে এই বইটা আমার কাছে এখনও আছে। বইয়ের স্তুপের মাঝে কোথাও আছে। আজকে একটু খোজার চেষ্টা করলাম বটে তবে খুজে পেলাম না।

এই বইটার বিশেষত্ব হচ্ছে এই বইটা লেখক আনোয়ার পাশা লিখেছিলাম যখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। তিনি অবরুদ্ধ অবস্থায় বইটা লিখেছিলেন। ২৫শে মার্চ পাকি হামলার দিন থেকে শুরু করে পরের তিনচার দিনের কাহিনী নিয়ে বইটা। বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুদীপ্ত শাহীন। ইংরেজির অধ্যাপক। টার স্ত্রী নাম আমিনা। তারা বাচ্চাদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টারের ২৩ নম্বর বিল্ডিংয়ে থাকতেন। ২৫শে মার্চ যখন পাক হানাদার হামলা করে তখন অন্য শিক্ষকদের সবাই মারা গেলেও তারা অলৌকিক ভাবে জীবিত ছিলেন। লাশে স্তুপের ভেতরে তারা ঢাকাকে দেখেছেন। তিনি একেবারে নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা নিয়ে উপন্যাসটা লিখেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিজের চোখেই অনেক শিক্ষক অধ্যাপকের মৃত্যু নিজ চোখে দেখেছেন। সেই সব বাস্তব বর্ণনাও দেওয়া আছে বইতে। এই পড়তে গেলে আপনি পাকিদের ভয়ংকর নৃশংশতা আঁচ করতে পারবেন।
এই বইতে শেষ প্যারাটা পড়ে আমি সেই সময়ে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। আমি বইটা লেখা হয়েছিল মার্চ থেকে জুনের মধ্যে। তার মানে স্বাধীনতার তখনও বেশ কয়েকমাস বাকি রয়েছে। কিন্তু লেখকের শেষ লাইন পড়ে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি সত্যি আশা করেছিলেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, রাত কেটে যাবে। সেই ভয়ংকর সময়ে এমন আশাবাদ ব্যক্তকরা সহজ ছিল না। তিনি আশায় ছিলেন দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু সেই স্বাধীন দেশ তিনি দেখে যেতে পারেন নি। ১৪ই ডিসেম্বর তাকে আলবদর বাহিনী হত্যা করে।
আমি মুক্তিযুদ্ধের পটভুমি নিয়ে লেখা অনেক গল্প উপন্যাস পড়েছি কিন্তু আনোয়ার পাশার এই লেখায় সেই সময়ের যে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে তা অন্য কোন লেখায় এতো বাস্তব ভাবে ফুটে ওঠে নি। আপনারা যদি মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে লেখা অনেক লেখা পড়তে আগ্রহী হন তবে তার ভেতরে এই ''রাইফেল রোটি আওরাত'' অবশ্যই থাকতে হবে নয়তো আপনার পড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা উপন্যাস পড়তে চান তবে সেটা ''রাইফেল রোটি আওরাত'' পড়বেন।

আজকে শহীন বুদ্ধিজীবি দিবসে আনোয়ার পাশাসহ সকল বুদ্ধিজীবিদেরকে জানাই শ্রদ্ধা।

আনোয়ার পাশার ছবি



পরিবারসহ ছবি





বর্তমানে দেশের ইতিহাস নিয়ে দুইটা দলের সক্রিয়তা খুব ভাল করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদল আছে যারা এই ইতিহাস একেবারে মুছে দিয়ে নিজেদের পছন্দের ইতিহাস রচনা করতে চাইছে আরেকটা দল যারা কিনা এই এতো বছর এই ইতিহাস বেঁচে খেয়েছে, তারা এই ইতিহাসকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নিজেদের কৃতকর্মকে ঢাকতে চাইছে। এই দুই শুয়োরের বাচ্চাদের কাছ থেকে দেশের মানুষের মুক্তি কবে মিলবে কে জানে!

আমি সব সময় কাগুজে বই কেনার পরাশর্ম দিই। তবে কেউ যদি একান্তই বই কিনতে অপারগ হয় তবে পিডিএফ থেকেও বইটা পড়তে পারেন। ইবাংলা লাইব্রেরীর এই লিংক থেকে বইটা পড়তে পারেন। অথবা এখান থেকেও ডাউনলোড করতে পারেন। সব থেকে ভাল হয় যদি রকমারি থেকে অর্ডার দেন।

ছবি উৎস
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৩১
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×