সারাজীবনে কখনো ভালো না বেসে থাকার চেয়ে, একবার ভালোবেসে তাকে হারানো উত্তম।
-আগাস্টিনভ।
মানুষ জীবনে একবার হলেও ভালবাসে বা ভালবাসা উচিত। কে এই কথা বলেছেন আমি জানি না। তবে হয়ত সত্যি অথবা না। কারণ কারও জীবনে অনেক ভালবাসা থাকার পরও অনেকেই আছেন ভাবেন পূর্ণতা কোথায়। আবার কেউ কেউ কিছু না থেকেও যেন পূর্ণ হয়েছেন অল্প ভালবাসায়।
তাই মানুষের জীবনে ভালবাসার অবদান অনস্বীকার্য বলা যায়। মানুষের অপূর্ণতা তখনই থাকে যখন সেই ভালবাসা তার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। সে তার পূর্ণতা আর খুজে পায় না। হয়ত এটাই নিয়তি। আর জীবনে নিয়তির কাছে সবাই অসহায়।
কিন্তু এসব বলছি কেন। বইয়ের কথা বলার জায়গাতে ভালবাসার কথা বলে চলেছি। তার পেছনেও একটি রহস্য আছে। একটি বইয়ের কথা বলছি এবং বইটি হচ্ছে ধীরাজ ভট্টাচার্যের লেখা “যখন পুলিশ ছিলাম”। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে বইয়ের নামের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক কোথায়।
যদিও এই বইটি ধীরাজ ভট্টাচার্যের পুলিশে থাকা অবস্থায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। সেখানে তিনি তার কাজের এবং দৈনন্দিন সব কিছু উল্লেখ করে গিয়েছেন। এর সাথে তার ভালবাসার উপাখ্যানও রচনা করেছেন।
মুল কাহিনীতে যাবার আগে লেখকের সম্পর্কে কিছু জানা যাক। ধীরাজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৫ সালে, যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা ললিতমোহন ভট্টাচার্য ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ ও স্কুল শিক্ষক। নিজ গ্রাম পাঁজিয়ার স্কুলে শৈশবশিক্ষা শেষে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিশন থেকে ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি।
এরপর আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় সিনেমার প্রতি প্রবল অনুরাগ জন্মে তাঁর যা তাঁকে কলেজ শেষ করতে দেয় নি। কিন্তু চলচ্চিত্রের প্রতি এই অনুরাগ তাঁর পরিবার নাকচ করে দেন। ফলে চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন পেছনে ঠেলে বাবার আদেশে তাঁকে ভর্তি হতে হয় কলকাতা পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে।
সিনেমার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলে পরিবারের কথা চিন্তা করে তিনি যোগদেন পুলিশের ইন্টিলিজেন্স। এরপর শুরু হয় পুলিশে টিকে থাকার লড়াই। দিন যতই গড়ায় তার ছিটেফোটা যেন হারিয়ে যায়। এই চাকরি যায় তো যায়। অবশেষে একদিনের ঘটনা অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়। তাই তাকে বদলি করে দেয়া হয় চট্টগ্রাম। এটি ১৯২৩-১৯২৪ সালের দিকের ঘটনা। আমি পুরোটা বলব না, তাহলে বই পড়ার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম এসেও শান্তি নেই। কারণ মানুষ তিনি বেশি আবেগ প্রবণ। তাই সকলের কাছে আপন হলেও কারও কারও শত্রুও হয়েছেন। আবারও সেখান থেকে তাকে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এ বদলি করা হয়। এখানে জানিয়ে রাখি সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভাল ছিল না। টেকনাফ যেতে হত স্টিমারে এবং তাও প্রায় আড়াই দিনের মত সময় লাগত। এছাড়া সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিতে হত।
লেখক তার সব কিছুর বর্ণনায় হুবহু সেটা তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি কক্সবাজার ও টেকনাফে অবস্থিত “মগ” দের আচার আচরণ, কৃষ্টি-কালচার, জীবন বৈচিত্র্যের সব কিছু তুলে ধরেছেন। এছাড়া অপরাধী ধরার জন্য চার পাচ দিন জঙ্গলের যাত্রা পাঠককে রোমাঞ্চিত করতে বাধ্য করবে। দুর্গম পথ ও গরিব লবণ চাষীদের প্রতি ব্যবহার আপনাকেও ভাবিয়ে তুলবে মানুষ স্বার্থের জন্য কতটা নিচে নামতে পারে সেটা সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন।
ধীরাজ ভট্টাচার্যের জীবনের পরিবর্তন আসে এই টেকনাফেই। তার জীবন পরিবর্তন করে দেয় মগ জমিদার কন্যা “মাথিন”।
থানার কূপ থেকে প্রতিদিন সখীবেষ্টিত হয়ে জল সংগ্রহে আসত কিশোরী মাথিন। সময়ের সাথে সাথে ধীরাজের হৃদয়ে স্থান দখল করে ফেলে সেই সুদর্শনা। দুজনের মুখের ভাষা ভিন্ন হলেও চোখের ভাষায় তারা নিজেদের কাছে টেনে নেন। এক পর্যা য়ে, জাতপাত-ধর্ম-বয়স-পেশা ভুলে ধীরাজ মাথিনের সাথে বিবাহ বন্ধনের দিন-তারিখ-ক্ষণ ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিচ্ছেদ বেদনায় পুড়তে হয় এই প্রেমীযুগলকে।
কক্সবাজার জেলার শেষ সীমান্তে টেকনাফ থানার কম্পাউন্ডে অবস্থিত শত বছরের পুরনো বিশুদ্ধ পানির ‘মাথিনের কূপ’ ধীরাজ-মাথিনের সেই যুগপৎ প্রেম ও বিরহের নিদর্শন হিসেবে আজও দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছে।
কেন ‘মাথিনের কূপ” আজও এত জনপ্রিয় নিদর্শন? ধীরাজ-মাথিনের বিচ্ছেদের কারণ কী? কে, কারা কেন ধীরাজ-মাথিনের বিচ্ছেদের পিছনে দায়ী ছিল? মাথিনের পরিণতি কী হয়েছিল? ধীরাজই বা শেষ পর্যন্ত কী করলেন? কেন করলেন?
অনেক প্রশ্ন তবে উত্তর আছে “যখন পুলিশ ছিলাম” বইটিতে। উত্তর গুলো জানতে এই বইটি পড়তে হবে। আশা করছি বইটি সবার ভাল লাগবে।
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:০৪