আমার কোন অনুভূতি নেই,
দু:খ সুখের ভেদাভেদ আমি করতে পারি না
আমার কোন ইচ্ছে জাগে না,
হয়ত আমি নির্জীব
- নির্জীব
আমার ভেতর আমি নেই, হারিয়ে গিয়েছি, নয়ত মরে গিয়েছে সেই আমি যাকে সবাই জানত। তবে কি আমার মৃত্যু ঘটছে, নাকি আমি বেচে আছি। প্রশ্নটি অবান্তর নয়, আবার প্রশ্নটি একেবারে অযৌক্তিক নয়। মানুষের মৃত্যু কি শুধু মাত্র দৈহিক, নাকি মানসিক ভাবেও মানুষ মৃত হতে পারে। বেচে থাকা ও মৃত্যুর ভেতর কতটুকু পার্থক্য রয়েছে। সেটাও মানুষ নিজে কিভাবে পরিমাপ করতে পারে। আদৌ কি পরিমাপ করা সম্ভব হবে। জীবন আর মৃত্যু তো পাশাপাশি।
মানুষ বেচে থাকে তার অনুভূতিতে। যদি কোন অনুভূতি না থাকে। যদি সে কোন কিছুই অনুভব না করে। তাকে আপনি বেচে থাকা বলতে পারেন, নাকি জীবন্ত মৃত্যু আখ্যা দেয়া সম্ভব। কারণ মানুষের অনুভূতি সব সময় জাগ্রত থাকে। এই পৃথিবীতে বেচে থাকার জন্য তার অনুভূতি সব সময় তাকে তাগিদ দিতে থাকে। সে এই পৃথিবীতে বেচে থাকার জন্য তার অনুভূতিকে বাচিয়ে রাখে। আর সেটাই দিন দিন তাকে বেচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায়।
যদি মানুষের এই অনুভূতি না থাকে, তাকে তখন আমরা কি আখ্যা দিতে পারি। যদিও এটা প্রায় অসম্ভব তবুও বলা যায় অনুভূতি না থাকা আর মৃত্যু মানুষ কাছাকাছি পর্যায়ের। যেখানে তারা ভেতর কোন কিছুই আর নাড়া দেয় না। তার ভেতরে থাকা মানুষটি হয়ত আর বেচে নেই। বাইরের মানুষটি শুধু বাহ্যিক ভাবে বেচে আছে। সব কিছুই সে দেখে জানে কিন্তু সে সেই বিষয়ে কিছু করতে বা বলতে পারে না। কারণ সে সেই অনুভব তার ভেতর আর বেচে নেই।
“অনুভূতিহীন জীবন মৃত্যুর চেয়ে ভয়ানক, অথবা বেচে থাকার অন্য রকম সুখ”
ধরুন আপনার কোন দুঃখ বা সুখ অথবা কোন কিছুই অনুভব হচ্ছে না। তখন আপনি কি করবেন। আপনার কাছে সেটা কেমন লাগবে। এটাও এক প্রকার অনুভূতি কিন্তু তার কোন নাম নেই। নেই উপলব্ধি। আপনি কি একে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। আপনি তখন কতটা অসহায় হয়ে যাবেন। নাকি নিজেকে মানিয়ে নিয়ে এই পৃথিবীর প্রকৃতির সাথে নিজেকে বিলীন করে দেবেন।
“জল নেই পাথর” ওয়াবেদ হকের নতুন উপন্যাস। উপন্যাসে বর্নিত হয়েছে যাকে ঘিরে বা উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র পলাশ সাহেবের দুঃখবোধ লোপ পেয়েছে। তিনি দুঃখবোধের উপরে চলে গিয়েছেন। সেই সাথে তার ভেতর এক অন্যরকম শক্তি কাজ করেছে যা তিনি একবার দেখে শোনেন তিনি সেটা ভুলে যান না। এটা নিয়ে তিনি বেশ অসহায়বোধ করলেও সময়ে সাথে সাথে মানিয়ে নিয়েছেন।
তিনি ডাক্তারের শরনাপন্ন হলেও তাতে কোন কাজ হয়নি। বরং তাকে পাগল বা মানসিক রোগী বলে আখ্যায়িত হতে হয়েছে। তবুও তিনি ভেবে ছিলেন এটা সাময়িক কিন্তু দিন দিন এটা বেড়েই চলেছে। অবশেষ জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। প্রকৃতি যেভাবে মানুষ কে বেচে থাকা শিখিয়ে দেয় সেভাবেই পলাশ সাহেবও শিখে যান কিভাবে বেচে থাকতে হবে। শুধু তার ভেতরে অনুভূতি গুলো চলে যায় বা মরে যায়।
এছাড়া একটা সময় তিনি খুনের চিন্তা মাথায় করে ঘুরে বেড়ান। আসলেই কি তিনি খুন করতে পারবেন। নাকি খুন করা খুব সহজ যা অনেকটা ডাল ভাতের মত। তিনি পেশাদার খুনী নন। তবুও তাকে খুন করতে হবে। কারণ তার দুঃখবোধ ফিরে আসুক তিনি চান। তবে কি এটা শেষ, নাকি অন্য কোন ভাবে তিনি বেচে থাকবেন। তার অনুভূতি গুলো বেচে থাকবে।
এই উপন্যাসটি পড়ার সময় আমি বার বার একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি যে বইটি লেখার সময় লেখক তার অনুভূতিকে কতটা জাগ্রত রাখতে পেরেছেন। নাকি তিনিও পলাশ সাহেবের সাথে একত্রিত হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে বাংলা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে ওবায়েদ হক বেশ এগিয়ে রয়েছেন। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে তার লেখার বাস্তবশৈলী।
আপনি যখন “জল নেই পাথর” পড়বেন তখন বুঝতে পারবেন লেখক কতটা পর্যবেক্ষণ করেছেন এই সমাজকে। সমাজ ব্যবস্থাকে ও সমাজে থাকা মানুষ গুলোকে। আপনার কাছে মনে হবে এই ঘটনা আপনিও কখনও না কখনও দেখছেন। আপনার সামনে অহরহ এসব ঘটনা ঘটে থাকে।
সমাজ, সমাজে থাকা মানুষ ও সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। যদিও সাহিত্য সত্যের জায়গাকে আমরা কাল্পনিক ধরে এগিয়ে চলি। তবুও আপনি বাস্তবতা কে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। যেটা আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থানকে বর্ণনা করে থাকে।
উপন্যাসটির সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে এই শেষ। আপনি ভেবে পাবেন না আসলে শেষ কি, আসলেই কি শেষ হয়েছে নাকি গল্পের আরও বাকি আছে। আমার মনে হয় লেখকের সার্থকতা ঠিক এই জায়গাতে। তিনি পাঠকের ভাবনার খোরাক জোগাতে সক্ষম হয়েছেন। উপন্যাসটি শেষ হয়েও যেন শেষ নয়।
জীবনের নিয়ম হয়ত এটাই। কোন কিছুই শেষ নয়, আবার নতুন করে শুরু নয়। সব কিছু একটি চক্রের ভেতর আবব্ধ হয়ে আছে। যেই চক্রের ভেতর আমরা সবাই বসবাস করছি। হয়ত একদিন আমরা আমাদের খুজে পাবো। গন্তব্যের শেষ হবে।
“Life is too short, Don’t waste it in thinking”
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০২