"এতদিন আগের ঘটনা এগুলা শুনে আপনি কি করবেন?" আমি বললাম "আমাদের জানা দরকার এখান থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।" "হ্যা যুদ্ধ হয়েছিল কিন্তু ঐখানে তো আমরা তেমন কিছু করতে পারিনি। নগরবাড়ী ফেরিঘাটের যুদ্ধ নিয়ে কথা হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধা ইসহাক আলীর সাথে।নিজের অবদানকে তেমন বড় করে দেখতে চান না তিনি।
নগরবাড়ী ফেরি ঘাটের যুদ্ধ
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে সংঘটিত হওয়া প্রতিরোধ যুদ্ধগুলোর মধ্যে নগরবাড়ী ফেরিঘাটের প্রতিরোধ যুদ্ধ অন্যতম।
নগরবাড়ী ফেরিঘাট পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার অন্তর্গত। যমুনা সেতু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ফেরি ঘাটই ছিল ঢাকার সাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সড়কপথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। যে কারনে ঢাকা থেকে পাকসেনাদের চলাচল রোধ করতে এর দখল নিজেদের কাছে রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আবার ঢাকার সাথে যাতে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন থাকে সেজন্য এটা পাকবাহিনীর কাছেও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
স্বাধীনতা ঘোষনার পর পরই ২৭ শে মার্চ পাবনা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। তারা বুঝতে পেরেছিল পাকবাহিনী খুব শীঘ্রই এর উদ্ধারে অভিযান চালাবে। তাই তৎকালীন ই পি আর, আনসার, পুলিশ এবং স্থানীয় ছাত্র জনতার সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী ২৮ শে মার্চ থেকেই নগরবাড়ী ফেরিঘাটে অবস্থান নিতে থাকে। স্থানীয় জনগনের সহায়তায় একরাতেই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ট্রেঞ্চগুলো প্রস্তুত করে ফেলেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই পাকবাহিনী নগরবাড়ী আক্রমনের পরিকল্পনা করে। খুব সম্ভবত ৭ ই এপ্রিল তারা এয়ার রেকি করে। প্লেনগুলোকে খুব নিচু দিয়ে উড়তে দেখে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেগুলো লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েন। এতে করে পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে যায়। ৮ এপ্রিল সকাল থেকেই পাকবাহিনী বিমান আক্রমণ শুরু করে। সেদিন মাঝরাত থেকেই শুরু হয় আর্টিলারি বোম্বিং। ৯ এপ্রিল সকালে আর্টিলারি ফায়ার এবং মর্টার ফায়ার কাভারে আরিচা থেকে গানবোট ও ফেরিযোগে পাকবাহিনী নগরবাড়ী অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। মাঝে মাঝে চলতে থাকে বিমান আক্রমণ । মুক্তিযোদ্ধারা তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে বিমান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধারা একসময় বুঝতে পারেন তাদের অনুন্নত অস্ত্র আর স্বল্প অ্যামুনিশন দ্বারা পাকবাহিনীর এরকম আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব নয়। তারা তাদের অবস্থান ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে আসেন। পাকবাহিনী নগরবাড়ী ঘাটের ৭ কি মি দক্ষিণে নটাখোলায় অবতরণ করে। তারপর শুরু হয় তাদের ধ্বংস তান্ডব। নগরবাড়ীর ১ কি মি পশ্চিমে মুক্তিযোদ্ধারা আবারো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংশ ভারতে চলে যায় প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য । ই পি আর এর একটি দল ডাব বাগান ( বর্তমানে শহীদ নগর ) এলাকায় পূনরায় অবস্থান নেয় এখানে পাকিবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি যুদ্ধ হয়। এই ডাব বাগানের যুদ্ধের উপর আরেকদিন আলোচনা করব।
আপাত দৃস্টিতে মনে হতে পারে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন কিছু করতে পারেনি কিন্তু তারা সেদিন যে সাহস যে দেশপ্রেম এর পরিচয় দিয়েছিল তা অভূতপূর্ব। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগেরই কোন প্রশিক্ষণ ছিল না, এমনকি তাদের অনেকের হাতে অস্ত্রই ছিল না কিন্তু তাদের সাহসের কমতি ছিল না কমতি ছিল না তাদের দেশ প্রেমের।
গত ২২ এবং ২৩ মার্চ আমার সৌভাগ্য হয়েছিল নগরবাড়ী ফেরিঘাটের যুদ্ধ ও ডাব বাগানের যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহন করা বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কথা বলার। কি নির্লিপ্ত তাদের প্রকাশ ভঙ্গি । ক্রেডিট নেয়ার কোন মনোভাবই নেই তাদের। এখনো শক্ত সামর্থ এখনো তাদের চোখে সেই প্রত্যয়, সেই আত্নবিশ্বাস। এরাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধা, এরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।