somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা দিবস ও আমার নিরবতা ।

১০ ই মে, ২০১৪ রাত ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সূর্য যখন সারা দিনের ক্লান্তি শেষে পশ্চিম আকাশে ডুব দিবে তার কিছু আগেই মামার বাড়ী থেকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিতাম আমরা। আমাদের বাড়ী থেকে মামার বাড়ীর দুরত্ব প্রায়দু’কিলোমিটার। সব সময়ই সাথে থাকতেন আমার মা। মায়ের কনিষ্ঠা ধরে সবুজ মেঠোপথে হাঁটা সাত-আট বছরের আমি যেন মায়ের চিরচেনা এই পথের পথ প্রদর্শক। রাস্তার দু’পাশে সবুজ মাঠে ছড়ানো গরুর দলকে দেখিয়ে মা’কে বলতাম- এই গরুগুলো যদি আমার হতো মা ! মা বলতেন- বাবা, এই রকম বলিস না। পরিশ্রম না করে কিছু চাওয়া ভালো নয় বাবা। আমি বলতাম- কী বলো মা ! আমি এত্ত সব গরুর মালিক হবো, সকালে গরুকে তাজা ঘাস খাওয়াবো, প্রচুর দুধ দিবে, আর তুমি কিনা বলছো তা ভালো নয় ! মা হাসতেন, আর বলতেন ধর্মকথা, সৎ পথে চলার কথা। আমি তা নিরবে শুনেই যেতাম। মাঝে মাঝে এমন হতো- মাকে ফেলে দৌড়ে কোন ঝোঁপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে আনন্দ পেতাম আমি। মায়ের মুখ তখন মেঘবরণ ধারন করত। আবার দৌড়ে যখন বেড়িয়ে আসতাম, তখন মা জড়িয়ে বুকে তুলে নিতেন। আর আস্তে করে বলতেন- এমন করিস কেন বাবা ?
এবার বর্ষাকাল। আমাদের সেই ছোট্ট নৌকায় মামার বাড়ি যাচ্ছি। চারদিকে পানির থৈ থৈ। পানির মধ্যথেকে উকি দেওয়া রঙ্গিন শাপলা ফুল দুদিকে সরিয়ে আমাদের নৌকাটা একেবেকে যাচ্ছে। আমি আর শাপলা ফুলের লোভ সামলাতে পারিনি। মায়ের কোল থেকে হুট করে সরে গিয়ে যখন শাপলা ফুল তুলতে যাব ঠিক তখনই আমার পানিতে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তখন, মা আমার রাগ সামলাতে পারেননি। আমাকে রাগে-ক্ষোভে কয়েকটি আঘাত করে বসলেন। তারপর মায়ের কী কান্না। তাঁর চোখের পানি আর আমার চোখের পানি সব একই সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল।
তারপর আস্তে করে বললেন- এমন করিসনে বাবা !

এভাবে কিছু মাস, কিছু বছর প্রিয় মায়ের সান্নিধ্যে থেকে কখন জানি পঞ্চম শ্রেণী পাস করলাম। এবার বাড়ী ছাড়ার পালা। কারণ ভগবানের হাতের স্নেহের পরশ আমাদের ঐ পল্লীগ্রামে লাগেনি। বাড়ী থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে হাই স্কুল-এর অবস্থান। পায়ে হেটে যাওয়া-আসায় অতিক্রম করতে হবে প্রায় ছয় মাইল দুরত্ব। তাই বাবার দূরদর্শীতা, মায়ের পায়ের ধুলো আর চোখের নোনা জল সঙ্গে নিয়ে দিদির বাড়িতে হাই স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে বাড়ী ছাড়লাম আমি।
তারপর, আরও কয়েকটি বছর কেটে গেল এভাবে। ছুটিতে বাড়ী গিয়ে মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য সবসময় উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। বাড়ী গিয়ে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম আমার স্বল্প শিক্ষিত মা মনযোগ সহকারে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার বড় বড় বই পাঠ করছেন। তাঁর একাগ্রতা ও মেধার সমন্বয়ে রপ্ত করলেন এই চিকিৎসা পদ্ধতি। গ্রামের গরীব-অসহায় রোগীদের সেবা করতেন তাঁর কোমল হৃদয় দিয়ে । এভাবে পার্শবর্তী গ্রাম থেকেও রোগীরা আসতে থাকল। মায়ের এসব কীর্তি দেখে আমি খুবই মুগ্ধ হতাম।

একদিন বাড়ী গিয়ে দেখি অনেক মহিলা এক সাথে জড়ো হয়ে আছেন। মা আমার উনাদের কিছু বলছেন আর সবাই মুগ্ধ হয়ে মায়ের কথা শুনছেন। যখন মাকে বললাম- কী ব্যাপার মা ? মা বললেন- সবাই মিলে আমরা মহিলা ‘গীতাসংঘ’ গঠন করব। আমাদের কাজ হবে ধর্মকথা প্রচার করা, সমাজে নীতি কথা প্রচার করা। আমি অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরতেই মা বললেন- দেখ বাবা, কিছু সমস্যা তো থাকবেই। তবে আমার বিশ্বাস আমি সবাইকে এক রাখতে পারবই।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে যখন বাড়ী যেতাম তখন জমানো সব মনের কথা আমি মাকে বলতাম, মা ও বলতেন। মা একদিন বললেন- তুই এখন থেকে হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিস করিস তো। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। একটু অবহেলার সুরে বললাম- আমি ! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে আমি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হব ? মা বললেন- দেখ বাবা, কোন কাজকেই এভাবে ছোট ভাবা উচিত নয়, জীবনে কোন একদিন হয়তো এই ছোট কাজটাই তোর কাছে অনেক গুরুতপূর্ণ হয়ে ধরা দিবে। আমি হাসতাম আর বলতাম- ঠিক আছে মা, আমি চেষ্টা করবো।

একদিন লাজুক সুরে মা আমাকে বললেন- পার্থ, আমি না কয়েকটা গান লিখেছি। কয়েকটা অনুষ্ঠানে এই গানগুলো গেয়েছিও আমি। আমি অবাক হয়ে বললাম- কী বল মা ! তুমি গান লিখেছ ? হ্যাঁ রে, তুই এক কাজ করিস তো বাবা, আমি যখন আরো কিছু গান লিখব তখন সব গুলো গান কম্পিউটারে লিখে আমাকে দিবি। আমি বললাম-ঠিক আছে মা, তুমি আরো কিছু গান লিখে ফেল।

ছুটি কাটিয়ে যখন বাড়ী ছাড়তাম আমি তখন বিদায় বেলায় ঘর থেকে বের হয়ে আমার পিছু পিছু অনেক দূর চলে আসতেন মা। আমি বলতাম- মা, এবার তুমি যাও। মা তাঁর শাড়ীর আচল দিয়ে চোখের জল মুছে মুছে বলতেন- তুই যা বাবা, আমি আছি এখানে। আমি আর পেছন ফিরে তাকাতাম না, কেন জানি বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে যেত। তখন অনুভব করতাম মায়ের এক মায়াবী ছায়া আমার পিছু পিছু হেঁটে আসছে।

ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে চাকুরীতে যোগদানের আগ পর্যন্ত জীবনের এই গুরুত্বপুর্ণ সময়টুকু প্রায় মায়ের আদরের স্পর্শ ছাড়াই কাটিয়েছি আমি। তাই মনের মধ্যে একটা লালিত স্বপ্ন ছিল চাকরীতে যোগদান করেই মায়ের সংস্পর্শে থেকে হারানো সময়ের আদরটুকু পুষিয়ে নিব। মাকে যখন এই স্বপ্নের কথা বললাম, মা বললেন- এটা কিভাবে সম্ভব বাবা ! আমার চিকিৎসা, আমার সংগঠন, প্রিয় মহিলাদের সঙ্গ ফেলে আমার শহর জীবন ভালো লাগবে? তখন নিজেকে আমার খুব নিঃস্ব মনে হত। তবে আমি আমার লালিত স্বপ্নকে হারাতে চাইতাম না। একদিনতো মা বলেই ফেললেন- তোকে লেখাপড়া করিয়ে কি হবে, তুই তো আর চাকরী পেয়ে আমার কাছে থাকবি না।

শেষ পর্যন্ত আমার সুস্বপ্নটা পূরণ হয়নি। মা আর আমার কাছে আসেননি। অনেক দূরে চলে গেছেন, অনেক দূরে। আমার চাকরী পাওয়ার দুইমাস পর ‘মা’ দিবসের ঠিক আগের দিন মা চলে গেছেন আমাকে ফেলে। তাই সবার কাছে মা দিবসটা যখন উচ্ছল আর আনন্দের আমার কাছে তখন তা সুনসান নিরবতায় আচ্ছন্ন। আমার এতদিনের রঙ্গিন স্বপ্ন কেন জানি এক নিমিষেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আমার স্বপ্ন কেন অঙ্কুরদমেই ভেঙ্গে গেল, এর সঠিক উত্তর আমি এখনও পাইনি। জানি, পাব না কোন দিন। মা হারানো এক ছোট বোন আমাকে বলল- ‘দাদা, ইদানিং কেন জানি মায়ের কথা মনে পড়ে না। তবে কাউকে যখন তার মায়ের সাথে দেখি তখন কেন জানি খুব হিংসা হয়।’ হ্যাঁ, এই নিষ্ঠুর সত্যটা ইদানিং আমার মনের মাঝেও বাসা বেঁধেছে।

এখন আর আগের মতো গ্রামে যাওয়া হয়না। আগে গ্রামে যাওয়ার জন্য মন কাঁদতো আর এখন গ্রামে গেলে ফিরে আসার জন্য মন কাঁদে। কারণ গ্রামে মায়ের প্রতিটা স্মৃতিচিহ্ন আমাকে কাঁদায়, আমি আবেগতাড়িত হই। আমি আমার মাকে নিরবে খোঁজি গ্রামের মহিলাদের মাঝে,নদীর ঘাটে, ঠাকুর ঘরে প্রার্থনায় আর তাঁর তিলেতিলে গড়া ফার্মেসীতে। মায়ের গড়া সেই সংগঠন এখনও সাম্যের বাণী পৌছে দিচ্ছে মানুষের মনের মাঝে কিন্তু আমার মা নেই। বাড়ী থেকে বিদায়ের সময় এখনও অনেক মহিলা আমাকে বিদায় জানান তবে মায়ের সেই অশ্রুভেজা মুখখানি এখনও খোঁজি। আর তখন মনেমনে বলি- ও তোতা পাখিরে শেকল খুলে উড়িয়ে দিব, আমার মাকে যদি এনে দাও, আমার মাকে যদি এনে দাও।
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×