somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হৃদয়ে কাঁটা কম্পাস

১৬ ই মে, ২০১৪ রাত ১২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বৃহস্পতিবারের রাতটা আবিরের খুবই পছন্দ। টানা পাঁচ দিনের কর্মক্লান্তি সে এই এক রাতেই ভুলে যায়। এমনিতে রাত না জাগলেও বৃহস্পতিবারের রাতটা প্রায় জেগেই কাটিয়ে দেয়। গভীর রাতে রবীন্দ্র সংগীত তার মনের ক্লান্তি কিভাবে জানি ধুয়ে-মুছে নিয়ে যায়। তবে ইদানিং নামবিহীন অপরিচিত ব্লগারদের ব্লগ পড়া তাঁর নেশাতে পরিণত হয়েছে। এত এত কবিতা, গল্প, রাজনীতি, সমসাময়িক বিষয়গুলো ব্লগের দেওয়ালে ঠাঁই করে নিয়েছে তা জানাই ছিল না এতদিন। এ যেন অন্য এক পৃথিবী, তাঁর নতুন এক ভুবন। প্রতিটি শব্দের গাথুনি, রাজনৈতিক ধারালো মন্তব্য পড়ে সে শুধু অবাকই হয় না, তার আপসোসও লাগে। মনের কাছে প্রশ্ন রাখে- আমি কি কখনো এভাবে লিখতে পারবো ? তবে লেখকদের একেকটি বিদগুটে নাম দেওয়ার কারণ খুঁজে পায়না সে।

তবে আজ আর ভাল লাগছে না তাঁর। কেমন জানি একা একা লাগছে। রুমের দরজাটা বন্ধ করে জানালাটা খুলে দিল সে। পূর্নিমা রাত। আজ চাঁদটাকে এত বড় মনে হচ্ছে যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। তার মনে পড়ে গেল গ্রামের সেই চাঁদনী রাতের কথা। ছোট বেলায় চাঁদনী রাতে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরা একটা শখ ছিল তার। এখন এসব শুধুই স্মৃতি। কত দিন গ্রামে যাওয়া হয়না।
হঠাৎ আবিরের ফোনটা বেজে উঠল। চমকে উঠল সে। এত রাতে কেউ ফোন করার কথা নয়। তাঁর সব বন্ধুদের মাঝে সে’ই রাত জাগে। বন্ধুদের সাথে তার ঐ জায়গাতেই পার্থক্য। সবাই যখন কর্মক্লান্তিতে ঘুমে বিভোর সে তখন রাত জাগা পাখি। মোবাইলটাতে তাকিয়ে দেখল বন্ধু পিয়ালের নামটা ভেসে উঠেছে।

পিয়াল একটু তাড়াহুড়ো করে বলল-
-কিরে আবির, কিছু শুনছিস ?
- কি?
-তুই এখনও কিছু জানিস না ?
- না, কি ? আমাকে বল।
- নীলা..
- নীলা ? হ্যাঁ, শুনছি, নীলার কী হল বল।
- ও একটু আগে.... পিয়ালের কণ্ঠ আটকে গেল ।
- প্লীজ পিয়াল, এভাবে ভনিতা করিস না তো।
পিয়াল এবার নিজের কন্ঠকে শক্ত করে বলল
- নীলা একটু আগে সুইসাইড করেছে।
- সুইসাইড করেছে ?

ঠুস করে লাইনটা কেটে দিল আবির। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সারা শরীর বেয়ে কেমন জানি হিম শীতল বাতাস বয়ে গেল তাঁর। হৃদয়ের নরম কোনে কে যেন তীক্ষ্ন ধারালো ছুরি চালিয়ে দিল। খুব পিপাসা পেল তার। টেবিলে রাখা পানির জগ হাতে নিতেই সে আবিষ্কার করল তার হাত-পা কাপছে। ধপাস করে পরে গেল জগটা। বিছানায় যাওয়ার মত শক্তি তার পায়ে অবশিষ্ট রইল না। বসে পড়ল সে, যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল।

নীলা। পুরো নাম নীলোত্তমা চৌধুরী। আবির বলত- তোমার এই নামটা খুবই পছন্দ আমার, তবে ডাকতে ভালো লাগে না। নামের পরতে পরতে আভিজাত্যিক একটা ছোঁয়া আছে। তাছাড়া তোমাকে ডাকতে গেলে আরেকটা মেয়ের নাম ও লেজের মত চলে আসে। নীলা শুধু মুচকি হাসত।

নীলার সাথে আবিরের শুরুটাও একটু অন্যরকমের। আবিরের যেখানে জীবন বাঁচাতে টাকার প্রয়োজন, নীলা সেখানে বাবার অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা খরচে ব্যস্ত। পত্রিকায় সাহায্যের আবেদন চোখে পড়লেই নীলা টাকা পাঠানোর জন্য বাবার কাছে ধরনা দেয়। একমাত্র মেয়ে, তাই তার বাবারও না বলার সাধ্য নেই। এভাবে আবির যখন রোড এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে তখন তাঁর বন্ধুরা একটা পেপারে সাহায্যের আবেদন ছাপিয়ে দেয়। আর সেটা চোখে পরে নীলার। আর এভাবেই কাছে আসা, কথা বলা, বিকালের জনাকীর্ন ফুটপাতে চা খাওয়া শুরু।

তবে অতিশয় বাস্তববাদী আবির জানতো এ সম্ভব নয়। প্রচন্ড ভালোবাসতো সে, তবে এই অসীম ভালবাসাকে সে কখনও মনে প্রশ্রয় দেয়নি। সাগরের বিশালতাকে যেমন অনেকেই ভালোবাসে তেমনি আবার অনেকেই সাগরের জলে সাঁতার কাটতে ভয় পায়। আবিরেরও হয়েছে এই অবস্থা।

অন্যদিকে নীলা ঠিক বিপরীত। আবিরের এই চোট-খাটো যুক্তি সে মানতে নারাজ। তাদের এই সম্পর্কের সুন্দর একটা পরিনতি চেয়েছিল সে। তাঁর মনে পোষা স্বপ্নের কথা আবিরকে সুযোগ পেলেই শুনিয়ে দিত। আবির বলত- দেখ নীলা, এটা কখনো সম্ভব নয়। বাস্তবতার কাছে ভালবাসা সব সময়ই পরাজিত। তুমি একবার শুধু কল্পনা কর তোমার আর আমার অবস্থান।
-তার মানে তুমি আমাকে ভালবাসনা ?
- হু, বাসি।
- তাহলে চল আবির। তোমাদের সেই কুঁড়ে ঘরটাতেই আমরা আমাদের সুখের রাজ্য গড়ে তুলি। তোমার পোষা রাজহাঁস, পিঞ্জিরার শালিকটিকে আমি পরম মমতায় যত্ন করতে চাই। সবুজ ঘাসে বৃষ্টির পানির ছন্দ শুনতে চাই। আমি হারিয়ে যেতে চাই তোমার ভালবাসার গভীর আধারে।

না, শেষ পর্যন্ত ওদের প্রেমের মধুর সমাপ্তি ঘটেনি। উচ্চ বিলাসী নীলার বাবার আদেশ, মায়ের চোখের নোনা পানি আর অবিরের উদাসীনতা নীলাকে তাঁর কঠিন সিদ্ধান্ত অতি সহজে নিতে সাহায্য করে। মা-বাবার মতামতকেই প্রাধান্য দিয়ে নীলা বিয়ে করে নৌ-বাহিনীর চৌকস এক অফিসারকে।

তবে নীলা আবিরকে এক ফাঁকে জানিয়ে দিয়েছিল নতুন জীবনের কোন এক ক্ষণে সে জীবনের এক কঠিন, কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এই কী তাঁর কঠিন সিদ্ধান্ত ? আজ বড় একা লাগছে আবিরের। নিজেকে বড় নিঃস্ব মনে হচ্ছে। আজ সে এক নামীদামি কোম্পানীর বড় অফিসার। অথচ এই মুহুর্তে সে যেন ঝড়ের কবলে পড়া পালকবিহীন কাকের বাচ্চা। ছোট বেলায় নীড় হারা এসব কাকের বাচ্চার প্রতি তাঁর বড় মায়া হত। তাঁর কিছু বন্ধু এসব কাকের বাচ্চাকে খেলার ছলে ঢিল মেরে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত।

ফ্লোর থেকে উঠে সে কোন ভাবে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসার চেষ্টা করলো। সে তো এভাবে কখনও ভেঙ্গে পড়েনি। নীলার সব আবেগ অনুভুতির কথা সে হাসিচ্ছলে উড়িয়ে দিত। তবে আজ কেন তাঁর এই পরিনতি। একই মনের দুই রূপ। মানুষ চাওয়ার আগেই কিছু পেয়ে গেলে তাতে গুরুত্ব দেয় না কিন্তু পেয়ে হারালে এই কঠিন শূন্যতা পূরণ অসাধ্য হয়ে যায়। কিন্তু সে তো নীলার ভালবাসা হৃদয়ে ঠাই দিয়েছিল। নীলাকে সে যতটা না ভালবেসেছে তার চেয়ে সে মঙ্গল চেয়েছে বেশী। আবিরের কেন জানি মনেহত নীলার এমন পাগল করা ভালবাসা বাস্তবতার কাছে স্রোতের বেগে ভেসে যাবে।

আজ নীলাকে দেখতে তাঁর খুবই ইচ্ছা করছে। অনেকটা মনের জুড়ে সদ্য কেনা লেপটপটা চালু করে আবির। দুরুদুরু বুকে ফেসবুক ওপেন করেই নীলার ওয়াল টা তন্নতন্ন করে খুজতে থাকে সে। তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু স্ট্যটাস চোখে পড়ে তাঁর।
-‘তুমি যতই আমাকে তাড়াতে চাও, ততই তোমার সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছা করে। অনেকটা কুকুরের মতো। মনিবের গা ঘেষে দাঁড়াতে যতটা তাঁর ভালো লাগে ততটা আমারও।’

স্ট্যটাসটি পড়ে আবিরের শরীর শিরশির করতে থাকে। একটার পর একটা ছবি দেখে আবির। নীলার বিয়ের কিছু ছবি আগেও তো দেখেছিল সে, ততটা খারাপ লাগেনি। কিন্তু আজ ? এইতো সেই কালো রঙ্গের শাড়ী পড়া নীলা। শাড়ীটা আবিরই কিনে দিয়েছিল। নীলা তখন কপাল ভাঁজ করে বলেছিল- কালো শাড়ী ? আমার জন্য?
তারপর নরম সুরে বলল- ভালো লাগবে আমাকে ?
-হ্যাঁ, লাগবে। নীল আকাশে কালো মেঘের দল তো শুধু ভয়ের নয়, স্বস্তির কারণও বটে। তাই অন্যের কাছে তোমাকে কালোতে অস্বস্তি লাগলেও আমার কাছে আকাঙ্খীত মেঘের টুকরাই মনে হবে।

না, আর পারছে না আবির। হিম শীতল রাতেও তাঁর টি-শার্টটা শরীর থেকে ধেয়ে আসা ঘামের সাথে ছপছপ করে লেগে আছে। জানালার পর্দাটা এভাবে নড়ে উঠল কেন ? এটা কি অশরীরি কারো আসার লক্ষণ ? নীলার আত্মা কী তাঁকে নীড় হারা কাকের বাচ্চার মতো ঢিল মারতে আসছে ? নাকি করুনা দেখাতে। ভোরে আযানের করুন সুর তাঁর কানে আসতেই ঢুকরে কেঁদে উঠল আবির। শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু হিমশীতল হয়ে শিরায় শিরায় বইতে লাগল।

জীবনে এই প্রথম সে উপলদ্ধি করলো, বাস্তবতার কাছে নিজের ভাললাগাকে এভাবে জলাঞ্জলী দেয়া উচিত হয়নি তাঁর। এতটা হিসাব করে ভালবাসা হয়না। জীবনে চলার পথে না হয় লাভ-ক্ষতির হিসাব করা উচিত কিন্তু হৃদয়ে উকি দেওয়া নরম ভালবাসায় এভাবে জ্যামিতির কাঁটা কম্পাস বসানো একদম মানায় না। তাতে দুই হৃদয়েই রক্ত ঝরার সম্ভাবনা থেকে যায়।
এসব ভেবে ভোরের আকাশে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অতিশয় বাস্তববাদী আবির।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৪ রাত ১২:১৫
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×