দাদার সঙ্গে সুন্দরবনের নতুন জায়গায় বসতি স্থাপন করলেও নতুন স্থানে সুখ আমাদের জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আগেই বলেছি জীবিকার তাড়নায় দাদা সব ধরনের কাজ করতো ; তাই সে অন্যের জমিতে শ্রম দেওয়া, জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করা বা সুন্দরবনের বিভিন্ন খাড়িতে মাছ ধরতে যাওয়া সব প্রকারি । নিজের গ্রামে খপ্পরে পড়েছিলাম মানুষরূপী জানোয়ারদের মুখে। কিন্তু এখানেও প্রতি পদে পদে বিপদ আমাদের সঙ্গী ছিল । কথাই বলে ' জলে কুমির ডাঙায় বাঘ '। বাস্তবে সুন্দরবনের এই এলাকার মানুষজন ঠিক তেমনি ভাবে জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করেই বেঁচে আছে। যে বছর দাদা বিয়ে করল তার ঠিক পরের বছর মাছ ধরতে পাড়ার কয়েকজনের সঙ্গে দাদাও বার হয়েছিল। সেবার ফেরার নৌকাতে বাকি সকলে ফিরলেও দাদা আর ফেরেনি। ওরা এসে জানালো যে দাদাকে বাঘে নিয়ে গেছে। চোখের সামনে প্রথমে বাবাকে ও পরে দাদাকে হারিয়ে আমরা শোকে মুহ্যমান হয়ে গেলাম। পাশাপাশি দাদার আয়ে আমাদের সংসার চলত। সংসার চালানোর নতুন ভাবনায় আমরা পরলাম আতান্তরে। ঘটনার পরবর্তী কালীন সময়ে আশপাশের বাড়িগুলো থেকে যা সাহায্য এসেছিল তাতে আমাদের বেশ কিছুদিন চলে গেল। উল্লেখ্য মামারা আমাদের বাসস্থান দিলেও ওদের পক্ষে আমাদের খাওয়া -পরা দেওয়ার মতো সংগতি একেবারেই ছিল না। কাজেই জীবন সংকটে আমরা তখন হাবুডুবু খেতে লাগলাম। এক বেলা খাবার জোটে তো দুবেলা উপোস থাকি। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন বৌদি আমাদেরকে কিছু না জানিয়ে বাপের বাড়ী চলে যাওয়ার মনস্থির করল। যদিও ইতিপূর্বে দাদার পারলৌকিক সব কাজ সমাধা হয়ে গেছিলো। যাই হোক অভাবের সংসারে বৌদিকে আটকাবার কোন মুখ আমাদের ছিল না। তবে এর পরে আমরা মা-মেয়ে পড়লাম আরও সঙ্কটে।
কিছুদিন পরে পাড়া-পড়শি কয়েক জনের সহযোগিতায় আমরা মা-মেয়ে অন্যদের মত খাড়িতে মীন ধরার কাজে নেমে পড়লাম। এখানে আবার প্রতি পদে পদে কুমিরের ভয়। অদক্ষ হাতে সারাদিন খাড়িতে থাকলেও যা সামান্য মীন ধরা পড়ত তাতে আমাদের সমস্যার সুরাহা হলো না। এইভাবে বেশ কিছুদিন কাটলো। হঠাৎ একদিন সকালে বৌদি ফিরে এসে জানালো পাশের গ্রামের আশ্রমে রান্নার কাজে আমাকে নিয়ে যেতে চায় । খবরটি পেয়ে আমি লাফিয়ে উঠলাম। নতুন এই কাজটি পাওয়া আমার জীবনে যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার সমতুল্য ছিল। বৌদিকে যে সাময়িক ভুল বুঝেছিলাম তার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলাম। এই আশ্রমেই মমতামাসির সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ হয়েছিল। বৌদি না হয় বিধবা ! কিন্তু আমি এমন কাঁচা বয়সেও কেন আশ্রমের কাজে এলাম ; মমতামাসির এমন প্রশ্নে বৌদি সেদিন ঠিক মায়ের ভূমিকাটি পালন করেছিল। ধমক দিয়ে মমতামাসিকে থামিয়ে শুধু দেয়নি; যাতে আর কোনদিন এমন অবান্তর প্রশ্ন করে আমাকে বিব্রত না করে তার নিশ্চয়তাও আদায় করে নিয়েছিল । বয়সে বৌদি আমারই সমবয়সী অথচ তার এমন ব্যবহারে এক যথার্থ মায়ের ঠিকানাও যেন খুঁজে পেয়েছিলাম। আরো কয়েকদিন পরে বৌদি মাকেও এই আশ্রমে নিয়ে আসে। ফলে আশ্রমের ছাতার তলায় আমরা তিনজন আবার সংসার পাতলাম । খুঁজে পেলাম বাঁচার নিরাপদ ঠিকানাও।
মমতামাসিকে আশ্রমের কাজে পাঠিয়েছিলেন এই বাবু। পরে এই বাবু স্কুলটি তৈরি করে একদিন আশ্রমের মহারাজকে বলতে উনি এক কথায় মমতামাসিকে ছাড়তে রাজি হয়ে গেলেন । সত্যি কথা বলতে কি আশ্রমে রান্নার কাজে আমাদের এতজনের প্রয়োজনও ছিল না। ইতিপূর্বে মমতামাসির সঙ্গে আমার সদ্ভাব অত্যন্ত বেড়ে গেছিলো। পাশাপাশি আমার পূর্ববর্তী জীবন সম্পর্কে কিছুটা জানাজানি হওয়াতে কয়েকজনের ট্যারা ব্যাকা কথার জন্য আশ্রমে থাকাটা আমার পক্ষে বেশ অস্বস্তির হচ্ছিল দিনকে দিন। কাজেই চলে আসার সময় মমতামাসি আমাকেও এখানে কাজের কথা বলাতে এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম। আমার বিগত জীবনের পরিচয় থেকে মুক্তির জন্য এরকম আত্মীয়-পরিজন থেকে দূরে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা জায়গায় ছিল আদর্শ ঠিকানা। যাই হোক নতুন স্বপ্ন নিয়ে সেদিন থেকে এখানে থেকে যাওয়া। এখানে এসে প্রথম থেকেই সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু বছর দুয়েক আগে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনি আশ্রমে থাকাকালীন মাস চারেক আগে মা মারাও গেছে । বৌদির খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি বৌদি আশ্রমের কাজ ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে অন্যত্র কোথাও চলে গেছে। মানতে খুব কষ্ট হচ্ছিল যে বাবা ,মা কারোর মরা মুখ দেখার সুযোগ ইহ জীবনে আর হলো না। সেদিন আত্মীয় পরিজনদের হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে আবার হোস্টেলে ফিরে আসি।
জীবনের এই অধ্যায়ে এসে তাই পরিচিত কারোর সঙ্গে যে আবার দেখা হবে সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। তাই প্রথম দিন আপনাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম । একটু সংশয়ে ছিলাম ; একই রকম দেখতে অন্য কেউ হতে পারে ভেবে । কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে আপনি একই ব্যক্তি । আর তখন থেকে এ কারণেই আমাকে ঘোমটার আড়ালে নিয়ে যাওয়া।
ভারত - বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সুন্দরবন ব-দ্বীপ অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মতোই একটি গ্রাম বিধবাপল্লী। গ্রামের জনসংখ্যা চার থেকে সাড়ে চার হাজারের মতো হবে । এই গ্রামে এমন কোন বাড়ি নেই যে বাড়ির কোন সদস্যকে বাঘে তুলে নিয়ে যায়নি বা বাঘে ধরে নি। কেউ স্বামী, কেউ পুত্র ,কেউ বা দাদাকে হারিয়েছে। বিধবার আধিক্যের জন্য গ্রামের নামই হয়ে গেছে বিধবাপল্লী ।
বাঘের সঙ্গে কুমিরের পেটে যাওয়ার ঘটনাও এখানে আকছার ঘটে । অত্যন্ত দরিদ্র এলাকাবাসীর নদীর খাড়িতে মাছ ধরা বা মীন ধরা ও মধু সংগ্রহ করা প্রধান জীবিকা। আগে এক ফসলি জমিতে শুধু বর্ষাকালে যেটুকু চাষাবাদ হত কিন্তু আইলার পরে সে সুযোগটুকুও নষ্ট হয়ে গেছে । জমির উপরে নোনাপলি পড়ে কৃষির পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অন্য বিকল্প জীবিকা বলতে মাছ , কাঁকড়া ধরা ও মধু সংগ্রহ করা। সারাবছর মাছ ও মধু সংগ্রহ করতে গ্রামের পুরুষরা দলবেঁধে গেলেও ফেরার সময় এক-আধ জনের অনুপস্থিত থাকাটা গ্রামবাসীদের কাছে গা -সওয়া হয়ে গেছে।
চারিদিকে নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত গ্রামের অধিবাসীরা সাধারণত বিকালের পর কেউ আর বাইরে বার হয় না । রাত বিরেতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাই পরের দিন সকাল পর্যন্ত অসহায়ভাবে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই আর করার থাকে না। এলাকাবাসী বাঘের পিঠে বনবিবি রূপে দেবী দুর্গাকে পূজা করেন । তাদের বিশ্বাস বাঘ বা দক্ষিণী রঞ্জন রায়ের আক্রমণ প্রতিহত করতে বন বিবি রূপে দেবী দুর্গা তাদেরকে রক্ষা করবেন । সেজন্য এই অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে ঘরে যেমন বনবিবি ও দক্ষিণী রায়ের পুজো হয় ; পাশাপাশি প্রতিটি নৌকাযাত্রার আগে নারকেল যোগে বনবিবিকে তুষ্ট করার চল আছে।
মিতালীদির কাছ থেকে সালিশি সভার পরবর্তী ঘটনা ও তারপর মাঝের এতগুলি বছরের খবরা খবর শুনতে শুনতে কখন যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম তার আর খেয়াল ছিল না । হঠাৎ পাশ থেকে কাশির শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম। তাকিয়ে দেখি একে একে রমেনদা মমতামাসি, নমিতামাসি সহ কিচেনরুমের সকলের সঙ্গে শেফালীম্যাডামও দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ তুলে তাকাতেই,
- আমি আপনাদের সব কথা শুনেছি। বাস্তবে এই মুহূর্তে কথা বলার মতো অবস্থা নেই।
-ম্যাডাম ! আপনি কখন এসেছিলেন ?
প্রতিউত্তরে উনি মুখে কিছু না বলে হাত দিয়ে ইশারা করে এক ছুটে চলে গেলেন।
শেষ কথা গুলো বলার পর মিতালীদি বা মিলিদি আর ঘাড় সোজা করে রাখতে পারল না। সামনের বেঞ্চে ঝুঁকে হাতের উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগল । এতক্ষন তার পরিচয় শুনছিলাম এক মুডে । কিন্তু বাস্তবে এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আমারও গলা ধরে এল। চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকলাম। পাশে সবাই দাঁড়িয়ে আছে কারো মুখে কোন কথা নেই। শুকনো মুখে একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম । মমতামাসি প্রথমে এগিয়ে এসে মিলিদির মাথায় হাত বোলাতে লাগল।
- ভেঙ্গে পরিস না মা ! যার কেউ নেই তার ঈশ্বর আছেন । আমি তো সেই কবে থেকে তোর সঙ্গে এতগুলি বছর কাটিয়ে দিলাম । পাগলি মেয়ে কোথাকার ! একবারও আমার সঙ্গে বলে তোর মনটা একটু হালকা করতে পারলি না ! এতো বড় যন্ত্রণা নিয়ে দিব্যি আমার সঙ্গে কাটিয়ে দিলি ?
মিলিদি তবুও মুখ তুলছে না ; অঝোরে কাঁদতে থাকে । এবার মমতামাসি জোর করে মাথা উঁচু করতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। শাড়ির আচল দিয়ে পরম স্নেহে চোখের জল মুছতে মুছতে মমতা মাসী বললো,
-শান্ত হ মা ! এত ভেঙে পরিস না । তোকে পেটে ধরা গর্ভধারিনী মা নাই বা হতে পারলাম ; তাই বলে পারবি না আমাকে মা বলে ডাকতে বা মায়ের আসনে বসাতে ?
এবার সেই আদ্র চোখে মিলিদি মমতামাসির দিকে তাকাতেই দুজন দুজনকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরল। নতুন মা- মেয়ের পরিচয়ে উপস্থিত আমরা সকলে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়লাম। আনন্দাশ্রুতে আমাদের চোখও আর্দ্র হয়ে গেল।
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২৬