মরীচিকা (পর্ব-২৩)
( গত পর্বের শেষ কথা -রমেনদা কয়েনটি শূন্যে তুলতেই অমনি শান্তনু বেশ জোরে কল করলো.. )
- টেল ।
কয়েনটি নিচে পড়ে বেশ কিছুটা দূরে গড়িয়ে গেল। সবাই নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়লো ফলাফল দেখতে। আমি বেশ উপভোগ করতে লাগলাম বিষয়টি নিয়ে । শান্তনুও উঠে দাঁড়াল। মুহূর্তেই সবাই চিৎকার করে উঠলো। রমেনদা আনন্দে শান্তনুকে জড়িয়ে ধরলো। টসের ফলাফল বুঝতে তখন আমার আর বাকি থাকলো না। আমি শান্তনুকে হ্যান্ডশেক করে অভিনন্দন জানালাম। আমার দেখাদেখি উপস্থিত প্রায় সকলেই ওর মাথায় ও গায়ে হাত বুলাতে লাগলো। চিৎকারের প্রাবল্যে আশপাশের কয়েকজন ছুটে এলো । ছুটে এলেন শেফালীম্যাডামও । মুহূর্তেই বিষয়টি অনুধাবন করে উনিও শান্তনুর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। উপস্থিত কয়েকজন মজা করে শান্তনুর কাছে ছোলা বাদাম খাওয়ার অগ্রিম বায়না করল। বায়না করার উদ্দেশ্য যে আমি তা বুঝতে বাকি রইল না। আমিও বেশ মজা করেই ঘোষণা করলাম ঠিক আছে ফেরার পথে শান্তনু তোমাদের সকলের জন্য ছোলা বাদাম নিয়েই আসবে। হঠাৎ শেফালীম্যাডাম একটু আসছি বলে এক ছুটে রুমে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে একটি একশো টাকার নোট শান্তনুর হাতে গুঁজে দিতে দিতে বললেন,
- টাকাটা তুমি তোমার মতো করে খরচ করবে।
শান্তনু টাকাটা প্রথমে নিতে চাইছিল না। হাত দুটি কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে আরো গুটিয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ তুলে আমার দিকে তাকাতেই,
-শান্তনু টাকাটা নাও । দিদিমণি ভালোবেসে তোমাকে দিচ্ছেন। বরং প্রণাম করে আশীর্বাদও নাও।
- এই না না না না না..... প্রণাম-ট্রণাম নয়। আমাদের আশীর্বাদ সবসময়ই তোমাদের উপর থাকে।
শেফালীম্যাডাম বললেও শান্তনুর চোখে মুখে বেশ অস্বস্তি ফুটে উঠলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমি আবার বললাম,
- দিদিমণি ঠিকই ইঙ্গিত করেছেন শান্তনু। প্রণাম লোক দেখিয়ে করার প্রয়োজন নেই, অন্তরে শ্রদ্ধা রাখলেই হবে।
এবার আমি আবার ঘোষণা করলাম, শান্তনু এখন আমাদের জানাবে আজকে আমাদের গন্তব্যস্থল কোথায় হবে। কিন্তু ও মুখে কোন উত্তর দিল না। আমরা সবাই বেশ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । আমার দেখাদেখি অনেকেই ওকে জানতে চাইল কি হল? চুপ করে বসে রইলে কেন? জানাও কোথায় যাবে? তবুও ওর মুখে কোন উত্তর নেই। হঠাৎ বলে উঠলো,
-আমার বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
-বেশ তো! বাইরে যেতে ইচ্ছে না হলে আশপাশে কোথাও চলো।
এবারে দেখলাম মুখে কোন শব্দ না করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আমি আবার বললাম,
-তুমি তাহলে রুমে গিয়ে তোমার ড্রেসটা বদলে এসো, আমিও এই ফাকে একটু তৈরী হয়ে আসি।
আমার কথা শুনে ও তেমন আগ্রহ দেখালো না। আমি ওর মনোভাব বুঝতে পারলাম। আর ঘা না দিয়ে নিজে দ্রুত রুমে এসে কিছু টাকা নিয়ে ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
স্কুল থেকে বার হয়ে শাখাচুকিয়া বাজারে একটি চায়ের দোকানে চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বসলাম। শান্তনু চা- বিস্কুট খাওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখালো না। ও খেতে অস্বীকার করাতে আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম। হোস্টেলে মাঝে মাঝে সকাল- সন্ধ্যায় একটু চা হয় ঠিকই কিন্তু দিনের পর দিন হস্টেলের চা খেয়ে একটা একঘেয়েমি চলে এসেছিল । কাজেই আজ বাইরের চা খাওয়ার সুযোগ হওয়াতে, একটু রেলিশ করে খাওয়ার ইচ্ছা ছিল। যদিও আমার সে সাধ আর পূরণ হলো না । চায়ে চুমুক দিতে দিতে ওর দিকে দুটি বিস্কুট এগিয়ে ধরলাম। ও বিস্কুট নিতেও অস্বীকার করল । আমি হাতটি না টেনেই,
- শান্তনু বড়দের কথা কখনও অমান্য করতে নেই, বাবা।
ও মুখ নিচু করে বসে রইল। হাতে ধরা বিস্কুট নিয়ে আমি আবার বললাম,
- বাড়িতে বাবা মাকেও কি তুমি এভাবে অমান্য করো?
বাবা-মায়ের নাম করতেই হঠাৎ ও খুব জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। মেরুদন্ড সোজা করে কাট কাট হয়ে বসে চোখগুলো বড় বড় করে কি যেন একটা বলতে গিয়েও আটকে গেল। ওর চোখে মুখের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম । মুখের পেশির ক্রমাগত কম্পনে বুঝলাম মনের মধ্যে প্রবল একটা দোলাচল শুরু হয়েছে । আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে আবার প্রশ্ন করতে যাব এমন সময় বেশ জোরে কেঁদে উঠলো। আমি বেশ হতভম্ব হয়ে গেলাম। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
- আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। আমাকে কেউ ভালোবাসে না, আমাকে কেউ ভালোবাসে না।
চায়ের দোকানে তখন বেশ ভিড়। উপস্থিত আট-দশ জন লোক সকলে ওর কান্না দেখে উতলা হয়ে উঠলেন । সত্যিই তো! এত বড় একটা ছেলে চোখের সামনে এমন করে কাঁদছে, তা দেখে যেকোন লোকেরই এমন বিহ্বল হওয়ারই কথা । একটু আগে যারা নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত ছিলেন, এখন সকলের লক্ষ্য ওর দিকে। দু-একজন সরাসরি আমার দিকেও একবার দেখে নিলেন । আমি পড়লাম বেশ অস্বস্তিতে। বাধ্য হয়ে ওনাদের সামনে নিজের পরিচয় তুলে ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলাম। পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম,
-তুমি যদি আমাকে তোমার বন্ধু ভাবো, তাহলে নির্দ্বিধায় তোমার মনের কষ্ট আমাকে শেয়ার করতে পারো। চলো আজ আমি তোমার এই মনের কথা শুনবো। পাশাপাশি তোমার সঙ্গে তো আমার মাত্র কয়েক দিন আগেই পরিচয়। আমি কোন কষ্ট দেওয়ার জন্য তোমার বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ তুলি নি বাবা। পাশাপাশি একজন ছাত্র হিসেবে তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি তোমাকে কি চোখে দেখছি?
যাই হোক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করে, চায়ের দোকানের পেমেন্ট দিয়ে রাস্তায় নামতেই একটি অটো পেয়ে গেলাম। ঝটপট উঠে পড়লাম অটোতে।
সেদিনে আমাদের যাত্রাটি ছিল একটু আলাদা, কারণ আমরা নিজেরাই জানিনা আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি। অটো -ড্রাইভার যখন জানতে চাইলো,
-দাদা কোথায় যাবেন?
আমি শুনেও না শোনার ভান করে বাইরের প্রকৃতি দেখতে লাগলাম। ড্রাইভার আবার জিজ্ঞাসা করলো,
-আপনারা কোথায় যাবেন?
-কোথায় যাব তা সঠিকভাবে জানিনা । তবে কোনো একটা ফাঁকা মাঠ বা বড় পুকুর কিংবা খাবারের দোকান পেলে গাড়ি থামাবে । আমরা একটু ঘুরতে বের হয়েছি।
-না না খাবারের দোকান নয়! আমি কিছু খাব না। এই প্রথম আমি শান্তনুর কোন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া পেলাম। আমার কথা অটো -ড্রাইভার বুঝতে পারল। সে পাল্টা বলল,
-দাদা আপনি যদি একটু বেশি ভাড়া দেন, তাহলে মন্দিরতলাতে নিয়ে যাই। জায়গাটা একবার দেখে রাখতে পারেন।
- ভাড়া নিয়ে ভেবোনা। তবে কি আছে মন্দিরতলায়? আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
-একটা পুরানো মন্দির; সঙ্গে আছে একটি পুরানো বটগাছ, যার কোন গুঁড়ি নেই ; পাশে আছে বহু পুরাতন একটি জলাশয়ও।
-মন্দিরটি কত দিনের পুরানো? এখন আর পূজা-অর্চনা হয় না?
-সে অনেক কথা! আপনি বোধহয় বাইরে থাকেন?
- হ্যাঁ! তোমার অনুমান সঠিক।
-আমরা ছোট থেকেই বাপ-ঠাকুরদার মুখ থেকে শুনে আসছি , প্রচলিত কথা অনুযায়ী মন্দিরের বিগ্রহটি নাকি কোন এক সময় খুব জাগ্রত ছিল। খুব ধুমধাম করে এখানে পূজা-অর্চনা হত। পাশের বটগাছ তলায় সপ্তাহব্যাপী মেলাও বসতো। খুব ধুমধাম করে এসময় মায়ের নামে পূজা দেওয়া হতো, ছিল বলির ব্যবস্থাও । পরের দিকে মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ বৃদ্ধি পায়। আমিষ- নিরামিষের কোন বাদ বিচার ছিল না। মাংসের গন্ধে নাকি ম-ম করতে থাকতো মন্দির চত্বর। পুরোহিত মশাই বেশ কয়েকবার স্বপ্নে দেখেন মা কালী নাকি ওনাকে মেলায় সব অনাচার বন্ধ করতে বলেছিলেন । কিন্তু কে শোনে কার কথা! একবার মেলা চলাকালীন সকালে বটগাছে একসাথে দুজনকে ঝুলতে দেখা যায়। তারপরে পুরোহিত মশাই সেই যে কোথায় চলে গেলেন তার কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারেননি । সেই থেকে মন্দিরে পূজা-অর্চনা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় । তেমনি বহু বছর ধরে চলে আসা মেলাটিও হয়ে যায় বন্ধ। আশপাশে কয়েকটি বাড়ি ঘর ছিল। ওই ঘটনার পর তারাও অন্যত্র চলে যায়।
গ্রাম্য রাস্তায় শান্ত প্রকৃতির মাঝে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আমরা ক্রমশ এগিয়ে চলেছি । শান্তনুকে দেখলাম ভীষণ আগ্রহ নিয়ে ড্রাইভারের কাছ থেকে গল্প শুনতে। ড্রাইভার থেমে যেতেই ও পাল্টা প্রশ্ন করল,
-তারপর?
-তারপর আর কি? সেই থেকেই মন্দিরটি পোড়ো হয়ে পড়ে আছে।
-তুমি কি ছোট বেলায় এখানকার মেলায় আসতে?
-আমি আসবো কি করে? ঘটনাটির তো বহু আগের, আমাদের বাবা- ঠাকুরদার মুখ থেকে শোনা।
আমি ড্রাইভারের নাম জিজ্ঞাসা করতেই,
-আজ্ঞে! আমার নাম রোহিত পান্ডে।
-আচ্ছা রোহিত, ওখানে যেতে তুমি কত নেবে?
-আজ্ঞে! ইতিমধ্যে অনেকটা রাস্তা চলেও এসেছি। আমি যদি ওখানে আপনাদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসি সেক্ষেত্রে আপনাদের ফিরতে বেশ সমস্যা হতে পারে। ওদিকটা গাড়ি-ঘোড়া একেবারেই নেই, লোক বসতি না থাকলে যা হয় । তবে আপনারা যদি এক ঘন্টার মতো কাটান, তাহলে বিবেচনা করে একটা দেবেন দাদা।
-দেখো! আমার বিবেচনার উপর না ছেড়ে তুমি কত নেবে পরিষ্কার করে বলো।
- আসলে দাদা এখনো সকালে বৌউনি হয়নি বলে বলতে একটু অসুবিধা হচ্ছে।
- দেখো রোহিত ওসব একঘন্টা- দুঘন্টা বলে কথা নয়। আমাদের ভালো লাগলে আমরা অনেকক্ষণ থাকবো, আর ভালো না লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসবো। তোমাকে আমি দুশো টাকা দেবো, তুমি ভাই আর না করো না।
- ঠিক আছে দাদা, তাই দিবেন।
-জায়গাটি তুমি আমাদের ভাল করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে কিন্তু।
রোহিত মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
- জানেন দাদা, কিছুদিন আগে এখানে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।
- হ্যাঁ! বল কি? কিসের ঝামেলা?
বিশেষ দ্রষ্টব্য :- আজকের পর্বটি ব্লগে আমার ছোট্ট আপু মুক্তাপুকে উৎসর্গ করলাম। আপু খুব সুন্দর লেখেন। উনি প্রথম পাতায় লেখার সুযোগ পেলে আনন্দ পাব।
মরীচিকা (পর্ব-২১)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২০ সকাল ৯:৩১