somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরীচিকা (পর্ব -২১)

০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মরীচিকা (পর্ব-২২)

আটান্নগেট থেকে ফিরতে সেদিন আমাদের বেশ সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। তবে আশানুরূপ সময়ের আগেই পৌঁছে গেছিলাম। হোস্টেলে পৌঁছে ড্রেস বদল করে চোখে - মুখে সামান্য একটু জল দিয়ে আমি সোজা শান্তনুর রুমে চলে গেলাম। ঘরে ঢুকেই বেশ অবাক হলাম। প্রচন্ড জ্বরে ও কাতরাচ্ছে। এ দৃশ্যের জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ওর রুমমেট অর্ঘ্যকে জিজ্ঞাসা করতেই বললো, সন্ধ্যা থেকেই ও এমন করছে । চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। গায়ে হাত দিয়ে দেখি গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। নিজেকে নিজের কাছে খুব অপরাধী মনে হলো। সকালে অসুস্থতার কথা শুনেও নিজে হাতে এমন কোনো ব্যবস্থা না করার জন্য বিবেকের দংশনে পড়ে গেলাম। আর কাল বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম স্কুলের অফিস রুমে । গিয়ে শুনলাম ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ( টি আই সি) একটি কাজে বাইরে গেছেন; রাতে নাও ফিরতে পারেন। উনি কাউকে আগে থেকে শান্তনুর কথা জানিয়ে রেখেছিলেন কিনা খোঁজ নিয়ে কোনো সদুত্তর পেলাম না। আর কথা না বাড়িয়ে উপস্থিত কয়েকজনকে শান্তনুর শারীরিক অবস্থার কথা জানালাম। রাত বিরাতে অসুখ বিসুখ হলে স্কুলের অফিসে সব সময় কিছুনা কিছু ওষুধ মজুদ করা থাকে । অনেকেই ওখান থেকে ওষুধ নিয়ে সেবন করানোর পরামর্শ দিল। অ্যালোপ্যাথি ওষুধ না জেনে এভাবে খাওয়ানোটা আমার কাছে আধুনিক এলোপ্যাথারি চিকিৎসা বলেই মনে হয়। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার দরুন ,ভালো করতে গিয়ে যদি খারাপ হয়- এ আশঙ্কা আমার মধ্যে সব সময় কাজ করে । কাজেই আমি ওদের কথায় কর্ণপাত না করে রমেনদাকে তড়িঘড়ি বাজারে পাঠালাম ডাক্তারবাবুর উদ্দেশ্যে । এমন অসময়ে বাজারে যেতে রমেনদাও যে খুব একটা রাজি ছিল তা নয়। এরকম অজ পাড়াগাঁয়ে অন্যান্য দোকান পসরা ইতিমধ্যে বন্ধ হলেও ডাক্তারের চেম্বার আর পাঁচটা সাধারণ দোকানের মত নয় যুক্তি দিয়ে একপ্রকার জোর করেই তাকে বাজারে পাঠালাম। আর মিলিদিকে বললাম ছেলেটির মাথায় একটু জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে ।

আমার ব্যস্ততা দেখে আশপাশের অন্যান্য রুম থেকেও ছেলেরা চলে এলো । উৎসুক্য মুখে তারা শান্তনুর কপালে জলপট্টি দেওয়া দেখতে লাগলো। একসঙ্গে এতজনের ভীড়ে জায়গাটি মুহুর্তের মধ্যে বেশ গরম ও অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে ওদেরকে অযথা ভিড় না করে বরং রাতের খাওয়ার পর্ব মিটিয়ে নিজ নিজ কক্ষে চলে যেতে বললাম। প্রথমে আমার কথায় সায় না দিয়ে ওরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। আমি আরো একবার বললাম ওদেরকে চলে যেতে। এবার অবশ্য ওরা আমার কথা আর অমান্য করল না। দু- একজন করে চলে যাওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরটি ফাঁকা হয়ে গেল। মিলিদি একভাবে জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে। আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে বারে বারে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যাচ্ছি ডাক্তার নিয়ে রমেনদা কখন আসবেন সে আশায় । মিলিদির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে, কেন ওর আসতে দেরি হচ্ছে এই নিয়ে কথা বলতে বলতেই হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ পেলাম। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে রমেনদা হাজির।

গ্রামে ডাক্তারের অপ্রতুল। স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে দিনের বেলাতেও ডাক্তার থাকে না , রাতের বেলা তো দুরের কথা। এরকম গায়ে গঞ্জে রাতের বেলা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, পাশ করা ডাক্তারবাবুর আসাটা স্বপ্নেরও অতীত । এক্ষেত্রে বাজারের একমাত্র কোয়াক ডাক্তারই এলাকার একমাত্র ভরসা। আমার সঙ্গে অবশ্য ওনার অনেকদিন আগেই পরিচয় হয়েছিল। কোন এক সকালে অসুস্থতার কারণে আমিও গিয়েছিলাম ওনার চেম্বারে। তার পরে মাঝে এতগুলি মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এহেনো ডাক্তারবাবু সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে শুকনো মুখে নিতান্ত সৌজন্য সূচক কুশল বিনিময়ের পরে উনি ওনার কাজে লেগে পড়লেন। জ্বর, নাড়ি পরীক্ষা করতে লাগলেন। জ্বরটা অবশ্য আমি আগেই দেখেছিলাম 102 এর সামান্য বেশি।বুকে কফ্ তেমন নেই দেখে গত দুদিন ধরে কি কি খেয়েছে সেসব খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। মিলিদি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে লাগলো। উনি আরো খোঁজ নিতে লাগলেন বাইরের কোন খাবার শান্তনু খেয়েছে কিনা। গত কয়েকদিনে আমি ওকে যেটুকু চিনেছি তাতে হোস্টেলের বাইরে যে কোন খাবার যে ও খাবে না সে বিষয়ে আমি এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে ডাক্তারবাবুকে তার পরিচয় দিলাম। দুপুরে একবার পটি করেছে জানতে পেরে পেট ইনফেকশনের তত্ত্বও উড়িয়ে দিলেন। অবশেষে কিছু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে নিতান্ত ভাইরাল ফিভার, দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই জানিয়ে উনি বিদায় নিলেন।

ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে হালকা কিছু খাবারের সঙ্গে নির্দিষ্ট ওষুধগুলো খাইয়ে দিলাম। অবশ্য খাওয়ানোটা খুব সহজ ছিল না। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পর কোন এক সময় উপস্থিত আমাদের সকলের দিকে একটু তাকিয়ে নিল। কি বুঝলো কিংবা বুঝলো না- সেটি আমি বুঝতে না পারলেও হঠাৎ একসময় দুম করে উঠে বসে বাধ্য ছেলের মত কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে করে বসে থাকল। আমি আবার বার কয়েক ডাকাডাকি করে মাথায় হাত বুলিয়ে খাবারটি এগিয়ে ধরতেই, হাত বাড়িয়ে থালাটি ধরে পায়ের উপর রেখে বিছানায় বসে বসে খেতে লাগলো। খাওয়া শেষ হলে যথারীতি ওষুধটি এগিয়ে ধরতেই জল মুখে নিয়ে সেটিও খেয়ে নিল এবং চার হাত পা এক জায়গায় করে গুটিসুটি মেরে আবার শুয়ে পড়লো। শান্তনু শুয়ে পড়তেই মিলিদিও ব্যস্ত হয়ে পড়লো; বার দুয়েক আমার চোখের দিকে তাকালো। আমি ওর চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম,
-তোমাকে বোধহয় এবার একটু ডাইনিং রুমের দিকে যেতে হবে। এতগুলো ছেলেমেয়ে চাপ সামলাতে ওরা হিমশিম খেয়ে পড়বে .... আমার মুখের কথা তখনও শেষ হয়নি,
-হ্যাঁ! দাদা, এবার একটু ওদিকে যেতে হবে।
-ঠিক আছে, তুমি তাহলে আর দেরি করো না । এখনই যাও, বাকিটা আমি সামলে নেব।

মিলিদি চলে যেতেই আমি শান্তনুর মাথার কাছে বসে আরো কিছুক্ষণ জলপট্টি দিলাম। ইতিমধ্যে অনেকক্ষণ জলপট্টি দেওয়ায় কপালটি বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে; যে কারণে কিছুক্ষণ জলপট্টি দেওয়া বন্ধ রেখে এমনিই বসে রইলাম। এখন অবশ্য ওর মধ্যে কোনো অস্থিরতা বা অস্বাভাবিকত্ব দেখছি না। এক্কেবারে স্বাভাবিক ভাবেই যেন ঘুমাচ্ছে। অর্ঘ্য খেয়ে এলে আমি ওকে কিছুক্ষণের জন্য বসিয়ে রেখে ডাইনিং রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শান্তনুর সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য সকলেই আগ্রহভরে ছুটে এলো।

কিচেন স্টাফদের সম্পর্কে আগেও বলেছি , সেদিন ওদের চোখে- মুখের ভাষাই যেন বলে দিচ্ছিল নিতান্ত অশিক্ষিত মানুষগুলোই যেন শান্তনুদের আপনজন। তাদের সেই আকুতি, সেই উৎসুক্যের মধ্যে কোন কৃত্রিমতা নেই; নেই কোন ভনিতা। ওরাই যেন আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্যুত ছেলেমেয়েগুলোর আপনজন। অনাত্মীয় ছেলেমেয়েগুলোর সুখ-দুঃখের সর্বক্ষণের সাথী। এমন কি অভিভাবকের মতো গুরু দায়িত্বও এই গরিবগুর্বো মানুষগুলো যেন নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। প্রায়ই দেখি হোস্টেলের একঘেঁয়েমি খাবারে বিরক্ত হয়ে, কোনো না কোনো বাচ্চা এসে তাদের কাছে বায়না করছে, ডিম টোস্ট বা ডিমের ওমলেট কিংবা স্পেশাল কোন ডিস তৈরি করে দিতে । দিনের পর দিন সন্তানসম বাচ্চাদের এমন আবদার হাসিমুখে পালনের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি ওদের চোখে-মুখে লক্ষ্য করতাম। অথচ অসুস্থ হয়ে পড়লে স্পেশাল কেয়ারের দায়িত্ব যাদের উপর সেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সামান্য কিছু ঔষধ বা প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রেখে জাহির করে যেন নিজস্ব ভবনের মধ্যে বাচ্চাদেরকে তারা ফাইভ স্টার নার্সিংহোমের পরিষেবা দিয়ে থাকে। এমন কি নিজেদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে এডমিশনের সময় তারা গালভরা প্রচারও করে থাকে।

আমি ডাইনিং রুম থেকে ফিরে গিয়ে দেখি শান্তনুর জ্বর কমে গেছে। গা ঘামতে শুরু করেছে। একজ্যাক্ট সময় মনে নেই তবে ওষুধ খাওয়ানোর মিনিট চল্লিশেক পরে ওর শারীরিক অবস্থার এই পরিবর্তন আমার কাছে বেশ আশাব্যঞ্জক লাগলো। ওরই একটা গামছা দিয়ে গলা মুখের ঘাম মুছে দিলাম। তবুও কোন সাড়াশব্দ নেই, একেবারে বেঘোরে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ ওর মাথার কাছে বসে থাকলাম। সারা দিনের ক্লান্তিতে আমারও চোখ মুদে আসছে। পাশের টেবিল ল্যাম্প জালিয়ে অর্ঘ্য নিঃশব্দে পড়ে যাচ্ছে। ওকে উদ্দেশ্য করে,
- অর্ঘ্য! তোমার তো পড়াশোনায় আজ মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেলো।
-না না স্যার! আপনি এভাবে কেন বলছেন? আমরা যে কেউ তো, যে কোন সময় অসুস্থ হতেই পারি। টুকটাক অসুস্থ আমরা মাঝে মধ্যে হয়েই থাকি। তবে আজ শান্তনুর অসুস্থতা নিঃসন্দেহে অনেকটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিল। চোখের সামনে আমি নিজেই খুব অসহায় বোধ করছিলাম। আপনি এভাবে ওর পাশে এসে দাঁড়ানোয় যে কারণে আমি খুব স্বস্তি পেলাম ।
-যাক বাবা! তোমার যে সুন্দর একটা হৃদয় আছে। সহমর্মিতার মানসিকতা আছে, এটা একজন বড় মানুষ হওয়ার পক্ষে মস্ত বড় গুন। তুমি এমন নির্মল হৃদয়ের অধিকারী হও, অনেক বড় হও এবং মানুষের মত মানুষ হও।
-হ্যাঁ, স্যার! আশীর্বাদ করবেন।
- অর্ঘ্য আমি এখন উঠছি। তুমি পড়ছো পড়ো, তবে দরজাটা ভেতর থেকে ছিটকিনি দিও না। আমি মাঝ রাতে আর একবার এসে শান্তনুকে দেখে যাব। ইতিমধ্যে যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে অবশ্যই আমাকে জানিও।
- ঠিক আছে স্যার, সমস্যা হলে অবশ্যই আপনাকে ডাকতে যাব।

সারাদিনের ক্লান্তির সঙ্গে রাতও বেশ বাড়তে থাকায় শেষের দিকে শরীরকে যেন আর টানতেই পারছিলাম না। ফলে শুয়ে পড়তেই সেদিন ঘুমিয়ে গেছিলাম। তবে মনে দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমালে সাউন্ড স্লিপ বিঘ্ন ঘটে। সেদিনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে জিরো বাল্বের অস্পষ্ট আলোয় দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটো বেজে পনের মিনিট হয়েছে । উঠে বসলাম এবং শান্তনুর রুম থেকে একবার ঘুরে আসার মনস্থির করলাম । এমন নিস্তব্ধ নিশীথে একটা জনপ্রাণী কোথাও জেগে আছে বলে মনে হলো না। টেবিলে রাখা বোতল থেকে দুঢোক জল খেয়ে নিয়ে টর্চটি সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম শান্তনুর রুমের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে শান্ত নিরবতার মধ্যে কিছু ঝিঁঝিঁ পোকার বিরামহীন শব্দ কানে ভেসে এলো । অদ্ভুত একটা গা ছমছম পরিবেশে মনে মনে বেশ অস্বস্তি বোধ করলাম। আরো দু পা বাড়াতেই হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো একদল শিয়ালের হুংকার যা আমার মনের অস্বস্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। অস্বীকার করবো না যে এতদিন হোস্টেলে থাকলেও রাতের বেলায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় এরকম পরিবেশের সঙ্গে ইতিপূর্বে কখনো পরিচয় ঘটেনি । অবশেষে এক পা দু পা করে দরজার মুখে এগিয়ে গেলাম। দরজায় আলতো করে চাপ দিতেই আর্মেনিয়ান গীর্জায় একটা বাজার ঘন্টার মতোই কব্জায় বিকট একটা শব্দ হলো। আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আশপাশে একবার তাকিয়ে দেখলাম কেউ জেগে আছে কি না। তেমন কিছু না পেয়ে আরো দু এক পা এগিয়ে শান্তনুর কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর একেবারে নেই। আমি এক প্রকার চিন্তা মুক্ত হয়ে আবার নিজের রুমে চলে আসি।

পরের দিন সকালে সবে ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে সমরেশ মজুমদের উত্তরাধিকারে চোখ বুলাচ্ছি এমন সময় অর্ঘ্য এসে জানালো,
- স্যার! শান্তনু প্রচন্ড কাঁদছে।
-কেন? কেন কাঁদছে? ওর গায়ে কি তাহলে আবার জ্বর এসেছে?
-না স্যার! গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর নেই, তবে কেন কাঁদছে সে বিষয়ে কিছু বলছে না।
- চলো! চলো! আমি এখনই দেখছি, বলে ছুটে গেলাম শান্তনুর রুমে।
-কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন? বলে কপালে হাত দিয়ে দেখলাম গায়ে জ্বর নেই। আমার প্রশ্ন শুনেও শান্তনু নির্বিকার ভাবে কেঁদে চলেছে।আমি আরো একটু মাথায়, পিঠে হাত বুলাতে কান্না থামাল কিন্তু মুখ নিচু করে থাকল। আমার কোন কথাতেই ও উত্তর দিচ্ছে না।এরপর আমি ওকে এক প্রকার জোর করে ব্রাশ করার উদ্দেশ্যে বেসিনে নিয়ে গেলাম। হাত মুখ মুছিয়ে সঙ্গে করে ডাইনিং রুমে নিয়ে এলাম ।গতকাল থেকে এক প্রকার না খেয়ে আছে। মিলিদিকে বললাম একটু দ্রুত গরম দুধ ও বিস্কুটের ব্যবস্থা করতে । গতকাল রাতে হোস্টেলের প্রায় সবাই ওর অসুস্থতার কথা জেনে গেছে। ও ডাইনিং রুমে আসাতে অন্যান্যরাও যে যার রুম থেকে ছুটে আসতে লাগলো। সবাই উৎসুক ভরা চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আর ও যেন কোন অপরাধীর মতো এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে,
- শান্তনু দেখো তোমার কত বন্ধু এসেছে তোমার খোঁজ নিতে। কাল রাতে ওরা প্রায় সবাই গেছিল তোমার রুমে খোঁজ নিতে । এখন কেমন ফিল করছো ওদেরকে জানাও। ওরা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছে, তুমি কেমন আছো।
তবুও ওর মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আমি এবার ছেলেদের উদ্দেশ্যে বললাম,
-দেখতো বাবুরা, তোমরা ওকে কথা বলাতে পারো কিনা।
ওরা সাধ্যমত ওকে কথা বলানোর চেষ্টা করতে লাগল। কয়েকজনকে রীতিমতো তোষামোদ করতেও দেখলাম। কিন্তু তবুও শান্তনুর মুখে কোন উত্তর নেই, নেই কোন প্রতিক্রিয়াও । অস্বীকার করবো না যে ওর এই কথা না বলা প্রসঙ্গে আমিও বেশ বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। কথা বলতে বলতে রমেনদা একটা বড় মগে করে এক মগ দুধ ও একটি ট্রেতে বিস্কুট নিয়ে টেবিলে রাখল। খিদেটা বোধহয় একটু বেশিই পেয়েছিল। টেবিলে খাবারটি রাখতেই একবার মাত্র বলাতে বাধ্য ছেলের মত খাওয়া শুরু করলো। ও খাওয়া শুরু করলে ছাত্ররা যে যার মত কাজে চলে গেল। খাওয়া শেষ হলে শান্তনু উঠতে যাচ্ছিল। আমি তখন ওর হাত ধরে বসালাম,
-শান্তনু,আজ সকালে তোমাকে আর পড়তে হবে না। সক্কালবেলা প্রেসিডেন্ট সাহেব নিজে এসেছিলেন এবং আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেছেন। আর তোমার প্রয়োজনে আমাকে পাশে থাকার কথা জানিয়ে গেছেন । ওনাকে জানিয়ে রেখেছি যে প্রয়োজনে তোমাকে নিয়ে আমি একটু ঘুরতেও যেতে পারি।
ঘুরতে যাওয়ার কথা বলতেই এবার দেখলাম ও চোখ তুলে তাকালো।
-কি যাবে না?
-কোথায়?
-দেখো, ঘুরতে যাওয়ার প্রসঙ্গটি যেহেতু আজ প্রথম উঠেছে কাজেই দুজনের দু'রকম পছন্দের জায়গা থাকতে পারে। অথচ আমরা একে অপরকে জোর করব না। এখন ঠিক করতে হবে যে আজ কার পছন্দ প্রাধান্য পাবে। এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব টস এর মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।
টসের প্রসঙ্গ তুলতেই এই প্রথম ওর মুখের মধ্যে একটা ছোট্টো হাসি চিকচিক করে উঠলো। কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি হাসতে হাসতে রমেনদাকে বললাম একটি কয়েনের ব্যবস্থা করতে। রমেনদা সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে এক টাকায় একটি কয়েন বার করে দিল। আমাদের টসের ফলাফল দেখতে উপস্থিত কিচেন স্টাফরারা সকলে হৈ হৈ করতে করতে ছুটে এল। রমেনদা কয়েনটি শূন্যে তুলতেই অমনি শান্তনু বেশ জোরে কল করলো....

মরীচিকা (পর্ব-২০)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২০ সকাল ৮:০৮
৩৭টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×