মরীচিকা (পর্ব-২১)
সেদিন কলেজের বড় বাবুর ডাকে অফিস রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ানোর সময় মনের মধ্যে হাজারো কু ডাক ডাকতে থাকে। শ্রেণিকক্ষ থেকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং এর মাঝে বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি আছে যেখানে পাইন দেবদারু অর্জুনরা সুবিন্যাস্ত ভাবে মিলেমিশে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মর্মর ধ্বনিতে আমার কল্পনার জগতে ছেদ পড়ে। পাশ দিয়ে শুকনো পাতার উপর দিয়ে একটি কুকুরের বিদ্যুৎ গতিতে বিড়ালকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়ার কারণে। দুরু দুরু বুকে পা ঘষতে ঘষতে অনুমতি নিয়ে বড় বাবুর ঘরে ঢুকতেই জানিয়ে দিলেন,
-অনির্বাণের মা আজ সকালে মারা গেছেন। একটু আগে ওর বাড়ি থেকে ফোন করে খবরটি দিয়েছে।
খবরটি এক্কেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । সেদিন মাসিমাকে অসুস্থ্য দেখে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু চলে যাওয়ার মত অবস্থায় উনি একেবারেই ছিলেন না । মুনিয়ার মুখের ছবি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো । চূড়ান্ত অসহায়ত্বের মধ্যে পড়লাম । আমার এখন করনীয় কি বা এই অসময়ে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে কিনা নানান প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো । কলেজে এমন কেউ নেই যে বিষয়টা তাদের কারও সঙ্গে শেয়ার করবো অথবা বাড়িতে বাবাকেও যে জানাবো সে সাহসও পাচ্ছি না । এক পা দু পা করে শরীরটাকে কোনোক্রমে টানতে টানতে আবার ক্লাস রুমে গেলাম । আমার বিষন্নদশা দেখে কলেজের কয়েকজন জিজ্ঞাসা করলে, খবরটি দিলেও তাদের মুখের ছবির তেমন কোনো পরিবর্তন চোখে পড়লো না । ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে ক্লাস করতে ভাল লাগছে না বলে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম ।
রুমে ফিরে বেশি সময় নষ্ট না করে সামান্য কিছু জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে বাড়িওয়ালাকে রাতে ফিরব না, জানিয়ে বেরিয়ে এলাম । লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে পৌঁছে যাওয়া । এমন অসময়ে বার হলেও যেতে অবশ্য কোনো সমস্যা হয়নি । সন্ধ্যার কিছু পরে আমি ওদের বাড়িতে পৌঁছে যাই । ওখানে গিয়ে শুনলাম ত্রাণ সংগঠন থেকে দ্রুত অনির্বাণকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। ও এখন রাস্তায় আছে । হয়তো রাতের দিকে এসে পড়বে , তা না হলে আগামীকাল সকালে । বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। গোটা গ্রামের লোক ওদের বাড়িতে চলে এসেছে । ভিড়ের মধ্যে সামান্য খোঁজাখুঁজি করে মুনিয়াকে খুঁজে পেলাম । শুনলাম মুনিয়া সেই সকাল থেকে একভাবে কেঁদে চলেছে। কেউ ওকে শান্ত করতে পারছে না । আমিও একটু দূরে দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ পাশ থেকে অপরিচিত একজন আমার পরিচয় জানতে চাওয়াতে অনির্বাণের বন্ধু পরিচয় দিতেই, দেখনা মেয়েটাকে একটু শান্ত করতে পারো কিনা । আমি মুখ কাচুমাচু করে এগিয়ে গিয়ে ওর গায়ে হাত দিতেই, মুনিয়া উচ্চস্বরে হাউমাউ করে আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়ল। সদ্য মাতৃহারা ছোট্ট একটি মেয়ের আর্তনাদে আমার বুক ফেটে যেতে লাগলো । সমাজের অনেক না পাওয়ার সান্ত্বনা আছে, কিন্তু স্বজন হারানোর কি কোন সান্ত্বনা আছে? অসহায় মেয়েটির চুলের বিলি কাটতে কাটতে নানান উপায় খুঁজতে থাকি । সকাল থেকে এক গ্লাস জল পর্যন্ত স্পর্শ করেনি । খাওয়ানোর বারকয়েক ব্যর্থ চেষ্টা আমিও করে এভাবেই বসে রইলাম । সেদিন অনেক রাতে অনির্বাণ বাড়ি ফেরে এবং গভীর রাতে মায়ের অন্তেষ্টি কার্য সম্পন্ন হয় । পরদিন সকালে ছোট্ট মুনিয়াকে অনেক বুঝিয়ে আমি রওয়ানা দিই।
এরপর থেকে অনির্বাণের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব অত্যন্ত গাঢ় হয়েছিল। আমি সত্যিকারের একজন ভালো বন্ধু পেয়েছিলাম। ওকে নিয়ে আমার ভাবজগতে বিরাট প্রভেদ লক্ষ্য করলাম । অত্যন্ত সৎ পরিশ্রমী ছেলেটি অসম্ভব মূল্যবোধের অধিকারী । যেহেতু আমি ওর পারিবারিক বা আর্থিক অবস্থার নিদর্শন পেয়েছি। কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়ে ছোটখাটো আর্থিক সাহায্য বা টিফিন শেয়ার করার প্রস্তাব দিলে ও বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করত। ওর হাসি বাচনভঙ্গির মধ্যে এমন মধুরতা মেশানো থাকতো যে কখনো ওর প্রত্যাখ্যান আমাকে রুষ্ট করেনি। অস্বীকার করবো না যে ওর আচরণের মধ্যে একটা মাদকতা মেশানো থাকতো যা একপ্রকার আমাকে পাগল করে তুলেছিলো ।
পার্ট টু পরীক্ষার পরে হঠাৎ একদিন অনির্বাণ আমাকে বললো,
-শেফালী একটা উপকার করবি?
-এই হাদা! তোকে উপকার আমি কেন করতে যাব? আগে উপযাজক হয়ে বহুবার তোকে উপকার করতে চেয়েছি কিন্তু তুই ফিরিয়ে দিয়েছিস। আজ আমিই তোকে প্রত্যাখ্যান করলাম।
সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান হাতটি চেপে ধরে বলল,
-তোকে বাধ্য হয়ে বলেছি রে! আমার যে অন্য কোন উপায় নেই ।
- কেন আগে কি তোর কোনো উপায় ছিল ?
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
- আগে মা ছিল। মায়ের কিছু গয়না গাটিও ছিল। আর আমার কিছু টিউশনিও ছিল । এরকম ক্ষেত্রে আগে মাকে বললে মা যে করেই হোক ব্যবস্থা করে দিত। কিন্তু এখন তো আর মা নেই । আর বাবার সামান্য জর্জমানি। বাবার কাছে কোনদিন মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারিনি। এখনো কিছু চাইতে মন সায় দিচ্ছে না । পাশাপাশি আমার সিদ্ধান্ত যে বাবাকে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ করবে সেটাও বিলক্ষণ জানি ।
কথাগুলি বলার সময় ওর গলা ধরে এল । আমি সঙ্গে সঙ্গেই বললাম,
-ঠিক আছে! হেল্প তোকে করবো। কত টাকা লাগবে?
-পাঁচশ টাকা।
-পাঁচশো টাকা! মাত্র পাঁচশো টাকা লাগবে? কি এমন রাজকার্য করবি শুনি?
- আমার না অনার্স পড়তে আর ভালো লাগছে না । ঠিক করেছি বিদেশী ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হব । জাপানি ভাষাকে আপাতত লক্ষ্য স্থির করেছি । আগামীকালই ভর্তি হওয়ার লাস্ট ডেট ।
- সে কি! তুই পাগল নাকি? অনার্সে এত ভালো রেজাল্ট করলি অথচ সব বাদ দিয়ে অন্য লাইনে যাবি?
-হ্যাঁ রে! মন থেকে সায় দিচ্ছে না । পড়ছি ঠিকই ,পরীক্ষা দিলে হয়তো পাশ করবো, ডিগ্রী পাবো । বাবা খুশি হবে ,পাড়া পড়শিও খুশি হবে। কেবল খুশি হব না আমি । মনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে আর পারলাম না।
- ঠিক আছে তোর যা ভাল লাগে কর ।
অনির্বাণ গোলপার্কে জাপানি ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হল । প্রথম দিকে মাঝে মাঝে কলেজে আসতো আমার সঙ্গে দেখা করতে । ইতিমধ্যে ওর ধার করা টাকাটাও আমাকে একদিন পরিশোধ দিয়েছে। সেদিন অবশ্য ওর আচরণে খুব ব্যথা পেয়েছিলাম । আসলে চেয়েছিলাম টাকাটা ওর কাছেই রাখুক। ওর বাবা আমার খোঁজ খবর নেন বা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেন । কিন্তু এ দিনের পর সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা প্রাণহীন সম্পর্ক অনুভব করলাম । একদিন আমাকে পাওয়ার জন্য আমার কলেজের অন্যান্য বন্ধুদের যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল সেখানে কারো কাছে ধরা না দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যখন সফল হয়েছি। যদিও কাউকে ঠিক নিজ মনের উপযুক্ত বলে মনে করিনি, ঠিক তখনই আরেকজনকে কাছে পেয়েও না পাওয়ার হতাশা আমাকে তখন সদ্য গ্রাস করেছে । যাকে তিল তিল করে মনে ধারণ করেছিলাম। তৈরি করেছিলাম পৃথক একটি সত্তা, তার কাছ থেকে এমন শীতল আচরণ পেয়ে আমার অন্তরাত্মা হতাশায় ভরে গেল । যদিও অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার সময় ও খুব সহযোগিতা করেছিল। ফর্ম তোলা ও জমা দেওয়ার থেকে ভর্তি হওয়ার সময় পর্যন্ত ও পাশে ছিল। ওটাই ছিল অনির্বাণকে আমার করে পাওয়া । এম এ পার্ট ওয়ানের রেজাল্টের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে হঠাৎ একদিন ওকে হন্তদন্ত হয়ে ইউনিভার্সিটিতে দেখে অবাক হয়েছিলাম।
- শেফালী আমার না আর দেশে থাকা হবে না। আমার একটা যোগাযোগ হয়েছে । মনের দিক দিয়ে অনেক লড়াই করেছি বিদেশে যাব না বলে, কিন্তু আমাদের যা পেশা তাতে আর ঠেকাতে পারলাম না। আপাতত আমাকে দোভাষীর কাজে জাপানে যেতে হবে। পরবর্তী কর্মসূচি ওখানে গিয়ে স্থির হবে, মুখ নিচু করে কথাটি বলে আমার চোখের দিকে না তাকিয়েই চলে গেল।
আমি ওর পিছন পানে চেয়ে রইলাম। ইতিমধ্যে আমার মনে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে তবুও ওকে মনের অনেক গভীরে স্থান দিয়েছিলাম ।লালন করা স্বপ্নটা মুহূর্তে যেন চোখের সামনে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল । ও চলে যেতেই ইউনিভার্সিটির লনে আমি ধপাস করে বসে পড়লাম। পরে কি ঘটেছিল আর আমার মনে নেই। যখন সেন্স আসে দেখি বেঞ্চের উপরে আমি শুয়ে আছি। আমার মাথা চোখ মুখ সব জলে ভেজা। পরিচিত মুখ একটিও নেই । উৎসুক সকলে জানতে চাইছে আমি সকাল থেকে কিছু খেয়েছি কিনা বা আগে কখনো এরকম ঘটনা ঘটেছে কিনা । মাথা নেড়ে আকার ইঙ্গিতে ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম । ব্যাগের খোঁজ করতেই সামনে একজন এগিয়ে দিল । ব্যাগ থেকে বোতলটি খুলে ঢক ঢক করে সামান্য জল খেয়ে সোজা হয়ে বসলাম । উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম । ওটাই ছিল অনির্বাণের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ ।
শেফালী ম্যাডামের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কাহিনী শুনতে শুনতে সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না। কথা শেষ হতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। দ্রুত পা চালিয়ে বাসস্ট্যান্ডে উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম । ফেরার সময় অবশ্য সেদিন বেশি সময় লাগেনি ,পৌনে আটটার মধ্যে আমরা হোস্টেলে পৌঁছে গেলাম । সেদিন রাতে ফিরে আগে থেকে ঠিক করে রাখা আমার প্রথম কাজ ছিল শান্তনুর সঙ্গে দেখা করা। যথারীতি এক পা -দু পা করে ওর রুমের দিকে এগোতে লাগলাম । ছাত্ররা সবাই এ সময় গভীর পড়াশোনায় ব্যস্ত । আলতো করে ভেজানো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বার দুয়েক কেশে নিলাম। ভেতর থেকে পড়াশোনার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। শান্তনুর নাম ধরে একটু জোরে ডাকতেই সকালে ক্লাসে খবর দেওয়া ওর রুমমেট অর্ঘ্য বেরিয়ে এসে বলল,
- স্যার! শান্তনুর প্রচন্ড জ্বর । ও আজ সারাদিন বিছানা ছেড়ে ওঠেনি।
- সেকি! সারাদিন কিছু খাইনি তাহলে?
-জানি না স্যার।
আমি ওর বিছানার কাছে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরে একেবারে গা পুড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই চোখে পড়লো প্রচন্ড জ্বরে অদ্ভুত আচরণ করছে । আমি ছুটে গেলাম অফিসের দিকে ..
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২০ সকাল ৭:৫২